আল-বুরহান ( দলিল-প্রমাণ)

আসসালামু আলাইকুম ওয়া রহমাতুল্লাহ! আমাদের ওয়েবসাইটে আপনাকে স্বাগতম। একটু নিচে দেখুন> বিষয় ভিক্তিক সাজানো রয়েছে, আপনার পছন্দ অনুযায়ী পাঠ করুন এবং পোষ্টগুলো ভালো লাগলে শেয়ার করুন আর আপনার কোন প্রশ্ন থাকলে এই নাম্বারে- ০১৬৮৭-১১৩৮৮০ হোয়াটস অ্যাপে পাঠিয়ে দিন । জাযাকাল্লাহু খাইর।

মাকাসিদুশ শারইয়া-৮ম ক্লাস

No Comments

 


استصناع 

আমীনুল হক আজাদী 

ইসতিসনা শব্দটি আরবি সনাআ শব্দ থেকে এসেছে। সনাআ শব্দের অর্থ শিল্প। ইসতিসনা হচ্ছে এমন একটি ক্রয়-বিক্রয় চুক্তি, যেখানে ক্রেতার দেওয়া নমুনা ও আদেশ মতে উভয়ের সম্মতিতে নির্ধারিত মূল্যে নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে বিক্রেতা কোনো পণ্য তৈরি করে ক্রেতার কাছে বিক্রি করে। (বাদায়িউস সানায়ে ৫/২, আশ শারহুল কাবির ৩/২১৫, হাশিয়াতুল বাজিরমি ২/৩৩৯, আল ইকনা ২/২৯১, কাশশাফুল কিনা ৩/২৯১ ও আহকামুল মাআমালাতিশ শরইয়্যাহ ৪৭৬-৪৭৮)।


বর্তমান সমাজে ইসতিসনার ব্যাপক প্রচলন রয়েছে। প্রয়োজনীয়তার বিবেচনায় এ জাতীয় লেনদেনকে ইসলামি শরিয়তে জায়েজ সাব্যস্ত করা হয়েছে। আল্লামা কাসানি (রহ.) বলেন, এটি বাইয়ে মাউদুম হওয়া সত্ত্বেও মানুষের সহজতার জন্য এ বেচাকেনাটিকে সমর্থন দেওয়া হয়েছে। এ বিষয়ে ফুকাহায়ে কেরামের ঐকমত্য রয়েছে। ইমাম মুহাম্মাদ ইবনে হাসান (রহ.) বলেন, ইসতিসনা সব মুসলমানের ঐকমত্যে জায়েজ। (আল জামউস সগীর ১/৩২৫)। 


এ বিষয়ে অনেকগুলো দলিল রয়েছে। 


প্রথম দলিল : হজরত জুলকারনাইন (রহ.) পৃথিবী ভ্রমণ করে ইয়াজুজ-মাজুজের অত্যাচারিত এলাকায় গিয়ে পৌঁছলে এলাকাবাসী তাকে বিনিময় দেওয়ার শর্তে একটি দেওয়াল নির্মাণ করার আবেদন করে। যাতে তারা ইয়াজুজ-মাজুজের নিপীড়ন থেকে রেহাই পায়। পবিত্র কোরআনে আল্লাহ তায়ালা সে ঘটনার দিকে ইঙ্গিত করে বলেন, ‘তারা বলল, হে জুলকারনাইন! নিশ্চয় ইয়াজুজ ও মাজুজ জমিনে অশান্তি সৃষ্টি করছে, তাই আমরা কি আপনাকে এ জন্য কিছু খরচ দেব যে, আপনি আমাদের ও তাদের মধ্যে একটা প্রাচীর নির্মাণ করে দেবেন?’ (সূরা কাহ্ফ : ৯৪)। জুলকারনাইনের সঙ্গে এলাকাবাসীর এ চুক্তিটি ছিল বাই-ইসতিসনার ভিত্তিতে। 


দ্বিতীয় দলিল : হাদিস শরিফে এসেছে, রাসুল (সা.) এক আনসারি মহিলার কাছে লোক পাঠিয়ে বলেন, তোমার কাঠমিস্ত্রি গোলামকে বল, আমাকে যেন একটি বসার মিম্বর বানিয়ে দেয়, আমি যখন মানুষের সঙ্গে কথা বলব, তখন সেখানে বসব। (আল জামউস সগির ২/৭৩৮, হাদিস নং ১৯৮৮, মুসলিম শরিফ ১/৩৮৬, হাদিস নং ৫৪৪)। হুজুর (সা.) এর এ চুক্তিটিও বাই-ইসতিসনার ভিত্তিতে ছিল। 


তৃতীয় দলিল : অন্য হাদিসে রয়েছে, হজরত ইবনে ওমর (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসুল (সা.) একটি স্বর্ণের আংটি বাই-ইসতিসনার ভিত্তিতে বানিয়েছিলেন। তিনি তা পরিধান করতেন। পরিধানকালে তার পাথরটি হাতের ভেতরের দিকে রাখলেন। তখন লোকেরাও (এরূপ) করল। এরপর তিনি মিম্বরের ওপর বসে তা খুলে ফেললেন এবং বললেন, আমি এ আংটি পরিধান করেছিলাম এবং তার পাথর হাতের ভেতরের দিকে রেখেছিলাম। অতঃপর তিনি তা ছুড়ে ফেলে দিলেন। আর বললেন, আল্লাহর কসম! আমি এ আংটি আর কোনোদিন পরিধান করব না! তখন লোকেরাও আপন আপন আংটিগুলো খুলে ফেলল। (বোখারি শরিফ, হাদিস নং ৬২৭৫)।


চতুর্থ দলিল : রাসুল (সা.) এর যুগ থেকেই বাই-ইসতিসনার ওপর আমল চলে আসছে। প্রতিটি যুগেই এর ওপর আমল হওয়াটাও একটি আমলি ইজমা। কারণ হাদিস শরিফে রয়েছে, রাসুল (সা.) এরশাদ করেন, ‘আমার উম্মতের সবাই কখনোই গোমরাহির ওপর একমত হতে পারে না।’ (সুনানে আবু দাউদ, হাদিস নং ৩৯৫১)। আরেকটি হাদিসে বলা হয়েছে, হজরত আবদুল্লাহ ইবনে মাসউদ (রা.) বলেন, ‘মুসলমানরা যা ভালো মনে করে সেটা আল্লাহর কাছেও ভালো। আর মুসলমানরা যা খারাপ মনে করে তা আল্লাহর কাছেও খারাপ।’ (মুসনাদে আহমাদ, হাদিস নং ৩৬০০)।


ফুকাহায়ে কেরাম বাই-ইসতিসনার ধরন কী হবে তা নিয়ে ফিকহের কিতাবে বিস্তারিত আলোচনা করেছেন। ইমাম আবু হানিফা (রহ.) এর কাছে পণ্য তৈরি করার পর ক্রেতার ওই পণ্য নেওয়া-না নেওয়ার অধিকার থাকবে। যেহেতু তার মতে এটি কোনো বেচাকেনা চুক্তি নয়; বরং ওয়াদামাত্র। অনুরূপ বিক্রেতারও ক্রেতাকে দেওয়া-না দেওয়ার অধিকার থাকবে। তবে এ অধিকার হলো পণ্যটি তৈরি হওয়ার পর তাকে দেখার আগে। দেখিয়ে ফেললে তাকেই দিতে হবে। অন্যকে দেওয়ার অধিকার থাকবে না। (আল ইখতিয়ার ২/৩৮)। ইমাম আবু ইউসুফ (রহ.) এর মতে ফিরে যাওয়ার অধিকার কারোই থাকবে না। ইজাব কবুল তথা প্রস্তাব ও সম্মতি হয়ে যাওয়ার পর চুক্তি সম্পন্ন হয়ে যায়। ফিকাহবিদরা ইমাম আবু ইউসুফ (রহ.) এর অভিমতের ওপর ফতোয়া প্রদান করেছেন।


ইমাম শাফেয়ি, মালেক ও আহমাদ ইবনে হাম্বল (রহ.) এর কাছে ইসতিসনা হলো বাইয়ে সালামের পর্যায়ের। তারা ইসতিসনা শুদ্ধ হওয়ার জন্য বাই সালামের শর্তগুলোকে শর্ত করেছেন। বাইয়ে সালামের গুরুত্বপূর্ণ একটি শর্ত হলো বিনিময় মজলিসেই প্রদান করা। তবে ইমাম আবু হানিফা (রহ.) এর কাছে ইসতিসনা আর বাই সালাম অভিন্ন নয়। সুতরাং বাইয়ে সালামের শর্তগুলো এখানে প্রযোজ্য নয়। 


ইসতিসনা জায়েজ হওয়ার জন্য কিছু শর্ত রয়েছে :


১. এমন মেয়াদ নির্দিষ্ট করা যাবে না, যার আগে পণ্যটি নেওয়া সহিহ হবে না। 


২. পণ্য তৈরির যাবতীয় উপকরণ কারিগরের হতে হবে। অধিকাংশ উপকরণ অর্ডারদাতার হলে ইসলামি ফিকহের পরিভাষায় এটিকে ইজারা বা কর্মচারী নিয়োগের মতো হয়ে যাবে। তখন কাজের ওপর উজরত তথা চাকরির বিধান প্রয়োগ হবে। 


৩. পণ্যটি বহুল প্রচলিত হতে হবে। অপ্রচলিত অচেনা কোনো জিনিসের বাই-ইসতিসনা সহি নয়। পণ্যটি এমন হতে হবে, যাতে মানুষের বাই-ইসতিসনা করার প্রচলন রয়েছে। 


৪. পণ্যের পূর্ণ বিবরণ পরিপূর্ণ দিতে হবে। তার জাত, ধরন, পরিমাণ ও অন্য বিবরণগুলোকে বিস্তারিত বলতে হবে।


একটি প্রশ্ন-উত্তরের মাধ্যমে বাই-ইসতিসনার একটি দৃষ্টান্ত দেওয়া যাক। 


প্রশ্ন : বর্তমানে ফ্ল্যাট ক্রয়-বিক্রয়ের একটি পদ্ধতি প্রচলিত রয়েছে, প্রথমে পুরো প্রজেক্টের নকশা তৈরি করা হয় ও কোন ক্যাটাগরিতে তা তৈরি করা হবে তার বিস্তারিত বিবরণ সংবলিত তথ্যপূর্ণ ক্যাটালগ বা ফিরিস্তিও প্রকাশ করা হয় এবং নির্মাণকাজ শুরু করার আগেই সেসব ফ্ল্যাট ক্রয়-বিক্রয় করা হয়। এভাবে ফ্ল্যাট ক্রয়-বিক্রয় করা যাবে কিনা?


উত্তর : কোনো বস্তুর ক্রয়-বিক্রয়ের ক্ষেত্রে শরিয়তের একটি মূলনীতি হলো বাস্তব ক্ষেত্রে বস্তুটির অস্তিত্ব থাকা। কেননা অস্তিত্বহীন বস্তুর ক্রয়-বিক্রয় জায়েজ নেই। তবে ফুকাহায়ে কেরাম একটি সুরতকে এর ব্যতিক্রম বলেছেন। যাকে ফিকাহের পরিভাষায় বলে (ইসতিসনা) বা অর্ডার বা নির্দেশ দিয়ে কারও মাধ্যমে কোনো বস্তু প্রস্তুত করানো। সমাজে যার প্রচলন রয়েছে, যেমন জুতা বানানো। আর প্রচলিত ফ্ল্যাটের ক্রয়-বিক্রয়ও এ ধরনের অন্তর্ভুক্ত। কারণ আগে থেকেই ফ্ল্যাটের নকশা, অবস্থান তৈরির কৌশল এবং কোন ক্যাটাগরিতে তৈরি করা হবে তার বিস্তারিত বিবরণ সংবলিত তথ্যপূর্ণ ক্যাটালগ বা ফিরিস্তি প্রকাশ করা হয়ে থাকে। আর এসব বিবরণ জানা এবং কোন স্থানে তার ফ্ল্যাটের অবস্থান তাও গ্রাহক সঠিকভাবে জানা ও দেখার সুযোগ সহজেই পেতে পারে এবং পরবর্তী সময়ে তা সঠিকভাবে বিবরণ অনুযায়ী কার্যকরও হয়ে থাকে। ফলে জানা না থাকার কারণে যেসব ঝগড়া-বিবাদ ও কলহের আশঙ্কা হয়ে থাকে তা আর হয় না। তাই প্রচলিত পদ্ধতিতে ক্রয়-বিক্রয় জায়েজ আছে। (বাদায়ে সানায়ে : ৬/৬৭৭, আল মাবসুত লিস সারাখসি : ১২/১৩৮, কিতাবুল ফাতাওয়া : ৫/২৭১)।


ব্যাংকিংয়ে ইসতিসনা : শুধু মেশিনপত্র বা হাতে তৈরি পণ্যের ক্ষেত্রে বাই ইসতিসনা চুক্তি করা যাবে। ধরা যাক, কোনো গার্মেন্ট মালিক এক হাজার শার্ট তৈরি করার একটি রপ্তানি অর্ডার পেলেন। কিন্তু তার হাতে সে অর্ডার সম্পন্ন করার মতো পর্যাপ্ত অর্থের সংস্থান নেই। এমতাবস্থায় ব্যাংকের দ্বারস্থ হলে ব্যাংক গ্রাহকের আবেদনক্রমে ইসতিসনা চুক্তি করে বর্ণিত পণ্যের মূল্য অগ্রিম পরিশোধ করে উৎপাদনে সহযোগিতা করে। পণ্য তৈরি করার পর নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যেই উৎপাদক (গ্রাহক) ব্যাংকের (ক্রেতার) কাছে বুঝিয়ে দেয়। অতঃপর গ্রাহকের পক্ষে ব্যাংক পণ্যের রপ্তানি শিপমেন্ট করে। আমদানিকারক কর্তৃক ডকুমেন্টস গৃহীত হওয়ার পর অর্জিত রপ্তানিমূল্য গ্রাহকের হিসাব থেকে ব্যাংক তার পাওনা সমন্বয় করে নেয়।

والله اعلم بالصواب