জিজ্ঞাসা-১২৪৪৬:
আসসালামু আলাইকুম মোয়াজ্জাজ মুফতি সাহেব আমার জিজ্ঞাসা হল প্রচলিত পদ্ধতি ব্যতীত নামাজ আদায়ের আর কি কি সহী পদ্ধতি আছে হাদিসে, দয়া করে জানাবেন।
جزاك الله احسن الجزاء وحياك الله وحياة طيبة
তারিখ: ২৮/০১/২৩ ঈসায়ি/ইংরেজি
মাওলানা আনোয়ার হোসেন সিলেট থেকে।
জবাব: وعليكم السلام ورحمة الله وبركاته
نحمده ونصل على رسوله الكريم اما بعد بسم الله الرحمن الرحيم
তাসলিম ও হামদ-সানার পর প্রথম কথা হলো, আমরা তথা আহলে সুন্নাত ওয়াল জামাতের আকিদা হলো, চার মাজহাবই হক। প্রত্যেক ইমাম নসের ভিত্তিতে মাসয়ালা ইস্তেমবাত করেছেন।
নামাজের মৌলিক বিষয়ে মতভেদ নেই। শাখাগত মাসয়ালায় মতভেদ রয়েছে, পদ্ধতি আছে। এ বিষয়ে কিতাবুল ফিকহি আলাল মাজহাবিল আরবা-লেখক আব্দুর রহমান আলজাযিরি , শরহি মাআনিল আসার এবং হিদায়া কিতাবের সালাত অধ্যায়,
দেখে নিলে ইনশাল্লাহ আপনার কাংখিত জবাব পাবেন।
চার মাজহাব সম্পর্কে আরব আলেমদের মতামত নিম্নরূপ:
(০১) শায়েখ আব্দুল ওয়াহহাব নজদী রহঃ কে এরা এদের মুরব্বি জ্ঞান করেন। তো তাঁর মাযহাব কি ছিল? চলুন, শুনে নিই নজদী রহঃ এর নিকট থেকেই। তিনি লিখেছেন-
غيرهم، لعدم ضبط مذاهب الغير؛ الرافضة، والزيدية، والإمامية، ونحوهم؛ ولا نقرهم ظاهراً على شيء من مذاهبهم الفاسدة، بل نجبرهم على تقليد أحد الأئمة الأربعة .
অর্থ : আমরা ফিকহী বিষয়ে ইমাম আহমাদ বিন হাম্বাল রাহ.-এর মাযহাবের অনুসারী। যারা চার ইমামের কোনো একজনের তাকলীদ করে আমরা তাদের উপর কোনো আপত্তি করি না। কারণ (চার ইমামের মাযহাব সংকলিতরূপে বিদ্যমান। পক্ষান্তরে) অন্যদের মাযহাব সংকলিত আকারে বিদ্যমান নেই। তবে রাফেযী, যাইদিয়া, ইমামিয়্যাহ ইত্যাদি বাতিল মাযহাব-মতবাদের অনুসরণকে আমরা স্বীকৃতি দিই না। বরং তাদেরকে চার ইমামের কোনো একজনের তাকলীদ করতে বাধ্য করি। -আদ দুরারুস সানিয়্যা ১/২৭৭
(০২) সাবেক প্রধান মুফতী বিন বায রহঃ এর মাযহাবঃ
বিন বায রহঃ বলেন-
مذهبي في الفقه هو مذهب الإمام أحمد بن حنبل رحمه الله.
‘ফিকহের ক্ষেত্রে আমার মাযহাব হল, ইমাম আহমদ ইবনে হাম্বল রাহ.-এর মাযহাব’। -মাজমুউ ফাতাওয়া ইবনে বায ৪/১৬৬
তিনি আরো বলেছেন,
وأتباع الشيخ محمد بن عبد الوهاب رحمه الله كلهم من الحنابلة، ويعترفون بفضل الأئمة الأربعة و يعتبرون أتباع المذاهب الأربعة إخوة لهم في الله.
অর্থ : শাইখ মুহাম্মাদ বিন আব্দুল ওয়াহহাব নাজদীর অনুসারী সকলেই হাম্বলী মাযহাবের অন্তর্ভুক্ত। তারা চার ইমামকেই অত্যন্ত শ্রদ্ধার দৃষ্টিতে দেখেন এবং চার মাযহাবের অনুসারীদেরকে নিজেদের দ্বীনী ভাই মনে করে থাকেন। -মাজমুউ ফাতাওয়া ইবনে বায ৫/১৫০
(০৩) সালেহ আল ফাউজান এর মাযহাবঃ
সৌদীর প্রসিদ্ধ আলেম শায়েখ সালেহ আল ফাউজান লিখেন,
هاهم الأئمة من المحدثين الكبار كانوا مذهبيين، فشيخ الاسلام ابن تيمية وابن القيم كانا حنبليين، والإمام النووي وابن حجر شافعيين، والإمام الطحاوي كان حنفيا وابن عبدالبر كان مالكيا.
অর্থ : বড় বড় হাদীস বিশারদ ইমামগণ মাযহাবের অনুসারী ছিলেন। শায়খুল ইসলাম ইবনে তাইমিয়া রাহ. ও ইবনুল কায়্যিম রাহ. ছিলেন হাম্বলী, ইবনে হাজার রাহ. ও ইমাম নববী রাহ. ছিলেন শাফেয়ী মাযহাবের অনুসারী। ইমাম ত্বহাবী রাহ. ছিলেন হানাফী মাযহাবের অনুসারী। ইবনু আব্দিল বার রাহ. ছিলেন মালেকী মাযাহবের অনুসারী। -ইয়ানাতুল মুসতাফিদ শরহু কিতাবিত তাওহীদ ১/১২
(০৪) সৌদীর প্রসিদ্ধ আলেম মুহাম্মদ বিন সালেহ আল উসাইমিন রহঃ এর মাযহাবঃ
তিনি লিখেছেন, সৌদি আরবের সর্বোচ্চ উলামা পরিষদের সদস্য শাইখ মুহাম্মাদ বিন সালিহ আলউছাইমীন রাহ.-এরও মাযহাব ও তাকলীদের সমর্থনে একাধিক বক্তব্য রয়েছে। তিনি নিজের ফিকহী মাসলাকের পরিচয় দিতে গিয়ে স্পষ্ট বলেছেন,
نحن الآن مذهبنا مذهب الامام أحمد رحمه الله.
অর্থ : বর্তমানে আমাদের মাযহাব হল, ইমাম আহমাদ রাহ.-এর মাযহাব। -লিকাআতুল বাবিল মাফতুহ ১২/১০০
মাযহাব মানার প্রয়োজনীয়তা উল্লেখ করতে গিয়ে আরো লেখেন-
الانتماء الى المذهب ودراسة قواعده و أصوله يعين الإنسان على فهم الكتاب والسنة.
অর্থ : কোনো মাযহাবের সাথে সম্বন্ধযুক্ত হওয়া এবং তাঁর উসূল ও কাওয়ায়েদ অধ্যয়ন করা মানুষকে কুরআন-সুন্নাহ বুঝতে সহায়তা করে। -মাজমুউ ফাতাওয়া ওয়া রাসাইলে উছাইমীন ২৬/২৪৫
এছাড়া শাইখ উছাইমীন রাহ.-এর শরাহ-ভাষ্যসহ প্রকাশিত ইবনে কুদামা মাকদীসী রাহ.-এর ‘লুমআতুল ই‘তিকাদ’ কিতাবে স্পষ্ট লিখা আছে-
وأما النسبة إلى إمام في فروع الدين كالطوائف الأربع فليس بمذموم، فإن الاختلاف في الفروع رحمة، والمختلفون فيه محمودون في اختلافهم، مثابون في اجتهادهم، واختلافهم رحمة واسعة، واتفاقهم حجة قاطعة.
অর্থ : দ্বীনের ফুরু‘ তথা শাখাগত বিষয়ে কোনো ইমামের সাথে সম্বন্ধ নিন্দার বিষয় নয়। যেমন চার মাযহাব। কারণ, ফুরু‘-এর ক্ষেত্রে মতভেদ হচ্ছে রহমত। এই মতপার্থক্যকারীগণ তাদের মতপার্থক্যের ক্ষেত্রে প্রশংসিত এবং ইজতিহাদের ক্ষেত্রে আজর ও ছওয়াবের অধিকারী। তাদের মতপার্থক্য হল, প্রশস্ত রহমত আর তাদের মতৈক্য হচ্ছে অকাট্ট দলীল।
ইবনে কুদামা রা.-এর উপরোক্ত বক্তব্যকে দালিলিকভাবে প্রমাণ করতে গিয়ে শাইখ উছাইমীন রাহ.-এর ব্যাখ্যায় লেখেন,
الفروع: جمع فرع وهو لغة : ما بني على غيره، واصطلاحًا: ما لا يتعلق بالعقائد، كمسائل الطهارة والصلاة ونحوها.
والاختلاف فيها ليس بمذموم حيث كان صادرًا عن نية خالصة واجتهاد، لا
عن هوى وتعصب؛ لأنه وقع في عهد النبي -صلى الله عليه وسلم- ولم ينكره، حيث قال في غزوة بني قريظة: “لا يصلين أحد العصر إلا في بني قريظة، فحضرت الصلاة قبل وصولهم فأخر بعضهم الصلاة، حتى وصلوا بني قريظة، وصلى بعضهم حين خافوا خروج الوقت، ولم ينكر النبي -صلى الله عليه وسلم- على واحد منهم” رواه البخاري، ولأن الاختلاف فيها موجود في الصحابة وهم خير القرون؛ ولأنه لا يورث عداوة ولا بغضاء ولا تفرق كلمة.
অর্থ : …আর পরিভাষায় ফুরু‘য়ী বা দ্বীনের শাখাগত মাসায়েল হল, যা আকীদা সম্পৃক্ত নয়, যেমন পবিত্রতা এবং নামাযের বিভিন্ন মাসায়েল। আর এক্ষেত্রে যে মতপার্থক্য, এটা কোনো নিন্দনীয় বিষয় নয়। যখন এর ভিত্তি হয় বিশুদ্ধ নিয়্যতের সাথে ইজতিহাদ। খেয়াল-খুশি বা অন্যায় পক্ষপাত নয়। কারণ তা নবীযুগেও সংঘটিত হয়েছে কিন্তু তিনি এর উপর কোনো আপত্তি করেননি। যেমন বনু কুরাইযার যুদ্ধের সময় তিনি বললেন, তোমরা বনু কুরাইযায় আসরের নামায পড়বে। অতপর গন্তব্যে পৌঁছার পূর্বেই আসরের সময় হয়ে গেল। একদল নামাযকে বিলম্বিত করলেন, বনী কুরায়যায় পৌঁছে নামায পড়লেন। আর একদল সময় চলে যাচ্ছে দেখে পথিমধ্যেই নামায পড়ে নিলেন। কিন্তু আল্লাহর রাসূল কোনো পক্ষের উপরই আপত্তি করলেন না, তিরষ্কার করলেন না। আর তাছাড়া এধরনের মতপার্থক্য তো সাহাবীদের মাঝেও হয়েছে। আর তারা হলেন এ উম্মতের সর্বোত্তম শ্রেণী। আর এই মতপার্থক্য উম্মাহর মাঝে কোনোরূপ হিংসা-বিদ্বেষ বা অনৈক্য সৃষ্টি করেনা। -শরহু লুমআতুল ই‘তিকাদ পৃষ্ঠা ১৬৪
সারকথা, সকল ইমামের বাতলানো মাসয়ালা কুরআন সুন্নাহ মোতাবেক।
والله اعلم بالصواب
উত্তর প্রদানে