হিন্দুদের পূজা ও অন্যান্য ধর্মাবলম্বীদের ধর্মীয় অনুষ্ঠানে মুসলিমদের শুভেচ্ছা জানানো: শরয়ি বিশ্লেষণ
ইসলাম তাওহিদের ওপর প্রতিষ্ঠিত একটি পূর্ণাঙ্গ জীবনব্যবস্থা, যেখানে শিরক ও কুফরের প্রতি সামান্যতম সমর্থনও নিষিদ্ধ। অন্যদিকে, হিন্দু ধর্মে বহু ঈশ্বরবাদ ও মূর্তিপূজার গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রয়েছে। ফলে, মুসলমানদের জন্য প্রশ্ন ওঠে—হিন্দুদের পূজা বা অন্যান্য ধর্মীয় উৎসবে শুভেচ্ছা জানানো শরিয়াহসম্মত কি না?
এই বিষয়ে কুরআন, হাদিস, সালাফদের বক্তব্য এবং সমসাময়িক আরব আলওমদের ফতোয়ার আলোকে বিস্তারিত ব্যাখ্যা দেওয়া হবে।
১. ইসলামের দৃষ্টিতে অমুসলিমদের ধর্মীয় উৎসবের প্রতি অবস্থান
ইসলামে ধর্মীয় উৎসব শুধুমাত্র আল্লাহর নির্ধারিত বিধান অনুযায়ী পালনীয়। মুসলমানদের জন্য নির্ধারিত উৎসব হলো ঈদুল ফিতর ও ঈদুল আজহা, যেগুলো ইসলামের মৌলিক বিশ্বাসের সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ।
অন্যদিকে, ইসলামের মৌলিক আকীদার (বিশ্বাসের) বিপরীত এমন কোনো উৎসব, যেখানে শিরক বা কুফরের উপাদান আছে, তা পালন করা বা সেটার প্রতি সম্মান জানানো কঠোরভাবে নিষিদ্ধ।
কুরআনের দলিল
আল্লাহ তাআলা বলেন—
আর যারা মিথ্যা সাক্ষ্যে (অর্থাৎ মিথ্যা ও বাতিল কার্যকলাপে) উপস্থিত হয় না এবং যখন তারা অসার বিষয়ে পড়ে, তখন তা পাশ কাটিয়ে সম্মানজনকভাবে চলে যায়। (সূরা আল-ফুরকান: ৭২)
মুফাসসিরগণ বলেন, এখানে "যুর" (الزُّورَ) শব্দের অর্থ হলো—মিথ্যা, বাতিল, শিরক ও কুফরের যে কোনো আচার-অনুষ্ঠান। অর্থাৎ, মুসলিমদের জন্য কেবল অংশগ্রহণ করাই নিষিদ্ধ নয়, বরং এমন স্থান থেকেও দূরে থাকার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।
হাদিসের দলিল
রাসুলুল্লাহ ﷺ বলেছেন:
যে ব্যক্তি কোনো জাতির সাদৃশ্য গ্রহণ করে, সে তাদের অন্তর্ভুক্ত। (আবু দাউদ: ৪০৩১)
এই হাদিসের ভিত্তিতে ইসলামি ফিকহবিদগণ বলেন, অমুসলিমদের ধর্মীয় রীতিনীতি অনুসরণ করা বা তাদের ধর্মীয় অনুষ্ঠানে সমর্থনসূচক আচরণ করা সম্পূর্ণ হারাম।
২. হিন্দুদের পূজায় শুভেচ্ছা জানানো: শরিয়াতের বিশ্লেষণ
মুসলিমদের জন্য হিন্দুদের পূজার মতো শিরকপূর্ণ উৎসবে শুভেচ্ছা জানানো দুটি কারণে নিষিদ্ধ:
(ক) এটি শিরকের প্রতি পরোক্ষ সম্মতি
ইসলামে শিরক সর্বোচ্চ গুনাহ, যা কোনো অবস্থাতেই ক্ষমাযোগ্য নয় যদি কেউ তওবা না করে। আল্লাহ বলেন:
"নিশ্চয়ই আল্লাহ তাঁকে শরীক করা ক্ষমা করেন না, তবে তিনি যাকে ইচ্ছা ক্ষমা করেন। (সূরা আন-নিসা: ৪৮)
হিন্দুদের পূজা মূলত মূর্তিপূজা এবং বহু-ইলাহবাদভিত্তিক, যা ইসলামের মৌলিক বিশ্বাসের সম্পূর্ণ বিপরীত। তাদের এই আচারকে শুভেচ্ছা জানানো মানে পরোক্ষভাবে সেটাকে স্বীকৃতি দেওয়া, যা ইসলামি আকিদার পরিপন্থী।
(খ) এটি ঈমানের দুর্বলতার লক্ষণ
ইসলাম আমাদের নির্দেশ দেয় সত্যের ওপর অটল থাকতে এবং কুফর ও শিরক থেকে সুস্পষ্ট দূরত্ব বজায় রাখতে। যারা অন্য ধর্মের উৎসবে সমর্থন জানায়, তারা ঈমানের দুর্বলতার পরিচয় দেয়।
শাইখুল ইসলাম ইবনে তাইমিয়া (রহ.) বলেন:
তাদের ধর্মীয় উৎসবে শুভেচ্ছা জানানো সর্বসম্মতিক্রমে নিষিদ্ধ, যেমনটি ইবনুল কাইয়্যিম ও অন্যান্যরা বলেছেন। (ইকতিদাউস সিরাতিল মুস্তাকীম, ১/২২৭)
৩. বিশিষ্ট ফিকহবিদদের মতামত
(ক) ইমাম ইবনুল কাইয়্যিম (রহ.) বলেন:
কুফরী ধর্মীয় প্রতীকের প্রতি শুভেচ্ছা জানানো সর্বসম্মতিক্রমে হারাম। (আহকাম আহলিজ-জিম্মাহ ১/১৬১)
(খ) সৌদি আরবের স্থায়ী ফতোয়া বোর্ড
সৌদি ফতোয়া বোর্ড বলেন:
لَا يَجُوزُ لِلْمُسْلِمِ أَنْ يُهَنِّئَهُمْ بِأَعْيَادِهِمْ، فَإِنَّ ذَلِكَ إِقْرَارٌ لِدِينِهِمْ وَرِضًا بِهِ
মুসলিমদের জন্য তাদের উৎসবে শুভেচ্ছা জানানো জায়েজ নয়, কারণ এতে তাদের ধর্মের প্রতি সমর্থন প্রকাশ পায়। (ফতোয়া আল-লাজনা আদ-দায়িমাহ, ৩/৪৩৫)
৪. বিকল্প উপায়: কিভাবে আচরণ করা উচিত?
অনেকে যুক্তি দেন যে, শুভেচ্ছা জানানো সৌজন্যবোধের অংশ। কিন্তু সৌজন্যতা ও ইসলামী আকীদার মধ্যে পার্থক্য আছে। নিচে কিছু বিকল্প উপায় দেওয়া হলো:
• সাধারণ সৌজন্যতা বজায় রাখা:
তবে সৌজন্যতার নামে “শুভ দুর্গাপূজা/সরস্বতীপূজা” বা “শুভ দীপাবলি” ইত্যাদি বলা সম্পূর্ণ হারাম।
• ধর্মীয় স্বকীয়তা বজায় রাখা:
মুসলিমদের উচিত তাদের ধর্মীয় পরিচয় সুস্পষ্ট রাখা এবং শিরক থেকে সম্পূর্ণ দূরে থাকা।
• সুযোগ বুঝে ইসলামের দাওয়াত দেওয়া:
ইসলামের তাওহিদ ও একত্ববাদের বার্তা সুন্দরভাবে তাদের সামনে তুলে ধরা উচিত।
উপসংহার
√ হিন্দুদের পূজায় বা অন্য ধর্মীয় উৎসবে শুভেচ্ছা জানানো ইসলামে স্পষ্টভাবে হারাম।
√ এতে শিরকের প্রতি সমর্থন প্রকাশ পায়, যা ইমানের জন্য বিপজ্জনক।
√ সৌজন্যের নামে ধর্মীয় স্বীকৃতি দেওয়া ইসলামসম্মত নয়। বরং, আমাদের উচিত ইসলামের মৌলিক চেতনাকে বজায় রাখা।
(হে আল্লাহ! আমাদেরকে সত্যকে সত্য হিসেবে দেখান এবং তা অনুসরণ করার তাওফিক দিন। আর মিথ্যাকে মিথ্যা হিসেবে দেখান এবং তা বর্জন করার তাওফিক দিন)। আমিন! - আব্দুল্লাহ আল মামুন