জিজ্ঞাসা-১৩১৮৬:
আসসালামু আলাইকুম।
একটি মহা অবহেলিত সুন্নাহ!
রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন-কোন মুসলিম ব্যক্তির জন্যে সঙ্গত নয়, তার কাছে ওয়াসিয়্যাত করার মত সম্পদ আছে এমতাবস্থায় ওয়াসিয়্যাত লিখিত না রেখে তিন রাত অতিবাহিত করা।
'আবদুল্লাহ ইবনু 'উমার (রাঃ) বলেন, রসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) থেকে এ কথা শোনার পর এক রাতও আমার উপর পার হয়নি যে, আমার লিখিত ওয়াসিয়্যাত আমার কাছে ছিল না।
সহিহ মুসলিম, হাদিস নং ৪০৯৯
ই. ফা. ৪০৬১, ই. সে. ৪০৬০। এই হাদিসটির ব্যাখা কি হবে। জানালে উপকৃত হতাম। ধন্যবাদ
তারিখ:১১/০২/২৫ ঈসায়ি/ইংরেজি
মাওলানা ওলিউল্লাহ ।
জবাব: ওয়ালাইকুমুস সালাম ওয়া রহমাতুল্লাহ। নাহমাদুহু ওয়া নুসল্লি আলা রসূলিল কারিম। আম্মাবাদ -
তাসলিম ও হামদ-সানার পর
حَدَّثَنَا هَارُونُ بْنُ مَعْرُوفٍ، حَدَّثَنَا عَبْدُ اللَّهِ بْنُ وَهْبٍ، أَخْبَرَنِي عَمْرٌو، - وَهْوَ ابْنُ الْحَارِثِ - عَنِ ابْنِ شِهَابٍ، عَنْ سَالِمٍ، عَنْ أَبِيهِ، أَنَّهُ سَمِعَ رَسُولَ اللَّهِ صلى الله عليه وسلم قَالَ " مَا حَقُّ امْرِئٍ مُسْلِمٍ لَهُ شَىْءٌ يُوصِي فِيهِ يَبِيتُ ثَلاَثَ لَيَالٍ إِلاَّ وَوَصِيَّتُهُ عِنْدَهُ مَكْتُوبَةٌ " . قَالَ عَبْدُ اللَّهِ بْنُ عُمَرَ مَا مَرَّتْ عَلَىَّ لَيْلَةٌ مُنْذُ سَمِعْتُ رَسُولَ اللَّهِ صلى الله عليه وسلم قَالَ ذَلِكَ إِلاَّ وَعِنْدِي وَصِيَّتِي .
৪০৬১। হারুন ইবনে মারুফ (রাহঃ) ......... সালিম (রাহঃ) এর সূত্রে তাঁর পিতা থেকে বর্ণনা করেন যে, তিনি রাসূলুল্লাহ (ﷺ) কে বলতে শুনেছেন, কোন মুসলিম ব্যক্তির জন্য সঙ্গত নয় যে, তার কাছে এমন সস্পদ আছে যাতে সে ওসিয়াত করবে তিন রাত অভিবাহিত করবে। অথচ তার ওসিয়াত তার কাছে লিখিত থাকবে না। আব্দুল্লাহ ইবনে উমর (রাযিঃ) বলেন, রাসূলুল্লাহ (ﷺ) থেকে এ কথা শোনার পর এক রাতও আমার উপর অতিবাহিত যে, আমার ওসিয়াত আমার কাছে (লিখিত) ছিল না।
Salim reported on the authority of his father (’Abdullah b. Umar) that he (his father) had heard Allah’s Messenger (ﷺ) as saying:
It is not proper for a Muslim who has got something to bequeathe to spend even three nights without having his will written down with him regarding it. ’Abdullah b. ’Umar (Allah be pleased with them) said: Ever since I heard Allah’s Messenger (ﷺ) say this I have not spent a night without having my will (written) along with me.
সহীহ মুসলিম, হাদীস নং ৪০৬১ (আন্তর্জাতিক নং ১৬২৭-৪)
হাদীসের ব্যাখ্যা:
প্রথম কথা হলো, উপরোক্ত হাদিস শরিফটি পবিত্র কুরআনের এই আয়াতে কারিমার প্রতিধ্বনি। যেমন,
Surah Al-Baqara, Verse 180:
كُتِبَ عَلَيْكُمْ إِذَا حَضَرَ أَحَدَكُمُ الْمَوْتُ إِن تَرَكَ خَيْرًا الْوَصِيَّةُ لِلْوَالِدَيْنِ وَالْأَقْرَبِينَ بِالْمَعْرُوفِ حَقًّا عَلَى الْمُتَّقِينَ
তোমাদের কারো যখন মৃত্যুর সময় উপস্থিত হয়, সে যদি কিছু ধন-সম্পদ ত্যাগ করে যায়, তবে তার জন্য ওসীয়ত করা বিধিবদ্ধ করা হলো, পিতা-মাতা ও নিকটাত্নীয়দের জন্য ইনসাফের সাথে পরহেযগারদের জন্য এ নির্দেশ জরুরী। নিশ্চয় আল্লাহ তা’আলা সবকিছু শোনেন ও জানেন। সূরা বাকারা-১৮০
দ্বিতীয় কথা, ওয়াসিয়াতের আয়াতটি মিরাস বণ্টনের আয়াত নাজিল হওয়ার পর মানসুখ হয়েছে। দলিল-
وروى الإمام أحمد عن محمد بن سيرين قال: "جلس ابن عباس -ا-فقرأ سورة البقرة حتى أتى على هذه الآية: إِن تَرَكَ خَيْراً الْوَصِيَّةُ لِلْوَالِدَيْنِ وَالأقْرَبِينَ بِالْمَعْرُوفِ، فقال: نسخت هذه الآية".
অর্থ: মুহাম্মাদ ইবনে সিরিন রহ. বলেন, হজরত বসা ছিলেন তার সামনে সূরা বাকারার এ আয়াত তেলাওয়াতের করলে, তখন তিনি বললেন আয়াতটি মানখুস হয়েছে।
وروى ابن أبي حاتم عن ابن عباس -ا- في قوله: الْوَصِيَّةُ لِلْوَالِدَيْنِ وَالأقْرَبِينَ، نسختها هذا الآية: لِّلرِّجَالِ نَصيِبٌ مِّمَّا تَرَكَ الْوَالِدَانِ وَالأَقْرَبُونَ وَلِلنِّسَاء نَصِيبٌ مِّمَّا تَرَكَ الْوَالِدَانِ وَالأَقْرَبُونَ مِمَّا قَلَّ مِنْهُ أَوْ كَثُرَ نَصِيبًا مَّفْرُوضًا [سورة النساء:7].
অর্থ: ইবনে আবি হাতেম আজ আব্বাস আনতে বর্ণনা করেন, "পিতা-মাতা ও নিকটাত্নীয়দের জন্য ইনসাফের সাথে পরহেযগারদের জন্য এ নির্দেশ জরুরী। " আয়াতটি সুরা নিসার ৭ নং দ্বারা নাসেখ করা হয়েছে, Surah An-Nisa, Verse 7:
لِّلرِّجَالِ نَصِيبٌ مِّمَّا تَرَكَ الْوَالِدَانِ وَالْأَقْرَبُونَ وَلِلنِّسَاءِ نَصِيبٌ مِّمَّا تَرَكَ الْوَالِدَانِ وَالْأَقْرَبُونَ مِمَّا قَلَّ مِنْهُ أَوْ كَثُرَ نَصِيبًا مَّفْرُوضًا
পিতা-মাতা ও আত্নীয়-স্বজনদের পরিত্যক্ত সম্পত্তিতে পুরুষদেরও অংশ আছে এবং পিতা-মাতা ও আত্নীয়-স্বজনদের পরিত্যক্ত সম্পত্তিতে নারীদেরও অংশ আছে; অল্প হোক কিংবা বেশী। এ অংশ নির্ধারিত। সূরা নিসা-০৭
ثم قال ابن أبي حاتم: وروي عن ابن عمر وأبي موسى -، وسعيد بن المسيب، والحسن، ومجاهد، وعطاء، وسعيد بن جبير، ومحمد بن سيرين، وعكرمة، وزيد بن أسلم، والربيع بن أنس، وقتادة، والسدي، ومقاتل بن حيان، وطاووس، وإبراهيم النخعي، وشريح، والضحاك، والزهري أن هذه الآية منسوخة,نسختها آية الميراث.
অর্থাৎ ইবনে আবি হাতেম রহ. হযরতে ইবনে ওমর, আবু মুসা রা., সাইদ ইবনে মুসায়িব, হাসান, মুজাহিদ, আতা, সাইদ ইবনে জাবির, মুহাম্মাদ ইবনে সিরিন,যায়েদ ইবনে আসলাম, রাব ইবনে আনাস, কাতাদা, সাদি, তাবুস, ইব্রাহিম নখঈ, শারেহ, জাহহাক, জহুরী থেকে বর্ণনা করেন এই আয়াতটি মিরাসের আয়াত দ্বারা মানসুখ। সূত্র: তাফসিরে ইবনে কাসির-২/৪৯
চতুর্থ কথা হলো, নিম্নোক্ত হাদিস শরিফ দ্বারা উপরোক্ত হাদীস মানসুখ হয়েছে। দলিল
দলিল:
ولذلك قال صلى الله عليه وسلم : ( إِنَّ اللَّهَ قَدْ أَعْطَى كُلَّ ذِي حَقٍّ حَقَّهُ ، فَلَا وَصِيَّةَ لِوَارِثٍ ) رواه أبو داود (2870) والترمذي (2120) والنسائي (3671) وابن ماجه (2713) ي في صحيح أبي داود
অর্থ: রাসূলুল্লাহ (ﷺ) বিদায় হজের ভাষণে বলেন, ‘নিশ্চয়ই আল্লাহ প্রত্যেকের অধিকার যথাযথভাবে বর্ণনা করেছেন, সুতরাং ওয়ারিশদের জন্য কোনো অসিয়ত নেই। তাখরিজ: আবু দাউদ-২৮৭০ তিরমিজি-২১২০; ইবনে মাজাহ-২৭১৩
পঞ্চম কথা হলো,
এ হাদীছটি অন্তরে মৃত্যুচিন্তা জাগ্রত রাখা ও মৃত্যুর প্রস্তুতিস্বরূপ অসিয়তনামা লিখে রাখার প্রতি গুরুত্বারোপ করা হয়েছে। বলা হয়েছে-
مَا حَقٌّ امْرِئٍ مُسْلِمٍ (কোনও মুসলিম ব্যক্তির উচিত নয়)। অর্থাৎ যে ব্যক্তি নিজেকে মুসলিম বলে পরিচয় দেয়, যার বিশ্বাস এ জীবন স্থায়ী নয়, এর পর মৃত্যু আছে, মৃত্যুর পর দীর্ঘকাল কবরে অবস্থান করার রয়েছে, তারপর আখিরাতে আল্লাহর সামনে উপস্থিত হতে হবে এবং সেখানে ইহজীবনের যাবতীয় কাজকর্মের হিসাব দিতে হবে, তার ইসলামের দাবি সম্পর্কে সচেতন থাকা উচিত। তার কিছুতেই উচিত নয়...
لَهُ شيءٌ يُوصِي فِيهِ (যার কাছে অসিয়ত করার মতো কিছু আছে)। অর্থাৎ যার কাছে এমন অর্থ-সম্পদ আছে, যে সম্পর্কে চাইলে সে অসিয়ত করতে পারে। তার সম্পদ এত কম নয় যে, তাতে অসিয়ত করা যাবে না, তা করতে গেলে ওয়ারিছদের জন্য কিছু থাকবে না। এরূপ ব্যক্তির কী করণীয়, সে সম্পর্কে সামনে বলা হচ্ছে-
(সেই মুসলিম ব্যক্তির) নিজের কাছে লিখিত অসিয়তপত্র রাখা ছাড়া দু'রাতও কাটানো (উচিত নয়)'। কোন কোন বর্ণনায় আছে তিন রাত্রের কথা। কোন কোন বর্ণনায় আছে দু'রাত্রের কথা। দু'-তিন রাত দ্বারা মূলত অল্পকাল বোঝানো উদ্দেশ্য। অর্থাৎ সেই মুসলিম ব্যক্তির কর্তব্য সর্বদা মৃত্যুর জন্য প্রস্তুত থাকা এবং সে প্রস্তুতি হিসেবে সর্বদা নিজের কাছে তার সম্পদ সম্পর্কে অসিয়তনামা লিখে রাখা। অসিয়তনামা ছাড়া সে অল্পকালও কাটাবে না। কেননা মৃত্যু তো যে-কোনও সময়ই এসে যেতে পারে। যদি হঠাৎ করে মৃত্যু এসে যায় আর অসিয়তনামা লেখা না থাকে, তবে ওয়ারিছগণ তার সম্পদ নিজেদের মধ্যে ভাগ-ভাটোয়ারা করে নেবে। হয়তো এমন কোনও সৎকর্মে তার কোনও অংশ খরচ করবে না, যা আখিরাতে তার কাজে আসবে। এমনও হতে পারে যে, সে হয়তো তার সম্পদের অংশবিশেষে অসিয়ত করেছিল, কিন্তু কোনও সাক্ষী নেই। ফলে তার মৃত্যুর পর সে অসিয়ত কার্যকর করা হবে না। যদি লেখা থাকত, তবে কার্যকর করা হতো। সে ক্ষেত্রে লেখাটা সাক্ষীরই বিকল্প বলে গণ্য হতো। তাছাড়া সাক্ষী থাকলেও লিখিত অসিয়তের বাড়তি ফায়দা আছে। তা মৃত্যুর স্মারকরূপে কাজ করে। যখনই অসিয়তনামায় নজর পড়বে, তখনই মৃত্যুর কথা স্মরণ হবে।
উল্লেখ্য, যদি আল্লাহ তা'আলার বা বান্দার কোনও হক আদায় করা বাকি থাকে, তবে সে হক আদায় সম্পর্কে অসিয়ত করা ফরয ও অবশ্যকর্তব্য। অন্যথায় তা ফরয নয়। তা সত্ত্বেও প্রয়োজনের বেশি সম্পদ থাকলে অসিয়ত করা ভালো, যাতে সে অসিয়ত অনুযায়ী সম্পদের একটা অংশ ভালো কাজে ব্যয় করা হয় এবং মৃত্যুর পর তার আমলনামায় ছাওয়াব লেখা জারি থাকে। সে অসিয়ত লিখে রাখার দ্বারা যেহেতু মৃত্যুর কথাও স্মরণ হয়, তাই এর বাড়তি গুরুত্ব রয়েছে। সে কারণেই এ হাদীছে এটাকে মুসলিম ব্যক্তির অবশ্যকর্তব্যরূপে ব্যক্ত করা হয়েছে।
হযরত আব্দুল্লাহ ইবন উমর রাযি. রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের আদেশ-উপদেশ পালনের ক্ষেত্রে খুবই অগ্রগামী ছিলেন। যেসব কাজ ফরয নয়; বরং নফল পর্যায়ের, সেসব কাজও তিনি সর্বদা গুরুত্বের সঙ্গে পালন করতেন। এ হাদীছটিতে যেহেতু অসিয়তনামা সঙ্গে রাখার প্রতি উৎসাহ দান করা হয়েছে, তাই তিনি অত্যন্ত গুরুত্ব সহকারে এর উপর আমলে যত্নবান থেকেছেন। একটি রাতও তিনি অসিয়তনামা সঙ্গে রাখা ছাড়া কাটাননি। বস্তুত সব সাহাবীই নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের আদেশ-উপদেশ মানার ক্ষেত্রে এরকম যত্নবান থাকতেন। আমাদের কর্তব্য তাঁদের আদর্শ অনুসরণ করা। আল্লাহ তা'আলা তাওফীক দান করুন।
রেফারেন্স: ব্যাখ্যা সূত্রঃ_ রিয়াযুস সালিহীন (অনুবাদ- মাওলানা আবুল বাশার মুহাম্মাদ সাইফুল ইসলাম হাফি.)
সারকথা, মিরাস সংক্রান্ত ছাড়া অন্যান্য বিষয়ে ওয়াসিয়ত লিখে রাখা অবশ্যই ভালো। বিভিন্ন বুজুর্গদের জীবনীতে এরকম পাওয়া বালিশের নিচে ওয়াসিতনামা লিখে রাখতেন ইমাম গাজালি রহ. তারমধ্যে একজন।
উপরোক্ত হাদিসটি মিরাস সংক্রান্ত আয়াত নাজিল হওয়ার আগে, তাই ওয়াসিত লিখে রাখা ওয়াজিব বা সুন্নাত থাকেনি, মুস্তাহাব। সুতরাং না বুঝে, ব্যাখ্যা না করে শুধু "একটি মহা অবহেলিত সুন্নাহ!" নামে চালিয়ে দেওয়া মূর্খতার পরিচয়।
والله اعلم بالصواب