আল্লাহ-ওয়ালাদের ছুহবতের প্রয়োজনীয়তা
عَنْ أَبِي كَبْشَةَ ، قَالَ سَمِعْتُ أَبَا مُوسَى ، يَقُولُ : قَالَ رَسُولُ اللَّهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ : " مَثَلُ الْجَلِيسِ الصَّالِحِ مَثَلُ الْعَطَّارِ ، إِنْ لَا يُحْذِكَ يَعْبَقْ بِكَ مِنْ رِيحِهِ ، وَمَثَلُ الْجَلِيسِ السُّوءِ مَثَلُ الْقَيْنِ إِنْ لَا يُحْرِقْ ثِيَابَكَ يَعْبَقْ بِكَ مِنْ رِيحِهِ
অর্থ: হজরত আবু মুসা রা. থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ (ﷺ) বলেছেন- সৎ লোকের সাহচর্য ও অসৎ লোকের সাহচর্য যথাক্রমে আতর বিক্রেতা ও কর্মকারের ভাট্রি তে ফুঁক দেয়ার মতো। আতর বিক্রেতা হয়তো তোমাকে এমনিতেই কিছু দান করবে অথবা তুমি তার কাছ থেকে কিছু আতর কিনবে। আর অন্ততপক্ষে কিছু না হলেও তার সুঘ্রাণ তোমার অন্তর ও মস্তিষ্ককে সঞ্জীবিত করবে। পক্ষান্তরে ভাট্রিতে (হাফর) ফুঁক দানকারী তোমার কাপড় জ্বালিয়ে দিবে। আর কিছু না হলেও তার দুর্গন্ধ তুমি পাবে। বুখারি-২১০১,কিতাবুল বুয়ু; মুসলিম-১০২৩; মুসনাদে আহমদ-১৯৬২৪; তিরমিজি-১৯২৮; মিশকাত-৪৭৯১
প্রাসঙ্গিক আলোচনা: ঈমান দৃঢ়-মজবুত করার জন্য এবং অন্তর স্বচ্ছ, নির্মল ও পরিষ্কার করার জন্য নেককার ছুহবত একান্ত প্রয়োজন। অন্যথায় ঈমান নষ্ট করার জন্য, কুটিলতা, জটিলতা, অনুদারতা, স্বার্থপরতা ও পাপে অন্তর পরিপূর্ণ করার জন্য কুসংসর্গের মত মারাত্মক বিষ আর কিছুই নেই।
ছদিকীন তথা আল্লাহ ওয়ালাদের সঙ্গীর হওয়ার নির্দেশ: আল্লাহ পাক ফরমান- হে ঈমান ওয়ালারা! তোমরা আল্লাহকে ভয় কর আর তাকওয়া হাসিলের জন্য সাদেকীনদের সাথে থাক। সূরা আত-তওবা-১১৯এ আয়াতের তাফসির করতে গিয়ে তাফসিরে রুহুল মাআনির লেখক আল্লামা সাইয়্যিদ আলূসি আল-বাগদাদি রহ. লিখেন- অর্থাৎ তুমি তাদের (আল্লাহ ওয়ালাদের) সাথে এমনভাবে জুড়ে থাক এবং এতদিন পর্যন্ত তাদের ছুহবত অবলম্বন কর, যতদিন তুমি তাদের মত হয়ে যাও। সূত্র: তাফসিরে রুহুল মাআনি-১০ খণ্ড;৪২৮ পৃষ্ঠা
সকাল-বিকাল আল্লাহ ওয়ালাদের সাথে অবস্থানের নির্দেশ: কালামে পাকে ইরশাদ হচ্ছে- হে নবি! যারা সকাল-বিকাল শুধু আল্লাহর সন্তুষ্টি লাভের আশায় তাঁকে স্মরণ করে, আপনি এমন লোকের সঙ্গে অবস্থান করুন। সূরা কাহাফ-২৮
এ আয়াত নাযিল হবার পর হুজুর (ﷺ) এই জন্য শুকরিয়া আদায় করতেন যে, আমার উম্মতের মধ্যে এমন লোক পয়দা করেছেন, যাদের মজলিসে জমিয়ে বসার জন্য স্বয়ং আমাকে আদেশ করা হয়েছে এবং আল্লাহর যিকির থেকে গাফেল, খাহেশাতের তাবেদারিও সীমা অতিক্রম করে তাদের অনুসরণ হতে বিরত রাখা হয়েছে।
প্রতিনিয়িত ছালিহীনদের পথই কামনা: আমরা যে সূরা ফাতিহা নামাজে তিলাওয়াত করি। একটি আয়াত হলো হে আল্লাহ! তাদের পথে যারা আপনার নিয়ামত প্রাপ্ত। এ আয়াতের ব্যাখ্যা হলো-অর্থ: যাদের প্রতি আল্লাহ তাআলা অনুগ্রহ করেছেন, নবি, সিদ্দীক, শহীদ এবং সৎককর্মশীল (ছলিহীন)। সূরা আন নিসা-৬৯
সমস্ত বরকত মহান আকাবির-আসলাফের পথেই: হজরত আব্দুল্লাহ ইবনে আব্বাস রা. বলেন- অর্থ: তোমাদের পূর্বসরী ও আকাবিরদের সাথেই (সংস্পর্শে) বররকত ও পূন্য (অর্জন সম্ভব)। (মুস্তাদরেক হাকেম) সালফে-সালিহীনের মাঝে এমন একটি বিশাল দল অতিবাহিত হয়েছেন, যারা আল্লাহ ওয়ালা বুযুর্গ ব্যক্তির কাছে কেবলমাত্র এ উদ্দেশ্য গমন করেছেন, রাসূলে আরাবি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম (হাদিসের) মূল ও মুখ্য উদ্দেশ্য এবং পন্থা-পদ্ধতি কিরুপ ছিল, তা স্বচক্ষে সেই বুযুর্গের দেখে-বুঝে আসতে পারেন। সুতরাং তাঁদের ছুহবতের পাশাপাশি মহান আকাবির-আসলাফের জীবনী পাঠ করতে হবে। সাঈদুল খাতির, সূত্র: তারীকে দাওয়াত ও আযীমত, ১ম খণ্ড; ২২৭-২২৮ পৃষ্ঠা ।
এক শ্রেণীর মানুষ আছে, তারা ছুহবতকে অস্বীকার করে, তারা বলে, সরাসরি কুরআন-হাদিস মানবো। আরে ভাই মহান আল্লাহই সরাসরি মানুষের প্রতি কিতাব নাযিল করেননি। বরং নবির প্রতি নাযিল করেছেন। উম্মতকে নবি হাতে কলমে শিক্ষা দিয়েছেন। নবির ছুহবতে সাহাবি, সাহাবির ছুহবতে তাবেয়ি, তাঁদের ছুহবতে তাবে-তাবেয়ি পয়দা হয়েছে। এভাবে যুগে যুগে কামেলীনদের হাতে আরেক কামেল পয়দা হয়েছে। মেডিক্যাল স্যায়েন্সের কিতাব পড়েই কি শুধু ডাক্তার হওয়া যায়। না, ইন্টারনি, অভিজ্ঞ ডাক্তারের সান্নিধ্য দরকার হয়। এ মহা সত্যকে কিভাবে অস্বীকার করা যায়؟ ?
আল্লাহ-ওয়ালাদের ছুহবত-মহব্বত ঈমানের সাথে মৃত্যুর আমল: যাকিরীন তথা ছালিহীন ও আল্লাহর ওলিদের মর্তবা সম্পর্কে হাদিস শরিফে এসেছে-এক ব্যক্তি তার নিজের উদ্দেশ্যে যাওয়ার পথে কিছুক্ষণের জন্য ছালিহীন বা আল্লাহ ওয়ালাদের সঙ্গে যিকিরের মজলিসে বসল। অতঃপর আল্লাহ পাক যখন ফিরিশতাগণ তখন বলতে লাগলো, আয় আল্লাহ,অমুক ব্যক্তি তো নিছক নিজের কাজেই এসেছিল এবং সে সুবাদেই কিছুক্ষণ ওখানে বসেছিল। জবাবে আল্লাহ পাক ইরশাদ করেন- অর্থ: এরা আমার এমনই মাকবুল ও মাহবুব বা্ন্দা যে, তাদের মজালসে অংশগ্রহণকারীও (আমার রহমত হতে) বঞ্চিত হয় না। আমি আমার ঐ পাপী বান্দাটিকে ক্ষমা করে দিলাম। বুখারি-মুসলিম, মিশকাত-২১৬০ বাবে যিকরুল্লাহ আয্যা-জাল্লা তারা হতভাগা হয় না মানে জাহান্নামী হয় না। আর জান্নাতে যেতে হলে ঈমান লাগবে। সুতরাং প্রমাণিত হলো ঈমানের সঙ্গে মৃত্যু নসীব হবে।
বিখ্যাত মুহাদ্দিস হাফেয ইবনে হাজার আসকালানি রহ. বলেন- অর্থ: এটা নিঃসন্দেহ যে, আল্লাহ পাক তার ওলিদেরকে যত নিয়ামত ও অনুগ্রহ দান করেন, তাঁদের সম্মানার্থে তাঁদের মজলিসে ওঠা-বসাকারী বান্দাদেরকেও তিনি ঐ সকল নিয়ামত দান করে দেন।যেভাবে মহামান্য মেহমানের খাতিরে তার নগণ্য খাদেমওে ঐ সকল সম্মানজনক খাদ্য-সামগ্রী দ্বারা আপ্যায়ন করা হয়,যা মূলত ঐ মেহমানের জন্যই তৈরি করা হয়ে থাকে। ফাতহুল বারি-১১খণ্ড; ২১৩ পৃষ্ঠা ।
আল্লাহ ওয়ালাদের সঙ্গে মহব্বতের সম্পর্কের ফায়দা: আবু হুরাইরা (রা.) থেকে বর্ণিত যে, রাসূলুল্লাহ (ﷺ) বলেছেন: আল্লাহ তাআলা কেয়ামতের দিন বলবেন, যারা পরস্পরকে ভালোবেসেছে আমারই জন্য তারা আজ কোথায়? আজ আমি তাদেরকে আমার ছায়ায় ছায়া দান করবো। আজ এমন দিন আমার ছায়া ব্যতীত আর কোন ছায়া নেই। সহিহ মুসলিম- ১৯৮৮
এ কথা সত্য যে, নেক লোকের সঙ্গেই একমাত্র প্রকৃত ভালবাসা পয়দা হয়। আল্লাহ ওয়ালা ব্যতীত অন্য কার সঙ্গে ভালবাসায় দুনিয়ার স্বার্থ যুক্ত থাকে। সুতরাং আল্লাহর অনুগত বান্দাদের সঙ্গে সম্পর্ক রাখলে ইনশাল্লাহ এর বদলতে আরশের নিচে ঠাই পাওয়া যাবে।
আল্লাহ ওয়ালাদের পরিচয়: তিনি মুত্তাকি তিনিই আল্লাহ ওয়ালা অর্থাৎ যিনি জাহের-বাতেন সব ধরণের গোনাহ থেকে বিরত থাকেন। কখন কোন ভুল-গোনাহ হয়ে গেলে জলদি তওবা করে। এক হাদিসে তাঁদের আলামত বলা হয়েছে যে, যাদেরকে দেখলে আল্লাহর স্মরণ হয়, দ্বীন-ধর্মের জ্ঞান বাড়ে এবং আখেরাতের কথা স্মরণ হয় (দেল আখেরাতের দিকে ধাবিত হয়)।
দেখুন-খাযায়েনে কুরআন ও হাদিস-হাকীমুল উম্মমত প্রকাশনী। সূত্র: "মুসলিম জীবন সাফল্যে চল্লিশ হাদিস"-১০৭ পৃষ্ঠা, লেখক মাওলানা আব্দুর রাজ্জাক