বিপদ-মুসিবতের ১০ কারণ ও শাস্তি
মুফতি নূর মুহাম্মদ রাহমানী
প্রকাশ: রবিবার, ১২ এপ্রিল, ২০২০, ১১:৫৪ পিএম (ভিজিট : ৩২১২)
পাপের কুফল ও শাস্তি সবাইকেই ভোগ করতে হয়। আখেরাতে যেমন পাপের শাস্তি হবে, তেমনি দুনিয়াতেও কিছু শাস্তি ভোগ করতে হবে। পাপের ক্ষতি ও অপকারিতার শেষ নেই। নিচে ১০টি পাপের ১০টি ক্ষতি সম্পর্কে আলোচনা করা হলো।
ফরজ নামাজ ছেড়ে দেওয়া : ফরজ নামাজ ইচ্ছাকৃতভাবে কোনোরকমের ওজর ছাড়া ছেড়ে দিলে তার ওপর বিপদ-আপদ আসতে পারে। সাহাবি হজরত আবু দারদা (রা.) বলেন, আমার বন্ধু (রাসুল সা.) আমাকে অসিয়ত করেছেন, আল্লাহর সঙ্গে কাউকে শরিক কর না। তোমাকে (কেটে) টুকরো টুকরো করে ফেলা হলেও এবং তোমাকে জ্বালিয়ে ফেলা সত্তে¡ও। আর ইচ্ছাকৃতভাবে ফরজ নামাজ পরিহার কর না। কেউ ইচ্ছাকৃতভাবে ফরজ নামাজ ছেড়ে দিলে তার ওপর থেকে (আল্লাহতায়ালার) দায়িত্ব উঠে যায়।’ (ইবনে মাজা : হাদিস ৪০৩৪)। এ দ্বারা বুঝা যায়, ইচ্ছাকৃতভাবে জেনে-বুঝে ফরজ নামাজ ছেড়ে দিলে সে আল্লাহর দায়িত্ব ও নিরাপত্তা হতে বের হয়ে যায়। ফলে তার যেকোনো দুরবস্থা ঘটতে পারে।
ধন-সম্পদের জাকাত না দেওয়া : সম্পদের জাকাত না দিলে বৃষ্টি হবে না। হজরত ইবনে ওমর (রা.) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, একবার মহানবী (সা.) আমাদের কাছে এলেন। অতঃপর বললেন, যারা নিজের ধন-সম্পদের জাকাত বন্ধ করে দেবে, তাদের জন্য আসমান থেকে বৃষ্টি বন্ধ রাখা হবে। এমনকি চতুষ্পদ জন্তু না থাকলে আদৌ বৃষ্টি হবে না।’ (হিলইয়াতুল আওলিয়া : ৩/৩২০; ইবনে মাজাহ, হাদিস : ৪০১৯)
আল্লাহর অবাধ্য হওয়া : আল্লাহর অবাধ্য হলে জালেম শাসক চেপে বসে। হজরত আবু দারদা (রা.) থেকে বর্ণিত হাদিসে কুদসিতে রয়েছে, রাসুলুল্লাহ (সা.) এরশাদ করেন, আল্লাহতায়ালা বলেন, ‘আমি সব সৃষ্টির উপাস্য, আমাকে ছাড়া কোনো উপাস্য নেই। আমি রাজন্যবর্গের অধিপতি। সম্রাটদের সম্রাট। রাজাদের অন্তর আমার নিয়ন্ত্রণাধীন। বান্দাগণ যখন আমার আনুগত্য করে, তখন তাদের রাজা-বাদশাহদের অন্তরকে রহমত ও করুণার সমন্বয়ে তাদের দিকে ঘুরিয়ে দেই। আর যখন বান্দারা আমার অবাধ্যতা অবলম্বন করে, তখন রাজা-বাদশাহদের অন্তরকে রাগ ও কঠোরতার দিকে ঝুঁকিয়ে দেই; যার ফলে তারা প্রজাদের কঠিন নিপীড়ন আস্বাদন করায়।’ (আবু নুয়াইম, হিলইয়াতুল আওলিয়া : ৩/১৮০; মিশকাত, হাদিস : ৩৭২১)।
মানুষের ওপর জালেম ও অত্যাচারী শাসক চাপিয়ে দেওয়া হয় মানুষের অপকর্মের কারণে। হ্যাঁ, শাসকবর্গ জুলুম অত্যাচার করলে তারা এর পরিণতি দুনিয়া-আখেরাতে ভোগ করবে।
ব্যভিচার বেড়ে যাওয়া : ব্যভিচারের কারণে দুর্ভিক্ষ দেখা দেয়। হজরত আমর ইবনুল আস (রা.) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, আমি রাসুলুল্লাহ (সা.)-কে বলতে শুনেছি, যে জাতির মাঝে ব্যভিচার বিস্তার লাভ করে, তাদের দুর্ভিক্ষের মাধ্যমে পাকড়াও করা হয়।’ (মুসনাদে আহমদ, হাদিস : ১৭৮১২; মিশকাত, হাদিস : ৩৫৮২)
ঘুষের আধিক্য : ঘুষের লেনদেন বেড়ে গেলে ভীরুতা ও আতঙ্ক ছড়িয়ে দেওয়া হয়। হজরত আমর ইবনুল আস (রা.) হতে বর্ণিত, প্রিয়নবী (সা.) এরশাদ করেন, যাদের মাঝে ঘুষ বিস্তার লাভ করে, তাদের পাকড়াও করা হয় ভীতি ও আতঙ্কের মাধ্যমে।’ (মুসনাদে আহমদ, হাদিস : ১৭৮২২; মিশকাত, হাদিস : ৩৫৮২ )
অশ্লীলতার ছড়াছড়ি : খোলাখুলি অশ্লীল কাজ হতে থাকলে সমাজে মহামারী ছড়িয়ে পড়ে। হজরত ইবনে ওমর (রা.) বলেন, একদিন রাসুল আকরাম (সা.) আমাদের লক্ষ করে বললেন, হে মুহাজেরগণ! আল্লাহ না করুন, পাঁচটি বিষয়ে যখন তোমরা লিপ্ত হয়ে পড়বে, তখন পাঁচটি বিষয়ের পরিণতিতে অবশ্যই পাঁচটি বিষয় প্রকাশ পাবে। একটি হলো, যখন কোনো জাতি সম্প্রদায়ের মাঝে খোলাখুলি অশ্লীল কাজ হতে শুরু করে, তখন অবশ্যই তাদের মাঝে প্লেগ এবং এমন সব রোগ-ব্যাধি ছড়িয়ে পড়বে, যা তাদের বাপ-দাদাদের মধ্যে কারও হয়নি।’ (ইবনে মাজাহ, হাদিস : ৪০১৯)। হতে পারে, আল্লাহতায়ালা আমাদের যত্রতত্র অশ্লীলতা আর বেহায়াপনার কারণে করোনার মতো ভয়ঙ্কর মহামারী দিয়েছেন! হাদিসের ভাষ্য তাই বলে।
হারাম খাদ্য ও পোশাক-পরিচ্ছদ : হারাম খাবার-দাবার ও পোশাক-পরিচ্ছদে ইবাদত-বন্দেগি কবুল হয় না। হজরত আবু হুরাইরা (রা) বর্ণনা করেন, রাসুলুল্লাহ (সা.) এরশাদ করেছেন, নিঃসন্দেহে আল্লাহ পবিত্র। পবিত্রকেই তিনি গ্রহণ করেন এবং নিঃসন্দেহে আল্লাহ ঈমানদারদের সে আদেশই দিয়েছেন যা নবীগণকে দিয়েছেন। সুতরাং তিনি বলেছেন, ‘হে রাসুলগণ! পবিত্র বস্তু ভক্ষণ কর এবং সৎকর্ম সম্পাদন কর। আল্লাহতায়ালা আরও বলেছেন, ‘হে ঈমানদারগণ! আমি তোমাদের যা কিছু দান করেছি, তার মধ্য থেকে উত্তম বস্তু-সামগ্রী ভক্ষণ কর।’ অতপর মহানবী (সা.) এমন লোকদের কথা বলেছেন, যারা দীর্ঘ ভ্রমণে আসবে, যাদের মাথার চুল আলুথালু এবং দেহ ধূলিমলীন; যারা ওপরের দিকে হাত তুলে ইয়া রব, ইয়া রব বলে, অথচ তাদের খাদ্য হারাম, পানীয় হারাম, তাদের পোশাক হারাম এবং তাদের অস্তিত্ব হারাম দ্বারা পরিপুষ্ট, এবং এতদসত্তে¡ও কেমন করে এদের দোয়া কবুল হতে পারে।’ (মুসলিম, হাদিস : ১০১৫)।
জুলুম অত্যাচার : জুলুম অত্যাচার কিয়ামতের দিন অন্ধকার হয়ে উপস্থিত হবে। হজরত ইবনে ওমর (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসুল (সা.) এরশাদ করেন, হে মানুষ সকল! তোমরা জুলুম অত্যাচার থেকে বেঁচে থাক। কেননা, জুলুম অত্যাচার কিয়ামতের দিন অন্ধকার হয়ে উপস্থিত হবে।’ (মুসনাদে আহমদ, হাদিস : ৫৬৬২)
কৃপণতা : কৃপণতা ধ্বংসের পাড়ে নেওয়ার মন্ত্র। আল্লাহর নবী (সা.) বলেছেন, তোমরা কৃপণতা থেকে বেঁচে থাক। কারণ, কৃপণতা তোমাদের পূর্ববর্তী লোকদের ধ্বংস করে ছেড়েছে; তাদের অন্যায়ভাবে রক্তপাত ঘটাতে প্ররোচিত করেছে এবং হারাম সামগ্রীকে তারা (কার্যত) হালাল বানিয়ে নিয়েছে।’ (মুসলিম, হাদিস : ২৫৭৮; মিশকাত, হাদিস : ১৮৬৫)
সৎকাজে আদেশ এবং অসৎকাজে নিষেধ পরিহার : সৎকাজের আদেশ এবং অসৎকাজে নিষেধ দেওয়া পরিত্যাগ করলে আল্লাহর আজাব নেমে আসে। হজরত হুজাইফা (রা.) থেকে বর্ণিত, হুজুর (সা.) এরশাদ করেছেন, সে মহান সত্তার কসম যার হাতে আমার প্রাণ, অবশ্য অবশ্যই সৎকর্মের নির্দেশ দিতে থাকো এবং অসৎকর্ম থেকে বারণ করতে থাক। অন্যথায় আল্লাহতায়ালা তোমাদের ওপর নিজের (পক্ষ থেকে) আজাব পাঠিয়ে দেবেন। তখন আল্লাহর কাছে তোমরা দোয়া প্রার্থনা করবে, অথচ তা কবুল হবে না।’ (তিরমিজি, হাদিস : ২১৬৯)
সুদের সঙ্গে জড়িত হওয়া : সুদের দরুন আল্লাহর আজাব গ্রাস করে। হজরত ইবনে মাসউদ (রা.) থেকে বর্ণিত, প্রিয়নবী (সা.) বলেছেন, যাদের মাঝে ব্যভিচার ও সুদ বিস্তার লাভ করল, তারা নিজেদের ওপর আল্লাহর আজাব নামিয়ে নিল।’ (মুসনাদে আহমদ, হাদিস : ৩৮০৯; মুসনাদে আবু ইয়ালা, হাদিস : ৪৯৮১)
তাই আসুন আমরা সব রকমের গুনাহ ছেড়ে দিয়ে আল্লাহমুখী হই। বর্তমান করোনা পরিস্থিতিতে তো আরও বেশি আল্লাহমুখী হওয়া প্রয়োজন। যাতে আল্লাহ রাব্বুল আলামীন আমাদের করোনা মহামারীসহ সব বিপদ-আপদ থেকে উদ্ধার করেন।
লেখক : শিক্ষক, জামিয়া আরাবিয়া দারুল উলুম বাগে জান্নাত, চাষাড়া, নারায়ণগঞ্জ