জিজ্ঞাসা-১২৩৭১:
আসসালামু আলাইকুম। আমরা জানি যে আত্মহত্যাকারী জাহান্নামী এখন যুদ্ধের সময় যদি যুদ্ধে জয়ের জন্য আত্মঘাতী হামলার প্রয়োজন হয় তাহলে কি হবে? তারিখ: ০৭/১২/২২ ঈসায়ি/ইংরেজি
মাওলানা শরিফুল ইসলাম দিনাজপুর থেকে।
জবাব: وعليكم السلام ورحمة الله وبركاته
نحمده ونصل على رسوله الكريم اما بعد بسم الله الرحمن الرحيم
তাসলিম ও হামদ-সানার পর প্রথম কথা হলো, আত্মহত্যা একটি মহাপাপ এবং হারাম। এ সম্পর্কে কঠিক আজাবের ধমক এসেছে। যেমন,
عَنْ ثَابِتِ بْنِ الضَّحَّاكِ، عَنِ النَّبِيِّ صلى الله عليه وسلم قَالَ " لَيْسَ عَلَى رَجُلٍ نَذْرٌ فِيمَا لاَ يَمْلِكُ وَلَعْنُ الْمُؤْمِنِ كَقَتْلِهِ وَمَنْ قَتَلَ نَفْسَهُ بِشَىْءٍ فِي الدُّنْيَا عُذِّبَ بِهِ يَوْمَ الْقِيَامَةِ
রাসূল (ﷺ) ইরশাদ করেছেন- “যদি কেউ কোন জিনিস দ্বারা আত্মহত্যা করে, তাহলে কিয়ামতের দিন ঐ জিনিস দ্বারাই তাকে আযাব দেয়া হবে। সহীহ মুসলিম-২০৯
দ্বিতীয় কথা হলো, ইসলামে শরিআতে আত্মহত্যার কোন স্থান নেই। পক্ষান্তরে জিহাদে নিজের জান ব্যবহার করার উৎসাহ ও হুকুম দেয়া হয়েছে এবং এ কথাও বলা হয়েছে যে, আল্লাহ তা‘আলা জান্নাতের পরিবর্তে মুমিনের জান মাল ক্রয় করেছেন। দলিল:
إِنَّ اللَّهَ اشْتَرَى مِنَ الْمُؤْمِنِينَ أَنْفُسَهُمْ وَأَمْوَالَهُمْ بِأَنَّ لَهُمُ الْجَنَّةَ يُقَاتِلُونَ فِي سَبِيلِ اللَّهِ فَيَقْتُلُونَ وَيُقْتَلُونَ وَعْدًا عَلَيْهِ حَقًّا فِي التَّوْرَاةِ وَالْإِنْجِيلِ وَالْقُرْآَنِ وَمَنْ أَوْفَى بِعَهْدِهِ مِنَ اللَّهِ فَاسْتَبْشِرُوا بِبَيْعِكُمُ الَّذِي بَايَعْتُمْ بِهِ وَذَلِكَ هُوَ الْفَوْزُ الْعَظِيمُ
অর্থ: “আল্লাহ তা‘আলা ক্রয় করে নিয়েছেন মুমিনদের থেকে তাঁদের জান ও মাল এই মূল্যে যে, তাঁদের জন্য রয়েছে জান্নাত। তাঁরা যুদ্ধ করে আল্লাহর পথে; অতঃপর হত্যা করে ও নিহত হয়।” সূরা তাওবা-১১১
কুরআনের আলোকে আত্মোৎসর্গ
আয়াত নং-০১
وَمِنَ النَّاسِ مَنۡ یَّشۡرِیۡ نَفۡسَہُ ابۡتِغَآءَ مَرۡضَاتِ اللّٰہِ ؕ وَاللّٰہُ رَءُوۡفٌۢ بِالۡعِبَادِ
আর মানুষের মাঝে এক শ্রেণীর লোক রয়েছে যারা আল্লাহর সন্তুষ্টিকল্পে নিজেদের জানের বাজি রাখে। আল্লাহ হলেন তাঁর বান্দাদের প্রতি অত্যন্ত মেহেরবান। সূরা বাকারা-২০৭
তাফসির:
ولما حمل هشام بن عامر بين الصفين ، أنكر عليه بعض الناس ، فرد عليهم عمر بن الخطاب وأبو هريرة وغيرهما ، وتلوا هذه الآية : { ومن الناس من يشري نفسه ابتغاء مرضاة الله والله رءوف بالعباد
ইবনে কাসীর রাহ. এ আয়াতের ব্যাখ্যা করতে গিয়ে নকল করেন, একবার হিশাম ইবনে আমের রাযি. শত্রু বাহিনীর দুই কাতারের মাঝে হামলা করলে কিছু লোক এর বিরোধিতা করে। তখন হযরত ওমর রাযি., হযরত আবু হুরায়রা রাযি. সহ অন্যান্যরা আপত্তিকারী ব্যক্তিদের মত প্রত্যাখ্যান করে এই আয়াত তেলাওয়াত করেন- “মানুষদের মধ্যে এমন লোকও আছে, যে আল্লাহর সন্তুিষ্ট লাভের উদ্দেশ্যে আত্ম-বিক্রয় করে থাকে। আল্লাহ তাঁর বান্দাদের প্রতি অত্যন্দ দয়াবান।” তাফসীরে ইবনে কাসীর: ১/৩৬৯, দারু ইবনুল জাওযী, কায়রো
হাদিসের আলোকে আত্মোৎসর্গ:
হাদিস নং-০১
باب غَزْوَةُ مُوتَةَ مِنْ أَرْضِ الشَّأْمِ
أَخْبَرَنَا أَحْمَدُ بْنُ أَبِي بَكْرٍ، حَدَّثَنَا مُغِيرَةُ بْنُ عَبْدِ الرَّحْمَنِ، عَنْ عَبْدِ اللَّهِ بْنِ سَعِيدٍ، عَنْ نَافِعٍ، عَنْ عَبْدِ اللَّهِ بْنِ عُمَرَ ـ رضى الله عنهما ـ قَالَ أَمَّرَ رَسُولُ اللَّهِ صلى الله عليه وسلم فِي غَزْوَةِ مُوتَةَ زَيْدَ بْنَ حَارِثَةَ، فَقَالَ رَسُولُ اللَّهِ صلى الله عليه وسلم " إِنْ قُتِلَ زَيْدٌ فَجَعْفَرٌ، وَإِنْ قُتِلَ جَعْفَرٌ فَعَبْدُ اللَّهِ بْنُ رَوَاحَةَ ". قَالَ عَبْدُ اللَّهِ كُنْتُ فِيهِمْ فِي تِلْكَ الْغَزْوَةِ فَالْتَمَسْنَا جَعْفَرَ بْنَ أَبِي طَالِبٍ، فَوَجَدْنَاهُ فِي الْقَتْلَى، وَوَجَدْنَا مَا فِي جَسَدِهِ بِضْعًا وَتِسْعِينَ مِنْ طَعْنَةٍ وَرَمْيَةٍ.
অর্থ: আহমদ ইবনে আবু বকর (রাহঃ) ... আব্দুল্লাহ ইবনে উমর (রাযিঃ) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, মুতার যুদ্ধে রাসূলুল্লাহ (ﷺ) যায়েদ ইবনে হারিসা (রাযিঃ) কে সেনাপতি নিযুক্ত করে বলেছিলেন, যদি যায়েদ (রাযিঃ) শহীদ হয়ে যায় তাহলে জাফর ইবনে আবু তালিব (রাযিঃ) সেনাপতি হবে। যদি জাফর (রাযিঃ)-ও শহীদ হয়ে যায় তাহলে আব্দুল্লাহ ইবনে রাওয়াহা (রাযিঃ) সেনাপতি হবে। আব্দুল্লাহ [ইবনে উমর (রাযিঃ)] বলেন, ঐ যুদ্ধে তাদের সাথে আমিও ছিলাম। যুদ্ধ শেষে আমরা জাফর ইবনে আবু তালিব (রাযিঃ) কে তালাশ করলে তাকে শহীদগণের মধ্যে পেলাম। তখন আমরা তার দেহে তরবারী ও বর্শার নব্বইটিরও অধিক আঘাতের চিহ্ন দেখতে পেয়েছি।*
বুখারি- ৪২৬১, সিরিয়ায় সংঘটিত মূতার যুদ্ধের বর্ণনা অধ্যয়
ব্যাখ্যা: তিন সাহাবি মৃত্যুর কথা নিশ্চিত জানার পরও জিহাদে অংশ গ্রহণ করেছেন।
হাদিস নং-০২
أﻓﺮد ﻳﻮم أﺣﺪ ﻓﻰ ﺳـــﺒﻌﺔ ﻣﻦ اﻷﻧﺼـــﺎر ورﺟﻠﻴﻦ ﻣﻦ ﻗﺮﻳﺶ ﻓﻠﻤﺎ رﻫﻘﻮﻩ ﻗﺎل :ﻣﻦ ﻳﺮدﻫ ﻢ ﻋﻨﺎ أن رﺳـــﻮل اﻟﻠﻪ وﻟﻪ اﻟﺠﻨﺔ أو ﻫﻮ رﻓﻴﻘﻲ ﻓﻲ اﻟﺠﻨﺔ ﻓﺘﻘﺪم رﺟﻞ ﻣﻦ اﻷﻧﺼـﺎر ﻓﻘﺎﺗﻞ ﺣﺘﻰ ﻗﺘﻞ ﺛﻢ رﻫﻘﻮﻩ أﻳﻀـﺎ ﻓﻠﻢ ﻳﺰل ﻛﺬﻟﻚ ﺣﺘﻰ ﻗﺘﻞ اﻟﺴﺒﻌﺔ .
আনাস রাযি. থেকে বর্ণিত- “উহুদের দিন রাসূলুল্লাহ এর সাথে সাতজন আনসারী ও দুইজন কুরাইশী সাহাবী ছিলেন। এক সময় মুশরিকরা রাসূলুল্লাহ এর কাছে চলে আসল, তখন তিনি বললেন, তোমাদের মধ্যে কে আছ যে তাদের প্রতিহত করবে? তার জন্য জান্নাত রয়েছে, অথবা সে জান্নাতে আমার সাথী হবে। তখন এক আনসারী সাহাবী সামনে এগিয়ে লড়াই করলেন এবং শহীদ হয়ে গেলেন অতঃপর আবার তারা রাসূল এর কাছে চলে আসলে একে একে সাতজনই শহীদ হয়ে গেলেন। মুসলিম-১৭৮৯
ব্যাখ্যা : উহুদের দিন অনেক সাহাবায়ে কেরাম একা শত্রুর মাঝে ঢুকে আক্রমণ করেন এবং শাহাদাত বরণ করেন, যেখানে নিশ্চিত মত্যুর আশঙ্কা ছিল। রাসূল তাঁদের প্রশংসাও করেছেন।
হাদিস নং-০৩
وﺑﻠﻐﻨﺎ أن اﻟﺒﺮاء ﻳﻮم ﺣﺮب ﻣﺴﻴﻠﻤﺔ اﻟﻜﺬاب أﻣﺮ أﺻﺤﺎﺑﻪ أن ﻳﺤﺘﻤﻠﻮﻩ ﻋﻠﻰ ﺗﺮس، ﻋﻠﻰ أﺳﻨﺔ رﻣﺎﺣﻬﻢ، وﻳﻠﻘﻮﻩ ৭৭৫. ﻓﻲ اﻟﺤﺪﻳﻘﺔ .ﻓﺎﻗﺘﺤﻢ إﻟﻴﻬﻢ، وﺷﺪ ﻋﻠﻴﻬﻢ، وﻗﺎﺗﻞ ﺣﺘﻰ اﻓﺘﺘﺢ ﺑﺎب اﻟﺤﺪﻳﻘﺔ
হযরত বারা ইবনে মালেক রাযি. মুসায়লামা কাযযাবের সাথে যুদ্ধের দিন সাথীদেরকে বর্শার আগায় ঢাল রেখে তাঁকে তার উপর বসিয়ে বাগানের মধ্যে ছুঁড়ে দিতে বললেন। অতঃপর তিন তাদের মাঝে ঢুকে প্রচন্ড বেগে আক্রমণ করলেন এবং তাদের হত্যা করে বাগানের দরজা খুলে দিলেন। সুনানে বাইহাকি-৭৭৫
আত্মোৎসর্গ সম্পর্কে ফুকাহায়ে কেরাম:
আল্লামা শামী রাহ. শরহুস সিয়ারের উদ্ধৃতিতে বলেন-
ذﻛﺮ ﻓﻲ ﺷﺮح اﻟﺴﻴﺮ أﻧﻪ ﻻ ﺑﺄس أن ﻳﺤﻤﻞ اﻟﺮﺟﻞ وﺣﺪﻩ وإن
ﻇﻦ أﻧﻪ ﻳﻘﺘﻞ إذا ﻛﺎن ﻳﺼﻨﻊ ﺷﻴﺌﺎ ﺑ ﻘﺘﻞ أو ﻳﻮم أﺣﺪ وﻣﺪﺣﻬﻢ ﻋﻠﻰ ذﻟﻚ، ﺑﺠﺮح أو ﺑﻬﺰم، ﻓﻘﺪ ﻓﻌﻞ ذﻟﻚ ﺟﻤﺎﻋﺔ ﻣﻦ اﻟﺼﺤﺎﺑﺔ ﺑﻴﻦ ﻳﺪي رﺳﻮل اﻟﻠﻪ ﻓﺄﻣﺎ إذا ﻋﻠﻢ أﻧﻪ ﻻ ﻳﻨﻜﻲ ﻓﻴﻬﻢ ﻓﺈﻧﻪ ﻻ ﻳﺤﻞ ﻟﻪ أن ﻳﺤﻤﻞ ﻋﻠﻴﻬﻢ، ﻻﻧﻪ ﻻ ﻳﺤﺼﻞ ﺑﺤﻤﻠﺘﻪ ﺷ ﻲء ﻣﻦ إﻋﺰاز اﻟﺪﻳﻦ .
“নিহত হওয়ার প্রবল ধারণা থাকা সত্ত্বেও একা এক ব্যক্তি শত্রুর উপর হামলা করতে পারবে, যদি সে দুশমনকে হত্যা, আহত অথবা পরাস্ত করার মাধ্যমে কোন ক্ষতি করতে পারে। কেননা অনেক সাহাবী রাযি. উহুদের দিন রাসূল এর সামনে এ ধরনের হামলা করেছেন এবং হুজুর তাদের প্রশংসা করেছেন। আর যদি এ ধারণা হয় যে, সে তাদের কোন ক্ষতি সাধন করতে পারবে না, তবে তার জন্য তাদের উপর হামলা করা জায়েয হবে না। কেননা তার এই হামলার দ্বারা দ্বীনের কোন ফায়দা হবে না।”(ফাতাওয়ায়ে শামী: ৬/২০৬,)মাকতাবায়ে যাকারিয়া, দেওবন্দ)
আত্মোৎসর্গের শর্তসমূহ:
কুরআন, হাদীস ও ফুকাহায়ে কেরামের উপরোল্লিখিত বর্ণনা থেকে বুঝা যায় যে, আত্মোৎসর্গ হামলা জায়েয, তবে কিছু শর্তের সাথে।
১. নিয়ত সহীহ হওয়া। তথা ই‘লায়ে কালিমাতুল্লাহ, দ্বীনের সম্মান ও মর্যাদা বৃদ্ধির লক্ষ্য হতে হবে।
২. আক্রমণকারীর প্রবল ধারণা থাকা যে, তার এই হামলার দ্বারা শত্রুর ক্ষতি সাধিত হবে।
৩. যে কোনভাবে তার হামলা দ্বারা মুসলামানদের উপকার হতে হবে।
৪.কিন্তু যেসব রাষ্ট্রে যুদ্ধ চলছে না। বরং বিধর্মী এবং মুসলিমরা একত্র বসবাস করছে শান্তি ও নিরাপত্তার সাথে যেমন বাংলাদেশ এর মত যেসব রাষ্ট্রে কাফেরদের সাথে যুদ্ধ চলছে না, এসব এলাকা ও রাষ্ট্রে আত্মঘাতি হামলা কিছুতেই বৈধ নয়।
সারকথা কথা হলো, আত্মহত্যা ও আত্মঘাতী হামলা বাহ্যিকভাবে এক মনে হলেও হাকিকতান এক নয়। উপরোক্ত শর্তাবলীর ভিত্তিতে আত্মঘাতী জায়েজ আছে। কিছুইতেই ফেতনা করা যাবে না। যেমন ইরশাদ হচ্ছে-
وَالۡفِتۡنَۃُ اَکۡبَرُ مِنَ الۡقَتۡلِ ؕ
আর ধর্মের ব্যাপারে ফেতনা সৃষ্টি করা নরহত্যা অপেক্ষাও মহা পাপ। সূরা বাকারা-২১৭
বিস্তারিত দেখুন, দারুল উলূম হাজহাজারি প্রকাশিত-আত্মঘাতী হামলা কি বৈধ?
والله اعلم بالصواب