আল-বুরহান ( দলিল-প্রমাণ)

আসসালামু আলাইকুম ওয়া রহমাতুল্লাহ! আমাদের ওয়েবসাইটে আপনাকে স্বাগতম। একটু নিচে দেখুন> বিষয় ভিক্তিক সাজানো রয়েছে, আপনার পছন্দ অনুযায়ী পাঠ করুন এবং পোষ্টগুলো ভালো লাগলে শেয়ার করুন আর আপনার কোন প্রশ্ন থাকলে এই নাম্বারে- ০১৬৮৭-১১৩৮৮০ হোয়াটস অ্যাপে পাঠিয়ে দিন । জাযাকাল্লাহু খাইর।

জিজ্ঞাসা-১৩১৪৩: ইফরাত ও তাফরীত কাকে বলে। শরীয়তে এর হুকুম কি

No Comments

 



জিজ্ঞাসা-১৩১৪৩: 

আসসালামু আলাইকুম। 

ইফরাত এবং তাফরীত সম্পর্কে জানতে চাই। একটু বিশদ আলোচনা শুনতে চাই। ধন্যবাদ এবং শুভকামনা রইলো প্রিয় শায়েখ।

তারিখ:০৭/১২/২৪ ঈসায়ি/ইংরেজি                       

 মাওলানা  নূরে আলম সিদ্দিকী নাটোর থেকে।


 জবাব: ওয়ালাইকুমুস সালাম ওয়া রহমাতুল্লাহ। নাহমাদুহু ওয়া নুসল্লি আলা রসূলিল কারিম। আম্মাবাদ -

তাসলিম ও হামদ-সানার পর  প্রথম কথা হলো, ইফরাত ও তাফরীতের পরিচয় নিচে তুলে ধরা হলো:


معنى الإفراطِ لُغةً:

الإفراطُ: مَصدَرُ أفرط يقالُ: أفرَطَ: إذا تجاوَزَ الحَدَّ في الأمرِ.

ويقولون: إيَّاك والفَرْطَ في الأمرِ، أي: لا تُجاوِزْ القَدْرَ.

وفَرَط عليه في القَولِ يَفرُطُ: أسرَف وتقَدَّم .

معنى الإفراطِ اصطِلاحًا:

قال الجُرْجانيُّ: (الإفراطُ يُستعمَلُ في تجاوُزِ الحَدِّ من جانبِ الزِّيادةِ والكَمالِ) .

وقال المُناويُّ: (الإفراطُ: الإسرافُ في التَّقدُّمِ) .

وقال الكَفَويُّ: (الإفراطُ: التَّجاوُزُ عن الحَدِّ) .

يُنظَر: ((الصحاح)) للجوهري (3/1148)، ((مجمل اللغة)) لابن فارس (ص: 716)، ((مختار الصحاح)) لزين الدين الرازي (ص: 237)، ((لسان العرب)) لابن منظور (7/368)، ((تاج العروس)) للزبيدي (19/528).

আভিধানিক অর্থ :

বুৎপত্তিগতভাবে ইফরাত শব্দটির অর্থ হলো, কোন বিষয়ে সীমালঙ্ঘন করা।

আরবী বাকরীতিতে একথাটি ব্যাপকভাবে প্রচলিত- إيَّاك والفَرْطَ في الأمرِ

অর্থাৎ বিষয়টি নিয়ে বাড়াবাড়ি করতে যেয়োনা।

উপযাচক হয়ে অতিউৎসাহী মনোভাব নিয়ে আগবাড়িয়ে কোন কাজ করাকেও ইফরাত বলে। সূত্র: মুজমালুল লুগাত; ইবনে ফারেস-৭১৬


পারিভাষিক অর্থ:

আল্লাম জুরজানী ( রাহি.) বলেন, কোন বিষয় পূর্ণাঙ্গতার স্তরে উপনীত হবার পরও বাড়াবাড়ির ছলে অতিরিক্ত মাত্রায় যে কার্যটি সম্পাদন করা হয়ে থাকে, সেটাই হলো ইফরাত।

আল্লাম মুনাওয়ী (রাহি.) বলেন: অতিমাত্রায় আগবাড়িয়ে কিছু করতে যাওয়ার প্রবণতাকেই ইফরাত বলে। সূত্র: আলকুল্লিয়াত-১৫৫

আল্লাম কাফাউয়ী ( রাহি.) বলেন, সীমালঙ্ঘনের অপর নাম হলো, ইফরাত। সূত্র: আততাওকিফ-১০৩


ইফরাতের প্রকারভেদ:

يمكِنُ تقسيمُ الإفراطِ الذي يقَعُ من الإنسانِ سواءٌ كان في أمورِ الدِّينِ أو الدُّنيا إلى ثلاثةِ أقسامٍ:

الأوَّلُ: إفراطٌ مُتعَلِّقٌ بالأفكارِ والمعتَقَداتِ.

الثَّاني: إفراطٌ مُتعَلِّقٌ بالأقوالِ وسائِرِ ما يَصدُرُ عنه منطوقًا أو مكتوبًا.

الثَّالِثُ: إفراطٌ مُتعَلِّقٌ بالأفعالِ.

অর্থাৎ ধর্মীয় কিংবা জাগতিক বিষয়ে মানুষদের থেকে যে জাতীয় অতিরঞ্জন বা বাড়াবাড়ি প্রকাশ পায়, তা তিনভাগে ভাগ করা যেতে পারে। যথা-

প্রথমত. আক্বীদা বা হৃদয়ে লালিত ধর্মীয় বিশ্বাসকেন্দ্রিক চিন্তাধারা নিয়ে অতিমাত্রায় বাড়াবাড়ি করা।

দ্বিতীয়ত. স্বীয় মুখনিঃসৃত কিংবা লিখিত কথামালা নিয়ে অতিরঞ্জন। 

তৃতীয়ত. স্বীয় কার্যধারা সংক্রান্ত অতিরঞ্জন। সূত্র: মাউসুআতুল আখলাকি ওয়াস সুলূকি-৩২২৪


ইফরাত সম্পর্কে আল-কুরআন:

Surah An-Nisa, Verse 171:

يَا أَهْلَ الْكِتَابِ لَا تَغْلُوا فِي دِينِكُمْ وَلَا تَقُولُوا عَلَى اللَّهِ إِلَّا الْحَقَّ إِنَّمَا الْمَسِيحُ عِيسَى ابْنُ مَرْيَمَ رَسُولُ اللَّهِ وَكَلِمَتُهُ أَلْقَاهَا إِلَىٰ مَرْيَمَ وَرُوحٌ مِّنْهُ فَآمِنُوا بِاللَّهِ وَرُسُلِهِ وَلَا تَقُولُوا ثَلَاثَةٌ انتَهُوا خَيْرًا لَّكُمْ إِنَّمَا اللَّهُ إِلَٰهٌ وَاحِدٌ سُبْحَانَهُ أَن يَكُونَ لَهُ وَلَدٌ لَّهُ مَا فِي السَّمَاوَاتِ وَمَا فِي الْأَرْضِ وَكَفَىٰ بِاللَّهِ وَكِيلًا

হে আহলে-কিতাবগণ! তোমরা দ্বীনের ব্যাপারে বাড়াবাড়ি করো না এবং আল্লাহর শানে নিতান্ত সঙ্গত বিষয় ছাড়া কোন কথা বলো না।  সূরা নিসা-১৭১


فَاسْتَقِمْ كَمَا أُمِرْتَ وَمَن تَابَ مَعَكَ وَلَا تَطْغَوْا إِنَّهُ بِمَا تَعْمَلُونَ بَصِيرٌ

অতএব, তুমি এবং তোমার সাথে যারা তওবা করেছে সবাই সোজা পথে চলে যাও-যেমন তোমায় হুকুম দেয়া হয়েছে এবং সীমা লঙ্ঘন করবে না, তোমরা যা কিছু করছ, নিশ্চয় তিনি তার প্রতি দৃষ্টি রাখেন। সূরা হুদ-১১২

তাফসির:

قال البَغَويُّ: (وَلَا تَطْغَوْا لا تجاوِزوا أمري ولا تَعصوني، وقيل: معناه: ولا تَغْلوا فتَزيدوا على ما أَمَرتُ ونهَيتُ) ((معالم التنزيل)) (4/ 203)

আল-বাঘাবী রহ.  বলেছেন: আর সীমালঙ্ঘন করো না, আমার আদেশ লঙ্ঘন করো না এবং আমার অবাধ্য হয়ো না। এবং বলা হয়েছিল: এর অর্থ হল: এবং আমি যা আদেশ করেছি এবং নিষেধ করেছি তার সীমা অতিক্রম করো না। সূত্র: মাআলিমুত তানজিল-৪/২০৩


ইফরাত সম্পর্কে হাদিস শরিফ:

হাদিস নং-০১

حَدَّثَنَا أَبُو بَكْرِ بْنُ أَبِي شَيْبَةَ، حَدَّثَنَا حَفْصُ بْنُ غِيَاثٍ، وَيَحْيَى بْنُ سَعِيدٍ، عَنِ ابْنِ، جُرَيْجٍ عَنْ سُلَيْمَانَ بْنِ عَتِيقٍ، عَنْ طَلْقِ بْنِ حَبِيبٍ، عَنِ الأَحْنَفِ بْنِ قَيْسٍ، عَنْ عَبْدِ اللَّهِ، قَالَ قَالَ رَسُولُ اللَّهِ صلى الله عليه وسلم " هَلَكَ الْمُتَنَطِّعُونَ " . قَالَهَا ثَلاَثًا .

৬৫৪০। আবু বকর ইবনে আবি শাঈবা (রাহঃ) ......... আব্দুল্লাহ ইবনে মাসউদ (রাযিঃ) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ (ﷺ) বলেছেনঃ কথা ও কাজে অতিশয়তা (অবলম্বনকারীরা) ধ্বংস হয়ে গেছে। তিনি কথাটি তিনবার বলেছেন।

Abdullah reported Allah’s Messenger (ﷺ) as saying:

Ruined, were those who indulged in hair-splitting. He (the Holy Prophet) repeated this thrice.

—সহীহ মুসলিম, হাদীস নং ৬৫৪০ (আন্তর্জাতিক নং ২৬৭০)


হাদিস নং-০২

حَدَّثَنَا عَلِيُّ بْنُ مُحَمَّدٍ، حَدَّثَنَا أَبُو أُسَامَةَ، عَنْ عَوْفٍ، عَنْ زِيَادِ بْنِ الْحُصَيْنِ، عَنْ أَبِي الْعَالِيَةِ، عَنِ ابْنِ عَبَّاسٍ، قَالَ قَالَ رَسُولُ اللَّهِ ـ صلى الله عليه وسلم ـ غَدَاةَ الْعَقَبَةِ وَهُوَ عَلَى نَاقَتِهِ ‏"‏ الْقُطْ لِي حَصًى ‏"‏ ‏.‏ فَلَقَطْتُ لَهُ سَبْعَ حَصَيَاتٍ هُنَّ حَصَى الْخَذْفِ فَجَعَلَ يَنْفُضُهُنَّ فِي كَفِّهِ وَيَقُولُ ‏"‏ أَمْثَالَ هَؤُلاَءِ فَارْمُوا ‏"‏ ‏.‏ ثُمَّ قَالَ ‏"‏ يَا أَيُّهَا النَّاسُ إِيَّاكُمْ وَالْغُلُوَّ فِي الدِّينِ فَإِنَّمَا أَهْلَكَ مَنْ كَانَ قَبْلَكُمُ الْغُلُوُّ فِي الدِّينِ ‏"‏ ‏.‏

৩০২৯। আলী ইবন মুহাম্মাদ (রাহঃ)......ইব্‌ন আব্বাস (রাযিঃ) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ্ (ﷺ) জামরাতুল আকাবার ভোরে উষ্ট্রীর পিঠে আরোহণ করা অবস্থায় বলেনঃ আমার জন্য কংকর সংগ্রহ করে লও। আমি তাঁর জন্য সাতটি কংকর সংগ্রহ করলাম। তা ছিল সাইজে ছোট। তিনি তা নিজের হাতের তালুতে নাড়াচাড়া করতে করতে বললেনঃ তোমরা এই সাইজের কংকর নিক্ষেপ করবে। এরপর তিনি বললেনঃ হে লোক সকল! দ্বীনের বিষয়ে বাড়াবাড়ি করা থেকে তোমরা সাবধান থাকবে। কেননা, তোমাদের পূর্বেকার লোকদের দ্বীনের ব্যাপারের বাড়াবাড়ি, ধ্বংস করে দিয়েছে।


It was narrated that Ibn ’Abbas said:

“On the morning of ’Aqabah, when he was atop his she-camel, the Messenger of Allah (ﷺ) said: ’Pick up some pebbles for me.’ So I picked up seven pebbles for him, suitable for Khadhf.* He began to toss them in his hand, saying: ’Throw something like these.’ Then he said: ’O people, beware of exaggeration in religious matters for those who came before you were doomed because of exaggeration in religious matters.’”

—সুনানে ইবনে মাজা', হাদীস নং ৩০২৯ (আন্তর্জাতিক নং ৩০২৯)


হাদিস নং-০৩ 

1151 - حَدَّثَنَا عَبْدُ اللَّهِ بْنُ مَسْلَمَةَ، عَنْ مَالِكٍ، عَنْ هِشَامِ بْنِ عُرْوَةَ، عَنْ أَبِيهِ، عَنْ عَائِشَةَ رَضِيَ اللَّهُ عَنْهَا، قَالَتْ: كَانَتْ عِنْدِي امْرَأَةٌ مِنْ بَنِي أَسَدٍ، فَدَخَلَ عَلَيَّ رَسُولُ اللَّهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ، فَقَالَ: «مَنْ هَذِهِ؟» قُلْتُ: فُلاَنَةُ لاَ تَنَامُ بِاللَّيْلِ، فَذُكِرَ مِنْ صَلاَتِهَا، فَقَالَ: «مَهْ عَلَيْكُمْ مَا تُطِيقُونَ مِنَ الأَعْمَالِ، فَإِنَّ اللَّهَ لاَ يَمَلُّ حَتَّى تَمَلُّوا»

১০৮৪। আব্দুল্লাহ ইবনে মাসলামা (রাহঃ) ......... উম্মুল মু'মিনীন আয়িশা (রাযিঃ) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, বনু আসাদের এক মহিলা আমার কাছে উপস্থিত ছিলেন, তখন রাসূলুল্লাহ (ﷺ) আমার কাছে আগমন করলেন এবং জিজ্ঞাসা করলেন, এ মহিলাটি কে? আমি বললাম, অমুক। তিনি রাতে ঘুমান না। তখন তাঁর নামাযের কথা উল্লেখ করা হলে তিনি (নবী ﷺ) বললেনঃ রেখে দাও। সাধ্যানুযায়ী আমল করতে থাকাই তোমাদের কর্তব্য। কেননা, আল্লাহ্ তাআলা (সাওয়াব প্রদানে) বিরক্ত হন না, যতক্ষণ না তোমরা বিরক্ত ও ক্লান্ত হয়ে পড়।


Narrated ’Aisha:


A woman from the tribe of Bani Asad was sitting with me and Allah’s Apostle (p.b.u.h) came to my house and said, "Who is this?" I said, "(She is) So and so. She does not sleep at night because she is engaged in prayer." The Prophet (ﷺ) said disapprovingly: Do (good) deeds which is within your capacity as Allah never gets tired of giving rewards till you get tired of doing good deeds."


হাদীসের ব্যাখ্যা:

এ হাদীছে যে ইবাদতগুযার মহিলার কথা বলা হয়েছে তার নাম হাওলা বিনত তুয়াইত। তিনি কুরায়শ বংশের বনূ আসাদের লোক ছিলেন। খুব বেশি ইবাদত-বন্দেগী করতেন। রাতে একটুও ঘুমাতেন না, যে কারণে মানুষের মুখে মুখে তার ইবাদতের চর্চা ছিল। লোকে বলত, মদীনার নারীদের মধ্যে সবচে' 'ইবাদত-বন্দেগী তিনিই করে থাকেন।

হযরত ‘আয়েশা সিদ্দীকা রাযি. যখন নবী কারীম সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়া সাল্লামের প্রশ্নের উত্তরে ওই মহিলার পরিচয় দিলেন এবং তার ইবাদত-বন্দেগীর প্রশংসা করলেন, তখন নবী কারীম সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়া সাল্লাম বিরক্তি প্রকাশ করে তাঁকে থেমে যেতে বললেন।

তাঁর বিরক্তির কারণ- শরীরের বিশ্রাম ত্যাগ করে এত বেশি ইবাদত-বন্দেগী করা পসন্দনীয় নয়। কেননা তাতে একপর্যায়ে ক্লান্তি আসে এবং শরীর ভেঙে পড়ে। তখন আর ‘ইবাদত-বন্দেগী চালিয়ে নেওয়া সম্ভব হয় না। ফলে এতদিন আল্লাহর উদ্দেশ্যে নিজের পক্ষ থেকে যে আবদিয়াত ও দাসত্ব নিবেদন করা হচ্ছিল এবং তাঁর প্রতি রুজ ও বন্দেগী-আনুগত্যের সিলসিলা জারি ছিল তা বন্ধ হয়ে যায়। এটা একরকম বিমুখতা। এটা যেন আল্লাহর দরবারে কিছুদিন হাজির হওয়ার পর গরহাজির হয়ে যাওয়া, যা অত্যন্ত নিন্দনীয়। তাই তিরস্কার করে বলেছেন, থাম! অর্থাৎ সে যা করছে তা প্রশংসার বিষয় নয় যে, এত আগ্রহের সাথে বলছ।

অথবা এ তিরস্কার করেছেন ওই মহিলাকে। তাকে বলছেন, থাম। “ইবাদত বন্দেগীতে এত বাড়াবাড়ি করো না; বরং মধ্যপন্থা রক্ষা কর। যতটুকু নিয়মিতভাবে করে যাওয়া সম্ভব অতটুকুই কর।

তারপর বলা হয়েছে- আল্লাহ ক্লান্ত হন না, যাবৎ না তোমরা ক্লান্ত হয়ে পড়। আল্লাহ তা'আলার ক্ষেত্রে ‘ক্লান্ত হয়ে যাওয়া' কথাটির ব্যবহার আক্ষরিক অর্থে হতে পারে না। কেননা আল্লাহ তা'আলার পক্ষে ক্লান্ত হওয়া অসম্ভব। এটা একটা মানবীয় দুর্বলতা। আল্লাহ তা'আলা সমস্ত দুর্বলতার ঊর্ধ্বে। বস্তুত এখানে ক্লান্ত হওয়ার দ্বারা রূপকার্থে ‘কাজের ছাওয়াব ও প্রতিদান দেওয়া বন্ধ করা' বোঝানো উদ্দেশ্য, যেমনটা ইমাম নববী রহ. ব্যাখ্যা করেছেন। এর সমর্থন পাওয়া যায় হযরত আয়েশা সিদ্দীকা রাযি. বর্ণিত একটি হাদীছ দ্বারা। তাতে নবী সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইরশাদ করেনঃ-

اكلفوا من العمل ما تطيقون، فإن الله لا يمل من الثواب حتى تملوا من العمل 

“তোমরা অতটুকু আমলেরই ভার গ্রহণ কর, যতটুকু তোমরা করতে পারবে। কেননা আল্লাহ তা'আলা ছাওয়াব দেওয়া বন্ধ করেন না, যাবত না তোমরা আমল বন্ধ করে দাও।” তাফসীর ইবন কাছীর, ৮ম খ., ২৫৪ পৃ.

ইমাম মা'যিরী (مأزري) রহ. বলেন, এখানে حتى অব্যয়টি و অর্থে ব্যবহৃত। সে হিসেবে অর্থ হবে- আল্লাহ ক্লান্ত হবেন না, অথচ তোমরা ক্লান্ত হয়ে পড়বে।

সবশেষে নবী কারীম সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়া সাল্লাম 'ইবাদত-বন্দেগীর ক্ষেত্রে একটি মূলনীতি হিসেবে বলেন যে, আল্লাহ তা'আলার কাছে সর্বাপেক্ষা প্রিয় আমল তাই, যা আমলকারী নিয়মিতভাবে করে। কেননা যে ব্যক্তি নিয়মিতভাবে আমল করে সে ওই ব্যক্তির মত, যে বাদশার দরবারে নিয়মিতভাবে আসা-যাওয়া করে। যে ব্যক্তি কখনও হাজির হয় আবার কখনও গরহাজির থাকে, সে বাদশার অতটা প্রিয় হতে পারে না, যতটা নিয়মিত হাজিরাদাতা হয়ে থাকে। অনুরূপ যে ব্যক্তি নিয়মিত ইবাদত বন্দেগী চালিয়ে যায়, সে যেন মাওলার দরবারের একজন নিয়মিত হাজিরাদাতা। স্বাভাবিকভাবেই সে আল্লাহর বেশি প্রিয়ভাজন হবে। তাছাড়া কোনও ইবাদত কিছুদিন করার পর ছেড়ে দেওয়াটা গরহাজির হয়ে পড়ার মত। এতে কেমন যেন বিমুখতা ও অনীহা ভাব প্রকাশ পায়, যা একরকম বেআদবীও বটে। অনুপস্থিতির সে বেআদবী যাতে না হয়ে যায় এবং ছাওয়াব পাওয়ার সিলসিলা যাতে বন্ধ না হয়, সেজন্য উচিত যতটুকু পরিমাণ আমল নিয়মিত করা যাবে অতটুকুই গ্রহণ করা, তা অল্পই হোক না কেন। এক হাদীছে ইরশাদ হয়েছেঃ-

أحب الأعمال إلى الله أدومها وإن قل 

“আল্লাহর কাছে সর্বাপেক্ষা প্রিয় আমল তা-ই, যা স্থায়ী হয়, যদিও সে আমল অল্প পরিমাণ হয়। " সহীহ বুখারী, হাদীছ নং ৫৮৬১; সহীহ মুসলিম, হাদীছ নং ৭৮২। সুনানে আবু দাউদ, হাদীছ নং ১৩৬৮; জামে তিরমিযী, হাদীছ নং ২৮৫৬; সুনানে নাসাঈ, হাদীছ নং ৭৬২; সুনানে ইবন মাজাহ, হাদীছ নং ৪২৪০. মুসনাদে আহমাদ, হাদীছ নং ২৬৩০৮

—সহীহ বুখারী, হাদীস নং ১০৮৪ (আন্তর্জাতিক নং ১১৫১)



তাফরিতের পরিচয়:

التَّفريطُ لُغةً:

التَّفريطُ: مَصدَرُ فَرَّط في الأمرِ تفريطًا، ومِثلُه فَرَط في الأمرِ يَفْرُطُ فَرْطًا، أي: قَصَّر فيه وضَيَّعه حتَّى فات.

و(فرط) أصلٌ يدُلُّ على إزالةِ شَيءٍ من مكانِه وتنحيتِه عنه، ومنه التَّفريطُ، وهو التَّقصيرُ؛ لأنَّه إذا قصَّر فيه فقد قَعَد به عن رُتبتِه التي هي له .

تهذيب اللغة)) للأزهري (13/ 227)، ((الصحاح)) للجوهري (3/ 1148)، ((مقاييس اللغة)) لابن فارس (4/ 490)، ((مختار الصحاح)) لزين الدين الرازي (ص: 237)، ((لسان العرب)) لابن منظور (7/ 368)، ((القاموس المحيط)) للفيروزآبادي (ص: 681).


التَّفريطُ اصطِلاحًا:

قال ابنُ عَرَفةَ: التَّفريطُ: أن يُترَكَ الشَّيءُ حتَّى يمضيَ وَقتُ إمكانِه، ثمَّ يخرُجَ إلى وقتٍ يمتَنِعُ فيه .

أو: هو النَّقصُ وعَدَمُ الوفاءِ بما أمر اللهُ تعالى به .الغريبين في القرآن والحديث)) لأبي عبيد الهروي (5/ 1435).

 

আভিধানিক অর্থ: 

ব্যূৎপত্তিগতভাবে আরবী "তাফরীত" শব্দটিরঅর্থ হলো, কোন কাজে অবহেলা করা এবং চরম পর্যায়ের শৈথিল্য প্রদর্শন করতে করতে সেই কাজ সম্পাদনের সময়টিকেই হাতছাড়া করে ফেলা। 

ক্রিয়ামূলটি আরবী فَرْط শব্দ থেকে উৎকলিত। শব্দটির অর্থ হল, কোন বিষয়কে স্বীয় অবস্থান থেকে স্থানচ্যুত করে ফেলা।

আর তাফরীত শব্দের মাঝেও এই অর্থটি বিদ্যমান রয়েছে। কারণ কোন বিষয়ে অবহেলা করার মানেই হলো, প্রকারান্তরে তাকে স্বীয় মর্যাদা থেকে বঞ্চিত করা। সূত্র: লিসানুল আরব-৭/৩৬৮; ইবনে মানজুর রহ.


 পারিভাষিক অর্থ :

আল্লামা ইবনু আরফা বলেন, কোন কাজ সম্পাদনে এমনভাবে শিথিলতা প্রদর্শন করা, যার কারণে একপর্যায়ে তা পালনের মেয়াদকালও নি:শেষ হয়ে যাওয়া।

আরেকভাবে বলা যেতে পারে, তাফরীত হলো- আল্লাহর নির্দেশিত বিধান পালনে ক্রুটি করা এবং যথাযথভাবে তা আদায় না করা। সূত্র: আলগরিবীনা ফিল কুরআনি ওয়াল হাদিস-৫/১৪৩৫


তাফরিতের প্রকারভেদ:

التَّفريطُ إمَّا أن يكونَ تفريطًا في أمرِ الدِّينِ، أو تفريطًا في أمرِ الدُّنيا؛ فالتَّفريطُ في أمورِ الدِّينِ كالتَّفريطِ في العباداتِ، والتَّفريطُ في الدُّنيا كالتَّفريطِ في أمورِ المعاشِ، أو مُذاكَرةِ الطَّالِبِ دروسَه، إلى غيرِ ذلك.

অর্থাৎ তাফরীত বা অবহেলা দুই ধরনের হতে পারে।

 প্রথমত, ধর্মীয় বিষয় শৈথিল্য প্রদর্শন। যেমন- আল্লাহর নির্দেশিত বিধান পালনে অবহেলা করা।

 দ্বিতীয়ত. জাগতিক বিষয়ে অর্পিত দায়িত্বে শৈথিল্য প্রদর্শন। যেমন- দৈনন্দিন জীবিকা নির্বাহে অবহেলা করা, কিংবা ছাত্র নিজের পড়ালেখার ব্যাপারে অমনোযোগী হয়ে ওঠা ইত্যাদি। সূত্র: মাউসুআতুল আখলাকি ওয়াস সুলূকি-৩৫৮৫


তাফরীদ সম্পর্কে আল-কুরআন:

إِنَّ اللَّهَ يَأْمُرُ بِالْعَدْلِ وَالْإِحْسَانِ وَإِيتَاءِ ذِي الْقُرْبَىٰ وَيَنْهَىٰ عَنِ الْفَحْشَاءِ وَالْمُنكَرِ وَالْبَغْيِ يَعِظُكُمْ لَعَلَّكُمْ تَذَكَّرُونَ

আল্লাহ ন্যায়পরায়ণতা, সদাচরণ এবং আত্নীয়-স্বজনকে দান করার আদেশ দেন এবং তিনি অশ্লীলতা, অসঙ্গত কাজ এবং অবাধ্যতা করতে বারণ করেন। তিনি তোমাদের উপদেশ দেন যাতে তোমরা স্মরণ রাখ। সূরা নাহল-৯০


তাফসির: 

بِالْعَدْلِ (أي: بمُراعاةِ التَّوسُّطِ بَينَ طرَفَيِ الإفراطِ والتَّفريطِ، وهو رأسُ الفَضائلِ) .

 আদল বা ন্যায়পরায়ণতা দ্বারা উদ্দেশ্য হলো ইফরাত বা বাড়াবাড়ি এবং  অবহেলার চরম মাঝামাঝি বিবেচনা করা, যা গুণের প্রধান। সূত্র: তাফসিরুল আলুসি-৭/৪৫৪


قال تعالى: وَكُلُوا وَاشْرَبُوا وَلَا تُسْرِفُوا إِنَّهُ لَا يُحِبُّ الْمُسْرِفِينَ [الأعراف: 31] .

 খাও ও পান কর এবং অপব্যয় করো না। তিনি অপব্যয়ীদেরকে পছন্দ করেন না। সূরা আরাফ-৩১


তাফসির: 

قال ابنُ كثيرٍ: (فشَرْعُ اللهِ عَدلٌ بَينَ الغالي فيه والجافي عنه، لا إفر

অর্থাৎ আল্লামা ইবনে কাসীর ( রাহি.) বলেন, "আল্লাহ তায়ালা কর্তৃক প্রণীত শারীয়াহ তথা জীবন বিধান হলো কট্টরপন্থা ও নির্লিপ্ততার মধ্যস্থিত ভারসাম্যপূর্ণ এক অনন্য মানদণ্ড। যাতে নেই কোন বাড়াবাড়ি কিংবা ছাড়াছাড়ির লেশমাত্রও। বরং আছে মধ্যমপন্থার প্রকৃষ্ট উদাহরণ।" সূত্র: তাফসিরে ইবনে কাসির-৩/১৭২


তাফরিত সম্পর্কে হাদিস শরিফ:

6463 - حَدَّثَنَا آدَمُ، حَدَّثَنَا ابْنُ أَبِي ذِئْبٍ، عَنْ سَعِيدٍ المَقْبُرِيِّ، عَنْ أَبِي هُرَيْرَةَ رَضِيَ اللَّهُ عَنْهُ، قَالَ: قَالَ رَسُولُ اللَّهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ: «لَنْ يُنَجِّيَ أَحَدًا مِنْكُمْ عَمَلُهُ» قَالُوا: وَلاَ أَنْتَ يَا رَسُولَ اللَّهِ؟ قَالَ: «وَلاَ أَنَا، إِلَّا أَنْ يَتَغَمَّدَنِي اللَّهُ بِرَحْمَةٍ، سَدِّدُوا وَقَارِبُوا، وَاغْدُوا وَرُوحُوا، وَشَيْءٌ مِنَ الدُّلْجَةِ، وَالقَصْدَ القَصْدَ تَبْلُغُوا»

৬০১৯। আদম (রাহঃ) ......... আবু হুরায়রা (রাযিঃ) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ (ﷺ) বলেছেনঃ কস্মিনকালেও তোমাদের কাউকে নিজের আমল নাজাত দেবে না। তাঁরা বললেন, ইয়া রাসূলাল্লাহ! আপনাকেও না? তিনি বললেন, আমাকেও না। তবে আল্লাহ তাআলা আমাকে রহমত দিয়ে ঢেকে রেখেছেন। তোমরা যথারীতি আমল কর, ঘনিষ্ঠ হও। তোমরা সকালে, বিকালে এবং রাতের শেষাংশে আল্লাহর কাজ কর। মধ্যমপন্থা অবলম্বন কর। আকড়ে ধর মধ্যমপন্থাকে, অবশ্যই সফলকাম হবে।

—সহীহ বুখারী, হাদীস নং ৬০১৯ (আন্তর্জাতিক নং ৬৪৬৩)


ব্যাখ্যা:

قال النَّوَويُّ: (السَّدادُ: الصَّوابُ، وهو بَينَ الإفراطِ والتَّفريطِ؛ فلا تَغْلوا ولا تُقَصِّروا)

অর্থাৎ আল্লামা নববী (রাহি.) বলেন, বাড়াবাড়ি কিংবা ছাড়াছাড়ি উভয়টিই ত্যাগ করে মধ্যমপন্থা বজায় রাখাটাই হলো প্রকৃত সঠিকতার পরিচায়ক। সুতরাং অতিরঞ্জনও করবে না আবার শিথিলতাও দেখাবে না। সূত্র: শারহুন নাবুবি আলাল মুসলিম-১৭/১৬২


قال المُظهِريُّ: (القَصدُ: الوَسَطُ، أي: لا تفريطَ ولا إفراطَ في العَمَلِ، يعني: التَّفريطُ والإفراطُ مذمومانِ، وخيرُ الأمورِ أوساطُها)

অর্থাৎ, আল্লাম মুযহারী (রাহি.) বলেন, পরিমিতবোধই হলো মধ্যমপন্থা বজায় রাখা। যেখানে না থাকবে বাড়াবাড়ি, আর না থাকবে ছাড়াছাড়ি। কারণ উভয়টিই হলো নিন্দনীয়। বরং মধ্যমপন্থা অবলম্বন করাটাই হলো সর্বোৎকৃষ্ট পন্থা।

সূত্র: আলমাফাতিহু ফি শারহিল মাসাবিহ-৩/২০০


حَدَّثَنِي مَالِك عَنْ يَحْيَى بْنِ سَعِيدٍ عَنْ سَعِيدِ بْنِ الْمُسَيَّبِ أَنَّهُ سَمِعَهُ يَقُولُ لَمَّا صَدَرَ عُمَرُ بْنُ الْخَطَّابِ مِنْ مِنًى أَنَاخَ بِالْأَبْطَحِ ثُمَّ كَوَّمَ كَوْمَةً بَطْحَاءَ ثُمَّ طَرَحَ عَلَيْهَا رِدَاءَهُ وَاسْتَلْقَى ثُمَّ مَدَّ يَدَيْهِ إِلَى السَّمَاءِ فَقَالَ اللَّهُمَّ كَبِرَتْ سِنِّي وَضَعُفَتْ قُوَّتِي وَانْتَشَرَتْ رَعِيَّتِي فَاقْبِضْنِي إِلَيْكَ غَيْرَ مُضَيِّعٍ وَلَا مُفَرِّطٍ ثُمَّ قَدِمَ الْمَدِينَةَ فَخَطَبَ النَّاسَ فَقَالَ أَيُّهَا النَّاسُ قَدْ سُنَّتْ لَكُمْ السُّنَنُ وَفُرِضَتْ لَكُمْ الْفَرَائِضُ وَتُرِكْتُمْ عَلَى الْوَاضِحَةِ إِلَّا أَنْ تَضِلُّوا بِالنَّاسِ يَمِينًا وَشِمَالًا وَضَرَبَ بِإِحْدَى يَدَيْهِ عَلَى الْأُخْرَى ثُمَّ قَالَ إِيَّاكُمْ أَنْ تَهْلِكُوا عَنْ آيَةِ الرَّجْمِ أَنْ يَقُولَ قَائِلٌ لَا نَجِدُ حَدَّيْنِ فِي كِتَابِ اللَّهِ فَقَدْ رَجَمَ رَسُولُ اللَّهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ وَرَجَمْنَا وَالَّذِي نَفْسِي بِيَدِهِ لَوْلَا أَنْ يَقُولَ النَّاسُ زَادَ عُمَرُ بْنُ الْخَطَّابِ فِي كِتَابِ اللَّهِ تَعَالَى لَكَتَبْتُهَا الشَّيْخُ وَالشَّيْخَةُ فَارْجُمُوهُمَا أَلْبَتَّةَ فَإِنَّا قَدْ قَرَأْنَاهَا قَالَ مَالِك قَالَ يَحْيَى بْنُ سَعِيدٍ قَالَ سَعِيدُ بْنُ الْمُسَيَّبِ فَمَا انْسَلَخَ ذُو الْحِجَّةِ حَتَّى قُتِلَ عُمَرُ رَحِمَهُ اللَّهُ قَالَ يَحْيَى سَمِعْت مَالِك يَقُولُ قَوْلُهُ الشَّيْخُ وَالشَّيْخَةُ يَعْنِي الثَّيِّبَ وَالثَّيِّبَةَ فَارْجُمُوهُمَا أَلْبَتَّةَ

রেওয়ায়ত ১০. সাঈদ ইবনে মুসায়্যিব (রাহঃ) বর্ণনা করেন, উমর (রাযিঃ) যখন মিনা হইতে প্রত্যাবর্তন (২৩ হিজরী) করিলেন তখন তিনি (মক্কার অনতিদূরে) আবতাহ নাম স্থানে তাহার উট বসাইলেন। আর এদিকে কতকগুলি পাথর একত্র করিলেন। উহার উপর একখানা চাদর রাখিয়া চিৎ হইয়া শুইয়া পড়িলেন। অতঃপর আকাশের দিকে স্বীয় হস্তদ্বয় উত্তোলন করিয়া বলিতে লাগিলেনঃ হে আল্লাহ! আমার অনেক বয়স হইয়াছে। শক্তি রহিত হইয়া গিয়াছে, প্রজাবৃন্দ অনেক হইয়া গিয়াছে। এ সময় আপনি আমাকে আপনার সন্নিধানে ডাকিয়া লউন, যাহাতে আমা দ্বারা আপনার কোন আদেশ অমান্য না হইয়া যায় এবং আপনার ইবাদতে অনিচ্ছা প্রকাশ হইয়া পড়ে। অতঃপর তিনি মদীনা চলিয়া গেলেন, মদীনার লোকদের সম্মুখে খুতবা দিতে যাইয়া বলিলেনঃ হে উপস্থিত ভ্রাতৃবৃন্দ তোমাদের সম্মুখে সমস্ত পথই প্রকাশ হইয়া পড়িয়াছে; যত রকম ফরয কাজ ছিল সমস্তই নির্ধারিত হইয়া গিয়াছে। তোমরা পরিষ্কার সোজা পথে চালিত হইয়াছ। এখন তোমরা পথ ভুলিয়া যেন এদিক-ওদিক বিপথগামী না হইয়া যাও। তিনি তাহার এক হাত অন্য হাতের উপর রাখিয়া বলিলেনঃ দেখ, তোমরা প্রস্তরাঘাতের আয়াতটি ভুলিয়া যাইও না। কেহ যেন না বলে, আমরা আল্লাহর কিতাবে প্রস্তরাঘাতের আয়াত দেখিতেছি না। দেখ আল্লাহর রাসূল প্রস্তরাঘাত করিয়াছেন। ঐ আল্লাহর কসম, যাহার হাতে আমার প্রাণ রহিয়াছে, যদি মানুষ এ কথা না বলিত যে, উমর আল্লাহর কিতাবে অতিরিক্ত করিয়াছে তাহা হইলে আমি (الشَّيْخُ وَالشَّيْخَةُ فَارْجُمُوهُمَا الْبَتَّةَ) (অর্থাৎ যখন বিবাহিত পুরুষ অথবা নারী ব্যভিচার করে তবে তাহদেরকে প্রস্তরাঘাত কর) আয়াতটি কুরআনে লিখাইয়া দিতাম।


আমরা এই আয়াত পাঠ করিয়াছি। অতঃপর উহার তিলাওয়াত রহিত হইয়া গিয়াছে (কিন্তু ইহার হুকুম কিয়ামত পর্যন্ত থাকিবে)। সাঈদ বলেন, অতঃপর যিলহজ্জ মাস শেষ না হইতেই উমর (রাযিঃ) নিহত হইলেন।

—মুওয়াত্তা মালিক, হাদীস নং ১৫৫৫



দ্বিতীয় কথা হলো, ইসলামে ইফরাত ও তাফরীত দুটি হারাম। সর্বক্ষেত্রে মধ্যম পন্থা অবলম্বন করতে হবে। আর আর ইসলামী শরীয়তী হলো মাধ্যাম পন্থা। যেমন, আল্লাহ তাআলা বলেন,

وَكَذَٰلِكَ جَعَلْنَاكُمْ أُمَّةً وَسَطًا 

এমনিভাবে আমি তোমাদেরকে মধ্যপন্থী সম্প্রদায় করেছি। সূরা বাকারা-১৪৩


وَالَّذِينَ إِذَا أَنفَقُوا لَمْ يُسْرِفُوا وَلَمْ يَقْتُرُوا وَكَانَ بَيْنَ ذَٰلِكَ قَوَامًا

এবং তারা যখন ব্যয় করে, তখন অযথা ব্যয় করে না কৃপণতাও করে না এবং তাদের পন্থা হয় এতদুভয়ের মধ্যবর্তী। সূরা ফুরকান-৬৭


 নবী সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইরশাদ করেনঃ- فإذا نهيتكم عن شيء فاجتنبوه، وإذا أمرتكم بأمر فأتوا منه ما استطعتم ‘সুতরাং আমি যখন তোমাদেরকে কোনও বিষয়ে নিষেধ করি, তখন তোমরা তা থেকে বিরত থাকবে। আর যখন তোমাদেরকে কোনও বিষয়ে আদেশ করি, তখন যথাসাধ্য তা পালন করবে।' সহীহ মুসলিম, হাদীস নং ৩১২৭ (আন্তর্জাতিক নং ১৩৩৭

এর দ্বারা শরী'আতের যাবতীয় আদেশ-নিষেধ মেনে চলার প্রতি তাগিদ করা হয়েছে।

আদেশ পালনের ক্ষেত্রে ‘যথাসাধ্য' কথাটি যোগ করা হয়েছে। নিষেধাজ্ঞা পালনের ক্ষেত্রে এ কথা যোগ করা হয়নি। অথচ শরী'আত তার যাবতীয় বিধানেই মানুষের সক্ষমতার বিষয়টি বিবেচনায় রেখেছে। কুরআন মাজীদ সুস্পষ্টই বলেছেঃ- وما جعل عليكم في الدين من حرج অর্থ : তিনি দীনের ব্যাপারে তোমাদের প্রতি কোনও সংকীর্ণতা আরোপ করেননি। 

অর্থাৎ শরী'আতের বিধান পালনের ব্যাপারে কোনওরকম ওযর গ্রহণযোগ্য নয় ব্যাপারটা এরকম নয়। বরং ওযর অনুপাতে ছাড়ও দেওয়া হয়েছে। যেমন মরা জন্তু খাওয়া নিষেধ। কিন্তু কারও যদি কোনও হালাল খাদ্য না থাকে আর এ অবস্থায় ক্ষুধায় মারা যাওয়ার উপক্রম হয়, সে ক্ষেত্রে তার জন্য মরা জন্তু খেয়ে প্রাণ রক্ষা করা জায়েয। দেখা যাচ্ছে নিষেধাজ্ঞার ক্ষেত্রেও সাধ্য ও সক্ষমতার বিষয়টা বিবেচনায় রাখা হয়েছে।

সক্ষমতা অনুযায়ী আদেশ পালন

সুতরাং প্রশ্ন ওঠে, এ হাদীছে কেবল আদেশের ক্ষেত্রে 'যথাসাধ্য শব্দ কেন ব্যবহৃত হল? এর উত্তর হচ্ছে, তুলনামূলকভাবে নিষেধাজ্ঞার চেয়ে আদেশ পালন করা কঠিন। কেননা নিষেধাজ্ঞার অর্থ হচ্ছে কোনও কাজ করা হতে বিরত থাকা। অপরদিকে আদেশ পালন করতে গেলে কাজটি করতে হয়। বলাবাহুল্য, বিরত থাকা অপেক্ষা কাজ সম্পাদন করা কঠিন। তাই তুলনামূলকভাবে নিষেধাজ্ঞার চেয়ে আদেশ পালনের ক্ষেত্রেই অক্ষমতা বেশি দেখা দিয়ে থাকে। আর সে কারণেই বলা হয়েছে- তোমাদেরকে যা আদেশ করা হয়েছে তা যথাসাধ্য অর্থাৎ সক্ষমতা অনুযায়ী পালন করবে।

উদাহরণ দেওয়া যায় নামায দ্বারা। নামায দাঁড়িয়ে পড়া ফরয। কিন্তু কারও যদি এমন ওযর থাকে, যদ্দরুন দাঁড়িয়ে নামায পড়া তার পক্ষে সম্ভব নয়, তবে সে বসে বসে পড়বে। যদি বসতেও না পারে তবে শুয়ে শুয়ে পড়বে। নামায কিবলার দিকে ফিরে পড়া ফরয। কেউ যদি এমন কোনও জায়গায় থাকে, যেখানে তার পক্ষে নিশ্চিত কিবলা ঠিক করা সম্ভব নয়, তবে সে অনুমানের ওপর নির্ভর করবে এবং যেদিকে কিবলা বলে তার অনুমান ও প্রবল ধারণা হয়, সেদিকে ফিরে নামায পড়বে। এমনিভাবে মাটিতে মাথা রেখে সিজদা করা ফরয। কিন্তু কারও যদি ওযরের কারণে এভাবে সিজদা করা সম্ভব না হয়, তবে সে ইশারা দ্বারা সিজদা আদায় করবে। আর যদি কোনওভাবেই তার পক্ষে নামায পড়া সম্ভব না হয়, তবে তার জন্য পুরোপুরি মাফ। নামায পড়ার দায়িত্ব থেকে তাকে মুক্তি দেওয়া হয়েছে।

এভাবে শরী'আতের সবগুলো বিধান পালনের ক্ষেত্রেই সাধ্য ও সক্ষমতার প্রতি দৃষ্টি রাখা হয়েছে। অর্থাৎ ক্ষমতা থাকলেই পালন করতে হবে। যার যতটুকু ক্ষমতা থাকে, সে ততটুকু পালন করবে। যার বিলকুল ক্ষমতা থাকে না, সে পুরোপুরি মুক্ত। এ ক্ষেত্রে প্রত্যেকের কর্তব্য ‘উলামায়ে কিরামের শরণাপন্ন হওয়া। নিজে নিজে কোনও একটা বিষয়কে ওযর ধরে হুকুম পালনে কাটছাট করা কিছুতেই উচিত হবে না।



সারকথা হলো,  


  والله اعلم بالصواب