জিজ্ঞাসা-১৩১২৭:
আসসালামু আলাইকুম। কেমন আছেন হুজুর আমার একটা জানার ছিল হাদিসে আছে পায়ে পা কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে দাঁড়ান নামাজে কিন্তু নামাজে ফাঁকা ফাঁকা করে দাঁড়ানোর কোন হাদিস আছে
তারিখ:১৮/১১/২৪ ঈসায়ি/ইংরেজি
ইনসান আলি বরিশাল থেকে।
জবাব: ওয়ালাইকুমুস সালাম ওয়া রহমাতুল্লাহ। নাহমাদুহু ওয়া নুসল্লি আলা রসূলিল কারিম। আম্মাবাদ -
তাসলিম ও হামদ-সানার পর প্রথম কথা হলো, হাদিস শরিফে কাতার সোজা এবং পূর্ণ করা বা ফাঁকা না রাখার বিষয়ে কঠিন তাগিদ এসেছে।
তাই বলে দু ফাঁক করে পায়ের সাথে পা মিলাতে হবে, এই রকম কোন নির্দেশনা নেই, এই অর্থ কেউ গ্রহণ করে নি। কোন ইমাম, অতীত কালের মুহাদ্দিস এরকম আমেল করেননি। এটা নব অবিস্কৃত। নিম্নে হাদিস এবং এর ব্যাখ্যা তুলে ধরা হলো:
কাতার সোজা করা সম্পর্কিত হাদীস সমূহের দিকে নজর দিলেই তা স্পষ্ট হবে আশা করি-
হাদিস নং-০১
692 – حدثنا عمرو بن خالد قال حدثنا زهير عن حميد عن أنس عن النبي صلى الله عليه و سلم قال : ( أقيموا صفوفكم فإني أراكم من وراء ظهري ) . وكان أحدنا يلزق منكبه بمنكب صاحبه وقدمه بقدمه (صحيح البخارى-كتاب الجماعة والإمامة ، باب إلزاق المنكب بالمنكب والقدم بالقدم في الصف، رقم الحديث-692)
হযরত আনাস রাঃ বলেন-রাসূল সাঃ ইরশাদ করেছেন-“তোমরা কাতার সোজা কর। নিশ্চয় আমি তোমাদের পিছন থেকেও দেখি”।
আর আমাদের একেকজন কাঁধের সাথে পাশের জনের কাঁধ মিলাতো, আর পায়ের সাথে পা মিলাতো। {সহীহ বুখারী, হাদীস নং-৬৯২}
হাদিস নং-০২
حَدَّثَنَا عُثْمَانُ بْنُ أَبِي شَيْبَةَ، حَدَّثَنَا وَكِيعٌ، عَنْ زَكَرِيَّا بْنِ أَبِي زَائِدَةَ، عَنْ أَبِي الْقَاسِمِ الْجَدَلِيِّ، قَالَ سَمِعْتُ النُّعْمَانَ بْنَ بَشِيرٍ، يَقُولُ أَقْبَلَ رَسُولُ اللَّهِ صلى الله عليه وسلم عَلَى النَّاسِ بِوَجْهِهِ فَقَالَ " أَقِيمُوا صُفُوفَكُمْ " . ثَلاَثًا " وَاللَّهِ لَتُقِيمُنَّ صُفُوفَكُمْ أَوْ لَيُخَالِفَنَّ اللَّهُ بَيْنَ قُلُوبِكُمْ " . قَالَ فَرَأَيْتُ الرَّجُلَ يُلْزِقُ مَنْكِبَهُ بِمَنْكِبِ صَاحِبِهِ وَرُكْبَتَهُ بِرُكْبَةِ صَاحِبِهِ وَكَعْبَهُ بِكَعْبِهِ .
৬৬২. উছমান ইবনে আবি শাঈবা .... নুমান ইবনে বশীর (রাযিঃ) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ (ﷺ) সমবেত ব্যক্তিদের নিকট উপস্থিত হয়ে তিনবার বলেনঃ তোমরা তোমাদের কাতার সোজা কর। আল্লাহর শপথ! তোমরা কাতার সোজা করে দণ্ডায়মান হবে, অন্যথায় আল্লাহ্ তাআলা তোমাদের মধ্যে মতানৈক্য সৃষ্টি করবেন। রাবী বলেন, অতঃপর আমি মুসল্লীদেরকে পরস্পর কাঁধে কাঁধ, পায়ে পা এবং গোড়ালির সাথে গোড়ালি মিলিয়ে দাঁড়াতে দেখেছি।
Al-Nu’man b. Bashir said:
the Messenger of Allah (ﷺ) paid attention to the people and said three times; straighten your rows (in prayer); by Allah, you must straighten your rows, or Allah will certainly put your faces in contrary directions. I then saw that every person stood in prayer keeping his shoulder close to that of the other, and his knee close to that of the other, and his ankle close to that of the other.
সুনানে আবু দাউদ, হাদীস নং ৬৬২ (আন্তর্জাতিক নং ৬৬২)
হাদীসের ব্যাখ্যা:
বুখারী শরীফে বর্ণিত হযরত আনাস রা.-এর হাদীস, আবু দাউদ শরীফে বর্ণিত হযরত নু’মান বিন বাশীর রা.-এর হাদীস এবং এ অর্থে বর্ণিত অন্যান্য হাদীসের দোহাই দিয়ে বর্তমান কালের কিছু লোকজন নিজের দু’পায়ের মধ্যে অনেক ফাঁকা করে অন্যের পায়ের সাথে লাগিয়ে দেয় এবং এটাকে রসূল স.-এর ছুন্নাত বলে প্রচার করে থাকে।
এসব হাদীসের ব্যাপারে আমাদের মনত্মব্য হলো: এ সকল হাদীসের দুটি অংশ রয়েছে। এক. কাতার সোজা করার নির্দেশ। দুই. টাখনুর সাথে টাখনু, হাঁটুর সাথে হাঁটু এবং কাঁধের সাথে কাঁধ মিলিয়ে দাঁড়ানোর আমল। এর মধ্যে কাতার সোজা করার নির্দেশটি মারফু’ তথা রসূল স.এর বাণী। আর মিলিয়ে দাঁড়ানোর অংশটি মাউকুফ তথা সাহাবার আমল যা রসূলুল্লাহ স. দেখেছেন কি না তার কোন প্রমাণ হাদীসে বর্ণিত নেই। সুতরাং টাখনুর সাথে টাখনু, হাঁটুর সাথে হাঁটু এবং কাঁধের সাথে কাঁধ মিলিয়ে দাঁড়ানোকে রসূলুল্লাহ স.-এর হাদীস হিসেবে প্রচার করা কোনক্রমেই ঠিক নয়। তবে সাহাবাগণের আমল হিসেবে নিঃসন্দেহে প্রমাণিত যার অনুসরণ করা আমাদের জন্য উচিত এবং আমরা করেও থাকি। অবশ্য, তারা মিলানোর বাহ্যিক অর্থ করে থাকে। আর হাদীস বিশারদগণ এর উদ্দিষ্ট অর্থ করে থাকেন। অর্থাৎ গায়ে গায়ে মিলে দাঁড়ানো আর কাতারের সবাই এব বরাবর হওয়া, আগে/পিছে না হওয়া। টাখনুর সাথে টাখনু, হাঁটুর সাথে হাঁটু এবং কাঁধের সাথে কাঁধ মিলিয়ে দাঁড়ানোর বাহ্যিক অর্থ যেমন এ হাদীসের উদ্দেশ্য নয়, ঠিক তেমনই তা সম্ভবও নয়। কারণ কাঁধ এবং কদম লাগিয়ে দাঁড়ালে হাঁটুর সাথে হাঁটু লাগানো অসম্ভব। আবার পায়ের পেছনের অংশ তুলনামূলক সরম্ন হওয়ায় গিটের সাথে গিট লাগিয়ে দাঁড়ালে প্রযোজ্য ক্ষেত্রে পা হুবহু কিবলামুখী রাখাও অসম্ভব। বুখারী শরীফের সবচেয়ে নির্ভরযোগ্য ব্যাখ্যাকার যুগশ্রেষ্ঠ ইমাম, হাফেজ ইবনে হাজার আসকালনী রহ.-এ হাদীসের ব্যাখ্যায় বলেন: الْمُرَادُ بِذَلِكَ الْمُبَالَغَةُ فِي تَعْدِيلِ الصَّفِّ وَسَدِّ خَلَلِهِ وَقَدْ وَرَدَ الْأَمْرُ بِسَدِّ خَلَلِ الصَّفِّ وَالتَّرْغِيبِ فِيهِ فِي أَحَادِيثَ كَثِيرَةٍ أجمعها حَدِيث بن عمر عِنْد أبي دَاوُد وَصَححهُ بن خُزَيْمَةَ وَالْحَاكِمُ উক্ত হাদীস দ্বারা উদ্দেশ্য হলো সর্বাধিক গুরম্নত্বের সাথে কাতার সোজা করা এবং ফাঁকা বন্ধ করে পরস্পর মিলেমিলে দাঁড়ানো। তিনি আরো বলেন: ফাঁকা বন্ধ করে দাঁড়ানোর ব্যাপারে অনেক হাদীস আছে। তন্মধ্যে সবচেয়ে ব্যাপক অর্থেবহ হচ্ছে আবু দাউদ শরীফে বর্ণিত হযরত ইবনে উমার রা.-এর হাদীস। ইবনে খুযাইমা ও হাকেম উক্ত হাদীসকে সহীহ বলে মনত্মব্য করেছেন”।
পূর্ববর্ণিত হযরত আব্দুর রহমান, আবু হুরায়রা এবং হযরত আব্দুলস্নাহ বিন মাসউদ রা.-এর হাদীস এবং ইবনে হাজার আসকালানী রহ.-এর উপরিউক্ত ব্যাখ্যা থেকে প্রমাণিত হয় যে, নিজের দু’পায়ের মধ্যে অনেক ফাঁকা করে অন্যের পায়ের সাথে লাগিয়ে দেয়া রসূলুল্লাহ স.-এর ছুন্নাতও নয় আর সাহাবায়ে কিরামের আমলের সঠিক রূপও নয়; বরং এটা কারো কল্পনাপ্রসূত ব্যাখ্যা সম্বলিত আমল। আর তা বাসত্মবায়নের জন্য হাদীসে উলিস্নখিত শব্দের বাহানা ও আশ্রয় গ্রহণ করা হয়েছে মাত্র। কেবল নবীর আমলই হুজ্জাত, সাহাবীদের আমল হুজ্জাত বা প্রমাণিক ভিত্তি নয় বলে যারা হারহামেশা দারাজ কন্ঠে প্রচার করে থাকেন তারা আবার এ মাসআলায় এসে তাদের নীতির আমূল পরিবর্তন ঘটালেন ! এ দ্বৈত নীতি আশ্চর্য জনক নয় কী ? প্রসিদ্ধ সালাফী আলেম জেদ্দা ফিকহ একাডেডমীর সাবেক প্রধান ড. বকর বিন আব্দুলস্নাহ আবু যায়দ তাঁর ‘লা জাদীদা ফী আহকামিস সালাহ’ কিতাবে নামাযে নতুন আবিষ্কৃত কিছু পদ্ধতি চিহিৃত করেছেন। কাতারে পাশের মুসলস্নীর পায়ের সঙ্গে পা মিলিয়ে দাঁড়ানোর এ নব আবিস্কৃত পন্থাকেও তিনি এ তালিকার অনত্মর্ভুক্ত করেছেন। হায় ! আমাদের দেশের সালাফী ভাইরাও যদি এর থেকে শিক্ষা নিতেন তাহলে কতইনা ভাল হতো!
সারকথা হলো, সুতরাং বুঝা গেল পা ছড়িয়ে দাঁড়ানোর কথা এসব হাদীসে বুঝানো উদ্দেশ্য নয়। বরং কাতার সোজা করার গুরুত্ব ও সোজা করার পদ্ধতি বুঝানো উদ্দেশ্য। যেটা হযরত ইবনে হাজার আসকালানী রহ. বুখারীতে বর্ণিত হাদীসের ব্যাখ্যায় ফাতহুল বারীতে উল্লেখ করেছেন
المراد بذلك المبالغة فى تعديل الصف وسد خلله (فتح البارى-2/211
অর্থাৎ এটা দ্বারা উদ্দেশ্য হল-কাতার সোজা করার ক্ষেত্রে গুরুত্ব বুঝানো, আর কাতারের মাঝে ফাঁক বন্ধ করা। {ফাতহুল বারী-২/২১১}
والله اعلم بالصواب