জিজ্ঞাসা-১৩১১৩:
আসসালামু আলাইকুম।
আমা পিতা ,৭বিঘা চাষাবাদ জমি ও ১বিঘার উপর বসত বাড়ি রেখে মারা গেছেন।আমরা ৩ভাই ও ৩ বোন।মা বেঁচে আছেন।
এখানে চাষাবাদ জমির অর্ধেক মায়ের নামে এটা উল্লেখ আছে দলিলে কিন্তু দাগসত্ত্ব উল্লেখ নেই।
১. এখন বাবার অর্ধেক( চাষাবাদ)সম্পত্তি একরে হিসাবে করে আমরা কে কতটুকু পাব?
২. মা অনেক বয়বৃদ্ব ,তাই তিনি চাচ্ছেন তার সম্পত্তি ও শরীয়ত অনুযায়ী ভাগ হয়ে দলিল পত্র কর ।যার অংশ যত টুকু পড়বে সে ততটুকুর আরির টাকা(আমাদের এলাকা এসব জমিতে মাছ চাষ হয় অর্থ্যাৎ ঘের। অন্যদের জমি এক ঘেরের থাকলে সেই জমি বাবদ জমির মালিক কে বাৎসরিক টাকা দেওয়া হয়)।
3. উল্লেখ্য যে বাবা মারা প্রায় ২৬বছর। এই জমি ভাইয়েররা ও মা ব্যবহার করে ও বসত করে।বাবা ও মায়ের নামেই আছে।৩ভাই ভাগ করে খায়।কোন দলিল পত্র নামজারি কিছুই হয় নি এবং খাজনা ও দেওয়া হয়নি। সেক্ষেত্রে নামজারি/দলিল করতে এই খরচ কে বহন করবে? দয়াকরে শারয়ী পন্থায় উত্তর দিবেন।
তারিখ:০১/১১/২৪ ঈসায়ি/ইংরেজি
আয়েশা সিদ্দিকা , উত্তরা ঢাকা থেকে।
জবাব: ওয়ালাইকুমুস সালাম ওয়া রহমাতুল্লাহ। নাহমাদুহু ওয়া নুসল্লি আলা রসূলিল কারিম। আম্মাবাদ -
তাসলিম ও হামদ-সানার পর প্রথম কথা হলো,
ত্যাজ্য সম্পদ বা মীরাছের সম্পর্ক মৃত্যুর পরের সাথে। অর্থাৎ ব্যক্তি মারা যাবার পর তার সম্পদে মীরাছ জারী হয়।
জীবিত থাকা অবস্থায় মীরাছের শরয়ী বিধান জারী হয় না।
ছেলে মেয়ে পিতা মাতার মৃত্যুর পর তাদের ত্যাজ্য সম্পদ থেকে এক ছেলে দুই মেয়ের সমতুল্য হারে সম্পদ পায়। মহান আল্লাহ রব্বুল আলামীন বলেন,
يوصيكم اللَّهُ فِي أَوْلَادِكُمْ لِلذَّكَرِ مِثْلُ حَظِّ الْأُنْثَيَيْنِ
আল্লাহ তোমাদেরকে তোমাদের সন্তানদের সম্পর্কে আদেশ করেন, একজন পুরুষের অংশ দু’জন নারীর অংশের সমান। {সূরা নিসা-১১}
এক্ষেত্রে মা ও বাবার ত্যাজ্য সম্পদের হুকুম একই। তথা যেমন বাবার ত্যাজ্যসম্পদ থেকে ছেলে দুইভাগ এবং মেয়ে একভাগ পায়, তেমনি মায়ের সম্পদ থেকেও ছেলে দুইভাগ এবং মেয়ে একভাগ পায়।
তবে জীবিত অবস্থায় বন্টন করলে ছেলে মেয়ে সকল সন্তানকে সমান দেওয়া কর্তব্য। (ইমদাদুল মুফতীয়ীন পৃঃ ৮৭০)
عَنْ النُّعْمَانِ بْنِ بَشِيرٍ قَالَ : تَصَدَّقَ عَلَيَّ أَبِي بِبَعْضِ مَالِه، فَقَالَتْ أُمِّي عَمْرَةُ بِنْتُ رَوَاحَةَ : لَا أَرْضَى حَتَّى تُشْهِدَ رَسُولَ اللَّهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ ، فَانْطَلَقَ أَبِي إِلَى النَّبِيِّ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ لِيُشْهِدَهُ عَلَى صَدَقَتِي ، فَقَالَ لَهُ رَسُولُ اللَّهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ : أَفَعَلْتَ هَذَا بِوَلَدِكَ كُلِّهِمْ؟ قَالَ : لَا ، قَالَ : اتَّقُوا اللَّهَ وَاعْدِلُوا فِي أَوْلَادِكُمْ فَرَجَعَ أَبِي فَرَدَّ تِلْكَ الصَّدَقَةَ .
ولمسلم (1623) :
فَقَالَ رَسُولُ اللَّهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ : يَا بَشِيرُ ، أَلَكَ وَلَدٌ سِوَى هَذَا؟ قَالَ : نَعَمْ ، فَقَالَ : أَكُلَّهُمْ وَهَبْتَ لَهُ مِثْلَ هَذَا؟ قَالَ : لَا ، قَالَ : فَلَا تُشْهِدْنِي إِذًا ، فَإِنِّي لَا أَشْهَدُ عَلَى جَوْرٍ.
হযরত নুমান বিন বাশির রা. বলেন আমার পিতা আমাকে তার কিছু সম্পদ দান করলেন, তখন আমার মা আ'মরা বিনতে রওয়াহা রা. বললেন আমি এতে ততক্ষণ পর্যন্ত সন্তুষ্ট হবো না যতক্ষণ পর্যন্ত আপনি আমার সন্তানকে দেওয়া সম্পদের উপর রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে সাক্ষী না রাখবেন৷
ফলে আমার বাবা রসূলুল্লাহর নিকট গেলেন যাতে আমাকে দেওয়া দানের উপর রাসূলুল্লাহকে সাক্ষী বানাতে পারেন৷
তখন রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাকে জিজ্ঞেস করলেন, তুমি কি তোমার সকল সন্তানের সাথে এরূপ করেছো? তিনি বললেন, না৷ তখন নবীজি বললেন তোমরা আল্লাহকে ভয় করো এবং সন্তানদের মধ্যে সমতা রক্ষা করো ৷ তখন আমার বাবা ফিরে এলেন এবং সেই দানটি তিনি প্রত্যাহার করলেন৷ অন্য আরেক বর্ণনায় এসেছে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম জিজ্ঞেস করলেন তোমার কি এছাড়াও আরো সন্তান রয়েছে? তিনি বললেন, হ্যাঁ৷ নবীজী বললেন তাহলে কি তাদের সবার জন্য কি অনুরূপ অনুদান দিয়েছ? তিনি বললেন, না৷ তখন আল্লাহর নবী বললেন তাহলে এ বিষয়ে তুমি আমাকে সাক্ষী বানিও না ৷ কেননা আমি কোন অন্যায়ের উপর সাক্ষ্য হতে রাজি নই৷ বুখারী, হাদীস নং-২৫৮৭, মুসলিম, হা. নং ১৬২৩
তবে যৌক্তিক কারণে কমবেশি করা জায়েজ আছে। যেমন কোনো সন্তান প্রতিবন্ধী বা কেউ যদি পিতামাতার অধিক অনুগত হয় এবং তাদের খেদমত ও দেখাশোনার প্রতি অধিক যত্নবান হয় অথবা ইলম-আমল, তাকওয়া ও পরহেযগারিতে কোনো সন্তান অধিক অগ্রগণ্য হয় সেক্ষেত্রে পিতামাতা খুশি হয়ে তাকে কিছু বেশি দিতে চাইলে তা জায়েয।
এভাবে দেওয়া সাহাবা থেকে প্রমাণিত আছে। যেমন, আবু বকর রা. আয়েশা রা.-কে, উমর রা. আসেম রাহ.-কে এবং আবদুর রহমান ইবনে আউফ রা. তাঁর কোনো কোনো সন্তানকে অধিক দিয়েছেন। (মুআত্তা, ইমাম মালেক পৃষ্ঠা : ৬৪৩; শরহু মাআনিল আছার ২/২২৫; ফাতহুল বারী ৫/২৫৪)
তাই, আপনার মায়ের নামের সম্পদ আপনার মারের জীবদ্দশায় তার নামেই রাখা ভালো হবে যত দিন উনি বেচে আছেন। অন্যথায় আপনার বোনদেরকেও আপনাদের সমান দেওয়া কর্তব্য হবে। তা ছাড়া জীবদ্দশায় যাবতীয় সম্পদ উত্তরাধিকারীদেরকে সম্পূর্ণরূপে দলিল ও দখলসহ হস্তান্তর করে দিয়ে নিজে নিঃস্ব হয়ে যাওয়াটা ইসলামী শরিয়ার যে দিকনির্দেশনা এবং তাকাজা সে অনুযায়ী এটি উত্তম পন্থা নয়৷ কেননা এতে নিজের একান্ত প্রয়োজনের সময় অন্যের দ্বারস্থ হতে হয় কিংবা অন্যের মুখাপেক্ষী হতে হয় ৷ কুরআনে আল্লাহ বলেছেন,
وَلَا تَجْعَلْ يَدَكَ مَغْلُولَةً إِلَىٰ عُنُقِكَ وَلَا تَبْسُطْهَا كُلَّ الْبَسْطِ فَتَقْعُدَ مَلُومًا مَّحْسُورًا
আর তুমি তোমার হাতকে একেবারে গর্দানের সাথে লাগিয়ে (সংকুচিত করে রেখোনা) আবার পূর্ণ ছড়িয়েও দিও না, ফলে তোমাকে নিন্দিত ও নি:স্ব হয়ে যেতে হবে ৷ (সূরা বনী ইসরাইল- ২৯)
তাই, এখন প্রথমে আপনার মরহুম পিতার স্থাবর-অস্থাবর সম্পদ থেকে তার কাফন দাফন কার্য সম্পাদন, ঋণ-কর্জ পরিশোধ করার পর, অসিয়ত থাকলে তা এক-তৃতীয়াংশ সম্পদ থেকে পরিশোধ করত: অবশিষ্ট সম্পদ আপনারা ৩ ভাই, ৩ বোন ও আপনার মায়ের মাঝে শরীয়তে মোহাম্মদীর বিধান অনুযায়ী নিম্নহারে বণ্টিত হবে।
মোট সম্পদ ৭২ ভাগ হবে। তার মধ্যে মরহুমের স্ত্রী অর্থাৎ আপনার মা পাবে ৭২ ভাগের ৯ ভাগ (শতকরা হিসাবে ১২.৫%)
মরহুমের ১ম ছেলে পাবে ৭২ ভাগের ১৪ ভাগ (শতকরা হিসাবে ১৯.৪৪%)
২য় ছেলে পাবে ৭২ ভাগের ১৪ ভাগ (শতকরা হিসাবে ১৯.৪৪%)
৩য় ছেলে পাবে ৭২ ভাগের ১৪ ভাগ (শতকরা হিসাবে ১৯.৪৪%)
মরহুমের ১ম মেয়ে পাবে ৭২ ভাগের ৭ ভাগ (শতকরা হিসাবে ৯.৭২%)
২য় মেয়ে পাবে ৭২ ভাগের ৭ ভাগ (শতকরা হিসাবে ৯.৭২%)
৩য় মেয়ে পাবে ৭২ ভাগের ৭ ভাগ (শতকরা হিসাবে ৯.৭২%)
তারপর আপনার মায়ের মৃত্যুর পর আপনার মায়ের যাবতীয় স্থাবর-অস্থাবর সম্পদ থেকে তার কাফন দাফন কার্য সম্পাদন, ঋণ-কর্জ পরিশোধ করার পর, অসিয়ত থাকলে তা এক-তৃতীয়াংশ সম্পদ থেকে পরিশোধ করত: অবশিষ্ট সম্পদ আপনারা ৩ ভাই ও ৩ বোনের মাঝে (জীবিত থাকা সাপেক্ষে) শরীয়তে মোহাম্মদীর বিধান অনুযায়ী নিম্নহারে বণ্টিত হবে।
মরহুমার অর্থাৎ আপনার মায়ের মোট সম্পদ ৯ ভাগ হবে। তার মধ্যে মরহুমার ১ম ছেলে পাবে ৯ ভাগের ২ ভাগ (শতকরা হিসাবে ২২.২২%)
২য় ছেলে পাবে ৯ ভাগের ২ ভাগ (শতকরা হিসাবে ২২.২২%)
৩য় ছেলে পাবে ৯ ভাগের ২ ভাগ (শতকরা হিসাবে ২২.২২%)
মরহুমের ১ম মেয়ে পাবে ৯ ভাগের ১ ভাগ (শতকরা হিসাবে ১১.১১%)
২য় মেয়ে পাবে ৯ ভাগের ১ ভাগ (শতকরা হিসাবে ১১.১১%)
৩য় মেয়ে পাবে ৯ ভাগের ১ ভাগ (শতকরা হিসাবে ১১.১১%)
উল্লেখ্য, জমির খাজনা খারিজ, বাটোয়ারা দলিল ইত্যাদি খরচ আপনারা ভাই বোন সবাই মিলে মিউচুয়াললি বহন করতে পারেন। আবার ইচ্ছা করলে এজমালি সম্পদ থেকেও বহন করতে পারেন।
নোট: জীবিত অবস্থায় সম্পদ বণ্টনের ব্যাপারে ওলামায়ে কেরামের মধ্যে মতভেদ রয়েছে, এ বিষয়ে জিজ্ঞাসা-১২৩৬৪ শিরোনামে মাসয়ালাটি আলোচিত হয়েছে। লিংকটি শেয়ার করা হলো:
https://al-burhanbd.blogspot.com/2024/11/blog-post_2.html
والله اعلم بالصواب
উত্তর প্রদানে:
মুফতী আব্দুল হাই নাটোরী
রিলিজিয়ন কাউন্সেলিং অফিসার, বাংলাদেশ নেভাল একাডেমি (বিএনএ) পতেঙ্গা, চট্টগ্রাম। (নেভী)
দাওরা, জামিআ রাহমানিয়া আরাবিয়া সাত মসজিদ, মোঃপুর ঢাকা,
ইফতা, ইসলামিক রিসার্চ সেন্টার বসুন্ধরা, ঢাকা,
সাবেক, প্রধান আরবী সাহিত্য সম্পাদক রাহমানিয়া ছাত্র সংসদ,
সাবেক প্রধান মুফতী ও সিনিয়র মুহাদ্দিস জামিআ ছিদ্দীকিয়া ঈশ্বরদী, পাবনা।