আল-বুরহান ( দলিল-প্রমাণ)

আসসালামু আলাইকুম ওয়া রহমাতুল্লাহ! আমাদের ওয়েবসাইটে আপনাকে স্বাগতম। একটু নিচে দেখুন> বিষয় ভিক্তিক সাজানো রয়েছে, আপনার পছন্দ অনুযায়ী পাঠ করুন এবং পোষ্টগুলো ভালো লাগলে শেয়ার করুন আর আপনার কোন প্রশ্ন থাকলে এই নাম্বারে- ০১৬৮৭-১১৩৮৮০ হোয়াটস অ্যাপে পাঠিয়ে দিন । জাযাকাল্লাহু খাইর।

মোটিভেশন ক্লাস-২৬: অর্থনৈতিক ও সামাজিক উন্নয়নে যাকাতের ভূমিকা।

No Comments

 



মোটিভেশন ক্লাস -২৬:

 আসসালামুআলাইকুম । 

বিষয়: অর্থনৈতিক ও সামাজিক উন্নয়নে যাকাতের ভূমিকা, এটি প্রয়োজন।


হাফেজ হযরত মাওলানা নুরুল হক হাফিজাহুল্লাহু যশোর থেকে।

জবাব: ওয়ালাইকুমুস সালাম ওয়া রহমাতুল্লাহ। আলোচ্য বিষয়টি দুটি স্তরে আলোচনা করবো ইনশাআল্লাহ।

প্রথম স্তর: যাকাতের পরিচয়, খাতসমূহ, গুরুত্ব।

দ্বিতীয় স্তর: অর্থনৈতিক ও সামাজিক উন্নয়নে যাকাতের ভূমিকা

ক। প্রথম স্তর: যাকাতের পরিচয়, খাতসমূহ, গুরুত্ব।


ভূমিকা ইসলাম আল্লাহ প্রদত্ত একটি পূর্ণাঙ্গ জীবন ব্যবস্থা। এ জীবন ব্যবস্থায় সালাতের গুরুত্ব যেমন অপরিহার্য তেমনি যাকাতের গুরুত্বও অনস্বীকার্য। যাকাতভিত্তিক অর্থনৈতিক ব্যবস্থায় সুখী সমৃদ্ধিশালী প্রগতিশীল কল্যাণ রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা সম্ভব। আল্লাহর বাণী— وَأَقِيمُواْ ٱلصَّلَوٰةَ وَءَاتُواْ ٱلزَّكَوٰة # البقرة:43 তোমরা সালাত কায়েম কর যাকাত দাও। [আল-কুরআনুল কারীম, সূরা বাক্বারাহ: আয়াত ৪৩,৮৩,১১০, ২৭৭; সূরা নিসা: ৭৭, ১৬২; সূরা আন নুর: ৫৬; সূরা আহযাব: ৩৩; সূরা মুজ্জামিল:২০।] 


যাকাত এর আভিধানিক পরিচয় যাকাত একটি ব্যাপক প্রত্যয়। এটি আরবী শব্দ زكوة থেকে গেৃহীত। যার অর্থ পবিত্রতা বা পরিশুদ্ধতা। যাকাতের আরেক অর্থ পরিবর্ধন (Growth) শুধু তাই নয়, যাকাত একাধারে পবিত্রতা, বর্ধিত হওয়া, আর্শীবাদ (Blessing) এবং প্রশংসা অর্থেও ব্যবহৃত হয়, কোরান ও হাদিসে যাকাতের এ সব তাৎপর্য নিহিত। আল্লামা জুরযানী বলেন- الزكاة فى اللغة الزيادة অর্থাৎ যাকাতের আভিধানিক অর্থ অতিরিক্ত। মাওলানা আব্দুর রহীম বলেন, যাকাত শব্দের আসল অর্থ হচ্ছে প্রবৃদ্ধি (Growth), প্রবৃদ্ধি লাভ (Increa8uuuse), প্রবৃদ্ধির কারণ (To Cause to grow) ইত্যাদি যা আল্লাহ প্রদত্ত বারাকাত (Blessing) থেকে অর্জিত হয়। ইসলাম বিশ্বকোষে যাকাতের অর্থ সম্পর্কে আছে, যাকাত অর্থ পবিত্রতা ও পরিস্কার-পরিচ্ছন্নতা। আল্লামা শাওকানী বলেন, الزكاة مأخوذة من الزكاء وهو النماء- زكا الشيئ اذا نما وزاد رجل زكا أي زائد الخير- وسمى جزء منى المال زكوة أى زيادة مع أنه نقص منه لأنها تكثر بر كته بذلك أو تكثر أجر صاحبه- যাকাত শব্দটি মূল زكاء এর অর্থ প্রবৃদ্ধি, বর্ধিত হওয়া। কোন জিনিস বৃদ্ধি পেলে এই শব্দ বলা হয় বৃদ্ধিপ্রাপ্ত হওয়া। খুব বেশী কল্যাণকময় হলে তা زكى বলা হয়। আর ধন সম্পদের একটা অংশ বের করে দিলে তাকে যাকাত বা প্রবৃদ্ধি পাওয়া বলা হয়, অথচ তাকে কমে। তা বলা হয় এ জন্য যে যাকাত দিলে তাকে বরকত বেড়ে যায় বা যাকাত দাতা অধিক সওয়াবের অধিকারী হয়। ইবনুল মানযুর বলেন, যাকাত শব্দের অর্থ হলো পবিত্রতা, ক্রমবৃদ্ধি ও আধিক্য। সাদী আবু জীব বলেন, যাকাত আদায়ের মাধ্যমে বাহ্যিকভাবে সম্পদ কমলেও প্রকারান্তে এর পরিবর্ধন ঘটে। এছাড়া এর মাধ্যমে সম্পদ পবিত্র ও পরিচ্ছন্ন হয় এবং আল্লাহর অসন্তুষ্টি থেকে সমাজ হয় মুক্ত ও পবিত্র। আবুল হাসান বলেন, যাকাতের অর্থ الطهارة والنماء والبركة والمدح পবিত্রতা, বৃদ্ধি, বরকত ও প্রশংসা। আল মুজামুল অসীতে আছে, আভিধানিক অর্থ زكا যে জিনিস ক্রমশ বৃদ্ধি পায় ও পরিমাণে বেশী হয়। زكا فلان অমুক ব্যক্তি যাকাত দিয়েছে অর্থ-সুস্থ ও সুসংবদ্ধ হয়েছে।অতএব, যাকাত হচ্ছে বরকত, পরিমাণে বৃদ্ধি পাওয়া, প্রবৃদ্ধি লাভ, পবিত্রতা ও পরিচ্ছন্নতা, শুদ্ধতা- সুসংবদ্ধতা। যাকাত এর পারিভাষিক পরিচয় ইসলামী শরীয়াতের পরিভাষায় জীবন যাত্রার অপরিহার্য প্রয়োজন পুরণের পর সম্পদে পূর্ণ এক বছরকাল অতিক্রম করলে ঐ সম্পদ থেকে নির্দিষ্ট অংশ আল্লাহর নির্ধারিত খাতে ব্যয় করাকে যাকাত বলা হয়। আল্লামা জুরজানী বলেন: الزكاة فى الشرع عبارة عن إيجاب طائفة من المال فى مال مخصوص لمالك مخصوص ইউসুফ কারযাভী বলেন, শরীয়াতের দৃষ্টিতে যাকাত ব্যবহৃত হয় ধন-মালে সুনির্দিষ্ট ও ফরজকৃত অংশ বোঝানোর জন্য। যেমন পাওয়ার যোগ্য অধিকারী লোকদের নির্দিষ্ট অংশের ধন-মাল দেওয়াকে যাকাত বলা হয়। ইমাম ইবনে তাইমিয়া বলেন, যাকাত আল্লাহ নির্দেশিত অংশ ধন-মাল থেকে হকদারদের দিয়ে দেয়া, যাতে মন-আত্মা পবিত্র হয় এবং ধন-মাল পরিচ্ছন্ন হয় ও বৃদ্ধি পায়। নিজের অর্থ সম্পদের একটি নির্দিষ্ট অংশ অভাবী মিসকিনদের মধ্যে বন্টন করে দেওয়াকে যাকাত বলে। এটাকে যাকাত বলার কারণ হল এভাবে যাকাত দাতার অর্থ সম্পদ এবং তার নিজের আত্মা পবিত্র -পরিচ্ছন্ন হয়ে যায়। যাকাতের শরয়ী অর্থই তো, আল্লাহর সন্তোষ লাভের উদ্দেশ্যে কোন মালদার ব্যক্তি কর্তৃক কোন হকদার ব্যক্তিকে তার মালের নির্ধারিত অংশ অর্পন করা। যাকাত ফরজ হওয়ার সময়কাল ইসলামী বিশ্বকোষ এর ভাষ্যমতে, আল-কুরআনে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে ৮২ বার যাকাতের কথা বলা হয়েছে। আল-কুরআনে প্রত্যক্ষভাবে ৩২ বার যাকাত এর কথা বলেছেন। এর মধ্যে নামায ও যাকাতের কথা একত্রে বলেছেন ২৮ বার। ফুয়াদ আব্দুল বাকী বর্ণনা করেছেন, আল-কুরআনে মোট ১৯টি সুরায় ২৯টি আয়াতে যাকাত শব্দটির উল্লেখ দেখা যায়। আল-কুরআনের সূরা আত তাওবার ৬০ নং আয়াত দ্বারা যাকাত ফরজ হয়। আয়াতটি হলো: إِنَّمَا ٱلصَّدَقَٰتُ لِلۡفُقَرَآءِ وَٱلۡمَسَٰكِينِ وَٱلۡعَٰمِلِينَ عَلَيۡهَا وَٱلۡمُؤَلَّفَةِ قُلُوبُهُمۡ وَفِي ٱلرِّقَابِ وَٱلۡغَٰرِمِينَ وَفِي سَبِيلِ ٱللَّهِ وَٱبۡنِ ٱلسَّبِيلِۖ فَرِيضَةٗ مِّنَ ٱللَّهِۗ وَٱللَّهُ عَلِيمٌ حَكِيم # التوبة:60 দ্বিতীয় হিজরীতে রোজা ফরজ হওয়ার পরপরই শাওয়াল মাসে যাকাত ফরজ হয় এবং নবম হিজরীতে এটি পুর্ণাঙ্গরূপে কার্যকর করা হয়। হাফিয ইবন হাজর বলেন, যাকাত হিজরতের ২য় বৎসরেই ফরজ হয়েছে, রমজানের সিয়াম ফরজ হওয়ার পূর্বে। সায়াদ ইবন উবাদাহ বর্ণিত হাদিস থেকেও তা-ই প্রমাণিত। امرنا رسول الله (ص) بصدقة الفطر قبل أن تنزل الزكوة ئم نزلت فرضية الفرضية الزكوة রাসুল(সা) যাকাত সংক্রান্ত হুকুম নাজিল হওয়ার পূর্বে সাদকায়ে ফিতর দেয়ার জন্য আমাদের আদেশ করেছিলেন। যাকাত ফরজ হওয়ার কথা নাজিল হয়েছে তার পরে। যাকাতের গুরুত্ব ইসলামের ৫টি স্তম্ভ বা ভিত্তির একটি যাকাত। ঈমান ও নামাযের পরেই যাকাতের স্থান। আল্লাহর কালাম আল কুরআনে যাকাতের ব্যাপারে বারবার গুরুত্বারোপ করা হয়েছে। আল-কুরআনের নামায কায়েমের কথা বলার সাথে সাথে অনেক স্থানে যাকাত আদায়ের প্রসঙ্গটিও এসেছে। আল্লাহর বাণী وَٱلَّذِينَ هُمۡ لِلزَّكَوٰةِ فَٰعِلُونَ # المؤمنون:4 অর্থাৎ যারা যাকাতদানে সক্রিয়। যাকাত পূর্ববর্তী উম্মতের ওপরও ফরজ ছিল স্মর্তব্য যে, যাকাত ব্যবস্থা শুধু উম্মতে মুহাম্মদী (সা.) এর উপর নয় বরং অতীতের সকল নবীদের উম্মতের ওপরও অপরিহার্য পালনীয় ও প্রচলিত ছিল। তবে সম্পদের পরিমাণ এবং ব্যয়ের খাত বিভিন্ন সময় বিভিন্ন ছিল। আল কুরআনুল কারীমে এ ব্যাপারে বলা হয়েছে। যেমন সাইয়্যেদুনা ইবরাহীম (আ.) এবং তার বংশের নবীদের কথা উল্লেখ করার পর আল্লাহ রাববুল আলামীন বলেন: وَجَعَلۡنَٰهُمۡ أَئِمَّةٗ يَهۡدُونَ بِأَمۡرِنَا وَأَوۡحَيۡنَآ إِلَيۡهِمۡ فِعۡلَ ٱلۡخَيۡرَٰتِ وَإِقَامَ ٱلصَّلَوٰةِ وَإِيتَآءَ ٱلزَّكَوٰةِ # الأنبياء:73 এবং তাদেরকে করেছিলাম নেতা। তারা আমার নির্দেশ অনুসারে মানুষকে পথ প্রদর্শন করতো। তাদেরকে ওহী প্রেরণ করেছিলাম সৎকর্ম করতে, সালাত কায়েম করতে এবং যাকাত প্রদান করতে। ইসমাঈল (আ) সম্পর্কে বলা হয়েছে وَكَانَ يَأۡمُرُ أَهۡلَهُۥ بِٱلصَّلَوٰةِ وَٱلزَّكَوٰةِ# مريم:55 সে তার পরিজনর্বগকে সালাত ও যাকাতের নির্দেশ দিত। মূসা (আ) এর প্রসঙ্গে আল্লাহ বলেন, وَرَحۡمَتِي وَسِعَتۡ كُلَّ شَيۡءٖۚ فَسَأَكۡتُبُهَا لِلَّذِينَ يَتَّقُونَ وَيُؤۡتُونَ ٱلزَّكَوٰة # الأعراف:156 আর আমি আমার দয়া তা-তো প্রত্যেক বস্তুতে ব্যপ্ত। সুতরাং আমি তা তাদের জন্য নির্ধারিত করব, যারা তাকওয়া অবলম্বন করে, যাকাত দেয় ও আমার নিদর্শনে বিশ্বাস করে। ঈসা (আ.) এর সময়কার অবস্থা বর্ণনায় রাববুল আলামীন, وَجَعَلَنِي مُبَارَكًا أَيۡنَ مَا كُنتُ وَأَوۡصَٰنِي بِٱلصَّلَوٰةِ وَٱلزَّكَوٰةِ مَا دُمۡتُ حَيّٗا # مريم:31. যেখানেই আমি থাকি না কেন তিনি আমাকে বরকতময় করেছেন। তিনি আমাকে নির্দেশ দিয়েছেন, যতদিন জীবিত থাকি ততোদিন সালাত ও যাকাত আদায় করতে। মোটকথা, সে প্রাচীন যামানা থেকেই সকল নবী-রাসুলদের উম্মতের ওপর নামায ও যাকাত ফরজ হিসেবে পালনীয় ছিলো। কোন নবীর সময়কালেই দ্বীন ইসলাম দুটো ফরজ থেকে মুক্ত ছিল না। তবে উম্মতে মুসলিমার বর্তমান পর্যায়ে ধনীদের সম্পদ পুঙ্খানুপুঙ্খরুপে হিসেব করত: প্রতিবছর যাকাত আদায় বাধ্যতামূলক করা হয়েছে। যাকাত দরিদ্র ও অভাবগ্রস্থদের মধ্যে আল্লাহ নির্ধারিত অবশ্য কর্তব্য ও বাধ্যতামুলক প্রদেয় হিসেবে ঘোষণা করা হয়েছে। যাকাতের ব্যাপারে খুলাফায়ে রাশেদীন ও ইসলামী চিন্তাবিদদের অভিমত যাকাতের ফরযিয়্যাত বিষয়ে ইসলামের সোনালী যুগের মানবতার বন্ধু মুহাম্মদ (সা.) এর সান্নিধ্যে ধন্য সাহাবায়ে কিরাম বিশেষ করে খুলাফায়ে কিরামগণ গুরুত্বপূর্ণ মতামত দিয়েছেন। পাশাপাশি পরবর্তীকালীন ইসলামী চিন্তাবিদগণ তাদের অভিমত ব্যক্ত করেছেন। যেমন: হযরত আবু বকর (রা) বলেন, যারা যাকাত দিতে ছল চাতুরীর আশ্রয় নেবে আমি তাদের কাছ থেকে যাকাত এবং সম্পদের অর্ধেক আদায় করবো। ওমর (রা.) বলেন, আমি যদি আগে বুঝতে পারতাম তাহলে বিত্তশালীদের অতিরিক্ত সম্পদ গরীব ও মুহাজিরদের মাঝে ভাগ করে দিতাম। আলী (রা.) বলেন, অভাবগ্রস্থদের অভাব দূরীকরণে বিত্তশালীদের ধন-সম্পদের ওপর অনেক দায়িত্ব বর্তায়। যদি ক্ষধার্ত ও নাঙ্গা মানুষ থাকে তাহলে বুঝতে হবে যে সম্পদশালীরা তাদের দায়িত্ব পালন করছে না। আব্দুল্লাহ ইবনে উমার (রা.) বলেন, তোমাদের সম্পত্তিতে যাকাত এবং এর অতিরিক্ত আরো দাবি আছে।ইমাম কুরতুবী লিখেছেন, মুসলিম জনসমষ্টির ওপর বিপদ বা অভাব দেখা দিলে যাকাত দেয়া এবং অতিরিক্ত অর্থ ব্যয় করা ধনী লোকদের জন্য ওয়াজিব। ইমাম ইবনে তাইমিয়্যা বলেন, বুভুক্ষকে খাবার খাওয়ানো, বস্ত্রহীনকে পরিধেয় দেওয়া ফরযে কিফায়া হিসেবে জরুরী হয়ে পড়ে। আল্লামা ইউসুফ আল কারযাভী বলেন, যাকাত ব্যবস্থার মাধ্যমে সব অভাবগ্রস্থ ও দুদর্শাগ্রস্থ মানুষের অভাব দূর করা ও অর্থনৈতিকভাবে পূর্ণবাসন করা সম্ভব। যাকাত অভাবগ্রস্থকে পর্যাপ্ত পরিমাণে দিতে হবে যাতে সে আর অভাবগ্রস্থ না থাকে। মূলত যাকাত ব্যবস্থার দ্বারা ধনীদের সম্পদে গরীবদের অধিকার প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে আল্লাহ তাআলা দারিদ্রমুক্ত সমাজ বিনির্মাণের সুন্দর ব্যবস্থা করেছেন। যাকাত দুস্থ গরীবদের প্রতি ধনীদের কোন দয়া বা অনুগ্রহ নয়, বরং অধিকার বা হক, এটাই প্রকৃত সত্য ও শাশ্বত কথা। যাকাত বণ্টনের খাতসমূহ যাকাত বণ্টনের ব্যাপারে আল-কুরআনের স্পষ্ট ঘোষণা হচ্ছে: إِنَّمَا ٱلصَّدَقَٰتُ لِلۡفُقَرَآءِ وَٱلۡمَسَٰكِينِ وَٱلۡعَٰمِلِينَ عَلَيۡهَا وَٱلۡمُؤَلَّفَةِ قُلُوبُهُمۡ وَفِي ٱلرِّقَابِ وَٱلۡغَٰرِمِينَ وَفِي سَبِيلِ ٱللَّهِ وَٱبۡنِ ٱلسَّبِيلِۖ فَرِيضَةٗ مِّنَ ٱللَّهِۗ وَٱللَّهُ عَلِيمٌ حَكِيمٞ#التوبة:60] অর্থাৎ সাদাকাহ (যাকাত) তো কেবল নি:স্ব, অভাবগ্রস্থ ও তৎসংশ্লিষ্ট কর্মচারীদের জন্য, যাদের চিত্ত আকর্ষণ করা হয় তাদের জন্য, দাসমুক্তির জন্য, ঋণভারাক্রান্তদের, আল্লাহর পথে ও মুসাফিরদের জন্য। এটা আল্লাহর বিধান। মহাগ্রন্থ আল-কুরআনের আলোকে যাকাত ব্যয়ের খাত ৮টি। যার সংক্ষিপ্ত বিবরণ নিম্নে পেশ করছি: ১. নিঃস্ব ফকীর (الفقير): ফকীহ বলা হয় যার কোন সম্পদ নেই, নেই তার উপযোগী হালাল উপার্জন, যদ্বারা তার প্রয়োজন পূরণ হতে পারে। যার খাওয়া-পরা ও থাকার স্থান নেই। অন্যান্য নিত্য-প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র নেই। আবার কেউ বলেছেন, ফকীর সে যার সামান্য সম্পদ আছে। তবে জীবন ধারণের জন্য অপরের ওপর নির্ভর করে। ফকীরের সংজ্ঞায় আল্লামা তাবারী বলেন, المحتاج المتعفف الذى لايسأل সে অভাবগ্রস্থ যে নিজেকে সর্বপ্রকার লাঞ্ছনা থেকে রক্ষা করে চলেছে, কারোর নিকটই কিছুর প্রার্থনা করে না। ইবনে আববাস, হাসান আল বসরী, মুজাহিদ, ইকরামা ও জহুরীর মতে: ফকীর এমন ধরনের নিঃস্ব ব্যক্তিকে বলা হয়, যে মানুষের কাছে হাত পাতে না। তবে এক্ষেত্রে ফকীহদের সংজ্ঞা বিষয়ক ইমাম শাফিয়ীর দৃষ্টিভঙ্গি ভিন্নরূপ। তিনি বলেন, ফকীর ঐ ব্যক্তিকে বলা হয়, যে কর্মজীবি নয় , যার কোন সম্পদ নেই। ইমাম আবু হানিফা সহ অন্যান্য আহলুর রায়গণ বলেন-الفقير أحسن حالا من المسكين ومن الناس মিসকীন অপেক্ষা ফকীরের অবস্থা উত্তম। মুলকথা হলো, এ পর্যায়ের লোকদেরকে যাকাতের খাত থেকে সাহায্য করা যাবে। এ খাতটি অতীব গুরুত্বপূর্ণ বলে আল্লাহ ৮টি খাতের মধ্যে সর্ব প্রথমে উল্লেখ করেছেন। আর আরবী বাচনিক রীতি আছে, সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ের কথা সর্বপ্রথম বলা। ২. অভাবগ্রস্থ মিসকীন ( المسكين) : মিসকীন বলা হয় যার এমন পরিমাণ সম্পদ আছে যাদ্বারা তার ওপর নির্ভরশীল লোকদের প্রয়োজন পূরণে যথেষ্ট নয়। মুহাম্মদ আলী সাবুনী বলেন, মিসকীন সেই যার কোন কিছুই নেই। আবার কেউ কেউ বলেন, মিসকীন সে যার কিছু সম্পদ আছে কিন্তু লজ্জা সম্মানের ভয়ে কারো কাছে হাত পাতে না যারা। তারা জীবন-জীবিকার জন্য প্রানান্তকর প্রচেষ্টা করার পরও প্রয়োজন মত উপার্জন করতে পারেন না। এতকিছুর পরও নিজের কষ্টের কথা কাউকে বলতে পারেন না। হাদিসে মিসকীনের পরিচয়ে বলা হয়েছে: «الذى لا يجد غنى يغنية ولا يفطن له فيصدق عليه ولا يقوم فيسأل الناس» যে ব্যক্তি তার প্রয়োজন অনুযায়ী সম্পদ পায় না আর না তাকে বুঝতে বা চিনতে পারা যায়, যার জন্য লোকেরা তাকে আর্থিক সাহায্য করতে পারে। আর না সে লোকদের কাছে কিছু চায়। আল-ফাতওয়া আল-হিন্দিয়ায় বর্ণিত আছে, মিসকীন এমন ব্যক্তিকে বলা হয়, যার কিছুই নেই, যে মানুষের কাছে হাত পাতে বেড়ায় এবং খোরাক-পোশাকের জন্য অন্যের মুখাপেক্ষী হয়। এ প্রসঙ্গে মুহাম্মদ (সা.) এর হাদিস উল্লেখযোগ্য, তিনি বলেন, সেই লোক মিসকীন নয়, যাকে একটি বা দুটি খেজুর অথবা দু-এক লোকমা খাবারের লোভ দ্বারে দ্বারে ঠেলে নিয়ে বেড়ায়। বরং মিসকীন সে যে কারো কাছে চায় না। এ সম্পর্কে জানতে হলে কুরআনের এ আয়াত পাঠ কর, তারা মানুষকে আগলে ধরে সাহায্য চায় না। যেসব লোকদের প্রয়োজন অনুযায়ী সম্পদ যাকাতের খাত থেকে দিতে হবে। এ প্রসঙ্গে বর্ণিত আছে হযরত ওমর (রা) বলেন إذا أعطيتم فأغنوا যখন দিবেই, তখন ধনী বানিয়ে দাও সচ্ছল বানিয়ে দাও। উপরে বর্ণিত দুটি খাতকে সর্বাগ্রে উল্লেখ করাতে এ কথাই প্রমাণিত হয় যে, আল্লাহ সুবহানাহু তাআলা দারিদ্র দুর করা ও ফকীর মিসকীনদের অর্থনৈতিক নিরাপত্তা বিধানই যাকাত ব্যবস্থার প্রথম ও প্রধান লক্ষ্য। আর যাকাতের আসল উদ্দেশ্যই তাই। ৩. যাকাত বিভাগের কর্মচারী (العامل): যারা যাকাত আদায়কারী, সংরক্ষণকারী, পাহারাদার, লেখক, হিসাব রক্ষক এবং তার বণ্টনকারী এদের সবাইকে যাকাতের ফান্ড থেকে বেতন দিতে হবে। তবে এমন যেন না হয় যে, আমিলদের পারিশ্রমিক দিতে গিয়ে যাকাতের কোন অর্থ অবশিষ্ট না থাকে, সে ক্ষেত্রে তাদেরকে আদায়কৃত যাকাতের অর্ধেকের বেশী দেয়া যাবে না। আল্লাহ তাআলা এ ব্যবস্থা এজন্য করেছেন, যেন তারা মালের মালিকদের থেকে অন্য কিছু গ্রহণ না করেন। বরং এটা আসলে রাষ্ট্রের রাষ্ট্রীয় দায়িত্বের আওতায় পড়ে। রাষ্ট্রই এর যাবতীয় ব্যবস্থাপনা, গঠন ও পরিচালনা করবে। এসব লোককে নিয়োগও দিবে রাষ্ট্র। এ ক্ষেত্রে কর্মচারীদের নিযুক্তির শর্তাবলী অন্যতম হচ্ছে: ক) তাকে মুসলিম হতে হবে; খ) পূর্ণ বয়স্ক ও সুস্থ্য বিবেকসম্পন্ন হতে হবে; গ) যাকাতের বিধান সম্পর্কে ইলম থাকতে হবে; ঘ) আমানতদারী ও কাজের যথেষ্ট যোগ্যতা থাকতে হবে; ঙ) স্বাধীন মুসলিম নিয়োগ করতে হবে, ক্রীতদাস নয়। ৪. যাদের চিত্ত আকর্ষণ করা হয় তাদের জন্য (مؤ لفة القلوب) : ইসলামের জন্য যাদের মন আকর্ষণ করা প্রয়োজন কিংবা ইসলামের ওপর তাদের সুপ্রতিষ্ঠিত রাখার জন্যে এমন লোকদের যাকাতের খাত থেকে প্রদান করা। মুয়াল্লাফাতুল কুলুব কারা তা নির্ণয়ে ফকীহ ও আলিমদের মতামত হচ্ছে: ইমাম যুহরী বলেন: المؤلفة من أسلم من يهودى أو نصرانى وإن كان غنيا যে ইয়াহুদী বা খৃষ্টান ইসলাম কবুল করবে, সে-ই এর মধ্যে গণ্য, সে যদি ধনী হয় তবুও। ইমাম কুরতুবী বলেন, وهم قوم كانوا في صدر الإسلام ممن يظهر الإسلام يتألفون يدفع سهم من الصدقة اليهم لضعف يقينهم তাদেরকে মুয়াল্লাফাতুল কুলুব বলা হয়, যারা ইসলামী যুগে প্রকাশ্যভাবে ইসলাম গ্রহণ করেছে, কিন্তু ইসলামের প্রতি তাদের বিশ্বাস দুর্বল হওয়ায় যাকাতের অর্থ দিয়ে তাদেরকে ইসলামের প্রতি অনুরক্ত করা। মুহাম্মদ আলী সাবুনী বলেন, هم قوم من أشرف العرب أعطاهم رسول الله صلى الله عليه وسلم ليتألف قلوبهم على الإسلام মুয়াল্লাফাতুল কুলুব হলেন, আরবদের উচ্চ মর্যাদাশীল ব্যক্তিত্বদের বিশ্বনবী মুহাম্মদ (সা.) ইসলামের দিকে তাদের হৃদয় জয় করার নিমিত্তে উপঢৌকন প্রদান করতেন। এ শ্রেণীর লোকদের কয়েকটি পর্যায়ে আছে, যেমন: ক) এমন লোক যাকে অর্থ-সম্পদ দিলে সে বা তার গোত্র বা বংশের লোকেরা ইসলাম কবুল করবে বলে আশা করা যায়। যেমন এ রকম অনেক ঘটনা হাদিসে বর্ণিত হয়েছে। খ) নতুন ইসলাম কবুলকারী লোকেরা, তাদেরকে যাকাতের খাত থেকে প্রদান। যে অন্য ধর্মের লোক সে যখন ইসলাম কবুল করবে, সেই এর মধ্যে গণ্য । সে যদি ধনী হয় তবুও তাকে এ ফান্ড থেকে দেয়া যাবে। গ) দুর্বল ঈমানের লোকেরা, এমন লোক যাদেরকে অর্থ প্রদান করলে ঈমান দৃঢ় ও শক্তিশালী হবে এবং কাফিরদের সাথে জিহাদে তাদের থেকে বেশী আনুকুল্য পাওয়া যাবে। মহানবী (সা) এ শ্রেণীর লোকদেরকে যুদ্ধে প্রাপ্ত গণীমাতের মাল বেশী বেশী প্রদান করতেন। ফলে তারা ইসলামী আদর্শে আরো দৃঢ়তা ও অনুকরণীয় আদর্শে পরিণত হয়েছিলেন। ঘ) কাফির বা অন্য ধর্মের লোক। যাকে অর্থ উপহার দিলে তারা গোত্র বা বংশের লোকেরা ইসলাম কবুল করবে বলে আশা করা যায়। এ প্রসঙ্গে হাদিসে বর্ণিত হয়েছে, মহানবী হযরত মুহাম্মদ (সা.) সাফওয়ান ইবন উমায়্যাহকে হুনাইন যুদ্ধে প্রাপ্ত গণীমাতের মাল থেকে প্রদান করেছিলেন। অথচ সে সময়ে তিনি মুশরিক ছিলেন। সাফওয়ান বলেন, মহানবী (সা.) এরূপভাবে আমার প্রতি তার দানের হাত সম্প্রসারিত করতে লাগলেন অবশেষে তিনি আমার কাছে সবচেয়ে ভাল মানুষ হিসেবে পরিগণিত হলেন। পরবর্তীতে তিনি মহানবী (সা.) এর মহানুভবতায় মুগ্ধ হয়ে ইসলাম কবুল করেছিলেন বলে জানা যায়। ঙ) শত্রু পক্ষের প্রতিবন্ধকতা ও শত্রুতা থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্যে এমন শ্রেণীর লোক যার দুষ্কৃতির ভয় করা হয়, সীমান্তে অমুসলিম শত্রু দেশের আক্রমণ প্রতিরক্ষা ও মুসলিম সমাজকে রক্ষা করতে পারে এমন লোক, তাদেরকে যাকাতের ফান্ড থেকে অর্থ প্রদান করা। ৫. দাসমুক্তির জন্য (الرقاب) : যে ক্রীতদাস তার মালিককে অর্থ প্রদানের বিনিময়ে মুক্তিলাভের জন্য চুক্তিবন্ধ হয়েছে। এখানে এ পর্যায়ে মুসলিম যুদ্ধবন্ধীও এ খাতের আওতায় পড়বে। কাযী ইবনুল আরাবী বলেন, মুসলিম দাসকে যখন মুক্ত করতে যাকাতের খাত থেকে দেয়া যাবে, ঠিক তেমনি মুসলিম বন্দীকে কাফিরদের দাসত্ব শৃঙখলা ও লাঞ্ছনা থেকে মুক্ত করার কাজে যাকাতের অর্থ ব্যয় করা অধিক উত্তম বলে বিবেচিত হবে। এ বিষয়ে বিখ্যাত তাফসীরকারক সাইয়্যেদ রশীদ রিযা বলেন, فى الرقاب বলে যাকাতের যে ব্যয় খাতটি নির্দিষ্ট করা হয়েছে তাকে পরাধীন গোত্র ও জাতিসমূহকে মুক্ত করার কাজে ব্যবহার করা যাবে। ৬. ঋণভারাক্রান্তদের জন্য (الغارمون) : এমন ব্যক্তি যে ঋণভারাক্রান্ত অবস্থায় নিপতিত, তাকে যাকাতের ফান্ড থেকে সাহায্য করা। তবে যে কোন অসৎ কাজে বা অপব্যয়ের কারণে ঋণভারাক্রান্ত হয়েছে তাওবা না করা পর্যন্ত যাকাতের ফান্ড দেয়া যাবে না। আবার ঋণভারাক্রান্ত এর পর্যায়ে যেমন জীবিত ব্যক্তি শামিল, তেমনি মৃত্যু ব্যক্তিও এর আওতায় পড়ে। মৃতব্যক্তি যিনি ঋণ রেখে মারা গিয়েছেন। ইমাম কুরতুবী (রা.) তাই বলেছেন। ইবনুল হুমাম বলেছেন, গারিমুন হচ্ছে সে সমস্ত লোক যাদের উপর ঋণের বোঝা চেপে আছে অথবা লোকদের নিকট পাওনা আছে কিন্তু তারা তা আদায় করছে না, তাকে গারিমুন বলার প্রচলন আছে। আল্লাহর পথে: আল্লাহর পথ বলতে আকীদা বিশ্বাস ও কাজের দিক দিয়ে আল্লাহর সন্তুষ্টি পর্যন্ত পৌছিয়ে দেয় যে পথ, তাই আল্লামা রশীদ আহমদ বলেছেন, فى سبيل الله ইসলামী শাসন পুন:প্রতিষ্ঠার চেষ্টা প্রচেষ্টার কাজই ফী সাবিলিল্লাহর খাত। অর্থাৎ ইসলামী জীবন বিধান পুন:প্রতিষ্ঠার জন্যে সর্বাত্মক চেষ্টা প্রচেষ্টা চালানো, যেখানে ইসলামী আইন বিধান বাস্তবায়িত হবে, মুসলিম সভ্যতার পুনরাভ্যুদয়, মুসিলম উম্মতের পুনজার্গরণ, ইসলামী আকীদা বিশ্বাস, আচার-আচরণ, শরীয়াত, চরিত্র ইত্যাদি সবকিছু পুরামাত্রায় কার্যকর হবে। ইবনুল আসীর বলেন, فى سبيل الله এর অর্থ এমন কার্যক্রমকে বুঝায় যা খালিস নিয়্যাত আল্লাহর নৈকট্য লাভের উদ্দেশ্যে হয়ে থাকে, তা ফরজ নফল ও বিভিন্ন ধরনের ইবাদত বন্দেগীকে বুঝায়। জালালুদ্দিন সুয়ুতী বলেন, فى سبيل الله এর অর্থ যারা জিহাদের কাছে নিয়োজিত আছে। সলফে সালেহীনদের মতে ফী সাবিলিল্লাহ আল্লাহর দ্বীনের প্রচার, প্রতিষ্ঠা ও ইসলামী দেশষমূহের প্রতিরক্ষার জন্য পরিচালিত প্রচেষ্টা সাধনা ও সামগ্রিক তৎপরতাকে বুঝায়। এখানে فى سبيل الله অর্থ স্বশস্ত্র সংগ্রামকে বুঝানো হয়েছে। ইসলাম বিরোধী শক্তি তাদের চেষ্টা সাধনা ও অর্থ শক্তি দ্বারা লোকদেরকে আল্লাহর পথে চলার বাধাদানে নিয়োজিত হলে বিত্তশালী মুসলিমদের কর্তব্য হবে তাদের শক্তি, সামর্থ ও অর্থ দ্বারা কুফরী শক্তি প্রতিরোধকারীদের সাহায্য করা। তাই এরূপ সাহায্য করাই ফরজ যাকাতের একটি অংশ নির্দিষ্ট করা হয়েছে। মূলত আল্লাহর পথের পর্যায় ও স্তর অনেক। যেসব কাজের নির্দেশনা কোরান ও হাদিসে বর্ণিত হয়েছে, তা সবই এর আওতায় পড়বে। ওলামায়ে কিরামদের বিশ্লেষণে জিহাদের কয়েকটি পর্যায়ের অন্যতম হচ্ছে: এক. দাওয়াত ইলাল্লাহ, আল্লাহর পথে আপামর মানুষকে দাওয়াত দেয়া। যুগে যুগে সকল নবী রাসুলগণ তাদের সমসাময়িক জনগণকে আল্লাহর পথে দাওয়াত দিয়েছেন। তারা বলেছেন يَٰقَوۡمِ ٱعۡبُدُواْ ٱللَّهَ مَا لَكُم مِّنۡ إِلَٰهٍ غَيۡرُهُ #রالأعراف:59 অর্থ হে আমার সম্প্রদায়! আল্লাহর ইবাদত কর, তিনি ব্যতিত তোমাদের অন্য কোন ইলাহ নেই। দাওয়াত ইলাল্লাহর কর্মকৌশল, দাওয়াত প্রদানের কাঙিখত মান এবং পরিণতি সম্পর্কে আল্লাহ বলেন: ٱدۡعُ إِلَىٰ سَبِيلِ رَبِّكَ بِٱلۡحِكۡمَةِ وَٱلۡمَوۡعِظَةِ ٱلۡحَسَنَةِۖ وَجَٰدِلۡهُم بِٱلَّتِي هِيَ أَحۡسَنُۚ إِنَّ رَبَّكَ هُوَ أَعۡلَمُ بِمَن ضَلَّ عَن سَبِيلِهِۦ وَهُوَ أَعۡلَمُ بِٱلۡمُهۡتَدِينَ # النحل:125 তুমি মানুষকে তোমার প্রতিপালকের পথে আহবান কর হিকমত ও সদুপদেশ দ্বারা এবং তাদের সাথে তর্ক করবে উত্তম পন্থায়। তোমার প্রতিপালক তার পথ ছেড়ে কে বিপদগামী হয়, সে সম্বন্ধে সবিশেষ অবহিত এবং সৎ পথে আছে তাও তিনি সবিশেষ অবহিত। দুই. নিজেকে সত্যের সাক্ষ্য হিসেবে পেশ করা। আল্লাহ বলেন: কথায় কে উত্তম ঐ ব্যক্তির চেয়ে যে আল্লাহর প্রতি মানুষকে আহবান করে, সৎকর্ম করে এবং বলে আমি তো অনুগতদের অন্তর্ভুক্ত। তিন. জিহাদ ফী সাবিলিল্লাহ: আল্লাহর বাণী, وَجَٰهِدُواْ فِي ٱللَّهِ حَقَّ جِهَادِهِۦۚ # الحج:78 আল্লাহর পথে যেভাবে জিহাদ কর আল্লাহর পথে যেভাবে জিহাদ করা উচিত। ৮. মুসাফিরদের জন্য: এমন যার নিজ আবাসস্থলে সম্পদ আছে, কিন্তু সফরে সে বিপদগ্রস্থ ও নি:স্ব তাকে যাকাতের তহবিল থেকে সাহায্য করা। তবে সে সফর পাপের কাজের বা অনুরূপ পর্যায়ের কোন সফর হওয়া যাবে না। আল্লামা তাবারী মুজাহিদ সূত্রে বর্ণনা করেছেন যে, যাকাতের সম্পদ ধনী হওয়া সত্ত্বেও এ ধরনের নি:স্ব পথিকের একটি হক রয়েছে। যদি সে তার নিজের ধন-সম্পদ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে। মুসাফিরদেরকে খোরাক-পোশাকের ব্যয় এবং লক্ষ্যস্থল পর্যন্ত পৌঁছার জন্য যা প্রয়োজন অথবা তার ধন-মাল পথিমধ্যে কোথাও থাকলে তা যেখানে রয়েছে, সে পর্যন্ত পৌঁছার খরচ যাকাতের ফান্ড থেকে দিতে হবে। কতুটুকু পরিমাণ দিতে হবে এ ব্যাপারে দুটি মত পাওয়া যায়। এক: যাতায়াত ও অবস্থানের প্রয়োজনীয় খরচ ছাড়া অতিরিক্ত দেয়া যাবে না। দুই. প্রয়োজনের অতিরিক্ত গ্রহণ করা তার বৈধ হবে। যাকাত না দেয়ার কঠোর শাস্তি যাকাত দিবে না কিংবা অস্বীকারকারীদের কঠোর ও ভয়াবহ শাস্তির ভয় প্রদর্শন করা বর্ণিত হয়েছে হাদিসে। এখানে ভয় প্রদর্শনের মূলে চেতনাহীন মন মানসে চেতনা সৃষ্টি এবং লোভী ও স্বার্থপর মানুষকে দানশীল বানানোর উদ্দেশ্যে নিহিত আছে। মানবতার বন্ধু মুহাম্মদ (স.) যাকাত দানে উৎসাহ প্রদান ও ভয় প্রদর্শনের মাধ্যমে লোকদেরকে কর্তব্য পালনে উদ্বুদ্ধ করেছেন। পরকালীন শাস্তি যাকাত প্রদান না করলে তার ভয়াবহ শাস্তি বর্ণনায় কুরআনের ভাষ্য: وَٱلَّذِينَ يَكۡنِزُونَ ٱلذَّهَبَ وَٱلۡفِضَّةَ وَلَا يُنفِقُونَهَا فِي سَبِيلِ ٱللَّهِ فَبَشِّرۡهُم بِعَذَابٍ أَلِيمٖ ٣٤ يَوۡمَ يُحۡمَىٰ عَلَيۡهَا فِي نَارِ جَهَنَّمَ فَتُكۡوَىٰ بِهَا جِبَاهُهُمۡ وَجُنُوبُهُمۡ وَظُهُورُهُمۡۖ هَٰذَا مَا كَنَزۡتُمۡ لِأَنفُسِكُمۡ فَذُوقُواْ مَا كُنتُمۡ تَكۡنِزُونَ # التوبة:34-35 আর যারা স্বর্ণ ও রৌপ্য পুঞ্জীভুত করে এবং তা আল্লাহর পথে ব্যয় করে না, তাদেরকে মর্মন্তুদ শাস্তির সংবাদ দাও। যে দিন জাহান্নামের অগ্নিতে তা উত্তপ্ত করা হবে এবং তা দ্বারা তাদের ললাট, পার্শ্বদেশ ও পৃষ্ঠদেশে দাগ দেয়া হবে, সেদিন বলা হবে এটাই তা যা তোমরা নিজেদের জন্য পুঞ্জীভুত করতে। সুতরাং তোমরা যা পুঞ্জীভুত করেছিলে তা আস্বাদন কর। ٱلَّذِينَ يَبۡخَلُونَ وَيَأۡمُرُونَ ٱلنَّاسَ بِٱلۡبُخۡلِ وَيَكۡتُمُونَ مَآ ءَاتَىٰهُمُ ٱللَّهُ مِن فَضۡلِهِۦۗ وَأَعۡتَدۡنَا لِلۡكَٰفِرِينَ عَذَابٗا مُّهِينٗا # النساء:37 যারা কৃপণতা করে এবং মানুষকে কৃপণতার নির্দেশ দেয় এবং আল্লাহর নিজ অনুগ্রহে তাদেরকে যা দিয়েছেন তা গোপন করে, আর আমি আখিরাতে কাফিরদের জন্য লাঞ্ছনাদায়ক শাস্তি প্রস্ত্তত করে রেখেছি। এ ব্যাপারে শাস্তির ভয়াবহতা হাদিসে বর্ণিত আছে: عَنْ أَبِي هُرَيْرَةَ رَضِيَ اللَّهُ عَنْهُ، قَالَ: قَالَ رَسُولُ اللَّهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ: "مَنْ آتَاهُ اللَّهُ مَالًا، فَلَمْ يُؤَدِّ زَكَاتَهُ مُثِّلَ لَهُ مَالُهُ يَوْمَ القِيَامَةِ شُجَاعًا أَقْرَعَ لَهُ زَبِيبَتَانِ يُطَوَّقُهُ يَوْمَ القِيَامَةِ، ثُمَّ يَأْخُذُ بِلِهْزِمَتَيْهِ - يَعْنِي بِشِدْقَيْهِ - ثُمَّ يَقُولُ أَنَا مَالُكَ أَنَا كَنْزُكَ، ثُمَّ تَلاَ: (لَا يَحْسِبَنَّ الَّذِينَ يَبْخَلُونَ) " الآيَةَ আবু হুরায়রা (রা) হতে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেন, আল্লাহ যাকে ধন-মাল দিয়েছেন, সে যদি তার যাকাত আদায় না করে, তা হলে কিয়ামতের দিন তা একটি বিশধর অজগরের যার দুচোখের উপর দুটো কালো চি‎হ্ন রয়েছে রূপ ধারণ করবে। বলবে, আমিই তোমার ধন-মাল, আমিই তোমার সঞ্চয়। অত:পর রাসুল (সা.) এর আয়াতটি তেলাওয়াত করলেন, আর আল্লাহ নিজ অনুগ্রহে যা তোমাদেরকে দিয়েছেন তাতে যারা কৃপণতা করে, তাদের জন্য এটা মঙ্গল, এটা যেন তারা মনে না করে। না এটা তাদের জন্য অমঙ্গল। যাতে তারা কৃপণতা করবে কিয়ামতের দিন সেটাই তাদের গলায় বেড়ী হবে। আসমান ও জমিনের স্বত্বাধিকারী একমাত্র আল্লাহরই। তোমরা যা কর আল্লাহ তা বিশেষভাবে অবগত আছেন। , সহিহ মুসলিমে বর্ণিত আছে: عَنْ زَيْدِ بْنِ أَسْلَمَ، أَنَّ أَبَا صَالِحٍ ذَكْوَانَ، أَخْبَرَهُ أَنَّهُ سَمِعَ أَبَا هُرَيْرَةَ، يَقُولُ: قَالَ رَسُولُ اللهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ: «مَا مِنْ صَاحِبِ ذَهَبٍ وَلَا فِضَّةٍ، لَا يُؤَدِّي مِنْهَا حَقَّهَا، إِلَّا إِذَا كَانَ يَوْمُ الْقِيَامَةِ، صُفِّحَتْ لَهُ صَفَائِحُ مِنْ نَارٍ، فَأُحْمِيَ عَلَيْهَا فِي نَارِ جَهَنَّمَ، فَيُكْوَى بِهَا جَنْبُهُ وَجَبِينُهُ وَظَهْرُهُ، كُلَّمَا بَرَدَتْ أُعِيدَتْ لَهُ، فِي يَوْمٍ كَانَ مِقْدَارُهُ خَمْسِينَ أَلْفَ [ص:681] سَنَةٍ، حَتَّى يُقْضَى بَيْنَ الْعِبَادِ، فَيَرَى سَبِيلَهُ، إِمَّا إِلَى الْجَنَّةِ، وَإِمَّا إِلَى النَّار » قِيلَ: يَا رَسُولَ اللهِ، فَالْإِبِلُ؟ قَالَ: «وَلَا صَاحِبُ إِبِلٍ لَا يُؤَدِّي مِنْهَا حَقَّهَا، وَمِنْ حَقِّهَا حَلَبُهَا يَوْمَ وِرْدِهَا، إِلَّا إِذَا كَانَ يَوْمُ الْقِيَامَةِ، بُطِحَ لَهَا بِقَاعٍ قَرْقَرٍ، أَوْفَرَ مَا كَانَتْ، لَا يَفْقِدُ مِنْهَا فَصِيلًا وَاحِدًا، تَطَؤُهُ بِأَخْفَافِهَا وَتَعَضُّهُ بِأَفْوَاهِهَا، كُلَّمَا مَرَّ عَلَيْهِ أُولَاهَا رُدَّ عَلَيْهِ أُخْرَاهَا، فِي يَوْمٍ كَانَ مِقْدَارُهُ خَمْسِينَ أَلْفَ سَنَةٍ، حَتَّى يُقْضَى بَيْنَ الْعِبَادِ، فَيَرَى سَبِيلَهُ إِمَّا إِلَى الْجَنَّةِ، وَإِمَّا إِلَى النَّارِ» আবু হুরায়রা (রা) হতে বর্ণিত, রাসুল (সা.) বলেছেন, স্বর্ণ ও রৌপ্যের যে মালিকই তার উপর ধার্য হক আদায় করে দেবে না, কিয়ামতের দিন সেগুলোকে তার পার্শ্বে ঝুলন্ত অবস্থায় রেখে দেয়া হবে। পরে তার উপর জাহান্নামের আগুনে তাপ দেয়া হবে, সে উত্তপ্ত বস্ত্ত দ্বারা তার পার্শ্ব, ললাট ও পৃষ্ঠে দাগ দেয়া হবে; সে দিন যার সময়কাল ৫০ হাজার বছরের সমান দীর্ঘ। শেষ পর্যন্ত লোকদের মাঝে চূড়ান্ত ফায়সালা করা হবে। পরে তাকে তার পথ দেখানো হবে। হয় জান্নাতের দিকে নতুবা জাহান্নামের দিকে। গরু বা ছাগলের মালিকও যদি তার উপর ধার্য হক আদায় না করে, তাহলে কিয়ামতের দিন তা নিয়ে আসা হবে, সেগুলো নিজেদের দুভাবে বিভক্ত পায়ের খুর দিয়ে মালিককে লাথি মারবে এবং তার শিং দ্বারা তাকে গুঁতোবে যখনই তার উপর অপরটি এসে যাবে, প্রথমটি প্রত্যাহার করা হবে। শেষ পর্যন্ত আল্লাহ তাআলা কিয়ামতের দিন তার বান্দাদের মধ্যে চূড়ান্ত ফায়সালা করবেন, যে দিনের সময়কাল তোমাদের গণনামতে ৫০ হাজার বছরের সমান। পরে তাকে তার পথ দেখানো হবে, হয় জান্নাতের দিকে নতুবা জাহান্নামের দিকে। যাকাত না দেয়ার বৈষয়িক শাস্তি আল্লহার নির্দেশিত এ হুকুম যাকাত না দিলে বৈষয়িক শাস্তির বিষয় বর্ণিত হয়েছে: মহানবী মুহাম্মদ (সা.) বলেন, যে লোকেরা যাকাত দিতে অস্বীকার করবে, আল্লাহ তাদের কঠিন ক্ষুধা ও দুর্ভিক্ষে নিমজ্জিত করে দিবেন। অপর একটি হাদিসে বর্ণিত আছে, ওদের ধন-মালের যাকাত দিতে অস্বীকার করে আকাশ থেকে বৃষ্টিপাত বন্ধ করিয়েছে মাত্র। কেবল জন্তু জানোয়ারের কারণেই তাদের বৃষ্টিপাত হয়। শরীয়াতসম্মত শাস্তি যাকাত দিতে অস্বীকারকারীদের জন্য শরীয়াতসম্মত শাস্তির কথাও হাদিসে বর্ণিত হয়েছে। ইসলামী রাষ্ট্রের রাষ্ট্রপ্রধান বা প্রশাসক এ শাস্তি কার্যকর করবেন। রাসুল (সা.) বলেছেন-যে লোক সাওয়াব পাওয়ার আশায় যাকাত দিবে সে তার সাওয়াব অবশ্যই পাবে। আর যে তা দিতে নারাজ হবে, আমি তা অবশ্যই গ্রহণ করব তার ধন-মালের অংশ থেকে। তা হচ্ছে আমাদের রব-এর বহু সুনিদিষ্ট সিদ্ধান্তের অন্যতম। মুহাম্মদ (সা) এর বংশধরের লোকদের পক্ষে তা থেকে কিছু গ্রহণ করা হালাল নয়। আবু বকর রাষ্ট্রপ্রধান অবস্থায় যাকাত অস্বীকারকারীদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করেন। হাদিসে বর্ণিত হয়েছে: عَنْ أَبِي هُرَيْرَةَ، قَالَ: لَمَّا تُوُفِّيَ رَسُولُ اللَّهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ وَاسْتُخْلِفَ أَبُو بَكْرٍ بَعْدَهُ، وَكَفَرَ مَنْ كَفَرَ مِنَ العَرَبِ، قَالَ عُمَرُ لِأَبِي بَكْرٍ: كَيْفَ تُقَاتِلُ النَّاسَ؟ وَقَدْ قَالَ رَسُولُ اللَّهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ: « أُمِرْتُ أَنْ أُقَاتِلَ النَّاسَ حَتَّى يَقُولُوا: لاَ إِلَهَ إِلَّا اللَّهُ، فَمَنْ قَالَ: لاَ إِلَهَ إِلَّا اللَّهُ عَصَمَ مِنِّي مَالَهُ وَنَفْسَهُ، إِلَّا بِحَقِّهِ وَحِسَابُهُ عَلَى اللَّهِ »، فَقَالَ: وَاللَّهِ لَأُقَاتِلَنَّ مَنْ فَرَّقَ بَيْنَ الصَّلاَةِ وَالزَّكَاةِ، فَإِنَّ الزَّكَاةَ حَقُّ المَالِ، وَاللَّهِ لَوْ مَنَعُونِي عِقَالًا كَانُوا يُؤَدُّونَهُ إِلَى رَسُولِ اللَّهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ لَقَاتَلْتُهُمْ عَلَى مَنْعِهِ، فَقَالَ عُمَرُ: «فَوَاللَّهِ مَا هُوَ إِلَّا أَنْ رَأَيْتُ اللَّهَ قَدْ شَرَحَ صَدْرَ أَبِي بَكْرٍ لِلْقِتَالِ، فَعَرَفْتُ أَنَّهُ الحَقُّ» রাসুল (সা.) বলেন, আমি লোকদের বিরুদ্ধে লড়াই করার জন্য আদিষ্ট হয়েছি, যতক্ষণ না তারা লা-ইলাহা ইল্লাল্লাহু-এর সাক্ষ্য দিবে। তারা যদি তা করে তাহলে তাদের রক্ত তথা জান ও মাল আমার নিকট নিরাপত্তা পেয়ে গেল। তবে ইসলামের অধিকার আদায়ের জন্য কিছু করার প্রয়োজন হলে তা তাদের উপর বর্তাবে। হযরত আবু বকর(রা) যাকাত অস্বীকারকারীদের বিরুদ্ধে হুংকার দিয়ে বলেন, অবশ্যই আমি যুদ্ধ- লড়াই করবো যদি কেউ সালাত ও যাকাতের ব্যাপারে পার্থক্য সৃষ্টি করে। কেননা যাকাত মালের হক। আল্লাহর কসম, যদি কেউ একটি ছাগল ছানা দিতে অস্বীকৃতি জানায় যা তারা রাসুল (সা.) এর যামানায় দিত, তাহলেও আমি তাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ লড়াই করবো। যেসব মালে যাকাত ফরজ হয় ১. পশু ও জন্তু সম্পদের যাকাত: উষ্ট্রের সংখ্য ৫-৯ টি হলে =১টি ছাগী, আবার ১০-১৪ টি হলে =২টি ছাগী এবং ১৪-১৯টি পর্যন্ত =৩টি ছাগী। এভাবে পর্যায়ক্রমে গরু-মহিষ কমপক্ষে ৩০টি হলে ১ বছর বয়সী ১টি বাছুর যাকাত ফরজ। তবে শর্ত মালিকানায় একবছর অতিবাহিত হওয়া। ছাগল ও ভেড়া কমপক্ষে ৪০টি হতে ১২০টিতে ১টি ছাগী, ১২১টি হতে ২০০টি পর্যন্ত ২টি ছাগী এভাবে বাণিজ্যিক উদ্দেশ্যে ঘোড়া ও উট পালন করলে তার যাকাত আদায় করতে হবে। ২. স্বর্ণ ও রৌপ্যের যাকাত: সাড়ে সাত ভরি পরিমাণ স্বর্ণ বা এর তৈরি অলংকার, রৌপ্য সাড়ে বায়ান্ন ভরি বা এর অলংকার অথবা স্বর্ণ-রৌপ্য উভয়ই থাকলে উভয়েরই মোট মূল্য সাড়ে বায়ান্ন ভরি রৌপ্যের সমান হলে, তার বাজার মূল্য ২.৫% হারে যাকাত দিতে হবে। ৩. ব্যবসায় পণ্যের যাকাত: ব্যবসায়ের মজুদ পণ্যের মূল্য সাড়ে বায়ান্ন ভরি রৌপ্যের মূল্যের বেশী হলে তার উপর ২.৫% হারে যাকাত দিতে হবে। ৪. কৃষি সম্পদের যাকাত: কৃষির উৎপন্ন ফসলের ক্ষেত্রে এ যাকাত আদায় করতে হবে তার নাম ওশর। এ ক্ষেত্রে নিসাব হলো, সেচবিহীন জমির ফসলের শতকরা ১০ ভাগ এবং সেচপ্রদানকৃত জমির ফসলের শতকরা ২০ অংশ। আবার নিসাব পরিমাণ ২৬ মন ১০ সের মতান্তরে ৩০ মন না হলে ওশর দিতে হবে না। ৫. মধুর যাকাত: ৫ অসাকের মূল্য হিসেবে মধুর নিসাব ধার্য হবে। অর্থাৎ ৬৫৩ কিলোগ্রাম হলে তাতে ওশর দিতে হবে। ৬. খনিজ ও সামুদ্রিক সম্পদের যাকাত: খনিজ ও সামুদ্রিক সম্পদে এক-পঞ্চমাংশ যাকাত দিতে হবে। ৭. নগদ টাকা ও মজুদ সম্পদের যাকাত: নগদ টাকা বা মজুদ ব্যবসায়িক পণ্যের মূল্য সাড়ে বায়ান্ন ভরি রৌপ্যের মূল্যামানের বেশী হলে তার ওপর শতকরা ২.৫% হারে যাকাত দিতে হবে। যে সব সম্পদের যাকাত দিতে হয় না নিসাবের কম পরিমান সম্পদ, নিসাব বছরের মধ্যেই অর্জিত ও ব্যয়িত সম্পদ ব্যবহার্য সামগ্রী শিক্ষা উপকরণ, ঘর-বাড়ী, দালান-কোঠা যা বসবাস কিংবা কলকারখানা হিসেবে ব্যবহৃত যন্ত্রপাতি ও সাজ সরঞ্জাম ব্যবহার্য যানবাহন ব্যবহার্য পশু, ওয়াকফকৃত সম্পত্তি পোষা পাখি ও হাঁস মুরগী। আর্থ-সামাজিক উন্নযনে যাকাতের ভূমিকা আর্থ-সামাজিক উন্নয়নে যাকাতের ভূমিকা অপরিসীম। ড. হাম্মুদাহ আবদালাতি এ প্রসঙ্গে বলেন, জরুরী পরিস্থিতিতে যাকাতের রেটের কোন সীমারেখা নেই। যে যত বেশী দান করবে সবার জন্য ততই মঙ্গলজনক। বিভিন্ন তহবিল গঠনে যে প্রচারণা চালানো হয় যাকাত তাদের সব লক্ষ্যই পুরণ করে। মহান রাববুল আলামীন, মানবতার বন্ধু মুহাম্মদ (সা.) খুলাফায়ে রাশেদীনসহ সকল ইমাম ও ইসলামী চিন্তাবিদ যাকাতের ব্যাপারে বারবার তাগিদ দিয়েছেন। যার ফলশ্রুতিতে বলা যেতে পারে যাকাত আদায় করা আমাদের জন্য অপরিহার্য করণীয় কাজ এবং আর্থ সামাজিক উন্নয়নের চালিকা শক্তি যাকাত। যে ব্যাপারে কোন সন্দেহ ও সংশয়ের অবকাশ নেই। যাকাত আর্থ-সামাজিক উন্নয়নের চালিকা শক্তি। আর্থ-সামাজিক উন্নয়নের অর্থ ক্ষুধা-দারিদ্র, সন্ত্রাস-নৈরাজ্য, চাঁদাবাজী, দুর্নীতি, হতাশা, শ্রেণী বৈষম্য, অসহনশীলতা, অনৈক্য, দুশ্চিন্তামুক্ত, পারস্পারিক সহযোগিতা সহমর্মিতা এবং কল্যাণ কামনার বুনিয়াদে সকল সামাজিক শ্রেণী বৈষম্য দূর হয়ে সাম্য মৈত্রী ভ্রাতৃত্ব কল্যাণময়তা বিরাজ করে। পরস্পর এগিয়ে আসে একে অপরের দুঃখ দুর্দশা মোচন করতে। ধনী দরিদ্রের বৈষম্য দূর করে ভ্রাতৃত্ব ও ভারসাম্যমূলক এই সামাজিক ব্যবস্থার নাম আর্থ-সামাজিক উন্নয়ন। যে সমাজ আমাদের কাছে স্বপ্নের সোনার হরিণ, আজকের আধুনিক ধনতান্ত্রিক বিশ্ব যে সমাজের কথা কল্পনাও করতে পারে না, সে সমাজ উপহার দিয়েছে ইসলাম এখন থেকে আরো প্রায় পনের শত বছর আগে। খুন, রাহাজানি, হত্যা-কলহ, সুদ, ক্ষুধা, দারিদ্র, অন্যায়-অবিচার, অনৈতিকতা, শ্রেণী বৈষম্য, যিনা ব্যাভিচার, হত্যা ধর্ষণসহ সব অন্যায় অসামাজিক কাজ ছিল যে সমাজের অলংকার, সে শতধাবিভক্ত সমাজকে বিশ্বনবী মুহাম্মদ (সা) স্বপ্নের সোনালী সমাজে পরিণত করেছিলেন ইসলাম নামক শান্তির নির্ঝরণীয় মাধ্যমে। যাকাত ছিল যে সমাজের সকল আর্থ-সামাজিক উন্নয়নের রূপকার। নিম্নে আর্থ-সামাজিক উন্নয়নের যাকাতের উল্লেখযোগ্য ভূমিকার বিবরণ বর্ণনা করার প্রচেষ্টা করব, ইনশাল্লাহ। ১. দুশ্চিন্তামুক্ত সমাজ গঠন : এ কথা আজ অবিসংবাদিত সত্য যে, যাকাত ব্যবস্থার মাধ্যমে জাতি সম্পূর্ণরুপে দুশ্চিন্তামুক্ত হতে পারে। একটি সুখী, সুন্দর ও উন্নত সামাজিক পরিবেশ সৃষ্টির জন্য বিত্তশালী মুসলিমদের অবশ্যই তাদের সম্পদের একটি অংশ দরিদ্র ও অভাবগ্রস্থদের দুর্দশা মোচনের জন্য ব্যয় করতে হবে। এর ফলে যে শুধু অসহায় এবং দুস্থ মানবতারই কল্যাণ হবে তা নয়, সমাজে আয় বন্টনের ক্ষেত্রে বৈষম্য অনেকখানি হ্রাস পাবে। কোন ব্যক্তির কাছে অর্থ-সম্পদ নেই; যাকাত তাকে অর্থের যোগান দেবে, মৃত্যুর পরে তার পরিবার পরিজন ও সন্তানদের লালন-পালন করবে, বেকার, অক্ষম, বিকলাঙ্গ, রুগ্ন ও বিধবাদের সম্মানজনক জীবন যাপনের নিশ্চয়তা দেবে। এর সহজ সরল সমীকরণ এ যে, আজ এক ব্যক্তি বিত্তবান আছে বিধায় সে অন্যদেরকে সাহায্য করবে। কারণ কাল সে যদি অভাবী হড়ে পড়ে, তখন অন্যরা তাকে সহযোগিতা করবে। মারা গেলে স্ত্রী, সন্তান, সন্ততির অবস্থা কি হবে সে চিন্তারও কোন দরকার নেই। কারণ তার দায়িত্বও যাকাত ব্যবস্থার সফরে টাকা শেষ হয়ে গেলে কি হবে? এ চিন্তা থেকেও মুক্তি দেবে যাকাত। এক্ষেত্রে সমাজের একজন সদস্যের দায়িত্ব হলো সে তার সম্পদের অতিরিক্ত অংশ হতে একট নির্দিষ্ট পরিমাণ যাকাত ফান্ডে দিয়ে রাখবে যাতে এ অর্থ তার দুঃসময়ে রক্ষা করতে পারে। এভাবে যদি কোন ব্যক্তির জীবনে অর্থ চিন্তা না থাকে, ক্ষুধার চিন্তা না থাকে, তার স্ত্রী, সন্তান-সন্তুতির দারিদ্রের ভয় না থাকে, তাহলে সম্পূর্ণরূপে হতাশামুক্ত সমাজ গঠিত হবে। আর যে সমাজে অর্থ চিন্তা থাকে না, সে সমাজে চুরি, ডাকাতি, হত্যা, লুণ্ঠন, চাঁদাবাজি, আত্মসাৎ, জবরদখল, সুদ-ঘুষসহ সব অনৈতিক কাজ বন্ধ হয়ে যেতে পারে। ২. যাকাত ধনী দরিদ্রের বৈষম্য দূরীকরণে আর্থ-সামাজিক সেতুবন্ধন: প্রকৃতপক্ষে যাকাত ধনী দরিদ্রের বৈষম্য দুর করে ভারসাম্যপূর্ণ সমাজ গঠনে অগ্রণী ভূমিকা পালন করে। ইসলামী নৈতিকতা ও অর্থনৈতিক বিধান মেনে চললে সমাজে কখনও ধনী দরিদ্রের আকাশ চুম্বি পার্থক্য সৃষ্টি হতে পারে না। বর্তমানে শ্রেণী বিভক্ত, বৈষম্যপূর্ণ সমাজ ব্যবস্থার কারণে এক শ্রেণীর লোক সব সময় অবহেলিত। একমাত্র যাকাত ব্যবস্থাই পারে শ্রেণীহিন সমাজ প্রতিষ্ঠা করতে। প্রকৃতপক্ষে যাকাত, সাদকা দান উপঢৌকন, আপ্যায়ন, খাদ্য বিতরন, সালাম বিনিময় এ সকলের মাধ্যমে সম্প্রীতি, ঐক্যবোধ পারস্পারিক সহযোগিতা ও সহমর্মিতা এবং কল্যাণ কামনার বুনিয়াদের সকল বৈষম্য দুর হয়ে সাম্য মৈত্রী ও ভ্রাতৃত্বভিত্তিক কল্যাণময় সমাজ প্রতিষ্ঠিত হয়। তাই ইসলামে সামাজিক বৈষম্য দুর করে সাম্য মৈত্রীর সমাজ প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে যাকাত বিধান এক বিষ্ময়কার ব্যবস্থার নাম। ৩. যাকাত ব্যবস্থায় ধনীদের সম্পদে দরিদ্রের অধিকার: যাকাত ব্যবস্থার মাধ্যমে ধনীদের সম্পদে গরীবদের অধিকার প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে আল্লাহ দারিদ্রমুক্ত সমাজ বিনির্মাণের ব্যবস্থা করেছেন। যাকাত দুস্থ দারিদ্রের প্রতি ধনীদের দয়া বা অনুকম্পা নয় বরং অধিকার। এ প্রসঙ্গে আল্লাহ রাববুল আলামীন বলেন, وَفِيٓ أَمۡوَٰلِهِمۡ حَقّٞ لِّلسَّآئِلِ وَٱلۡمَحۡرُومِ # الذاريات:19 এবং তাদের সম্পদে রয়েছে অভাবগ্রস্থ ও বঞ্চিতদের হক। অন্যত্র বলা হয়েছে ধনীদের যা প্রদান করতে বলা হয়েছে তা বদান্যতা নয়, বরং গরীবদের অধিকার حق অধিকার হিসেবেই তা গরীবদের নিকট ফেরত আসা উচিত। বস্ত্তত গরীবরাই তাদের শ্রম দ্বারা জাতীয় সম্পদ সৃষ্টি করে। ৪. অভাব, দুর্দশা, ক্ষুধা ও দারিদ্রমুক্ত সমাজ গঠনে যাকাত: যাকাতের সর্বশ্রেষ্ঠ উপহার দারিদ্র বিমোচন, যা সামাজিক নিরাপত্তার মূল চালিকা শক্তি। যাকাত বন্টনের ৮টি খাতের মধ্যে ৪টি খাতই (ফকির, মিসকিন, দাসমুক্তি, ঋণগ্রস্থ) সর্বহারা, অসহায়, অভাবগ্রস্থ জনগোষ্ঠীর জন্য নিবেদিত। এছাড়া নও মুসলিমের খাতটাও বিভিন্ন অবস্থার প্রেক্ষিতে এর মধ্যে আসতে পারে। ওমর (রা.) মিসকিনের খাতটিকেও সম্প্রসারিত করে বেকার বা কর্ম-সংস্থানহীনদেরকেও এর অন্তর্ভুক্ত করেন। অথচ এর ১২০০ বছর পরে উইলিয়াম বেভারিজ এটাকে কল্যাণ নীতির অন্তর্ভুক্ত করেন। এছাড়া অষ্টম খাতটিও সামাজিক অভাবে পতিতদের জন্য। এর দ্বারা বুঝা যায় দারিদ্র দূর করাই যাকাতের মূল লক্ষ্য। শাহ ওয়ালী উল্লাহ দেহলভী (রহ) এর কথায় শুনা যায় তারই প্রতিধ্বনি। তিনি বলেন, Zakat has been ordained to serve two purposes; self discipline and provision against social destitution. অর্থাৎ যাকাত দুটি লক্ষ্যে নিবেদিত আত্মশৃঙ্খলা অর্জন ও সামাজিক দারিদ্র নিরসন। বিংশ শতাব্দির বিশিষ্ট ইসলামী চিন্তাবিদ ও সমাজ বিজ্ঞানী ড. হাম্মুদাহ আব্দালাতি বলেন, Zakat mitigates to a minimum the suffering of the ready and poor members of society. It is a most comforting conslation to the less fortunate people. Yet it is a loud appeal to everybody to rool up his sulves and improve his lot. যাকাত দরিদ্র জনগোষ্ঠীর দুঃখ কষ্ট নিবারণ করে। এটি অভাবীদের জন্য স্বস্তি ও ভাগ্যোন্নয়নের শ্রেষ্ঠ উপায়। দুঃস্থ, অভাবগ্রস্থ, মানুষের সমাধানে যাকাতই সবচেয়ে বড় হাতিয়ার। যাকাত অভাবগ্রস্থকে পর্যাপ্ত পরিমাণে দিতে হবে যাতে সে আর অবভাগ্রস্থ না থাকে। কোন কোন ফকীহ মত প্রকাশ করেছেন যে, যাকাত গ্রহীতাকে এক বছরের প্রয়োজন পুরণ করে দিতে হবে। কেউ কেউ আবার সারা জীবনের প্রয়োজন পুরণ করে দেওয়ার কথাও বলেছেন। উমার (রা) বলেছেন যখন দিবেই তখন স্বচ্ছল বানিয়ে দাও। দারিদ্র মানুষের পয়লা নম্বরের দুশমন। যে কোন সমাজ ও দেশের জন্য এটা জটিল ও তীব্র সমস্যা। সমাজের হতাশা ও বঞ্চনার অনুভুতির সৃষ্টি হয় দারিদ্রের মাধ্যমে। পরিণামে দেখা দেয় মারাত্মক সামাজিক সংঘাত। এ সমস্যা সমাধানের জন্য যাকাত ইসলামের অন্যতম মুখ্য হাতিয়ার হিসেবে বিবেচিত হয়ে আসছে ইসলামের সোনালী যুগ থেকে। মহানবী (সা.) বলেছেন, তোমরা দরিদ্র লোকের সাথে বন্ধুত্ব স্থাপন করো। তাদের প্রতি সাধ্যমত অনুগ্রহ ও উপকার করো। আখিরাতের পথে তারা তোমাদের জন্য সংগৃহীত ধন এবং প্রধান সম্বল। কিয়ামতের দিন আল্লাহ রাববুল আলামিন দরিদ্রের প্রতি আদেশ করবেন যে, পৃথিবীতে যারা তোমাদের এক লোকমা অন্ন এবং এক ঢোক পানি দান করেছে, এক প্রস্থ বস্ত্র দান করেছে আজ তোমরা তাদের হাত ধরে জান্নাতে চলে যাও। ওমর (রা) বলেছেন, আমার রাজ্যে ফোরাত নদীর তীরে যদি একটি কুকুরও না খেয়ে মারা যায় তাহলে তার জন্য আমি উমরকে আল্লাহর কাছে আসামির কাঠগড়ায় দাঁড়িযে জবাবদিহি করতে হবে। ৫. যাকাত সম্পদ পবিত্র করে সামাজিক সম্প্রীতি স্থাপন করে: মুসলিম ব্যক্তি আল্লাহর আদেশ পালন ও তাঁর সন্তুষ্টি অর্জনের জন্য যে যাকাত দেয় তা তার নিজের জন্য পবিত্রকারী। এ কাজটিকে যাকাত বলার কারণ হলো এভাবে যাকাতদাতার অর্থসম্পদ এবং তার নিজের আত্মা পবিত্র ও পরিস্কার পরিচ্ছন্ন হয়ে যায়। যে ব্যক্তি আল্লাহর দেয়া অর্থ সম্পদ থেকে আল্লাহর বান্দাদের অধিকার বের করে দেয় না, তার অন্তরে বিন্দুমাত্র কৃতজ্ঞতা নেই। সে সাথে তার আত্মা থেকে যায় অপবিত্র। কেননা আল্লাহ যে তার প্রতি অনুগ্রহ করেছেন এ জন্য তার অন্তরে বিন্দুমাত্র কৃতজ্ঞতা নেই। এ প্রসঙ্গে আল কুরআনের আসছে خُذۡ مِنۡ أَمۡوَٰلِهِمۡ صَدَقَةٗ تُطَهِّرُهُمۡ وَتُزَكِّيهِم তাদের সম্পদ হতে যাকাত (সাদাকা) গ্রহণ করবে, যা দ্বারা তুমি তাদের পবিত্র করবে এবং পরিশোধিত করবে। যাকাত ধনী ব্যক্তিদের সম্পদকে পবিত্র করে। যে পরিমাণ অর্থ সম্পদ যাকাত হিসেবে ধনীদের উপর ফরজ হয় তাতে দাতার কোন নৈতিক ও আইনগত অধিকার থাকে না। এ অর্থ সম্পদ গ্রহীতার অধিকার হিসেবেই চি‎‎হ্নিত হয়। দাতা যাকাত দিতে ব্যর্থ হলে তার অর্থ এ দাঁড়ায় যে তিনি অন্যের সম্পদ বেআইনী ভোগ দখল করছেন। এ বেআইনী সম্পদকে ভোগ দখল করার কারণে তার সব সম্পদ অপবিত্র হয়ে যায়। যাকাত কেবল দাতার সম্পদকে পবিত্র করে না বরং তার হৃদয়কে সুনির্মল ও প্রসারিত করে। তার মন-মানস আত্মকেন্দ্রিক চিন্তা চেতনামূলক হয়ে সমাজ কেন্দ্রিক সঞ্জিবিত হয়। সাথে সাথে সম্পদ লিপ্সা ও স্বার্থপরতা ইত্যাদি দূর হয়। যাকাত প্রাপ্তির ফলে গ্রহীতার মন থেকে ধনীদের প্রতি হিংসা-বিদ্বেষ, দ্বন্দ্ব-সংঘাত, শত্রুতা ও ঘৃণার মানসিকতা দূর হয়ে যায়। যার কারণে সমাজের সর্বস্তরে সম্প্রীতি বিরাজ করে সহমর্মিতা ও সহনশীলতা বৃদ্ধি পায়। ৬. যাকাত মজুদদারী বন্ধ করে অর্থনৈতিক গতিশীলতা বৃদ্ধি করে: যাকাত অর্থ সম্পদ দরিদ্র শ্রেণীর মধ্যে বন্টন করার মাধ্যমে শুধু সুবিচার প্রতিষ্ঠিত হয় না বরং অর্থনৈতিক গতিশীলতা বৃদ্ধি পায়। দরিদ্র মানুষের ক্রয় ক্ষমতা বৃদ্ধির ফলে উৎপাদন ও কর্মসংস্থান বৃদ্ধি পায়। ফলশ্রুতিতে বাজারে কার্যকর চাহিদার পরিমাণ বৃদ্ধি পায়। গতিশীল হয় অর্থনীতি। আমরা যে সমাজে বসবাস করি তার কল্যাণ ও উন্নতির সাথেই আমাদের কল্যাণ ও উন্নতি জড়িত। এ কথা সত্য যে, আপনি যদি আপনার অর্থ সম্পদ হতে আপনার অপরাপর ভাইদের সাহায্য করেন তবে তা আবর্তিত হয়ে বহু কল্যাণ সাথে নিয়ে আপনার কাছেই ফিরে আসবে। কিন্তু, যদি সংকীর্ন দৃষ্টির বশবর্তী হয়ে তা নিজের কাছেই জমা করে রাখেন কিংবা কেবল নিজের ব্যক্তি স্বার্থে ব্যয় করেন তবে শেষ পর্যন্ত তা ক্ষয়প্রাপ্ত হতে বাধ্য। আবার মজুদদারিকে ইসলাম নিষিদ্ধ করেছে। মহানবী (সা.) বলেছেন, যে ব্যক্তি তার অর্থ সম্পদ চল্লিশ দিনের বেশী জমা রাখবে সে জাহান্নামী। মজুদদারীর কারণে বাজারে কৃত্রিম সংকট সৃষ্টি হয় এবং দ্রব্য মূল্য হুহু করে বেড়ে যায়। ইসলাম মজুদ সম্পদের ওপর যাকাত ধার্য করার কারণে অর্থ সম্পদ মজুদ করাকে নিরুৎসাহিত করেছে। ৭. যাকাত ঋণগ্রস্তদের ঋণ পরিশোধের নিশ্চয়তা দেয় প্রাকৃতিক দুর্বিপাক, দুর্ঘটনা বা অন্য কোন কারণে কোন ব্যক্তি যদি তার অর্থ সম্পদ হারিয়ে নিঃস্ব হয়ে যায়, ঋণগ্রস্থ হয়ে যায় তাহলে যাকাত তার ঋণ পরিশোধ করবে, তার হারানো ব্যবসা বা অর্থ সম্পদ ফিরিয়ে আনার জন্য যথাযথ সহযোগিতা করবে। এখানে বলা দরকার যে তারা এমন ঋণগ্রস্থ যে, নিজের অর্থ সম্পদ দিয়ে ঋণ পরিশোধ করলে আর নিসাব পরিমাণ অর্থ নিজের কাছে থাকে না। এমন ব্যক্তি উপার্জনশীল হোক, ফকীর বলে পরিচিত হোক কিংবা ধনী হোক সর্বাবস্থায় তাকে যাকাত থেকে সাহায্য করা যেতে পারে। এ ব্যবস্থার কারণ হলো ইসলাম কখনও কোন ব্যক্তির ওপর যুলুম করে না। ব্যক্তি যখন ধনী ছিল তখন তার অর্থ থেকে রাষ্ট্র উপকৃত হয়েছে আর সে যখন দরিদ্র হয়ে গেছে তখন তাকে ইসলাম ফেলে দেবে? কখনো নয় বরং তার হারানো সম্পদ পুনরুদ্ধারের জন্য যাকাত তার দয়ার ভান্ডারকে উন্মুক্ত করে দেবে। যাকাত আদায়ের আটটি খাতের মধ্যে ঋণমুক্তি তাইতো একটি অন্যতম খাত। এ ব্যাপারে আল্লাহ বলেন: إِنَّمَا ٱلصَّدَقَٰتُ لِلۡفُقَرَآءِ وَٱلۡمَسَٰكِينِ وَٱلۡعَٰمِلِينَ عَلَيۡهَا وَٱلۡمُؤَلَّفَةِ قُلُوبُهُمۡ وَفِي ٱلرِّقَابِ وَٱلۡغَٰرِمِينَ وَفِي سَبِيلِ ٱللَّهِ وَٱبۡنِ ٱلسَّبِيلِۖ فَرِيضَةٗ مِّنَ ٱللَّهِۗ وَٱللَّهُ عَلِيمٌ حَكِيمٞ # التوبة:60 সাদকা তো কেবল নিঃস্ব, অভাবগ্রস্থ ও তৎসংশ্লিষ্ট কর্মচারীদের জন্য, যাদের চিত্ত আকর্ষণ করা হয় তাদের জন্য, দাসমুক্তির জন্য, ঋণভারাক্রান্তদের আল্লাহর পথে ও মুসাফিরদের জন্য। এটা আল্লাহর বিধান। আল্লাহ সর্বজ্ঞ, প্রজ্ঞাময়। ৮. অমুসলিমদের ব্যাপারে যাকাতের নীতি : অমুসলিমদের যাকাতের অর্থ লাভ করতে পারবে কিনা, এ ব্যাপারে আইম্মায়ে কিরামগণ বলেছেন, তা হলো যাকাতের অর্থ অমুসলিমদের দেওয়া যাবে না। কারণ হাদিসে বলা হয়েছে .... যাকাত তোমাদের ধনীদের কাছ থেকে আদায় করা হবে এবং তোমাদের গরীবদের মাঝে বণ্টন করা হবে। এ ব্যাপারে বক্তব্য হলো যাকাত নয় বরং বাইতুলমাল হতে অমুসলিমদের সামাজিক নিরাপত্তার ব্যবস্থা করা হয়। হযরত ওমর (রা.) এক ইয়াহুদীকে ভিক্ষা করতে দেখে বাইতুলমাল হতে তার ভাতার ব্যবস্থা করে দেন। ইমাম আবু ইউসুফ (রহ) তার কিতাবুল খারাজ এর মধ্যে লিখেছেন, হযরত ওমর ফারুক (রা.)এর শাসনামলে ইরাকের হিরাবাসী খ্রিষ্টানদের সাথে যে চুক্তি হয় তাতে লিখিত ছিল যে বৃদ্ধ কর্মক্ষমতা হারিয়ে ফেলেছে কিংবা কোন বিপদে পড়েছে কিংবা পূর্বে ধনী ও স্বচ্ছল ছিল এখন দরিদ্র হয়ে পড়েছে আর সমাজের লোকেরা তাকে ভিক্ষা দিতে শুরু করেছে এরূপ ব্যক্তি যতদিন ইসলামী রাষ্ট্রের নাগরিক থাকবে ততদিন তার ধার্য জিযিয়া প্রত্যাহার হবে এবং মুসলিমদের বায়তুলমাল হতে তার ও তার পরিবারের জীবিকার ব্যবস্থা করা হবে। আসলে যাকাত কেবল মুসলিমদের হক, অমুসলিমরা যাকাত পাবে না। তবে অমুসলিমদেরকে সাধারণ দান খয়রাত অবশ্যিই দেয়া যাবে। ৯. শিক্ষা প্রশিক্ষণ কর্মসূচীতে যাকাতের ভূমিকা : জনশক্তিকে জনসম্পদে পরিণত করার জন্য যাকাতের অর্থ দিয়ে শিক্ষা ও প্রশিক্ষণমূলক অনেক কর্মসূচী বাস্তবায়ন করা সম্ভব। যাকাতের অর্থ দিয়ে গরীব অথচ মেধাবী শিক্ষার্থীদের বই পুস্তক, খোরাক, পোশাক, শিক্ষা উপকরণসহ লিল্লাহবোর্ডিং এ উন্নততর ও গুণগত শিক্ষা প্রশিক্ষণ প্রদানের মাধ্যমে গরীব অথচ মেধাবী শিক্ষার্থীদের দক্ষ জনশক্তি হিসেবে গড়ে তোলে সমৃদ্ধ বাংলাদেশ গড়া যাবে। ১০. উৎপাদন বৃদ্ধিতে যাকাতের ভূমিকা : আল্লাহ প্রদত্ত ও নির্দেশিত যাকাত ব্যবস্থায় অর্থনীতিতে উৎপাদন বৃদ্ধি পায়। যাকাত নিঃস্ব ব্যক্তিদের ভিক্ষার হাতকে কর্মীর হাতে রূপান্তরিত করে। যে কোন উৎপাদন কাজে শ্রমের সাথে পুজির সংযোজন অনস্বীকার্য। মানুষ তার শ্রমের মাধ্যমে বিষ্ময়কর উন্নয়ন ঘটাতে পারে, কাজে লাগাতে পারে অসংখ্য প্রকৃতির সম্পদকে, পারে মরুভূমিকে উর্বর জমিতে পরিণত করতে। তবে এর জন্য প্রয়োজন যন্ত্রপাতি ও হাতিয়ার যা অর্থনীতির ভাষায় পুঁজি দ্রব্য বলা হয়ে থাকে। পুঁজির অভাবে বহু কর্মক্ষম দারিদ্র জনগোষ্ঠী বেকারত্ব জীবন যাপন করছে। যাকাতের মাধ্যমে অর্থ প্রদান করে এই সকল দরিদ্র জনশক্তিকে উৎপাদন কর্মকান্ডে ব্যবহার করে উৎপাদন বাড়ানো সম্ভব।



খ। দ্বিতীয় স্তর: অর্থনৈতিক ও সামাজিক উন্নয়নে যাকাতের ভূমিকা:


জাকাত ইসলামের অন্যতম আর্থিক ফরজ ইবাদত। ইসলামী রাষ্ট্রের অন্যতম অর্থনৈতিক উৎস। জাকাত দরিদ্র, অভাবী ও অক্ষম জনগোষ্ঠীর জন্য যেমন সামাজিক নিরাপত্তার নিশ্চয়তা দেয়, অনুরূপ জাকাত সমাজের অর্থনৈতিক উন্নয়নের হাতিয়ার। জাকাত প্রদানে সম্পদ পবিত্র হয় এবং তাতে প্রাচুর্য আসে।



আল্লাহর পক্ষ থেকে সম্পদের মাঝে বরকতের বারি বর্ষণ হয়। অধিকন্তু জাকাত প্রদানকারীর পরকালীন মুক্তির পথও সুগম হয়। ইসলামী অর্থব্যবস্থায় জাকাতের গুরুত্ব নিম্নে বর্ণনা করা হলো—

১. বায়তুল মাল গঠন : ইসলামী রাষ্ট্রের কোষাগারগুলো কয়েক ভাগে বিভক্ত। এখানে আছে জাকাতসংক্রান্ত বায়তুল মাল, জিজিয়া, উশর ও খারাজ সংক্রান্ত বায়তুল মাল, গনিমত ও খনিজ সম্পদ সংক্রান্ত বায়তুল মাল।



  জাকাত ইসলামী অর্থনীতির মেরুদণ্ড ও চালিকাশক্তি। জাকাত ইসলামী রাষ্ট্রের জাতীয় আয়ের একটি অন্যতম উৎস। এই বায়তুল মালের কাজ হলো, রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থাপনায় রাষ্ট্রের অভাবী, কর্মক্ষম, গরিব, মিসকিন, এতিম, বিধবাসহ অসহায় ও পিছিয়ে পড়া মানুষের অর্থনৈতিক নিরাপত্তার বিধান নিশ্চিত করা। এ ছাড়া রাষ্ট্রের দরিদ্র জনগোষ্ঠীর উন্নয়নে জনকল্যাণমূলক কাজের যাবতীয় খরচ সরবরাহ করা হবে এই বায়তুল মাল থেকে।

তবে তা করতে হবে কোরআনে বর্ণিত খাতগুলোর মধ্যে থেকেই।

২. অর্থনৈতিক ভারসাম্য গঠন : প্রচলিত সমাজ ব্যবস্থায় ধনী-গরিবের মধ্যে বিশাল দেয়াল রয়েছে। তাদের মধ্যে রয়েছে বড় ধরনের অর্থনৈতিক ব্যবধান। আর জাকাতের মাধ্যমেই তা দূর করা সম্ভব। জাকাতের মাধ্যমে ধনী-গরিবের মধ্যে অর্থনৈতিক ভারসাম্য প্রতিষ্ঠা করা যায়।


এ জন্য মহানবী (সা.) জাকাতকে ইসলামের সেতুবন্ধ বলে আখ্যায়িত করেছেন। ইমাম রাজি (রহ.) ধনীর সম্পদের সঙ্গে দরিদ্রের অধিকার সম্পর্কের ক্ষেত্রে কয়েকটি যৌক্তিকতা পেশ করেছেন।

ক. মানুষ যদি তার প্রয়োজন পরিমাণ সম্পদ অর্জন করে, তাহলে তাতে সে-ই বেশি হকদার। কারণ প্রয়োজনের বিচারে সে সব অভাবীর সঙ্গে অংশীদার। ওই সম্পদ অর্জনে প্রচেষ্টাকারী হিসেবে অন্যদের চেয়ে স্বতন্ত্র। সুতরাং ওই সম্পদে তার কর্তৃত্ব অন্যের কর্তৃত্বের চেয়ে বেশি।


খ. মানুষ যখন প্রয়োজনের অতিরিক্ত সম্পদ নিজ ঘরে কুক্ষিগত করে রাখে, তখন সম্পদ সৃষ্টির উদ্দেশ্য ব্যাহত হয়। আর তা আল্লাহর উদ্দেশ্যকে বানচাল করার অপপ্রয়াস। এটি অন্যায়ও বটে। তাই আল্লাহ তাআলা এ থেকে কিছু অংশ দরিদ্রের জন্য বরাদ্দ করার নির্দেশ দিয়েছেন।


গ. দরিদ্র ব্যক্তি আল্লাহর পোষ্য। আর ধনীরা আল্লাহর ভাণ্ডার। কারণ তাদের হাতে যে অর্থ আছে, তা আল্লাহর সম্পদ, তারা এই সম্পদের রক্ষক মাত্র। ইসলাম সুষমভাবে অর্থ-সম্পদের জাকাত নির্ধারণ করেছে। এতে ধনীর প্রচেষ্টা এবং দরিদ্রের অধিকারের প্রতি লক্ষ রেখেছে। এ ক্ষেত্রে ইসলাম ধনীকে নির্মূল করেনি আবার দরিদ্রের অভাবও উপেক্ষা করেনি। (মুশকিলাতুল ওয়া কাইফা আলাজাহা ইসলাম, ড. ইউসুফ কারাজাভি)


৩. সর্বজনীন অর্থনৈতিক নিরাপত্তা : জাকাত মানুষের সর্বজনীন অর্থনৈতিক প্রয়োজন পূরণ করে। মানুষের অর্থনৈতিক নিরাপত্তার বিধান নিশ্চিত করে জাকাত। ইমলামী দর্শনে জাকাত ধনীর কাঁধে গরিবের হক। জাকাতের অর্থ ব্যয়ের আটটি খাত পর্যালোচনা করলে এই সর্বজনীন অর্থনৈতিক নিরাপত্তার দিকটি স্পষ্ট হয়ে ওঠে। যেমন—ফকিরদের সাহায্য ও জীবিকার ব্যবস্থা, মিসকিনদের সাহায্য ও জীবিকার বন্দোবস্ত, দাসমুক্ত করা, ঋণগ্রস্তের পক্ষ থেকে ঋণ আদায়, মুআল্লাফাতুল কুলুব তথা যাদের ইসলাম গ্রহণের প্রতি আশা করা যায় বা ইসলামের প্রতি যাদের দুর্বলতা আছে, তাদের সাহায্য, মুসাফিরদের কল্যাণ এবং আল্লাহর পথে ব্যয় নির্বাহের জন্য জাকাতের অর্থ ব্যয় করা যায়। কোরআনে বর্ণিত এই আটটি খাতকে সম্প্রসারিত করে জাকাতের অর্থ আরো ব্যাপকায়তনে অর্থনৈতিক প্রয়োজন পূরণে কাজে লাগানো যায়।


৪. কর্মসংস্থান সৃষ্টি ও বেকারত্ব দূর করা : জাকাতের অর্থ দিয়ে নতুন নতুন কর্মক্ষেত্র সৃষ্টি করা যায়। জাকাতের অর্থ তা গ্রহণের উপযুক্ত ব্যক্তির মধ্যে বণ্টন করে তাদের পুঁজি সমবায়ের মাধ্যমে একত্র করে তা দিয়ে নানা ধরনের মিল, কলকারখানা ও শিল্পপ্রতিষ্ঠান গড়ে তোলা যেতে পারে। অথবা বেকাররা স্বাবলম্বী হতে পারে—এ পরিমাণ জাকাতের অর্থ প্রদানেরও সুযোগ রয়েছে। ইসলামী রাষ্ট্রে জাকাত তোলার জন্য আলাদা কর্মচারী নিয়োগ দেওয়ার বিধান রয়েছে, যাকে শরিয়তের পরিভাষায় ‘আমিল’ বলা হয়। এর মাধ্যমেও অনেকের কর্মসংস্থান তৈরি হয়।


৫. সম্পদের বৃদ্ধি : জাকাত প্রদানের কারণে সম্পদ কোথাও জমা হয়ে থাকতে পারে না। অগণিত মানুষের হাতে পৌঁছে যায় জাকাতের অর্থ-সম্পদ। তারা তাদের চাহিদা পূরণে তা ব্যবহার করতে পারে এবং তারা প্রাপ্ত অর্থ-সম্পদকে বিভিন্ন জায়গায় বিনিয়োগ করতে পারে। বিনিয়োগের কারণে সম্পদ এক জায়গায় পুঞ্জীভূত হয়ে থাকে না, বরং এর মাধ্যমে সম্পদ বাড়ে। ফলে মানুষের ক্রয়ক্ষমতা বাড়ে। এতে বাজারে চাহিদা বাড়লে উৎপাদনও বাড়ে। আর উৎপাদন বাড়লে কর্মসংস্থানও বাড়ে। ফলে সমাজ থেকে বেকারত্ব ও অভাব দূর হয়। এভাবে জাকাত ইসলামী সমাজে অর্থনৈতিক ব্যবস্থার উন্নতি সাধন করে।


৬. উৎপাদন বৃদ্ধিতে জাকাতের ভূমিকা : সমাজের একটি অংশের হাতে সম্পদ কুক্ষিগত থাকলে উৎপাদনব্যবস্থায় তার নেতিবাচক প্রভাব পড়ে। অসচ্ছলতার কারণে সাধারণ ভোক্তারা পণ্য ক্রয় করতে পারে না। ক্রয়ক্ষমতার অভাবে চাহিদা কমে আর চাহিদার অভাবে উৎপাদন হ্রাস পায়। আর জাকাত প্রদানের কারণে সম্পদের ব্যবহার বাড়ে। গরিব-মিসকিনদের ক্রয়ক্ষমতা বাড়ে। ফলে বাজারে চাহিদা বাড়লে উৎপাদন ও জোগানও বাড়ে। এতে চাহিদা, উৎপাদন ও মুনাফা সব বেড়ে যায়। এভাবে জাকাত ইসলামী সমাজে অর্থনৈতিক ব্যবস্থার উন্নতি সাধন করে।


news_google_icon_128কালের কণ্ঠের খবর পেতে গুগল নিউজ চ্যানেল ফলো করুন


ইসলাম ও মুসলিম বিশ্ব


প্রকাশ: সোমবার, ০৬ নভেম্বর, ২০২৩ ১৪:৩০

পরিবারের ৩৬ সদস্যকে হারিয়ে শোকে মুহ্যমান এক ফিলিস্তিনি নারীর চিঠি

 ড. গাদা আদিল


পরিবারের ৩৬ সদস্যকে হারিয়ে শোকে মুহ্যমান এক ফিলিস্তিনি নারীর চিঠি

গাজা উপত্যকার আল-মাগাজি শরণার্থী শিবিরে ইসরায়েলি হামলায় বেঁচে যাওয়া ব্যক্তিদের সন্ধান করা হচ্ছে। ছবি : এপি


ড. গাদা আদিল তৃতীয় প্রজন্মের একজন ফিলিস্তিনি উদ্বাস্তু এবং প্যালেস্টাইন ফর আলবার্টার সক্রিয় কর্মী। বর্তমানে তিনি কানাডার আলবার্টা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের অতিথি অধ্যাপক হিসেবে কর্মরত। যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনের উদ্দেশে লেখা তাঁর একটি চিঠি আলজাজিরায় প্রকাশিত হয়। পাঠকদের জন্য তা অনুবাদ করেছেন মুহাম্মাদ হেদায়াতুল্লাহ।



 

প্রেসিডেন্ট বাইডেন, ২৬ অক্টোবর বৃহস্পতিবার গাজায় আরেকটি হত্যাযজ্ঞের খবর শুনে আমার ঘুম ভাঙে। এবার ইসরায়েল আমার নিজ পরিবারের সদস্যদের হত্যা করেছে। হত্যাকাণ্ডটি উত্তর অংশের নয়; বরং গাজা উপত্যাকার দক্ষিণ অংশের খান ইউনুস শরণার্থী শিবিরে ঘটেছে, ইসরায়েলি সেনাবাহিনীর তথ্য অনুসারে যে স্থানটি নিরাপদ থাকার কথা ছিল। আমার জন্ম ও বেড়ে ওঠা যে আবাসিক ভবনে ইসরায়েলি বোমাবর্ষণে তা পুরোপুরি ধ্বংসস্তুপে পরিণত হয়েছে।



 

সেদিন এখানকার মানুষ যেন নতুন কোনো ভূমিকম্প অনুভব করেছিল। তারা মানুষের তৈরি ভয়াবহ ভূমিকম্প অনুভব করে। এতে ৪৭ জন পৃথিবী থেকে বিদায় নিয়ে সৃষ্টিকর্তার কাছে ফিরি যায়। তাদের মধ্যে ৩৬ জন আমার পরিবারের সরাসরি সদস্য।


আর বাকিরা তাদের বাড়িতে ‘কথিত’ নিরাপত্তার আশায় আশ্রয় নিয়েছিল। 

জনাব বাইডেন, আড়াই বছর আগে হোয়াইট হাউজে জর্জ ফ্লয়েডের বিচারে দোষী সাব্যস্ত হওয়া প্রসঙ্গে আপনি বলেছিলেন, ‘যথেষ্ট, যথেষ্ট হয়েছে। এই নির্বোধ হত্যাকাণ্ড যথেষ্ট হয়েছে।’ তখন আপনি ব্ল্যাক লাইভস ম্যাটার দাবিতে সোচ্চার হওয়া মানুষের সাধারণ উদ্দেশ্য সম্পর্কে কথা বলছিলেন। আর ওইসব লোক তখন কাঁদছিলেন।


তবে আজ আমার পরিবারের সদস্যদের হত্যা করা হয়েছে; অথচ আপনি স্বীকার করতেও রাজি নন যে এমন কোনো হত্যাকাণ্ড ঘটছে। বরং আপনি ইসরায়েলকে উৎসাহমূলক শব্দ উপহার দিয়ে যাচ্ছেন। আজ আপনি বলছেন, ‘আরো, আরো, এসব অর্থহীন হত্যাকাণ্ড আরো বেশি হোক।’ আর ইসরায়েল আপনার ইচ্ছা পূরণ করতে পেরে খুবই খুশি।


আমেরিকার পুলিশ বাহিনীর হাতে যখন তাদের কেউ নিহত হয় তখন আমেরিকান কৃষ্ণাঙ্গরা ওই নিহত ব্যক্তির নাম উচ্চৈস্বরে বলে সম্মান জানায়। যেহেতু ইসরায়েলি বাহিনী আমার পরিবারকে হত্যা করছে আমি তাদের নাম উচ্চারণ করে তাদের সম্মান জানাতে চাই। 


জনাব বাইডেন, আজ ৭৯ বছর বয়সী আমার নানা নায়েফ আবু শাম্মালা ও তাঁর ৭৬ বছর বয়সী স্ত্রী ফাতিয়াকে হারিয়ে গভীরভাবে শোকাহত।তারা উভয়ে ১৯৪৮ সালে ইসরায়েল প্রতিষ্ঠার সময়ে ফিলিস্তিনিদের জাতিগত নির্মূল অভিযান ‘নাকাবা’ থেকে বেঁচে গিয়েছিলেন। 


ফিলিস্তিনের অন্য ৫৩০টি শহর গ্রামের সঙ্গে গাজার উত্তরে প্রায় ৩০ কিলোমিটার (প্রায় ২০ মাইল) দূরের বেইট দারাস গ্রামটি জাতিগতভাবে ধ্বংস করা হয়। নাকবা থেকে রক্ষা পাওয়া সাড়ে সাত লাখ শরণার্থীর অনেকের মতো ফাতিয়া ও নায়েফ খান ইউনিস শরণার্থী শিবিরে আশ্রয় নেন। নিজ গ্রামে ফেরা পর্যন্ত একমাত্র অস্থায়ী এ শিবিরে তাদের থাকার কথা ছিল। নায়েফ ও ফাতিয়া আর আমাদের মধ্যে নেই। জাতিসংঘ প্রদত্ত নিজ ভূমিতে ফেরার অধিকার প্রয়োগের আগেই তারা মারা গেছে।


বোমা হামলায় নিহদের মধ্যে তাদের তিন মেয়েও রয়েছ। খান ইউনিসের মধ্যে সবচেয়ে সুন্দরী ও হাসিখুশি মুখের অধিকারী আয়েশা ও তার বোন দৌলত যে আমার পরিবারের সবচেয়ে সুন্দরী নারীদের একজন। কয়েকদিন আগে সে সংযুক্ত আরব আমিরাত থেকে পরিবারকে দেখতে এসেছিল। এবং কনিষ্ঠ বোন উমাইমা তার মেয়ে মালাকের সঙ্গে এসেছিল। ক্রমাগত বোমাবর্ষণ থেকে রক্ষা পেতে তারা পরিবারের বাড়িতে ছিলেন। 


নায়েফ ও ফাতিয়ার চার ছেলে হাসান, মাহমুদ, মোহাম্মদ ও জুহাইর এবং তাদের স্ত্রী ফাদিয়া, নিমা ও এশাকেও হত্যা করা হয়। ভাগ্যক্রমে একমাত্র জুহাইরের স্ত্রী বেঁচে যান। কারণ সে অন্য পরিবারের কাছে তাদের মৃতদের জন্য সমবেদনা জানাতে গিয়েছিলেন। নিহতদের মধ্যে হাসানের তিন সন্তান মোহাম্মদ, ইসমাইল ও সালমাও রয়েছে। নায়েফ ও ফাতিয়ার জীবিত ছেলে ইবরাহিম তার বড় ছেলে নায়েফকে হারিয়েছে। দাদার নামে তার নাম রাখ হয়। কেদেয়াহ ও আল্লাহাম পরিবারের সদস্যদের যারা আমার দাদার বাড়িতে আশ্রয় নিয়েছিল তাদের সবাইকেও হত্যা করা হয়েছে।


জনাব বাইডেন, যেন এটুকুই যথেষ্ট ছিল না। আমার দাদির বাড়িতেও বোমা হামলা হয়েছে। তার নাম উম সাইদ। ৯২ বছর বয়সী আমার দাদিও বেইত দারাস থেকে এসেছিলেন। তিনিও ৪৮ সালের নাকবা থেকে প্রাণে বেঁচেছিলেন। তিনি তার মেয়ে নাজাতকে নিয়ে খান ইউনিসের বাড়িতে থাকতেন। উভয়েই এখন ধ্বংসস্তূপের নিচে বিশ্রামের জায়গা খুঁজে পেয়েছেন। মানুষ তাদের লাশ বের করার চেষ্টা করছে তবে পারেনি। তার দুই ছেলে মারওয়ান ও আসাদ এবং মেয়ে মুনার পাশের বাড়িতেও বোমা হামলা হয়।  


মারওয়ান বেঁচে গেলেও তার স্ত্রী সুহায়লা ও চার সন্তান মোহাম্মদ, মাহমুদ, আয়া, শাহদ মারা গেছেন। মুনাও তার দুই ছেলে আমজাদ ও মোহাম্মদের সঙ্গে মারা যান। আসাদ, তার স্ত্রী ইমতিয়াজ এবং তাদের ছেলে মেডিকেলের চতুর্থ বর্ষের ছাত্র আবদুল রহমানও চলে গেছে।


আসাদের বাড়িসহ তার ছোট মুদির দোকান নিশ্চিহ্ন হয়ে গেছে। আমরা দেশে বেড়াতে গেলে আমার ছেলে আজিজের কাছে স্থানটি খুবই প্রিয় জায়গা ছিল। খান ইউনুস শিবিরে আসাদ খুবই ভালো মানুষ হিসেবে পরিচিতি ছিলেন। কারণ তিনি খুবই অল্প মূল্যে জিনিসপত্র বিক্রি করতেন। তার কাছে মোটা খাতা থাকলেও প্রায়ই তিনি বাকির অর্থ সংগ্রহ করতে ভুলে যেতেন কিংবা ক্ষমা করে দিতেন। আজ আসাদের সুন্দর হাসি, তার বিনম্র আচরণ, তার পরিবার, তার দোকান সবই আমাদের কাছ থেকে কেড়ে নেওয়া হয়েছে। 


বোমা বর্ষণের সময় আমাদের অনেক আত্মীয় ও প্রতিবেশী আসাদের দোকানে প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র কিনতে যায়। সে মানুষের ফোন ও ব্যাটারি বিনামূল্যে চার্জ করতে দিতে সৌর বিদ্যুৎ কিনেছিল। তখন অনেকে তার সৌর বিদ্যুৎ ব্যবহার করতে তার দোকানে যায়। এখন সবাই আমাদের ছেড়ে চলে গেছে। নিহতদের মধ্যে আকরাম, রিমন, বৈরুত, ইমাদ, নেইমাসহ আরো কয়েকজন রয়েছে যাদের নাম মনে করতে পারছি না।


জনাব বাইডেন, আপনি কি বিশ্বাস করেন, একজন ইসরায়েলি মায়ের ব্যথা একজন ফিলিস্তিনি মায়ের ব্যথার চেয়ে বেশি আঘাত করে? একজন ইসরায়েলি শিশুর জীবন কি ফিলিস্তিনি শিশুর জীবনের চেয়ে বেশি মূল্যবান? গাজায় শিশুদের গণহত্যাকে উৎসাহিত করতে আপনি এখন যা করছেন আমার কাছে এটিই একমাত্র ব্যাখ্যা।


আমি যখন শিশুদের নিয়ে কথা বলি তখন আমি তাদের নিজস্ব নাম, মুখ, হাসি ও স্বপ্নসহ মানব শিশুদের কথা বলি। আপনার সহযোগিতায় ইসরায়েল চার হাজারের বেশি শিশুর জীবন কেড়ে নিয়েছে, যার মধ্যে নবজাতকও রয়েছে। চার হাজার সুন্দর আত্মাকে আমাদের কাছ থেকে কেড়ে নেওয়া হয়েছে।


তাদের মধ্যে আমার বোনের নাতনি জুলিয়া আবু হুসেন রয়েছে যার বয়স ছিল মাত্র তিন বছর। আমার ভাগ্নে আমজাদ ও তার স্ত্রী রাওয়ান জুলিয়াকে আমার বোন সামিয়ার পরিবারের সঙ্গে নিরাপত্তার খোঁজে খান ইউনিসে নিয়ে যান। গাজার উত্তরে তাদের বাড়ি থেকে সেখানে যেতে তিন দিন লাগে। অথচ তা ৩০ মিনিটেরও কম সময়ের দূরত্বে অবস্থিত। ইসরায়েলি সেনাদের স্থান ত্যাগের আহ্বান শোনা গেলেও তাদের কোনো নিরাপত্তা দেওয়া হয়নি।


বোমাবর্ষণ শুরু হওয়ার পর রাওয়ান জুলিয়াকে নিজ কোলে নিয়ে পরিবারের অন্য সদস্যদের সঙ্গে রান্নাঘরে চলে যায়। ইসরায়েলি বোমায় আমাদের বাড়ি ক্ষতিগ্রস্ত হয়। জানালাগুলো ভেঙে বেশ কিছু টুকরো ঘরে ঢুকে পড়ে। জুলিয়া তার মায়ের কোলে মারা যায়। আর তার খালা নাজাম মারাত্মকভাবে আহত হয়।


জনাব বাইডেন, অতএব এখানে এমন শিশু রয়েছে যার জীবন এমন যুদ্ধের সহিংসতায় কেড়ে নেওয়া হয়েছে যা আপনি আন্তরিকভাবে সমর্থন করেছেন। আপনি কি বিষয়টি কল্পনা করতে পারছেন? আপনি কি সত্যিই এসব ট্র্যাজেডির মাত্রা বুঝতে পারছেন? নাকি আপনি এখনও প্রশ্ন করতে চাচ্ছেন যে ইসরাইল কি ফিলিস্তিনিদের গণহত্যার জন্য দোষী?


গাজায় প্রতিদিন আমার আত্মীয়স্বজন ও বন্ধুদের নিহত হওয়ার কথা শুনছি। আমি নানা উপায়ে মৃত্যুর খবর বর্ণনার চেষ্টা করছি। মারা গেছে, চলে গেছে, তাদের আত্মা জান্নাতে গেছে এমন ভাষায় আমি মৃত্যুর খবর দিচ্ছি। এদিকে মিডিয়া আমাকে বলছে যে তারা হয় মৃত নয়; কিংবা তারা মৃত, তবে তারা সন্ত্রাসী।


গত গ্রীষ্মে গাজায় গেলে আমার দাদি উম সাইদ আমাকে তার এমব্রয়ডারি করা পোশাক দিয়েছিল। তিনি জোরাজুরি করে করেছিলেন যেন আমি তা নিয়ে কানাডায় ফিরি। আমি তার কথা রাখতে পেরে কৃতজ্ঞ। আজ উম সাইদও তার বাড়ির ধ্বংসস্তূপের নিচে পড়ে আছে। তাকে মনে রাখার জন্য আমার কাছে কেবল তার এমব্রয়ডারি করা পোশাকই রয়েছে।


আমি নিশ্চিত, বর্তমানে যা ঘটছে এসব ইতিহাস লেখা হলে আপনি তাতে এমন ব্যক্তি হিসেবে থাকবেন যে ফিলিস্তিনি জনগণের বিরুদ্ধে ইসরায়েলি গণহত্যাকে উৎসাহ দিয়েছে ও শক্তি যুগিয়েছে। আপনাকে এমন একজন হিসেবে স্মরণ করা হবে যার সরকার সক্রিয়ভাবে যুদ্ধাপরাধে অংশ নিয়েছে।


জনাব প্রেসিডেন্ট, আরো গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো, আপনি এমন ব্যক্তি যিনি সৃষ্টিকর্তার ওপর বিশ্বাস রাখেন। সেই হিসেবে আপনার হাতের রক্ত বৈধ করতে প্রার্থনায় আপনি তাঁকে কী বলেন?


 


news_google_icon_128কালের কণ্ঠের খবর পেতে গুগল নিউজ চ্যানেল ফলো করুন


প্রাসঙ্গিক

ইসলাম ও মুসলিম বিশ্ব


প্রকাশ: শুক্রবার, ১৮ আগস্ট, ২০২৩ ১৮:৩০

কোরআন অবমাননার নিন্দা জানাল বার্লিন

 ইসলামী জীবন ডেস্ক


কোরআন অবমাননার নিন্দা জানাল বার্লিন

কোলন মসজিদ, জার্মানি

মুসলিমদের প্রধান ধর্মীয় গ্রন্থ পবিত্র কোরআনের বিরুদ্ধে উসকানিমূলক কাজের নিন্দা জানিয়েছে জার্মান সরকার। এমন কাজকে দেশটি ‘অপমানজনক ও অনুপযুক্ত’ মনে করে বলে জানিয়েছেন জার্মান সরকারের উপমুখপাত্র ক্রিস্টিন হফম্যান। গত ১৬ আগস্ট রাজধানী বার্লিনে আয়োজিত এক সংবাদ সম্মেলনে এসব কথা বলেন তিনি।


তুরস্কভিত্তিক সংবাদমাধ্যম আনাদোলু এজেন্সির এক প্রশ্নের পরিপ্রেক্ষিতে ক্রিস্টিন হফম্যান বলেন, ‘আমরা এ ধরনের কাজকে অসম্মানজনক ও অনুপযুক্ত বলে মনে করি।


তারা সবার মধ্যে বিভাজন তৈরি করতে চায়। আমরা এর বিরুদ্ধে অবস্থান গ্রহণ করেছি। আমরা এর নিন্দা জানাই।’ সংবাদ সম্মেলনে হফম্যান আরো জানান, কোরআন অবমাননার বিষয়ে বার্লিনের অবস্থান অত্যন্ত স্পষ্ট।

তবে বিষয়টি নিয়ে জার্মান চ্যান্সেলর ওলাফ স্কোলজ এবং ডেনিশ প্রধানমন্ত্রী মেটে ফ্রেডেরিকসেনের আসন্ন বৈঠকে আলোচনা হবে কি না তা নিশ্চিত করা যায়নি।

গত কয়েক মাসে সুইডেন, ডেনমার্কসহ উত্তর ইউরোপীয় ও নর্ডিক দেশগুলোতে বারবার পবিত্র কোরআনের কপি পোড়ানো হয়। সর্বশেষ গত ১৪ আগস্ট সুইডেনের রাজধানী স্টকহোমে কোরআনের কয়েকটি পৃষ্ঠা পোড়ানো হয়। বাকস্বাধীনতার অজুহাতে পুলিশের নিরাপত্তায় এ ধরনের ঘটনা ঘটে।


প্রতিবাদে মুসলিম দেশসহ সারা বিশ্ব ক্ষোভে ফুঁসে ওঠে। মিসরের আল-আজহার বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ, অর্গানাইজেশন অব ইসলামিক কো-অপারেশন (ওআইসি) ও মুসলিম ওয়ার্ল্ড লীগসহ মুসলিম দেশগুলো এ ধরনের কর্মকাণ্ডের তীব্র নিন্দা জানায়।

গত ১২ জুলাই এ ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে ধর্মীয় বিদ্বেষ রোধে জাতিসংঘের মানবাধিকার পরিষদে (ইউএনএইচআরসি) একটি প্রস্তাব পাস হয়। সর্বশেষ গত ২৫ জুলাই জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদে ধর্মীয় গ্রন্থের প্রতি সহিংসতার বিরুদ্ধে একটি নিন্দা প্রস্তাব পাস করা হয়। তাতে এ ধরনের ঘৃণ্য কাজকে আন্তর্জাতিক আইন লঙ্ঘনের শামিল বলা হয়।


এর আগে গত ১২ জুলাই কোরআন পোড়ানোর ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে ধর্মীয় বিদ্বেষ রোধে পশ্চিমা দেশগুলোর বিরোধিতার পরও জাতিসংঘের মানবাধিকার পরিষদে একটি প্রস্তাব পাস হয়।

সূত্র : আনাদোলু এজেন্সি


news_google_icon_128কালের কণ্ঠের খবর পেতে গুগল নিউজ চ্যানেল ফলো করুন

প্রাসঙ্গিক

ইসলাম ও মুসলিম বিশ্ব

প্রকাশ: শনিবার, ০১ জুলাই, ২০২৩ ১৫:২৩

রাশিয়ায় কোরআন অবমাননা শাস্তিযোগ্য অপরাধ : পুতিন

রাশিয়ায় কোরআন অবমাননা শাস্তিযোগ্য অপরাধ : পুতিন

সুইডেনে কোরআন অবমাননার নিন্দা জানিয়ে এটিকে অপরাধ বলে মন্তব্য করেছেন রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন। গত ২৯ জুন স্বায়ত্তশাসিত দাগেস্তান অঞ্চলের ডারবেন্ট শহরের একটি প্রাচীন মসজিদ পরিদর্শনকালে তিনি এ কথা বলেন। এ সময় পবিত্র ঈদুল আজহার দিন মুসলিম প্রতিনিধিদের পক্ষ থেকে পুতিনকে পবিত্র কোরআনের একটি কপি উপহার দেওয়া হয়। 


পুতিন বলেছেন, ‘কিছু দেশে কোরআনের অসম্মানকে অপরাধ হিসেবে দেখা হয় না।


তবে রাশিয়ায় তা শাস্তিযোগ্য অপরাধ।’ তার দেশে সংবিধান ও দণ্ডবিধি অনুসারে এ কাজকে অপরাধ হিসেবে মনে করা হয় বলে জানান তিনি। 

তিনি আরো বলেন, ‘কোরআন মুসলিমদের জন্য পবিত্র। অন্যদের কাছেও তা পবিত্র হওয়া উচিত।


আমরা সর্বদা এসব নিয়ম মেনে চলব।’ পবিত্র কোরআন উপহার পেয়ে সংশ্লিষ্টদের প্রতি কৃতজ্ঞতা জানান তিনি। 

গত ২৮ জুন ঈদের দিন রাজধানী স্টকহোমের কেন্দ্রীয় মসজিদের সামনে পবিত্র কোরআন পুড়িয়েছেন সালওয়ান মোমিকা নামের এক ইরাকি অভিবাসী। বাকস্বাধীনতার নামে পুলিশের নিরাপত্তায় তাকে এই ন্যক্কারজনক কাজ করার অনুমতি দেন সুইডিশ আদালত।


 

এরপর গতকাল শুক্রবার পবিত্র কোরআন অবমাননার প্রতিবাদে সুইডেনের সংসদ ভবনের সামনে জুমার নামাজ আদায় করেছেন স্থানীয় মুসলিমরা। 


এদিকে সুইডেনের এ ঘটনায় সৌদি আরব, তুরস্ক, মিসরসহ মুসলিম দেশগুলো নিন্দা জানিয়েছে। তা ছাড়া মার্কিন পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র বেদান্ত প্যাটেল বলেন, ধর্মীয় গ্রন্থ পুড়িয়ে ফেলা অসম্মানজনক ও আঘাতমূলক। এটি বৈধ হলেও যথাযথ না।


সূত্র : টিআরটি ওয়ার্ল্ড 


 





 


news_google_icon_128কালের কণ্ঠের খবর পেতে গুগল নিউজ চ্যানেল ফলো করুন

প্রাসঙ্গিক

ইসলাম ও মুসলিম বিশ্ব

প্রকাশ: শনিবার, ১০ জুন, ২০২৩ ২০:০২

শুধুমাত্র নারী হজযাত্রী ‍নিয়ে ভারতীয় বিমানের প্রথম ফ্লাইট

 ইসলামী জীবন ডেস্ক

শুধুমাত্র নারী হজযাত্রী ‍নিয়ে ভারতীয় বিমানের প্রথম ফ্লাইট

জেদ্দায় ভারতের নারী হজযাত্রীদের ফুল দিয়ে বরণ ‍করা হয়। ছবি : সংগৃহীত

১৪৫ নারী হজযাত্রী নিয়ে ভারতীয় বিমানের একটি ফ্লাইট সৌদি আরব পৌঁছেছে। বিমানের সেই ফ্লাইটে কেবল যাত্রী নয়; বরং চালক ও বিমানবালাসহ সবাই ছিল নারী। গত ‍বৃহস্পতিবার এয়ার ইন্ডিয়া এক্সপ্রেসের হজ ফ্লাইটে প্রথম বারের মতো এমন অভিনব দৃশ্যের অবতারণা ঘটে। সেদিন রাতে দক্ষিণাঞ্চলীয় কেরালা রাজ্যের কোঝিকোড় শহর ছেড়ে আসা বিমানটি জেদ্দায় পৌঁছে।


সৌদি সংবাদ মাধ্যম আরব নিউজ সূত্রে এসব তথ্য জানা যায়। 

বিমানটির পরিচালনায় ছিলেন ক্যাপ্টেন কনিকা মেহরা, ফার্স্ট অফিসার গরিমা পাসি ও চার কেবিন ক্রু। বিমানবন্দরে নারী হজযাত্রীদের বোর্ডিং পাস বিতরণ করেন ভারতের সংখ্যালঘু বিষয়ক মন্ত্রী জন বার্লা। 


আরব নিউজ সূত্রে জানা যায়, এ বছর ভারত থেকে চার হাজার নারী মাহরাম (পুরুষ অভিভাবক) ছাড়াই হজ পালন করতে সৌদি আরবের মক্কা ও মদিনায় যাবেন।


তাদের মধ্যে অধিকাংশ নারীই দেশটির কেরালা রাজ্যের বাসিন্দা। তারা লেডিস উইদাউট মাহরাম ক্যাটাগরিতে হজ পালন করতে সৌদি আরব যাবেন। 

এ বছর ভারত থেকে হজে অংশ নেবেন এক লাখ ৭৫ হাজার জন। কেরালা রাজ্য থেকে সর্বোচ্চ সংখ্যক লোক হজ পালন করবেন।


লেডিস উইদাউট মাহরাম ক্যাটাগরিতে ভারত থেকে এবার রেকর্ড পরিমাণ নারী হজ পালন করবেন। তাই শুধুমাত্র নারী হজযাত্রীদের নিয়ে ১১টি ফ্লাইটের ব্যবস্থা করা হয়। বাকি নারীরা সাধারণ ফ্লাইট করে সৌদি আরব যাবেন। 

কেরালা হজ কমিটির চেয়ারম্যান মোহাম্মদ ফয়েজি বলেন, ভারত থেকে মাহরাম ছাড়া হজ পালন করতে যাওয়া নারীদের অধিকাংশই কেরালা রাজ্যের। এখানকার প্রায় দুই হাজার নারী সৌদি আরব যাবেন।


মূলত এর পেছনে দুটি কারণ রয়েছে। প্রথম এই রাজ্যের অধিকাংশ শিক্ষিত। আরেকটি কারণ হলো, এখানকার নারীরা মধ্যপ্রাচ্য ভ্রমণে অভ্যস্ত। কারণ তারা প্রায়ই মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোতে কর্মরত আত্মীয়স্বজনের সঙ্গে সাক্ষাত করতে সেখানে যান। 

উল্লেখ্য, ২০২১ সালে নারীদের হজ পালনে ‘মাহরাম’ বা পুরুষ অভিভাবকের শর্ত তুলে নেয় সৌদি আরব। ২০২২ সালের অক্টোবরে দেশটির হজ ও ওমরাহ বিষয়ক মন্ত্রী ড. তাওফিক আল-রবিয়াহ আনুষ্ঠানিকভাবে এই শর্ত তুলে নেওয়ার ঘোষণা দেন। এ বছর করোনা-পূর্ব সময়ের মতো বৃহৎ পরিসরে অনুষ্ঠিত হতে যাচ্ছে। তাই বিভিন্ন দেশের নারী হজযাত্রীদের একটি অংশ মাহরাম ছাড়াই হজ পালন করতে সৌদি আরব যাচ্ছেন। 

 ১১. আর্থ-সামাজিক উন্নয়নে যাকাতের আরো কতিপয় পদক্ষেপ : এদেশের তথা সারা পৃথিবীতে অসংখ্য বৃদ্ধ-বৃদ্ধা নিজ পরিবারের গলগ্রহ হয়ে মানবেতর জীবন যাপন করছে। বর্তমান সমাজ ব্যবস্থার কারণে পাশ্চাত্য পরিবার প্রথা প্রায় বিলুপ্ত হওয়ার কারণে বৃদ্ধ বয়সে সেখানকার নারী পুরুষেরা তাদের সন্তান সন্ততি হতে বিচ্ছিন্ন অবস্থায় সরকারের করুনায় বেঁচে থাকে। অথচ যাকাত দিতে পারে তাদের সুন্দর স্বপ্নীল জীবনের নিরাপত্তা। কন্যা দায়গ্রস্থ পিতা অর্থের অভাবে কন্যা বিবাহ দিতে পারে না। এ সমস্ত অক্ষম পিতার কন্যার বিয়েতে যাকাত তার নিজস্ব ফান্ড থেকে অর্থনৈতিক সহযোগিতার মাধ্যমে দিয়ে দিবে। মুসাফিরদের সাহায্য প্রদান, দরিদ্র শিশুদের পুষ্টি সাহায্য, ইয়াতীম প্রতিপালনে ব্যবস্থা গ্রহণ, শীত বস্ত্ত বিতরণ, স্বাস্থ্য সম্মত শৌচাগার, নও-মুসলিম পুর্ণবাসন, ইউনিয়ন মেডিকেল সেন্টার স্থাপন, অসহায় মায়েদের প্রসবকালীন সাহায্য প্রদান, ঋণগ্রস্থ কৃষকদের ঋণ পরিশোধে সহায়তাসহ নানামুখী আর্থ-সামাজিক উন্নয়ন কর্মকান্ডে যাকাত তার সক্রিয় অংশগ্রহণের মাধ্যমে একটি সুখী সমৃদ্ধশালী শান্তির সমাজ কায়েমে অগ্রণী ভূমিকা রাখে। এছাড়া দ্বীনী শিক্ষা অর্জনে সহযোগিতা, ছাত্র-ছাত্রীদের জন্য বৃত্তি, মহিলাদের আত্মকর্মসংস্থানমূলক প্রশিক্ষণ, প্রযুক্তিগত প্রশিক্ষণ, বেকারদের আত্মকর্মসংস্থানের ব্যবস্হা না করা পর্যন্ত ভাতা প্রদান, দুস্থ পরিবারের জন্য গরু-ছাগলসহ অন্যান্য পশু কিনতে সাহায্য দান, গৃহহীনদের গৃহ তৈরী করে দেওয়া, অসহায় গরীব মানুষের গৃহস্থালী আসবাবপত্র ক্রয় করতে সহযোগিতা করাসহ সব প্রকার উন্নয়ন কর্মসূচীতে যাকাতের সরব উপস্থিতিই সুখী সমৃদ্ধশালী দেশ, জাতি,ডিজিটাল সমাজ গড়ার নিশ্চয়তা দিতে পারে। যাকাতের মূল উদ্দেশ্যই তো ক) গরীবের প্রয়োজন পুরণ, খ) ধনীরা তাদের কষ্টোপার্জিত সম্পদকে বিলিয়ে দেয়ার চেতনা ও গ) আল্লাহর নৈকট্য লাভ এ টার্গেট পুরণ করার নিমিত্তেই আর্থ-সামাজিক বহুবিধ পদক্ষেপ নেয়া যেতে পারে। বাংলাদেশের আর্থ-সামাজিক উন্নয়নে যাকাত ব্যবস্থার সফলতার সম্ভাবনা যাকাত ব্যবস্থা বাংলাদেশের আর্থ-সামাজিক উন্নতিতে কাঙ্খিত ভূমিকা রাখার সামর্থ বিষয়ে বলা যায়, এদেশের মেজরিটি পার্সেন্ট দরিদ্র মানুষের আর্থ-সামাজিক উন্নযনের মাধ্যমে তাদের আশা-আকাঙ্খার প্রতিফলন ঘটানোর মতো অর্থনৈতিক যোগান এদেশের বিভিন্ন খাত থাকে যাকাত পর্যাপ্ত পরিমাণে পাবে কিনা বা পাওয়া সম্ভব কিনা সেটা আলোচনার প্রয়োজন। ব্যক্তির হাতে মজুদ নগদ অর্থ, গৃহে বা ব্যাংকে রাখা স্বর্ণালংকার ও গোপনে রাখা ডলার/পাউন্ড বাদে শুধু ব্যাংকে সঞ্চিত মেয়াদি আমানত বা ফিক্সড ডিপোজিটের কথাই উল্লেখ করা যায় যা নূন্যতম এক বছরের জন্য রাখা হয়। বাংলাদেশের সরকারের পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ের অধিনে বাংলাদেশ ব্যুরো অব স্ট্যাটাসটিকস প্রকাশিত “Statistical yearbook of Bangladesh” এর তথ্যানুসারে ১৯৯৫-৯৬ অর্থ বছরে দেশে মেয়াদী সঞ্চয়ের পরিমাণ ছিল নিম্নরূপ: ক. তফসীল ব্যাংকসমূহের সঞ্চয় = ৩১,২৩১.১৭ কোটি টাকা খ. পোষ্টাল সেভিংস সমূহের সঞ্চয় = ০৬,৩২১.৪৭ কোটি টাকা গ. সকারের সঞ্চয় প্রকল্পে = ৬২,২৮৬.৮০ কোটি টাকা সর্বমোট = ৯৯,৮৩৯.৪৪ কোটি টাকা শতকরা ২.৫% যাকাত ধরলে এর যাকাত আসে প্রায় ২,৪৯৬ কোটি টাকা। অনুরূপভাবে এদেশের ছাহিবে নিসাব পরিমাণ ফসলের অধিকারী ব্যক্তিদের কাছ থেকে ওশর আদায় করলে তার পরিমাণ দাঁড়াবে আরো অন্তত: ১,০০০ কোটি টাকার বেশি। সবকিছু বাদ দিলেও দেখা যাচ্ছে শুধু মেয়াদী আমানত এবং ফসলে ওশর থেকে প্রায় ৩৫০০ কোটি টাকা আসা সম্ভব। এছাড়া এখনও অনেকগুলো খাত আছে যেখান থেকে যাকাত আসা সম্ভব। আর এই পরিসংখ্যান হলো এখন থেকে প্রায় এক যুগেরও আগের। বর্তমানে তো এই অর্থের পরিমাণ আরো বেশি আসতে বাধ্য। বাংলাদেশের ১৬ লাখ পরিবার রয়েছে ছিন্নমূল ও ঠিকানাহীন। এছাড়া আরো ৩২ লাখ পরিবার রয়েছে যাদের সামান্য আশ্রয় থাকলেও কোন জমি জমা নেই। এবার যদি প্রতি বছর এদেশের ৫,০৩৫ টি ইউনিয়ন ও পৌর ওয়ার্ড এর মধ্যে ৩৫০০ কোটি টাকা ভাগ করে দেয়া হয় তাহলে প্রতিটি ইউনিয়ন ও পৌর ওয়ার্ড পাবে প্রায় ৬৯ লক্ষ টাকা। এই টাকা হতে ৪০ হাজার করে যদি একেকটি পরিবারকে দিয়ে দেওয়া হয় তাহলে উক্ত পরিবারের স্বাবলম্বী হওয়ার জন্য আর কোন সমস্যা থাকে না। আর প্রতি বছর প্রতিটি পৌর ওয়ার্ড ও ইউনিয়নের ১৫০ জন ব্যক্তি এভাবে টাকা পেয়ে স্বাবলম্বী হতে থাকলে দশ বছরে বাংলাদেশ দারিদ্রমুক্ত হয়ে যাবে। প্রভুত সম্ভাবনাময় আমাদের এ সুজলা সোনার বাংলাদেশ। এখানে আছে প্রাকৃতিক সম্পদের প্রাচুর্য্য, বনজ সম্পদ, পশু সম্পদ, পানি সম্পদ, আর সব চাইতে বড় হলো ১৫ কোটি মানব সম্পদ। কিন্তু, এ সব সম্পদের সুষ্ঠু ব্যবহার না থাকায় বৈষম্যমূলক বণ্টননীতির কারণে সম্পদের অদক্ষ ব্যবহারের ফলে আমরা আস্তে আস্তে অসীম সম্ভাবনা থাকার পরেও প্রতিনিয়ত দারিদ্রের সাথে লড়াই করছি, হাত পাতছি পাশ্চাত্যের কাছে। আর তারা আমাদেরকে ইচ্ছা মতো যতটুকু না ঋণ দিচ্ছে তার চাইতে বেশি দিচ্ছে উপদেশ। যা আমাদের জাতির অস্তিত্বকে সংকটের মুখে দাঁড় করাচ্ছে। তারা আমাদেরকে উপদেশ দিচ্ছে আন্তর্জাতিক ভিক্ষার ঝুলি ম্যালথাসের দেশ উন্নয়নের টেস্ট কেস ইত্যাদি ইত্যাদি। শুধু তাই নয়, বিশ্ব ব্যাংকের বিশেষজ্ঞরা আমাদেরকে আরো বলছে, Success in solving its (Bangladesh) economics problem would be a convincing evidence that no other country in the world need face extreme poverty. অথচ এক সময় এদেশ ছিল পৃথিবীর মানুষের স্বপ্নের আবাসভুমি। শোনা যায় শায়েস্তা খাঁর আমলে টাকায় ৮মন চাউল পাওয়া যেত। বিশ্বের বিভিন্ন দেশকে বাংলাদেশ সহযোগিতা করত। আর আজ; যে দেশের মাটিতে সোনা ফলে, যে দেশের গাছে গাছে দেখা যায় নানান রকম ফুল-ফলের সমাহার, যে দেশের নদী, খাল বিলগুলোতে দেখা যায় রূপালী মাছের সমাহার, যে দেশে আছে ৩০ কোটি হাত; সে দেশের সংসদে বৈদেশিক ঋণ ছাড়া বাজেট পেশ হয় না। বন্যার্তদের সহযোগিতা করা যায় না, নদী-খাল-বিল খনন হয় না। সে দেশের মায়েরা মাত্র দুমুঠো অন্নের জ্বালায়, এক প্রস্থ কাপড়ের জন্য, একটুখানি মাথা গুঁজার ঠাই এর জন্য অসুস্থ সন্তান-সন্তুতি, বাবা মায়ের স্বামীর চিকিৎসার জন্য নিজেদের সতীত্বকে পর্যন্ত বিক্রি করে, নিজের গর্ভজাত সন্তানকে মাত্র ২০০ টাকায় বিক্রি করে দেয়। অথচ বেশি কিছু নয় শুধুমাত্র যাকাত ব্যবস্থার পুঙ্খানুপুঙ্খ অনুসরণের মাধ্যমে ১০ বছর বা আরও কম সময়ের এদেশকে সম্পূর্ণরূপে ক্ষুধা দারিদ্রমুক্ত করা সম্ভব। গৃহহীনের গৃহ, বস্ত্রহীনদের বস্ত্র, ক্ষধার্তকে অন্ন রোগগ্রস্থকে সুস্থতা, ঋণগ্রস্তকে ঋণ পরিশোধের নিশ্চয়তা, বৃদ্ধ, অসহায় বনী আদমকে বেঁচে থাকার নিশ্চয়তা দেওয়ার মাধ্যমে এ দেশকে আর্থ-সামাজিক উন্নতির স্বর্ণ শিখরে আরোহন করতে সক্ষম শুধু ইসলাম প্রদত্ত যাকাত ব্যবস্থা। চুরি-ডাকাতি, ছিনতাই, চাঁদাবাজি খুন-রাহজানি, যিনা-ব্যভিচার, ধর্ষণ-লুণ্ঠন, জোরদখল, টেন্ডারবাজী, আত্মসাৎ, শ্রেণী বৈষম্যসহ সকল প্রকার সমাজ বিধ্বংসী কাজ নিরসনকল্পে সুখী সমৃদ্ধশালী দেশ-জাতি পৃথিবী গঠনে সক্ষম একমাত্র যাকাত ব্যবস্থাই। সমাপনী পরের সুখে হাসব সবাই কাঁদব সবার দুখে, নিজের খাবার বিলিয়ে দিব অনাহারীর মুখে, আপনাকে লয়ে বিব্রত রহিতে আসে নাই কেহ অবনি পরে সকলের তরে সকলে আমরা প্রত্যেকেই আমরা পরের তরে। কবিতায় কবি তার মনের যে অভিব্যক্তি ব্যক্ত করেছেন, মহান রাববুল আলামীন যাকাত ব্যবস্থার মাধ্যমে প্রায় পনের শত বছর পূর্বে মানব মনে সে অনুভূতি জাগ্রত করার কার্যকরী পথ দেখিয়েছেন। সমাজ বিজ্ঞানী ড. হাম্মুদাহ আবদালাতি তাইতো যথার্থই বলেছেন, কুরআনিক শব্দ যাকাত কেবল বদান্যতা দান, সদয়তা, সরকারী কর, ঐচ্ছিক দান ইত্যাদিকেই অন্তর্ভূক্ত করে না, উপরন্ত এটা এসব কল্যাণকামী মন-মানস এবং নৈতিক ও আধ্যাত্মিক চেতনার সুসমন্বিতরূপ। আর এ চেতনার মূলকথা হলো মানুষ মানুষের দুঃখে এগিয়ে আসবে, অন্যের কষ্টতে নিজের কষ্ট মনে করবে, পাওনাদার দেনাদারকে স্বত:স্ফুর্তভাবে ক্ষমা করে দেবে, দরিদ্র অভাবী প্রতিবেশীর দুঃখ দুর্দশা মোচনে এগিয়ে আসবে। তাহলে প্রত্যেক নাগরিক তার জান-মাল পরিবার পরিজন সন্তান-সন্তুতির নিরাপত্তা ফিরে পাবে, যাকাত ব্যবস্থার মাধ্যমে সমাজ থেকে দুর হবে শ্রেণী বৈষম্য, কৌলিন্য ইত্যাদি। একথা সত্য যে, অধিকাংশ সামাজিক অপরাধ সংঘটিত হয় দরিদ্রতার কারণে। এ সমস্যার প্রতিবিধান করার জন্য যাকাত ইসলামের অন্যতম হাতিয়ার হিসেবে বিবেচিত হয়ে আসছে। যাকাতের অর্থসম্পদ প্রাপ্তির ফলে দারিদ্রের জীবন যেমন আনন্দ ও নিরাপদ হয় তেমনি কর্মসংস্থানেরও সুযোগ হয়। ফিরে আসবে আবার সেইদিন, যেদিন হযরত ওমর (রা.) যাকাতের অর্থ দেওয়ার লোক খুঁজে পেতেন না, গহীন রাতে সুন্দরী মহিলা রাস্তা দিয়ে একাকী চললেও সে থাকতো নিরাপদ, প্রত্যেকেই ছিল প্রত্যেকের জীবনের রক্ষাকর্তা, কেউ কারো জন্য মান হানিকর কিছু করা থেকে বিরত থাকত। যে দিনের কথা বলেছেন ড. হাম্মুদাহ আবদালাতি, It is authentically reported that there were times in the history of the Islamic administration when there was no person eligible to receive Zakah. Every subject Muslim, Christian and Jew of the vast Islamic empire had enough to satisfy his needs and the rulers had to deposit the Zakah collections in the public treassury. ইসলামী সোনালী শাসনকালের ইতিহাসে এমন এক সময় ছিল যখন যাকাত নেওয়ার মতো লোক ছিল না। তখন মুসলিম, খ্রিষ্টান, ইয়াহুদী সকল নাগরিক তার অভাব মোচনে সক্ষম ছিল। শাসকবর্গ যাকাতের অর্থ সরকারী কোষাগারে জমা রাখত। এখনও সে পরিবেশ আসতে পারে, যদি যাকাতভিত্তিক অর্থনীতি এবং সুষম বণ্টননীতি নিশ্চিত করা যায়। আল্লাহ তাওফিক দিন। আমীন! 

সূত্র : আরব নিউজ, মো. এনামুল হক- এর যাকাত সংক্রান্ত প্রবন্ধ ও সাইফুল ইসলাম তাওহিদ হাফিজাহুল্লাহু এর প্রবন্ধ হতে সহায়তা নেওয়া হয়েছে।