শবে বরাতের ফজিলত
শাহ মাহমুদ হাসান
মাহে শাবান অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ও ফজিলতপূর্ণ একটি মাস। আর শবেবরাত তথা ১৪ শাবান দিবাগত রাত অত্যন্ত ফজিলতপূর্ণ ও তাৎপর্যপূর্ণ। নবী কারীম (সা.) এ রাতটিকে লাইলাতুন নিসফি মিন শাবান অর্থাৎ শাবানের মধ্যবর্তী রাত বলে আখ্যায়িত করেছেন।
তবে আমাদের সমাজে এ রাত নিয়ে রয়েছে মিশ্র প্রতিক্রিয়া। একটি দল এ রাতকে আলোকসজ্জা, আতশবাজি, হালুয়া-রুটির উপলক্ষ বানিয়ে নিয়েছে। যার সাথে ইসলামের কোন সম্পর্ক নেই। আর একটি দল উপরোক্ত কর্মের বিরোধিতা করতে গিয়ে শবে বরাতের অস্তিত্বকেই অস্বীকার করে বসেছে এবং তারা এ রাতের কোনো বৈশিষ্ট্যই মানে না; বরং এ রাতের সব কিছুকেই বিদআত বলে চালিয়ে দেয়। বাস্তবে এ দলটিও সঠিক অবস্থানে নেই কারণ শবে বরাতের অনেক ফজিলত ও আমলের ব্যাপারে প্রিয় নবী (সা.) উম্মতকে উৎসাহিত করেছেন।
নবী কারীম (সা.) কাছে শাবান মাসের মর্যাদা এত অধিক যে যখন তিনি রজব ও এ শাবান উপনীত হতেন, তখন এই দুই মাসের বরকত প্রাপ্তি ও রমজানকে স্বাগত জানানোর উদ্দেশ্যে আল্লাহর কাছে এই বলে প্রার্থনা করতেন,
اللهُمَّ بَارِكْ لَنَا فِي رَجَبٍ، وَشَعْبَانَ، وَبَلِّغْنَا رَمَضَانَ
‘আল্লাহুম্মা বারিক লানা ফি রাজাবা ওয়া শাবান ওয়া বাল্লিগনা রামাদান’ অর্থাৎ হে আল্লাহ, আপনি রজব ও শাবান মাসে আমাদের বরকত দান করুন এবং আমাদের হায়াতকে রমজান পর্যন্ত বৃদ্ধি করে দেন।
নাসাঈ শরীফের বর্ণনায় এসেছে, নবী কারীম (সা.) শাবান মাসের গুরুত্ব বর্ণনা করতে গিয়ে বলেন,
ذَلِكَ شَهْرٌ يَغْفُلُ النَّاسُ عَنْهُ بَيْنَ رَجَبَ وَشَهْرِ رَمَضَانَ ، تُرْفَعُ فِيهِ أَعْمَالُ النَّاسِ ، فَأُحِبُّ أَنْ لاَ يُرْفَعَ عَمَلِي إِلاَّ وَأَنَا صَائِمٌ
‘রজব ও রমজানের মধ্যবর্তী এ মাস সম্পর্কে লোকেরা গাফেল থাকে; অথচ এ মাসে বান্দার আমল আল্লাহ তায়ালার মহান দরবারে পেশ করা হয়। আমার আমল যখন পেশ করা হয়, তখন রোজা অবস্থায় থাকা আমি পছন্দ করি।’
তাই তিনি প্রায় সমগ্র শাবান মাস জুড়েই রোজা রাখতেন। তিরমিজি শরিফের বর্ণনায় এসেছে হজরত উম্মে সালমা (রা.) বলেন, আমি নাবী কারীম (সা.) কে শাবান ও রমজান ছাড়া দুই মাস একাধারে রোজা রাখতে দেখিনি।
রাসূলে কারীম (সা.) বরাতের রাত জেগে ইবাদাত বন্দেগিতে মাশগুল থাকতেন। হযরত আয়েশা (রা.) বলেন, এক রাতে নবী কারীম (সা.) উঠে নামাজে দাঁড়িয়ে গেলেন, এবং এত দীর্ঘ সময় ধরে সিজদা করলেন যে আমার ভয় হলো তিনি হয়তো মারাই গেছেন। এ চিন্তা করে আমি বিছানা ছেড়ে উঠে রাসুল (সা.) এর বৃদ্ধাঙ্গুলি নাড়া দিই, তার নড়াচড়ার কারণে আমার বিশ্বাস হলো তিনি জীবিত আছেন। তারপর নিজ বিছানায় ফিরে এলাম। এরপর তিনি সিজদা থেকে মাথা উঠালেন এবং নামাজ শেষ করে আমাকে বললেন, হে আয়েশা! তোমার কি ধারণা হয়েছে যে নবী তোমার সঙ্গে সীমা লঙ্ঘন করেছে? আমি বলি, জি না, হে রাসুল! তবে আপনার দীর্ঘ সময় ধরে সিজদার কারণে আমার মনে হয়েছে আপনি হয়তো মৃত্যুবরণ করেছেন। এরপর নবী কারীম (সা.) বললেন, হে আয়েশা! তুমি কি জানো, আজকের এ রাতটি কোন রাত? আমি বললাম, আল্লাহ ও তাঁর রাসুল এ বিষয়ে অধিক জ্ঞাত। নবী কারীম (সা.) ইরশাদ করেন, এ রাতটি শাবানের মধ্যবর্তী রাত। এ রাতে আল্লাহ তায়ালা নিজ বান্দাদের প্রতি বিশেষ করুণার বর্ষণ করেন, অনুগ্রহ প্রার্থীদের দয়া করেন। তবে হিংসুকরা তার দয়া ও অনুগ্রহ প্রাপ্ত হয় না। (বায়হাকী : ৩৮৩৫)।
এ রাতে আল্লাহ তাআলার পক্ষ থেকে রহমত, বরকত ও মাগফেরাতের দ্বার ব্যপকভাবে অবারিত করা হলেও মুশরিক এবং হিংসুক এই ব্যপক রহমত ও সাধারণ ক্ষমা থেকেও বঞ্চিত থাকে। এ ব্যাপারে নবী কারীম (সা.) আরো ইরশাদ করেন,
يطلع الله إلى خلقه في ليلة النصف من شعبان فيغفر لجميع خلقه إلا لمشرك أو مشاحن
শাবানের মধ্যবর্তী রাতে অর্থাৎ ১৪ই শাবান দিবাগত রাতে আল্লাহ তায়ালা সৃষ্টিকুলের প্রতি রহমতের দৃষ্টি দেন এবং মুশরিক ও হিংসুক লোক ছাড়া সবাইকে ক্ষমা করেন। (ইবনে মাজাহ : ১৩৯০)। যারা শাবান মাসের ফজিলতকে একেবারেই অগ্রাহ্য করে তাদের পরম শ্রদ্ধেয় ও গ্রহণযোগ্য নাসীর উদ্দীন আলবানী (রহ.) ও এই হাদিসটিকে সহিহ বা বিশুদ্ধ বলেছেন। (আস-সিলসিলাহ আস-সাহীহাহ : ৩/১৩৫)।
সুতরাং যখন কোন বিশেষ সময়ের ব্যাপারে আল্লাহ তাআলার পক্ষ থেকে এরকম রহমত ও মাগফেরাত আশ্বাস থাকে, তখন সেই সময় নেক আমলের ব্যাপারে যত্নবান হয়ে আল্লাহর রহমত ও মাগফেরাতের পাবার জন্য স্বচেষ্ট হওয়া উচিত।
নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন,
إن الله تبارك وتعالى ينزلُ لَيْلَةَ النِّصْفِ من شعبان إلى سَماءِ الدُّنيا ، فَيَغْفِرُ لأكثرَ من عَدَدِ شعر غَنَمِ كلْب
নিশ্চয়ই আল্লাহ পাক শাবানের ১৫ তারিখ রাত্রিতে পৃথিবীর আকাশে অবতরণ করেন। অতপর তিনি বণী কালবের মেষের গায়ে যত পশম রয়েছে তার চেয়ে বেশী সংখ্যক বান্দাকে ক্ষমা করেন’। (তিরমিযি : ৭৩৯)।
নবী কারীম (সা.) ইরশাদ করেন,
إِذَا كَانَتْ لَيْلَةُ النِّصْفِ مِنْ شَعْبَانَ ، فَقُومُوا لَيْلَهَا ، وَصُومُوا نَهَارَهَا ، فَإِنَّ اللهَ يَنْزِلُ فِيهَا لِغُرُوبِ الشَّمْسِ إِلَى سَمَاء الدُّنْيَا ، فَيَقُولُ : أَلاَ مِنْ مُسْتَغْفِرٍ لِي ، فَأَغْفِرَ لَهُ ، أَلاَ مُسْتَرْزِقٌ ، فَأَرْزُقَهُ ، أَلاَ مُبْتَلًى فَأُعَافِيَهُ ، أَلاَ كَذَا ، أَلاَ كَذَا ، حَتَّى يَطْلُعَ الْفَجْرُ.
'১৫ শাবানের রাত যখন হয়, তোমরা রাতটি ইবাদত-বন্দেগির মধ্যে কাটাও এবং দিনের বেলা রোজা রাখো। কেননা এ রাতে সূর্যাস্তের পর আল্লাহ তায়ালা প্রথম আসমানে এসে বলেন, আছে কি কোনো ক্ষমাপ্রার্থী? আমি তাকে ক্ষমা করে দেব। আছে কি কোনো রিজিক অন্বেষণকারী? আমি তাকে রিজিক প্রদান করব। কে আছে রোগাক্রান্ত? আমি তাকে আরোগ্য দান করব। এভাবে সুবহে সাদিক পর্যন্ত আল্লাহ তায়ালা মানুষের বিভিন্ন অসুবিধা ও প্রয়োজনের কথা উল্লেখ করে তাদের ডাকতে থাকেন।' (ইবনে মাজাহ : ১৩৮৮)।
তাই এ রাতে অতি আবেগ ত্বাড়িত হয়ে অতিরঞ্জিত করার যেমনি কোন সুজোগ নেই তেমনি কোন অজুহাতেই এই রাতে গাফেল থাকা বিবেকবান ইমানদারের কাজ নয়। বরং শবে বরাত ও শবে কদরের মত নেকীর মৌসুম গুলোকে কাজে লাগিয়ে আল্লাহর রেজামন্দি হাসিল করাই মোমিনের একান্ত কর্তব্য।