কুরআন ও বিজ্ঞানে মানবমস্তিষ্কের তথ্য
-ডা: মুহাম্মাদ মাহতাব হোসাইন মাজেদ
কুরআনে কমপক্ষে ১৬ বার আমাদের ব্রেইন বা মস্তিষ্কের কথা বলা হয়েছে। মস্তিষ্কের জন্য কুরআনে যে শব্দটি ব্যবহার করা হয়েছে, তা হলো আলবাব। ‘আলবাব’ শব্দটি (লুব) শব্দের বহুবচন। ইংরেজি লোব ও আরবি লুব শব্দের উচ্চারণ ও অর্থ একই। আমাদের মাথার ভেতরে ডান ও বাম উভয় গোলার্ধ বা হেমিস্ফেয়ারেই চারটি ‘লোব’ থাকে। এগুলো হলো ফ্রন্টাল লোব, প্যারাইটাল লোব, টেম্পোরাল লোব ও অক্সিপিটাল লোব।
১. ফ্রন্টাল লোব : কপালের পেছনেই আছে সেরেব্রাল কর্টেক্সের সম্মুখ অংশ। এটা আমাদের শরীরের বিভিন্ন কার্যক্রমের নিয়ন্ত্রণ করে। ২. প্যারাইটাল লোব : ফ্রন্টাল লোবের ঠিক পেছনেই প্যারাইটাল লোবের অবস্থান। এটা বিভিন্ন ইন্দ্রিয় দ্বারা গৃহীত তথ্যের সমন্বয় সাধন করে। ৩. টেম্পোরাল লোব : এর অবস্থান ফ্রন্টাল আর প্যারাইটাল লোবের নিচের দিকে। এটা ঘ্রাণ ও শ্রবণ, কথা বলা ও দেখা, দীর্ঘস্থায়ী স্মৃতি তৈরির সাথে যুক্ত। ৪. অক্সিপিটাল লোব : একদম পেছনের দিকে থাকে এটা। এই লোব দৃষ্টির সাথে যুক্ত।
এই চার ধরনের লোব বা লুবের সমষ্টিকে ইংরেজিতে লোবগুলো বলে এবং আরবিতে আলবাব বলা হয়। কুরআনে কমপক্ষে ১৬ বার উলিল আলবাব বা মস্তিষ্কের অধিকারীদের কথা বলা হয়েছে। মানুষকে ভালোভাবে শোনা, ভালোভাবে দেখা ও ভালোভাবে স্মরণ করা অর্থাৎ, ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য সত্যকে উপলব্ধি করার জন্য সাধারণত ‘উলুল আলবাব’ শব্দটি ব্যবহার করা হয়েছে। যেমন- আল্লাহ বলেন, যারা মনোনিবেশসহকারে কথা শোনে, অতঃপর যা উত্তম, তার অনুসরণ করে। তাদেরকেই আল্লাহ সৎপথ প্রদর্শন করেন এবং তারাই বুদ্ধিমান বা উলুল আলবাব।’ (সূরা আজ জুমার: ১৮) যে ব্যক্তি জানে যে, যা কিছু পালনকর্তার পক্ষ থেকে আপনার প্রতি অবতীর্ণ হয়েছে তা সত্য সে কি ওই ব্যক্তির সমান, যে অন্ধ? তারাই বোঝে, যারা বোধশক্তিসম্পন্ন বা উলুল আলবাব। (সূরা লোকমান : ১৯)
সুতরাং এটা স্পষ্ট যে, কুরআনে ব্রেইন বা মস্তিষ্কের কথা বলা হয়েছে। আর মস্তিষ্ক মানবদেহের সবচেয়ে জটিল অঙ্গ। এটি আমাদের বিশ্বের প্রতিটি চিন্তা, কর্ম, স্মৃতি, অনুভূতি এবং অভিজ্ঞতা তৈরি করে। এটি প্রায় ১.৪ কিলোগ্রাম ওজনের টিস্যুর মতো, যাতে ১০০ বিলিয়ন স্নায়ুকোষ বা নিউরন আছে। পবিত্র কুরআনে বিবেকের কথা বারবার উল্লেখ করা হয়েছে। শুধু ‘আকল’ তথা ‘বিবেক’ শব্দ থেকে ব্যুৎপন্ন শব্দাবলির ব্যবহার কুরআন মাজিদে প্রায় সত্তরের কাছাকাছি। আর আল্লাহ তায়ালার নিদর্শন নিয়ে চিন্তার প্রতি উদ্বুদ্ধ করা হয়েছে- এমন আয়াতের সংখ্যা অগণিত। ইসলাম চিন্তা ও বিবেককে যেভাবে মূল্যায়ন করেছে, তা বোঝার জন্য এতটুকুই যথেষ্ট- যেকোনো দায়িত্ব অর্পণের ক্ষেত্রে ইসলাম বিবেককেই প্রধান শর্ত ঘোষণা করেছে। তাই পাগল, শিশু বা ঘুমন্ত ব্যক্তিদের জন্য ইসলামের বিধিবিধান স্থগিত রাখা হয়েছে। পাশাপাশি এই মানবমস্তিষ্কের কারণে মানুষকে ‘আশরাফুল মাখলুকাত’ বা সৃষ্টির সেরা জীব ঘোষণা করা হয়েছে। চিন্তাশক্তি কাজে লাগালে সত্য পর্যন্ত পৌঁছা মানুষের জন্য সহজ। তাই জগৎ-প্রকৃতি নিয়ে ভাবার পাশাপাশি ভাবতে হবে নিজেকে নিয়েও। পবিত্র কুরআনে ইরশাদ হয়েছে, ‘আমি (আল্লাহ) অচিরেই তাদের জন্য আমার নিদর্শন ব্যক্ত করব, বিশ্বজগতে এবং তাদের নিজেদের মধ্যে। ফলে তাদের কাছে সুস্পষ্ট হয়ে উঠবে যে তাই সত্য...।’ (সূরা : হা-মিম, আস-সাজদা : ৫৩) যাপিত জীবনের সবকিছু মানবমস্তিষ্ক ধারণ করে এবং সেগুলো নিয়ে বিচার-বিশ্লেøষণ করে। তা চিন্তায় উদ্বুদ্ধ করে মহান আল্লাহ বলেন, ‘... তুমি তাদের কাছে বৃত্তান্ত বিবৃত করো, যাতে তারা চিন্তা করে।’ (সূরা আরাফ, আয়াত : ১৭৬)
মানবমস্তিষ্কের কার্যক্ষমতা কেমন, এ বিষয়ে বিজ্ঞানের ভাষ্য হলো, কেন্দ্রীয় স্নায়ুতন্ত্রের স্ফীত, তরল দ্বারা পূর্ণ গহ্বরযুক্ত ও মেনিনজেস নামক আবরণী দ্বারা আবৃত যে অংশটি করোটির ভেতরে অবস্থান করে তাকে মস্তিষ্ক বলে। ভ্রƒণ অবস্থায় স্নায়ুকাণ্ডের অগ্রবর্তী দণ্ডাকার অংশ ভাঁজ হয়ে পরপর তিনটি বিষমাকৃতির স্ফীতি তৈরি করে। স্ফীতি তিনটি মিলেই গঠিত হয় মস্তিষ্ক। প্রাপ্তবয়স্ক লোকের মস্তিষ্কের আয়তন ১৫০০ ঘন সেন্টিমিটার, গড় ওজন ১.৩৬ কেজি এবং এতে প্রায় ১০০ বিলিয়ন নিউরন থাকে। মস্তিষ্ক মেনিনজেস নামক পর্দা দ্বারা আবৃত। মানুষের মস্তিষ্কের প্রধান তিনটি অংশ। যথা- (ক) গুরুমস্তিষ্ক : মস্তিষ্কের প্রধান অংশ হলো গুরুমস্তিষ্ক। এটি ডান ও বাম খণ্ডে বিভক্ত। এদের ডান ও বাম সেরিব্রাল হেমিস্ফিয়ার বলে। মানবমস্তিষ্কের সেরিব্রাল হেমিস্ফিয়ার অধিকতর উন্নত ও সুগঠিত। (খ) মধ্যমস্তিষ্ক : গুরুমস্তিষ্ক ও পনস-এর মাঝখানে মধ্যমস্তিষ্ক অবস্থিত। মধ্যমস্তিষ্ক দৃষ্টিশক্তি, শ্রবণশক্তির সাথে সম্পর্কযুক্ত। (গ) লঘুমস্তিষ্ক : লঘুমস্তিষ্ক গুরুমস্তিষ্কের নিচে ও পশ্চাতে অবস্থিত। এটা গুরুমস্তিষ্কের চেয়ে আকারে ছোট। লঘুমস্তিষ্ক কথা বলা ও চলাফেরা নিয়ন্ত্রণ করে। এর তিনটি অংশ যথা- সেরিবেলাম, পনস ও মেডুলা।
মানবমস্তিষ্ক প্রায় ১০০ বিলিয়ন স্নায়ুকোষ ধারণ করে এবং সহস্র বিলিয়নেরও বেশি স্নায়ুতন্তু ধারণ করে যাদের বলা হয় সিনোপসিস। এটি এক লাখ ঘটনাকে একসাথে এবং সারা জীবনে কোটি কোটি ঘটনা ধারণ করতে পারে। আর মানুষের মস্তিষ্কে আছে ১০০ বিলিয়নেরও বেশি নিউরন বা নার্ভ সেল। একটি গমের দানার সমপরিমাণ মস্তিষ্ক টিস্যুতে এক লাখের মতো নিউরন থাকে, যেগুলো পরস্পরের সাথে এক বিলিয়ন বন্ধন তৈরি করে। মস্তিষ্কে প্রায় ১০ হাজার রকমের নিউরন রয়েছে। মস্তিষ্কের আদেশ এসব নিউরনের মাধ্যমে বৈদ্যুতিক তরঙ্গের আকারে পৌঁছে। এসব তরঙ্গের গতি ঘণ্টায় ৪০০ কিলোমিটার বা তারও বেশি।
প্রতিদিন মস্তিষ্ক ১২ থেকে ২৫ ওয়াট বিদ্যুৎ উৎপন্ন করে। যা লো ভোল্টেজের এলইডি জ্বালানোর জন্য যথেষ্ট। আর শরীরের যেকোনো অঙ্গের চেয়ে মস্তিষ্কে অনেক বেশি পরিমাণ শক্তি উৎপন্ন হয়। আমরা শরীরের প্রয়োজনে যে খাবার খাই, তার পাঁচ ভাগের এক ভাগই খরচ হয় মস্তিষ্কের শক্তি উৎপাদনের পেছনে। এই খাদ্য ও অক্সিজেন পৌঁছে দেয়ার জন্য ১০৪০-৮০ লিটার রক্ত পরিবাহিত হয় ২৪ ঘণ্টায়। মস্তিষ্কের সুরক্ষা নিশ্চিত করতে মহান আল্লাহ তাতে একটি পর্দা দিয়েছেন, যার নাম ব্লাড-ব্রেইন-ব্যারিয়ার। রক্ত থেকে মস্তিষ্কে কী যাবে, তা নিয়ন্ত্রণ করে এই পর্দা। ক্ষতিকর পদার্থ এই পর্দা ভেদ করে সাধারণত যেতে পারে না। তবে নিকোটিন কিংবা অ্যালকোহলকে বাধা দিতে পারে না সে। হয়তো এ কারণেই মহান আল্লাহ মদ, অ্যালকোহল-সহ সব মস্তিষ্কের জন্য ক্ষতিকারক জিনিস হারাম করেছেন।
মস্তিষ্কের মেমোরি স্পেস নিয়ে গবেষণাতথ্যে নর্থ ওয়েস্টার্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের সাইকোলজির অধ্যাপক ড. পল রেবার উল্লেখ করেছেন, মানুষের মস্তিষ্কে আছে ১০০ কোটি বা এক বিলিয়ন নিউরন। প্রতিটি নিউরন একে অন্যের সাথে গড়ে তুলেছে এক হাজার সংযোগ, যার গাণিতিক সংখ্যা হবে এক ট্রিলিয়নের বেশি। বিজ্ঞানীরা বলছেন, যদি প্রতিটি নিউরন একটি করে মেমোরি ধারণ করে তাহলেও কারো জীবদ্দশায় কখনো মেমোরি স্পেস শেষ হবে না; বরং একেকটা নিউরন অসংখ্য মেমোরি ধারণ করতে সক্ষম। বিজ্ঞানীরা বলছেন, ব্রেইনের মেমোরি ধারণক্ষমতা কমপক্ষে ২.৫ পেটাবাইট অথবা ১ মিলিয়ন জিবি বা ১০ লাখ গিগাবাইট ধারণক্ষমতা রয়েছে মস্তিষ্কের মেমোরি কার্ডের। অন্তত ৩৪২ বছর লাগবে এই মেমোরি কার্ড পূর্ণ হতে। আল্লাহর সৃষ্টির এই বিস্ময়কর রূপ থেকে বিশ্বাসী হৃদয় বলে ওঠে : হে আমাদের রব, তুমি তা নিরর্থক সৃষ্টি করোনি। তুমি পবিত্র। তুমি আমাদের জাহান্নামের আগুন থেকে রক্ষা করো।’ (সূরা আলে ইমরান : ১৯১)
এখন প্রযুক্তির যুগ। প্রতিদিন আমাদের সামনে হাজির হচ্ছে নতুন নতুন শক্তিশালী প্রযুক্তি, যা দেখে আমরা বিস্মিত হই। অথচ আমাদের ভেতরেই মহান আল্লাহ এত বড় বড় বিস্ময় রেখে দিয়েছেন, যা আমরা জানিই না। দুনিয়াতে আমরা যত উন্নত প্রযুক্তি দেখি, এর সবই মহান আল্লাহ তাঁর কোনো না কোনো বান্দার মস্তিষ্ক থেকে বের করেছেন। মস্তিষ্ক মহান আল্লাহ প্রদত্ত অমূল্য নিয়ামত। এটি মানবদেহের প্রধান নিয়ন্ত্রণকেন্দ্র। মহান আল্লাহ এত বড় বড় নিয়ামত আমাদের দিয়ে রেখেছেন যে তাঁর একটি নিয়ামতের শুকরিয়া জ্ঞাপন করার জন্য আমাদের গোটা জীবনটাও যথেষ্ট নয়। তাই আমাদের উচিত জীবনের প্রতিটি মুহূর্ত মহান আল্লাহর নির্দেশিত পথে পরিচালিত করার চেষ্টা করা।
লেখক : কলাম লেখক ও গবেষক
সূত্র: দৈনিক নয়া দিগন্ত অনলাইন, ১২ ফেব্রুয়ারি ২০২৪