জহির উদ্দীন বাবর দিগ্বিজয়ের বাঘ-১
- মুসা আল হাফিজ
১৫২৬ খ্রিস্টাব্দে ভারতে প্রতিষ্ঠিত হলো মুঘল সাম্রাজ্য। ইতিহাসে সূচিত হলো নতুন ও বর্ণাঢ্য এক অধ্যায়। বিস্ময়কর প্রাণশক্তির অধিকারী মুঘল নেতা জহির উদ্দীন মুহম্মদ বাবর হলেন দিল্লির শাসক। ইতোপূর্বে রাজশক্তির দুর্বলতায় বিভিন্ন অঞ্চলে ছড়িয়ে পড়েছিল বিচ্ছিন্নতা ও বিভক্তি। বাবরের হাতে তা শুধু দমনই হলো না, বরং উপমহাদেশে উদ্বোধন হলো এমন এক বাস্তবতার, যা তার সমাজ, সংস্কৃতি, শিক্ষা, সাহিত্য, ভাষা, স্থাপত্য, খাদ্যরুচি, নগরব্যবস্থা, কৃষি, শিল্প, পোশাক, সংগীত, রাজনীতি, অর্থনীতিসহ প্রতিটি ক্ষেত্রে বহু শতাব্দীর ধারায় নিয়ে এসেছে বিপ্লবাত্মক রূপান্তর। উপমহাদেশের বৈচিত্র্যপূর্ণ জীবনযাত্রাকে দিয়েছে এমন আকার ও চরিত্র, যার গর্ভ থেকে বেরিয়ে এসেছে সুকৃতির বিপুল সম্ভার। এই মহাযাত্রা ও নবযুগের সূচনা ঘটে বাবরের হাত দিয়ে, যিনি একই সাথে ছিলেন সমরকুশলী, মননশীল, দিগি¦জয়ী এবং রাষ্ট্রনায়ক। তাঁর জন্ম হয় ১৪৮৩ খ্রিস্টাব্দে। মধ্য এশিয়ার দুই পরাক্রমশালী পৌরুষের ধারা এসে মিশেছিলো তার রক্তে। নবজাতক শিশুটির মাথার চুল কামানো উপলক্ষে বিশাল মেজবানির আয়োজন হলো। সেদিনই শিশুটির নাম রাখা হলো জহির উদ্দীন মুহম্মদ বাবুর বা বাবর। বাবুরই হলো তার ডাকনাম। ‘বাবুর’ শব্দটির মানে ‘বাঘ’, জহির উদ্দীনের মধ্যে একটি বাঘের জীবন আশা করছিলেন তার মা-বাবা।
বাবার দিক থেকে বাবর ছিলেন তৈমুর লঙ্গের বংশধর। মায়ের দিক থেকে ছিলেন চেঙ্গিস খানের উত্তরপুরুষ। ফলে বীরত্ব তার স্বভাবের অংশ ছিলো, পরাক্রম ও দুঃসাহস দিয়ে সাজানো ছিলো তার মানস, অভিযান ও জয়ের উদ্যম ছিলো তার সত্তার সত্য। বাবরের মা কুতলুগ নিগার খানম ছিলেন বিদূষী ও রণনিপুণ রমণী। তার বাবা ওমর শেখ মীর্জা ছিলেন মধ্য এশিয়ার ফারগানা রাজ্যের অধিপতি, যা বর্তমানে উজবেকিস্তানের অন্তর্ভুক্ত। ওমর শেখের বড় ভাই আহমদ মীর্জা ছিলেন সমরকন্দ, বোখারাসহ সমৃদ্ধ রাজ্যসমূহের শাসক। উভয় ভাইয়ের মধ্যে দ্ব›দ্ব তৈরি হয় ফরগনা রাজ্যের উত্তর দিকে অবস্থিত আখশী দুর্গের অধিকার নিয়ে। এরই মধ্যে শেখ মীর্জার মৃত্যু ঘটলো এক অঘটনে। উড়ন্ত পায়রার সৌন্দর্য দেখতে গিয়ে বাড়ির ছাদ থেকে তিনি পড়ে যান। এতেই ঘটে তাঁর জীবনাবসান। সময়টা ১৪৯৪ খ্রিস্টাব্দের ৮ জুন। তবে ঘটনাটি অন্যভাবেও বর্ণিত আছে। রাজপ্রাসাদের ছাদের একটি অংশে কবুতর পালতেন শেখ মীর্জা। প্রাসাদটি ছিলো একটি উপত্যকার ঠিক উপরে। একদিন হঠাৎ ঘটলো তুমুল ভ‚মিধ্বস। ওমর শেখ তখন কবুতরদের দেখভাল করছিলেন। ভ‚মিধ্বসের ফলে কবুতরসহ প্রাসাদের উপর থেকে তিনি পতিত হন উপত্যকার গভীর গর্তে। এতেই তার মৃত্যু হয়। উমর শেখ মির্জার বয়স তখন মাত্র ৩৯ বছর। এই ঘটনা বাবরের জীবনকে কাঁপিয়ে দেয়। আপন আত্মজীবনীতে বাবার মৃত্যুকে তিনি ব্যক্ত করেছেন এভাবে: ‘রমজান মাসের এক সোমবারে উমর শেখ মির্জা তার সমস্ত কবুতর উড়িয়ে দিলেন এবং নিজে ঈগল হয়ে গেলেন।’
সূত্র: দৈনিক ইনকিলাব ১৫ ফেব্রুয়ারি ২০২৪