জিজ্ঞাসা: ১৩০: সিজদা সাহুর সঠিক নিয়ম নিয়ে একটু আলোচনা করুন। ধন্যবাদ।
মাওলানা হেলাল কবির বগুড়া থেকে--
জবাব:
সাহু সিজদার পদধতি:
ওলামায়ে আহনাফ-এর মতে, সিজদায়ে সাহু দেওয়া ওয়াজিব হয় এমন কোনভুল করলে, শেষ বৈঠকে শুধু তাশাহুদ পড়ে ডান দিকে একবার সালাম ফিরিয়ে তাকবীর বলে, এরপর দুইটা সিজদা করবে। তারপর আবার যথারীতি আত্তাহিয়্যাতু-দরুদ-দুআ মাসুরা পড়ে দুই দিকে সালাম ফিরাবে। কিতাবুন-নাওয়াযিল-৩/৬০৫
নোট: ডান দিকে সালাম সালাম না ফিরিয়ে সিজদায়ে সাহু করলেও আদায় হবে। তবে মাকরুহ তানজিহি হবে।
আমাদের দেশে প্রচলিত যে সাহু সিজদার পদ্ধতি যা আমরা করে থাকি। এটা অনেকে সহিহ বলে না। যদি বুখারির হাদিস আমাদের আমলের সাথে না মেলে তখনেই বলে এটা সহিহ না, জাল/দুর্বল, কোনো দলিল নেই, ভিত্তি নেই ইত্যাদি। আমরা এখন প্রমাণ করবো যে, আমাদের কোন দলিল আছে কিনা ইনশাল্লাহ। আপনার প্রশ্নকে সহজভাবে বুঝার জন্য কয়েকভাবে ভাগ করছি:
প্রশ্ন: ক। সাহু সিজদার সালাম কি শুধু ডান (এক সালামা) দিকে, না বাম দিকেও (দুই সালাম) ফিরাতে হবে?
উত্তর: ক। সাহু সিজদার সালাম শুধু ডান দিকে হবে অর্থাৎ সালাম একটি হবে। দলিল:
ما رواه الترمذي والحاكم من حديث عائشة أن رسول الله صلى الله عليه وسلم كان يسلم في الصلاة تسليمة واحدة تلقاء وجهه ، يميل إلى الشق الأيمن شيئاً .
قال الحاكم : صحيح على شرط الشيخين ، ووافقه الذهبي .
لتخريج : أخرجه الترمذي (296) واللفظ له، وابن خزيمة (1/360)، والحاكم (1/354) باختلاف يسير.
অর্থাৎ হজরত আয়েশা রা. বলেন, রসূল (ﷺ) এক সালাম ফিরাতেন। তাখরিজ: তিরমিজি-২৯৬; মুস্তাদরেকে হাকেম-১/৩৫৪
নোট: ইমাম হাকেম রহ. বলেন, হাদিসটির সনদ বুখারি ও মুসলিমের শর্তানুযায়ী সহিহ ও ইমাম যাহাবিও রহ. অনুরূপ বলেছেন।
প্রশ্ন: খ। সিজদায়ে সাহু সালাম ফিরানোর আগে না পরে?
উত্তর: খ। এ বিষয়ে, ইমাম শাফেয়ি রহ. এর মতে, সালাম ফিরানোর আগে আর ইমাম আবু হানিফা, ইমাম মালেক ও ইমাম আহমদ রহ. –এর মতে সালাম ফিরানোর পর সাহু সিজদা করতে হবে। দলিল:
হাদিস নং-০১
হজরত আব্দুল্লাহ রা. হতে বর্ণিত, রসূল (ﷺ) যহোরের সালাত পাঁচ রাকাত আদায় করলেন, তাকে জিজ্ঞেস করা হলো, সালাত কি কি বৃদ্ধি করা হয়েছে? তিনি বললেন, এ প্রশ্ন কেন? (প্রশ্ন কারী) বললেন, আপনি তো পাঁচ রাকাত সালাত আদায় করেছেন্ অত:পর তিনি তিনি সালাম ফিরানোর পর পর দুটি সিজদা করলেন। বুখারি-১২২৬
হাদিস নং-০২
وَإِذَا شَكَّ أَحَدُكُمْ فِي صَلاَتِهِ، فَلْيَتَحَرَّ الصَّوَابَ فَلْيُتِمَّ عَلَيْهِ، ثُمَّ لِيُسَلِّمْ، ثُمَّ يَسْجُدُ سَجْدَتَيْنِ»
হযরত আব্দুল্লাহ বিন মাসঈদ রাঃ থেকে বর্ণিত। রাসূল (ﷺ) ইরশাদ করেছেনঃ তোমাদের মাঝে যখন কারো নামাযের ব্যাপারে সন্দেহ হয়ে যাবে, তখন তার জন্য উচিত এ ব্যাপারে চিন্তা ফিকির করা, তারপর নামায পূর্ণ করে সালাম ফিরাবে তারপর দুই সিজদা করবে। সহীহ বুখারী-১/৫৮, হাদীস নং-৪০১, সহীহ মুসলিম, হাদীস নং-৫৭২
প্রশ্ন: গ। সিজদা সাহুর পর তাশাহুদ , দুরদ ও দুআ মাসুরা পড়া লাগবে কিনা
উত্তর: গ। হ্যাঁ, সালাম ফিরানো ও সিজদায়ে সাহুর যথারীতি সব পড়তে হবে, এটাই পরিপূর্ণ পদ্ধতি। দলিল:
হাদিস নং-০১
ইমরান ইবনে হুসাইন রা. থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ (ﷺ) আসরের নামায তিন রাকাত পড়ে সালাম ফিরিয়ে দেন। তারপর ঘরে প্রবেশ করেন। এক ব্যক্তি যাকে খিরবাক বলা হয় এবং যার উভয় হাত কিছুটা লম্বা ছিল, বলল, ইয়া রাসূলাল্লাহ। এরপর সে তিনি যা করেছেন তা উল্লেখ করল। তখন তিনি রাগান্বিত হয়ে চাদর টানতে টানতে বেরিয়ে লোকদের কাছে গিয়ে জিজ্ঞাসা করলেন, এ কি ঠিক বলেছে? তারা বলল, জ্বী। অতপর তিনি এক রাকাত পড়লেন। তারপর সালাম ফিরালেন। তারপর দুটি সেজদা করে সালাম ফিরালেন (অর্থাৎ তাশাহুদ ইত্যাদি পড়ে সালাম ফিরালেন)। -সহীহ মুসলিম, হাদীস ৫৭৪
হাদিস নং-০২
دثنا أبو بكر بن أبي شيبة، وزهير بن حرب، جميعاً عن ابن علية، قال زهير: حدثنا إسماعيل بن إبراهيم، عن خالد، عن أبي قلابة، عن أبي المهلب، عن عمران بن حصين: أن رسول الله صلى الله عليه وسلم صلى العصر، فسلم في ثلاث ركعات، ثم دخل منزله، فقام إليه رجل يقال له الخرباق، وكان في يديه طول، فقال: يا رسول الله، فذكر له صنيعه، وخرج غضبان يجر رداءه، حتى انتهى إلى الناس، فقال: أصدق هذا؟ قالوا: نعم. فصلى ركعة، ثم سلم، ثم سجد سجدتين، ثم سلم.
যিয়াদ ইবনে ইলাকা থেকে বর্ণিত, মুগীরা ইবনে শুবা রা. আমাদের নিয়ে নামায পড়েন। দুই রাকাত পড়ে না বসে দাঁড়িয়ে গেলে মুকতাদীরা সুবহানাল্লাহ বলে। তিনি তাদের দাঁড়াতে ইশারা করলেন। যখন নামায শেষ করলেন তখন সালাম ফিরালেন, দুটি সেজদা করলেন। তারপর আবার সালাম ফিরালেন এবং বললেন, রাসূলুল্লাহ (ﷺ) এরূপ করেছেন। -জামে তিরমিযী, হাদীস ৩৬৫
হাদিস নং-০৩
ثنا عبد الله بن عبد الرحمن، قال: أخبرنا يزيد بن هارون، عن المسعودي، عن زياد بن علاقة، قال: صلى بنا المغيرة بن شعبة، فلما صلى ركعتين قام ولم يجلس، فسبح به من خلفه، فأشار إليهم أن قوموا، فلما فرغ من صلاته سلم وسجد سجدتي السهو وسلم، وقال: هكذا صنع رسول الله صلى الله عليه وسلم.
ইমরান ইবনে হুসাইন রা. থেকে বর্ণিত, নবী (ﷺ) তাদের নিয়ে নামায পড়েন এবং এতে তাঁর ভুল হয়। অতপর তিনি দুটি সেজদা করেন। তারপর তাশাহহুদ পড়েন। তারপর সালাম ফিরান। -জামে তিরমিযী-৩৯৭ ; সুনানে আবু দাউদ-১০৩৯
নোট; ইমাম তিরমিযী বলেন, هذا حديث حسن صحيح এই হাদীস হাসান সহীহ।
আসার নং-০১
عَنْ عَبْدِ اللهِ، رَضِيَ اللهُ عَنْهُ قَالَ: «السَّهْوُ أَنْ يَقُومَ فِي قُعُودٍ , أَوْ يَقْعُدَ فِي قِيَامٍ , أَوْ يُسَلِّمَ فِي الرَّكْعَتَيْنِ , فَإِنَّهُ يُسَلِّمُ , ثُمَّ يَسْجُدُ سَجْدَتَيِ السَّهْوِ , وَيَتَشَهَّدُ , وَيُسَلِّمُ»
হযরত আব্দুল্লাহ বিন মাসঈদ রাঃ থেকে বর্ণিত। তিনি বলেনঃ ভুল হল এই যে, নামাযী ব্যক্তি বসার বদলে দাঁড়িয়ে যাওয়া। অথবা দাঁড়ানোর বদলে বসে যাওয়া, বা [তিন বার চার রাকাতওয়ালা নামাযে] দুই রাকাত পড়ে সালাম ফিরিয়ে দেয়া। তাহলে এমন ব্যক্তি সালাম ফিরানোর পর দুই সেজদা করবে,তারপর তাশাহুদ পড়ে সালাম ফিরাবে। {তাহাবী শরীফ, হাদীস নং-২৫৬৫}
নোট: ইবরাহীম নাখায়ী পর্যন্ত এর সনদ সহীহ।
আসার-০২
حدثنا أبو معاوية، عن الأعمش، عن إبراهيم: أنه سجد سجدتي السهو فتشهد فيهما ثم سلم.
আ‘মাশ থেকে বর্ণিত, ইবরাহীম নাখায়ী রাহ. সেজদা সাহু করেছেন এবং তাতে তাশাহহুদ পড়েছেন। তারপর সালাম ফিরিয়েছেন। -মুসান্নাফে ইবনে আবী শাইবা, বর্ণনা ৪৪৯৪
আসার-০৩
عن معمر، عن قتادة، قال: يتشهد في سجدتي السهو ويسلم.
মামার থেকে বর্ণিত, কাতাদা রাহ. বলেন, সেজদা সাহুতে তাশাহহুদ পড়বে এবং সালাম ফিরাবে। -মুসান্নাফে আবদুর রাযযাক, বর্ণনা ৩৫০১
সাহু সিজদার সঠিক পদ্ধতি হচ্ছে সাহু সিজদা যার ওপর ওয়াজিব হয়েছে, সে শেষ বৈঠকে তাশাহহুদ পড়ে ডান দিকে এক সালাম ফেরাবে। এরপর তাকবির বলে নামাজের মতো দুইটি সিজদা করে বসে যাবে এবং তাশাহহুদ, দরুদ, দোয়ায়ে মাসুরা পড়ে সালাম ফেরাবে। সালামের আগে সিজদা করলে নামাজ হয়ে যাবে। তবে তা মাকরুহে তানজিহি। মুসনাদে আহমদ, হাদিস : ১৮১৮৮; বুখারি, হাদিস : ১১৫০-১১৫৩; তিরমিজি, হাদিস : ৩৬১
بَاب مَنْ لَمْ يَتَشَهَّدْ فِي سَجْدَتَيْ السَّهْوِ
حَدَّثَنَا سُلَيْمَانُ بْنُ حَرْبٍ، حَدَّثَنَا حَمَّادٌ، عَنْ سَلَمَةَ بْنِ عَلْقَمَةَ، قَالَ قُلْتُ لِمُحَمَّدٍ فِي سَجْدَتَىِ السَّهْوِ تَشَهُّدٌ قَالَ لَيْسَ فِي حَدِيثِ أَبِي هُرَيْرَةَ.
সালামাহ ইবনু ‘আলকামা (রহ.) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, আমি মুহাম্মাদ (ইবনু সীরীন) (রহ.)-কে জিজ্ঞেস করলাম, সিজদা্ সাহ্উর পর তাশাহ্হুদ আছে কি? তিনি বললেন, আবূ হুরাইরাহ্ (রাযি.)-এর হাদীসে তা নেই। বুখারি-১১৫৬ ইসলামিক ফাউন্ডেশন
একটি সংশয় তার জবাব
প্রশ্ন: ঘ। যারা সাহু সিজদার পর তাশাহুদ পড়া পক্ষে নয় তাদের একটি দলিল হলো এই হাদিস,
সালামা ইবনে আলকামা বলেন, আমি মুহাম্মদ (ইবনে সীরীন)কে জিজ্ঞাসা করলাম, সেজদা সাহুতে কি তাশাহহুদ আছে? বললেন,
ليس في حديث أبي هريرة আবু হুরায়রা রা.-এর হাদীসে তা নেই। -সহীহ বুখারী, হাদীস ১২২
উত্তর: ঘ। প্রিয় পাঠক! লক্ষ্য করুন, ইবনে সীরীন রহ. এ কথা বলেননি যে, এ কোনো হাদীসে নেই, শুধু আবু হুরায়রা রা.-এর হাদীসে না থাকার কথা বলেছেন। সুতরাং এক সাহাবির থেকে না থাকলে যে উক্ত বিষয়ে হাদিস নেই, একথা কি যুক্তিযুক্ত?
অথচ অন্য হাদিসে ইবনে সীরীন রহ. সিজদায়ে সাহুর পর তাশাহুদ পড়া পছন্দ করেছেন। দলিল:
ইবনে সীরীন বলেন,
وأحب إلي أن يتشهد তাশাহহুদ পড়া আমার কাছে পছন্দনীয়। -সুনানে আবু দাউদ, হাদীস ১০
উপসংহার: উপরোক্ত বিষয়গুলোতে ইমামদের মধ্যে মতভেদ আছে; সুতরাং ইমাম শাফেয়ির মতও সঠিক; তাই সেই মাজহারে লোকেরা তার অনুসরণ করবে।
আর হানাফি মাজহাবের মতের পক্ষেও সহিহ হাদিস, সাহাবা-তাবেয়িদের আমল রয়েছেন, সুতরাং তার অনুসারিরা সেই অনুযায়ী আমল করবেন। সুবিধাবাদী জিন্দাবাদ হওয়ার সুযোগ নেই।
والله اعلم بالصواب
আল্লাহপাকই সকল বিষয়ে সঠিক জ্ঞানের অধিকারী।
উত্তর দিচ্ছেন, মুফতি মুহাম্মাদ আব্দুর রাজ্জাক (বগুড়া)