ঈমানের সঙ্গে মৃত্যুলাভের দশ আমল
হাদিস শরিফে নবি সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, মানুষের ভালো মন্দ পরিণাম তার শেষ আমল আমল অনুযায়ী হবে। শেষ ভালো যার সব ভালো তার। কাজেই আলেমগণ কুরআন সুন্নাহর আলোকে এমন দশটি আমলের কথা বলেছেন, যা পালন করলে মৃত্যুকালে কালিমা নসিব হবে, ইনশাআল্লাহ। আমলগুলো নিচে তুলে ধরছি।
১. দৃষ্টির হেফাজত :
النظرةُ سهمٌ مسمومٌ من سهامِ إبليسَ من تركَه خوفًا من اللهِ آتاهُ اللهُ إيمانًا يجدُ حلاوتَه في قلبِه
وفي المستدرك عن حذيفة قال: قال رسول الله صلى الله عليه وسلم: النظرة سهم من سهام إبليس مسمومة، فمن تركها من خوف الله أثابه الله عز وجل إيمانا يجد حلاوته في قلبه.
মুসতাদরাকে হাকেমের হাদিসে এসেছে, দৃষ্টি হল ইবলিসের তীরসমূহের বিষাক্ত একটি তীর। যে ব্যক্তি আল্লাহর ভয়ে কুদৃষ্টি থেকে বাঁচবে, আল্লাহ তায়ালা তাকে এমন ইমান দান করবেন, যার মিষ্টতা সে অন্তরে অনুভব করবে। (মুসতাদরাক; হাদিস নং ৭৮৭৫)
মোল্লা আলি কারি রহ. এক হাদিসের ব্যাখ্যায় লেখেন,
قد ورد أن حلاوة الإيمان إذا دخلت قلبا لا تخرج منه أبدا
فَفِيهِ إِشَارَةٌ إِلَى بِشَارَةِ حُسْنِ الْخَاتِمَةِ لَهُ،
ঈমানের মিষ্টতা যখন কোন অন্তরে প্রবেশ করে, কস্মিনকালেও তা থেকে বের হয় না। এতে উত্তম মৃত্যুর প্রতি সুসংবাদের ঈঙ্গিত রয়েছে। (মিরকাতুল মাফাতিহ)
২. নিয়মিত মেসওয়াক: হাদিস শরিফে বর্ণিত হয়েছে, কেউ যদি নিয়মিত পাবন্দির সঙ্গে মেসওয়াক করে, মৃত্যুকালে মালাকুল মওত শয়তানকে মৃতব্যক্তি থেকে দূরে সরিয়ে দেবেন। এ প্রসঙ্গে আল্লামা শামি রহ. লেখেন,
ومن منافعه تذكير الشهادة عند الموت
মেসওয়াকের সর্বোচ্চ উপকারিতা হচ্ছে, মৃত্যুর সময় কালিমায়ে শাহাদাত স্মরণ করিয়ে দেওয়া।
(রদ্দুল মুহতার)
৩. আল্লাহর শোকর আদায় করা: পাক কুরআনে দয়ালু আল্লাহ বলেছেন, وَإِذْ تَأَذَّنَ رَبُّكُمْ لَئِنْ شَكَرْتُمْ لَأَزِيدَنَّكُمْ وَلَئِنْ كَفَرْتُمْ إِنَّ عَذَابِي لَشَدِيدٌ
যদি তোমরা শোকর আদায় কর, আমি তোমাদের নেয়ামত বৃদ্ধি করে দেব। ( সুরা ইবরাহীম, আয়াত ০৭)
সুতরাং ইমানের নেয়ামতের ওপর শোকর আদায় করলে আল্লাহপাক ইমানের নেয়ামত বাড়িয়ে দেবেন। মৃত্যুর সময় কালিমা নসিব করবেন।
৪. দান-সদকা: দান সদকা দ্বারা আল্লাহ তায়ালা অপমৃত্যু থেকে রক্ষা করেন। প্রিয় নবী সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, إن الصدقة لطفئ غضب الرب وتدفع ميتة السوء
নিঃসন্দেহে সদকা আল্লাহর ক্ষোভের আগুন নিভিয়ে দেয় এবং অপমৃত্যু থেকে রক্ষা করে। ( সুনানে তিরমিজি হাদিস নং ৬৬৪)
উল্লেখ্য, সবচেয়ে খারাপ মৃত্যু হচ্ছে ইমানহারা হয়ে মারা যাওয়া। কাজেই দানকারী ব্যক্তির মৃত্যু হবে ইমানের সঙ্গে। আল্লাহ তাকে ইমানহারা হওয়া থেকে রক্ষা করবেন।
৫. আল্লাহওয়ালাদের সাহচর্য : আহলুল্লাহ বা আল্লাহওয়ালাগণের সাহচর্য মৃত্যুকালে ইমান নসিব হওয়ার কারণ। হাদিসে এসেছে,
هُمُ الجُلَسَاءُ لاَ يَشْقَى بِهِمْ جَلِيسُهُم
এরা এমন এক সম্প্রদায়, যাদের সাহচর্য লাভকারী ব্যক্তিরা বঞ্চিত হবে না। (সহিহ বুখারি, হাদিস নং ৬৪০৮)
এ হাদিস দ্বারা বোঝা গেল, আল্লাহওয়ালাদের সান্নিধ্য লাভকারী ব্যক্তিগণ মাহরুম হবেন না। মৃত্যুর সময় তাদেরও ইমান নসিব হবে।
৬. আল্লাহ তায়ালার প্রতি ভালোবাসা প্রকাশ : যে ব্যক্তি আল্লাহ তায়ালাকে ভালোবাসবে, তার সঙ্গে বন্ধুত্ব করার চেষ্টা করবে, আল্লাহ কেয়ামত দিবসে তাকে দুশমনদের কাতারে রাখবেন না৷ ফকিহুন নফস মুফতি রশিদ আহমাদ গঙ্গুহি রহ. বলেছেন, যে ব্যক্তি জীবনে একবার মহব্বতের সঙ্গে “আল্লাহ” বলে ডাকবে, তার এ ডাক কখনও না কখনও তার জাহান্নাম থেকে মুক্তির কারণ হবে।
৭. আল্লাহর ভয়ে গুনাহ ছেড়ে দেওয়া : হাদিস শরিফে এসেছে, একজন অভিজাত ও সুন্দরী রমনী যদি কোন পুরুষকে আহ্বান করে, আর জবাবে সে বলে, আমি আল্লাহকে ভয় করি, আল্লাহ তায়ালা এমন ব্যক্তিকে আরশপাকের নিচে ছায়া দেবেন। ( মুসনাদে আহমাদ)
কাজেই আল্লাহর ভয়ে গুনাহ ছেড়ে দিলেও ইমানি মৃত্যু লাভ করবে।
৮. আজানের জবাব দেওয়া: নবিজি সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, কেউ যদি আজানের জবাব দেয় এবং দোয়ায়ে ওসিলা পাঠ করে, কেয়ামত দিবসে তার জন্য আমার সুপারিশ ওয়াজিব হয়ে যাবে।
614 - حَدَّثَنَا عَلِيُّ بْنُ عَيَّاشٍ، قَالَ: حَدَّثَنَا شُعَيْبُ بْنُ أَبِي حَمْزَةَ، عَنْ مُحَمَّدِ بْنِ المُنْكَدِرِ، عَنْ جَابِرِ بْنِ عَبْدِ اللَّهِ: أَنَّ رَسُولَ اللَّهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ قَالَ: " مَنْ قَالَ حِينَ يَسْمَعُ النِّدَاءَ: اللَّهُمَّ رَبَّ هَذِهِ الدَّعْوَةِ التَّامَّةِ، وَالصَّلاَةِ القَائِمَةِ آتِ مُحَمَّدًا الوَسِيلَةَ وَالفَضِيلَةَ، وَابْعَثْهُ مَقَامًا مَحْمُودًا الَّذِي وَعَدْتَهُ، حَلَّتْ لَهُ شَفَاعَتِي يَوْمَ القِيَامَةِ "
৫৮৭। আলী ইবনে আইয়্যাশ (রাহঃ) ......... জাবির ইবনে আব্দুল্লাহ (রাযিঃ) থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ (ﷺ) বলেছেনঃ যে ব্যক্তি আযান শুনে দুআ করেঃ ‘হে আল্লাহ- এ পরিপূর্ণ আহবান ও নামাযের প্রতিষ্ঠিত মালিক, মুহাম্মাদ (ﷺ) কে ওসীলা ও সর্বোচ্চ মর্যাদার অধিকারী করুন এবং তাঁকে সে মাকামে মাহমুদে পৌছিয়ে দিন যার অঙ্গিকার আপনি করেছেন’- কিয়ামতের দিন সে আমার শাফা’আত লাভের অধিকারী হবে।
Narrated Jabir bin `Abdullah:
Allah’s Messenger (s) said, "Whoever after listening to the Adhan says, ’Allahumma Rabba hadhihi-dda` watit-tammah, was-salatil qa’imah, ati Muhammadan al-wasilata wal-fadilah, wa b`ath-hu maqaman mahmudan-il-ladhi wa`adtahu’ [O Allah! Lord of this perfect call (perfect by not ascribing partners to You) and of the regular prayer which is going to be established, give Muhammad the right of intercession and illustriousness, and resurrect him to the best and the highest place in Paradise that You promised him (of)], then my intercession for him will be allowed on the Day of Resurrection".
সহীহ বুখারী, হাদীস নং ৫৮৭ (আন্তর্জাতিক নং ৬১৪)
হাদীসের ব্যাখ্যা:
ইমাম ইবনুছ্ ছুন্নী রহ. তাঁর লিখিত আমালুল ইয়াওমি ওয়ালস্নাইলা কিতাবের ৯৫ নাম্বারে ইমাম নাসাঈ ও তাঁর উস্তাদ আমর বিন মানছূর-এর মাধ্যমে উপরিউক্ত হাদীসটি হুবহু সনদে বর্ণনা করেছেন। সে হাদীসে آتِ مُحَمَّدًا الْوَسِيلَةَ وَالْفَضِيلَةَ বাক্যের পরে وَالدَّرَجَةَ الرَّفِيعَةَ শব্দটি বর্ণিত হয়েছে। উক্ত হাদীসের রাবীগণ সকলে নির্ভরযোগ্য হওয়া সত্ত্বেও অনেকে وَالدَّرَجَةَ الرَّفِيعَةَ শব্দটিকে শায তথা অপ্রবল এবং কোন লিপিকার থেকে ভুলক্রমে সংযোজিত হয়েছে বলে মনত্মব্য করেছেন। আবার এ হাদীসটি ইমাম বায়হাকী রহ. তাঁর আস সুনানুছ ছগীর কিতাবের ২২৯ নাম্বারেও বর্ণনা করেছেন। সে বর্ণনায় উক্ত দুআর শেষে إِنَّكَ لَا تُخْلِفُ الْمِيعَادَ বাক্যটি বৃদ্ধি করা আছে। বুখারী শরীফের প্রসিদ্ধ চারজন সংকলকের মধ্যে আল্লামা আবুল হাইছাম কুশমিহানী রহ.-এর সংকলনেও বুখারী শরীফের হাদীসে উপরিউক্ত বাক্যটি বৃদ্ধি আছে। কোন কোন ইমাম এটাকেও শায বলেছেন। সুতরাং গ্রহণযোগ্য সূত্রে বর্ণিত উপরিউক্ত দুআটি পড়াই উত্তম হবে।
ফায়দা: আযানের মধ্যে রসূল স.-এর পুতপবিত্র মোবারক নাম উচ্চারিত হয়, অথচ আযানের জবাবে তাঁর প্রতি দুরূদ পড়ার নিয়ম নেই। এ কারণে মুআজ্জিন আযান শেষে আর শ্রোতাগণ আযানের জবাব দেয়া শেষ করে প্রথমে দুরূদ পড়বে অতঃপর আযানের দুআ পাঠ করবে। হযরত আব্দুল্লাহ বিন আমর ইবনুল আছ রা. থেকে সহীহ সনদে বর্ণিত আছে যে, রসূল স. ইরশাদ করেন: إِذَا سَمِعْتُمُ الْمُؤَذِّنَ، فَقُولُوا مِثْلَ مَا يَقُولُ ثُمَّ صَلُّوا عَلَيَّ، তোমরা মুআজ্জিনকে আযান দিতে শুনবে তখন যেভাবে তাঁকে বলতে শুনবে সেভাবে বলবে অতঃপর আমার প্রতি দুরূদ পড়বে। (মুসলিম-৭৩৫, মুসনাদে আহমাদ-৬৫৬৮) এটাই হানাফী মাযহাবের মত। (শামী: ১/৩৯৮)
(বুখারি শরিফ) সুতরাং আজানের জবাব দেওয়াও মৃত্যুকালে ইমান নসিব হওয়ার কারণ।
৯. বেশি বেশি কালিমা পাঠ করা: জীবদ্দশায় যে ব্যক্তি যে কাজ বেশি করে বা যে কথা বেশি বলে, মৃত্যুকালেও সে সেই কথা বেশি বলে। এটা অভিজ্ঞতার আলোকে সুপ্রমাণিত। কাজেই যে ব্যক্তি জীবনে বেশি বেশি কালিমা পাঠ করবে, মৃত্যুকালে তার জবানে কালিমা চালু হয়ে যাবে।
১০. ইমানের সঙ্গে মৃত্যুর জন্য দোয়া করা : ইমানের সঙ্গে মৃত্যুর জন্য দোয়া করা হচ্ছে দশম আমল। এজন্য সকাল বিকাল এ দোয়াটি পড়া যেতে পারে, أللهم بارك لنا فى الموت وفيما بعد الموت
এছাড়া, কুরআনে বর্ণিত এ দোয়াটিও পড়তে পারি, ربنا لا تزغ قلوبنا بعد اذ هديتنا وهب لنا من لدنك رحمة انك انت الوهاب
আল্লাহ তায়ালা আমাদের সকলকে আমল করার তাওফিক দান করুন এবং মৃত্যুর সময় ইমান নসিব করুন। আমিন।
লেখক: মুফতি যুবাইর মাহমুদ রাহমানি, মুহাদ্দিস, জামিআ হোসাইনিয়া মদিনাতুল উলুম, তজুমদ্দিন, ভোলা।
আওয়ার ইসলাম থেকে সংগৃহীত