আল-বুরহান ( দলিল-প্রমাণ)

আসসালামু আলাইকুম ওয়া রহমাতুল্লাহ! আমাদের ওয়েবসাইটে আপনাকে স্বাগতম। একটু নিচে দেখুন> বিষয় ভিক্তিক সাজানো রয়েছে, আপনার পছন্দ অনুযায়ী পাঠ করুন এবং পোষ্টগুলো ভালো লাগলে শেয়ার করুন আর আপনার কোন প্রশ্ন থাকলে এই নাম্বারে- ০১৬৮৭-১১৩৮৮০ হোয়াটস অ্যাপে পাঠিয়ে দিন । জাযাকাল্লাহু খাইর।
No Comments

 


ভ্রান্ত আক্বীদা-১১:


জনৈক ইসলামী চিন্তাবিদ লিখেছেন,দ্বীনের অর্থ হচ্ছে, ইসলামী হুকুমত, আর দ্বীনের মধ্যে আসল হলো জিহাদ। নামায, রোযা, হজ্ব, যাকাত এ সবই ইসলামী হুকুমত প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে জিহাদের ট্রেনিং কোর্স মাত্র। [সূত্র: খুতবাত ৩০৭, ৩১৫।] 


এ ধরণের বহু নতুন কথা ইসলামের নামে লোকেরা সমাজে চালু করেছে। অথচ এ ধরণের নতুন কথা এবং শরী‘আতের নতুন ব্যাখ্যার কোন অবকাশ কুরআন-হাদীসে নেই। এ ধরণের নতুন কথা ও কাজকে শরী‘আতের পরিভাষায় ইলহাদ, তাহরীফ [অর্থগত বিকৃতি] এবং কোন কোনটি ‘বিদ‘আত’ বলে । ইলহাদ তো সুস্পষ্ট কুফর। আর বিদ‘আতের হাকীকত হলো, দ্বীনের মধ্যে নতুন সংযোজন করা এবং নিজে শরী‘আত প্রণেতা সাজা। এটা এত বড় অপরাধ যে, সাধারণত এ জাতীয় গুনাহ থেকে তাওবা নসীব হয় না। (নাউযুবিল্লাহ)।


দ্বীনের অর্থ কোন হাদীসে বা তাফসীরে ‘ইসলামী হুকুমত’ বলা হয় নি, বা আরবী কোন অভিধানেও এ অর্থ পাওয়া যায় না। তাছাড়া দ্বীনের এই রাজনৈতিক ব্যাখ্যা মেনে নিলে মারাত্মক এক অসুবিধার সম্মুখীন হতে হয়। তা এই যে, আল্লাহ তা‘আলা লক্ষাধিক নবী-রাসূল আ. কে তাঁর মনোনীত দ্বীন কায়িমের লক্ষ্যে দুনিয়াতে পাঠিয়েছেন। তাঁদের মধ্য হতে সীমিত সংখ্যক নবী রাসূল আ. ইসলামী রাষ্ট্র পরিচালনা করেছেন। [সূত্র: তাফসীরে মাযহারী খণ্ড ১, পৃষ্ঠা ৩৪৭, আল ইলমু ওয়াল উলামা, পৃষ্ঠা ২৮৬।] 


অবশিষ্ট সকলেই ইসলামী হুকুমত ও রাষ্ট্র পরিচালনা ছাড়াই আল্লাহর জমিনে আল্লাহর দ্বীন কায়িম করেছেন। এমতাবস্থায় দ্বীনের অর্থ যদি ইসলামী হুকুমত ধরা হয়, তাহলে বাধ্য হয়ে এ কথা মেনে নিতে হয় যে, অধিকাংশ নবী-রাসূল আ. দ্বীন কায়িমে কামিয়াব হননি। কত মারাত্মক কথা!   


তাছাড়া এ কথাও সঠিক নয় যে, দ্বীনের মধ্যে আসল হলো জিহাদ। আর নামায, রোযা ইত্যাদি হচ্ছে সেই জিহাদেরই ট্রেনিং কোর্স। কুরআন, সুন্নাহ ও সকল হক্কানী উলামায়ে কিরামের সিদ্ধান্ত হলো, নামযা, রোযা, হজ্ব, যাকাত এগুলো হলো দ্বীনের বুনিয়াদী ও মৌলিক ইবাদত। আর আল্লাহর জমিনে দ্বীন কায়িম করার প্রচেষ্টার নাম হলো জিহাদ। যেমন, হক্কানী উলামায়ে কিরামের মাধ্যমে দ্বীনের বিভিন্ন বিভাগে সহীহভাবে যেসব মেহনত চলছে, সেসবই জিহাদের অন্তর্ভুক্ত। সুতরাং, জিহাদ মূল লক্ষ্যবস্তু নয়; তবে পরিপূর্ণভাবে দ্বীন কায়িম করার উপায় ও উপলক্ষ হিসেবে ইসলামী হুকুমত কায়িম বা তার প্রচেষ্টা চালানো জরুরী। [সূত্র : কামালাতে আশরাফিয়া, পৃষ্ঠা ৯৯।]


মোদ্দাকথা, দ্বীনের মূল লক্ষ্যবস্তু হচ্ছে, আল্লাহর ইবাদত-বন্দেগী। [সূত্র: সূরা যারিয়াত, আয়াত-৫৬, বুখারী খণ্ড ১, পৃষ্ঠা-৬।] 


আর আল্লাহর বন্দেগী তথা সহীহ ঈমান ও আমলে সালিহা [যার মধ্যে ইসলামী হুকুমত কায়িমের জন্যে সর্বাত্মক প্রচেষ্টা শরী‘আত সমর্থিত পদ্ধতিতে চালিয়ে যাওয়াও শামিল]- এর নগদ পুরষ্কার হিসেবে আল্লাহ তা‘আলা মুসলমানদেরকে ইসলামী হুকুমত দান করেন।[সূত্র : সূরা নূর, আয়াত ৫৫।] 


যেমন-আল্লাহপাক ইরশাদ করেছেন, আল্লাহ তা‘আলা যদি ইসলামী হুকুমত দান করেন, তাহলে মুসলমানগণ সেই ইসলামী হুকুমতের মাধ্যমে নামায, রোযা, হজ্ব, যাকাত ইত্যাদি কায়িম করবে। সম্পূর্ণ হুকুমতকে তারা দ্বীন কায়িমের এবং জনগণের খিদমতের জন্যে কাজে লাগাবে। [সূত্র : সূরা হজ্ব, আয়াত ৪১] 


আর যদি আল্লাহ তা‘আলা ইসলামী হুকুমত দান না-ও করেন, তবুও মুসলমানদের সাধ্যানুযায়ী দ্বীনের কাজ করে যেতে হবে। ইসলামী হুকুমতের আশায় দ্বীনের কাজ না করে বসে থাকার কোন অনুমতি নেই।


এখন আসুন, চিন্তাবিদ মহোদয়ের কথা অনুযায়ী যদি নামায-রোযাকে জিহাদের ট্রেনিং কোর্স হিসেবে মেনে নেয়া হয়, তাহলে প্রশ্ন হয়, ট্রেনিং কোর্স কি সারাজীবন এক ধরণের থাকে না ট্রেনিং শেষ হওয়ার পর এর গুরুত্ব কিছুটা হ্রাস পায়? দ্বিতীয়ত নামায, রোযা, হজ্ব, যাকাত ইত্যাদিকে ট্রেনিং কোর্স ধরা হলে জিহাদের মাধ্যমে ইসলামী হুকুমত কায়িম হওয়ার পর ট্রেনিং কোর্সের প্রয়োজন কি? তৃতীয়ত যাদের উপর কখনো জিহাদ ফরয হয় না, যেমন অন্ধ ও বিভিন্ন শ্রেণীর মাযুর, তাদের ওপর নামায, রোযা ফরয হওয়ার অর্থ কী? সুতরাং উক্ত ধারণা কোনভাবেই সহীহ হতে পারে না। বরং তা দ্বীনের মধ্যে নতুন সংযোজন হওয়ার কারণে সুস্পষ্ট গোমরাহী। এরূপ ধারণা থেকে বেঁচে থাকা প্রত্যেক মুসলমানের ঈমানী দায়িত্ব। 


ভ্রান্ত আক্বীদা-১২: 


জনৈক ইসলামী চিন্তাবিদ লিখেছেন যে, কুরআনের তাফসীর করার জন্য একজন অধ্যাপকই যথেষ্ট; এজন্য আলিম হওয়া জরুরী নয়। তার এ দর্শনের ভিত্তিতে বর্তমানে অনেক জেনারেল শিক্ষিত লোকদেরকে [যারা কুরআনের সহীহ তিলাওয়াত জানে না] তাফসীর করতে দেখা যায়। সেই চিন্তাবিদ সাহেব স্বীয় তাফসীরের ভূমিকায় লিখেছেন, আমি তাফসীর লিখতে গিয়ে তাফসীরের পুরাতন ভাণ্ডার থেকে কোন সহযোগিতা নেয়ার চেষ্টা করি নি। বরং এক একটি আয়াত তিলাওয়াত করার পর উক্ত আয়াত সম্পর্কে আমার মন-মস্তিস্কে যে প্রভাব পড়েছে, আমি হুবহু তা তাফসীর হিসেবে লিখে দিয়েছি।[সূত্র : তানকীহাত-১৭৫, ২৯১] 


উল্লেখিত কথাগুলো শরী‘আতের দৃষ্টিতে মারাত্মক ক্ষতিকর ও ঈমান বিধ্বংসী। এ ধরণের তাফসীরকে বলা হয়, ‘তাফসীর বির রায়’ বা মনগড়া তাফসীর, যা সম্পূর্ণ হারাম। এভাবে পবিত্র কুরআনের তাফসীর করা, লেখা, শ্রবণ করা ও সে তাফসীর পড়া-সবই হারাম। হাদীসে আছে, যে ব্যক্তি নিজের রায় মুতাবিক তাফসীর করবে, সে যেন তার ঠিকানা জাহান্নামের মধ্যে নির্ধারণ করে নেয়। [সূত্র: তিরমিযী শরীফ, খণ্ড-২, পৃষ্ঠা-১২৩ ও মিশকাত শরীফ, পৃষ্ঠা ৩৫।]


সকল হক্কানী উলামায়ে কিরাম এ ব্যাপারে একমত যে কুরআনের তাফসীর করার জন্যে ১৫টি বিষয়ের ওপর দক্ষতা ও বুৎপত্তি অর্জন করা জরুরী। [সূত্র : মিরকাত খণ্ড ১, পৃষ্ঠা ২৯২, ইতকান, পৃষ্ঠা ১৮১।] যাতে করে আরবী ভাষার ওপর এবং নবী সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম থেকে সাহাবায়ে কিরাম রাযি. যে তাফসীর ধারা বর্ণনা করেছেন, তা সামনে রেখে তাফসীর বর্ণনা করা যেতে পারে। উক্ত ১৫টি বিষয়ের ব্যাপারে যার দক্ষতা ও পারদর্শিতা নেই, শরী‘আতের দৃষ্টিতে তার জন্যে তাফসীর লেখা বা তাফসীর করার অনুমতিও নেই। এরূপ ব্যক্তির তাফসীরকে ‘তাফসীর বির রায়’ বা মনগড়া তাফসীর বলা হয়। আর ঐ ধরণের তাফসীর দ্বারা মুসলমানদের মাঝে কেবলমাত্র গোমরাহী ছড়ায় এবং এর দ্বারা ইসলামের প্রভূত ক্ষতি সাধিত হয়। এটা নিঃসন্দেহে ঈমান বিধ্বংসী কাজ, যা ক্ষেত্র বিশেষে কুফরী পর্যন্ত পৌঁছে দেয়। চিন্তাবিদ মহোদয়ের অধ্যাপকগণ ১৫টি বিষয়ের ওপর পারদর্শী হওয়া তো দূরের কথা, এ সবগুলোর নামও জানেন না, অথচ তাঁরা তাফসীর করছেন। 


- মুফতী মনসূরুল হক দা. বা.

প্রধান মুফতী ও শাইখুল হাদীস,

জামিয়া রহমানিয়া, মুহাম্মাদপুর,ঢাকা।