আল-বুরহান ( দলিল-প্রমাণ)

আসসালামু আলাইকুম ওয়া রহমাতুল্লাহ! আমাদের ওয়েবসাইটে আপনাকে স্বাগতম। একটু নিচে দেখুন> বিষয় ভিক্তিক সাজানো রয়েছে, আপনার পছন্দ অনুযায়ী পাঠ করুন এবং পোষ্টগুলো ভালো লাগলে শেয়ার করুন আর আপনার কোন প্রশ্ন থাকলে এই নাম্বারে- ০১৬৮৭-১১৩৮৮০ হোয়াটস অ্যাপে পাঠিয়ে দিন । জাযাকাল্লাহু খাইর।

আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা: ইসলামে মাতৃভাষার তাৎপর্য ও গূরুত্ব - জসিম বিন আখতার

No Comments

 



আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা: ইসলামে মাতৃভাষার তাৎপর্য ও গুরুত্ব

 - জসিম বিন আখতার হাফিজাহুল্লাহু 


শুরুরকথা:- মহান রাব্বুল আ'লামীন যতটা ক্ষমতার মতবাদের নেতা তার মধ্যে মানুষের ভাষা বা কথা বলতে সক্ষম, যা অন্য প্রাণী থেকে বৈশিষ্ট্যগুলি গ্রহণ করেছে। এ বিষয়ে মহান আল্লাহ বলেন: الرَّحْمَـنُ - عَلَّمَ الْقُرْآنَ - خَلَقَ الْإِنسَانَ - عَلَّمَهُ الْبَيَانَ "কুরনাময়"। তিনিই শিক্ষা মুসলিম ক্ব্বুরআন, করেছেন মানুষ, তাকে শিখিয়েছেন (ভাষা) ভাব প্রকাশের ক্ষমতা বা কথা বলার ক্ষমতা'' (সূরা রাহমান ১-৪)। আর এই ভাষা মানুষের মনের ভাব আদান প্রদান সর্বশ্রেষ্ঠ বাহন। আপাত দৃষ্টিতে যায়, জীবন হিতর পথ দেখা বাহান যদি মজবুত থাকে এবং বাহাক যদি হয় তবে বা জিনিসটি নির্ভাবনায় লক্ষ্যে গণক সহজ হয়। এখানে ভাষাগত বাহন, মানুষ তার বাহাক এবং মনের ভাব বাহিত জিনিস। বাহন, বাহক এবং বাহিত এই তিন দলে যে জাতি যতটা সে জাতি এই পাবিব হিসাবে অগ্রগামী। সতর্কতাগত বৈচিত্রে ভাব আদান প্রদানের বিষয়টা মানুষের প্রথম অর্জন করে তাদের মায়েদের কাছ থেকে। আমাদের সন্তান তার জন্মের পর আমার কাছ থেকে সেই ভাষা আয়ত্ব করে তার মাতৃভাষা। পূর্বাকিস্তান সংখ্যা গরি জনগণের মাতৃভাষা বাংলা রাষ্ট্রীয় মর্যাদা শক্তির দাবীর প্রেপে অংশে ১৯৫২ সালে সংঘটিত ঐতিহাসিক রাষ্ট্রভাষা আন্দোলন আন্দোলন ২১শে রাজনীতিতে রাজনৈতিক মতবাদ পরিগ্রহ করে। গৌরদীপ্ত এ প্রচারাভিযান শুরু বছর বছর ১৯৯৯ অভিষেক পর ১৭ই নভেম্বর তারিখে আমাদের ২১শে এপ্রিল তারিখে নতুন মরদায়। এই পঞ্চাশ ইউনেস্কো ২১শে এপ্রিলকে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা হিসেবে গতভাবে আমাদের ভাষা আন্দোলনকে মানুষের গৌরবিত উত্তরে রূপান্তরিত করেছে। ১লা মে যেমন আন্তর্জাতিক মে, যা পালিত হয় সুপ্রিম সবদেশ, ২০০০ থেকে ২১শে তারিখে সমগ্র বিশ্বব্যাপী আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা সাল পালিত হচ্ছে। আর ইসলামে এই মাতৃভাষা কী তাৎপর্য ও গূরুত্ব রয়েছে।

ভাষা:- (ইংরেজি: Language) ধারণাটির কোন সুনির্দিষ্ট, যৌক্তিক ও অবিতর্কিত সংজ্ঞা দেয়া কঠিন, কেননা যেকোন কিছুর সংজ্ঞা ভাষার মাধ্যমেই দিতে হয়। তাই ভাষার আত্মসংজ্ঞা প্রদান দুরূহ। তবে ভাষার একটি কার্যনির্বাহী সংজ্ঞা (working definition) হিসেবে বলা যায় যে, ভাষা মানুষের মস্তিষ্কজাত একটি মানসিক ক্ষমতা যা বাকসংকেতে রূপায়িত (ধ্বনিভিত্তিক বা লৈখিক রূপে) হয়ে একই সমাজের মানুষের মধ্যে যোগাযোগ স্থাপনে সহায়তা করে। ভাষা মানুষে-মানুষে যোগাযোগের প্রধানতম বাহন। ভাষার কতটুকু মানুষের কোন জন্মগত বৈশিষ্ট্য আর কতটুকু পরিবেশনির্ভর, সে ব্যাপারে আধুনিক ভাষাবিজ্ঞানীদের মতভেদ আছে। তবে সবাই একমত যে, স্বাভাবিক মানুষমাত্রেই ভাষা অর্জনের মানসিক ক্ষমতা নিয়ে জন্মায় এবং একবার ভাষার মূলসূত্রগুলি আয়ত্ত করে ফেলার পর বাকী জীবন ধরে মানুষ তার ভাষায় অসংখ্য নতুন নতুন বাক্য সৃষ্টি করতে পারে। এরকম অসীম প্রকাশক্ষমতাসম্পন্ন ভাষা একান্তই একটি মানবিক বৈশিষ্ট্য; মানুষ ছাড়া আর কোন প্রাণী এই ক্ষমতার অধিকারী নয়। প্রতিটি মানুষ ভাষা আয়ত্ত করার সহজাত বৈশিষ্ট্য নিয়ে জন্ম নেয় এবং ঐ মানুষটি যে নির্দিষ্ট ঐতিহাসিক পর্যায়ের নির্দিষ্ট ভৌগোলিক পরিবেশ-বেষ্টিত ভাষিক সমাজের অন্তর্গত, সেই সমাজে সে দৈনন্দিন ভাষাপ্রয়োগের মাধ্যমে তার নিজস্ব ভাষাজ্ঞান বিকশিত করে।

ভাষা মূলত বাগযন্ত্রের মাধ্যমে কথিত বা "বলা" হয়, কিন্তু একে অন্য মাধ্যমে তথা লিখিত মাধ্যমেও প্রকাশ করা সম্ভব। এছাড়া প্রতীকী ভাষার (sign language) মাধ্যমেও ভাবের আদান-প্রদান হতে পারে। ভাষার একটি গুরুত্বপূর্ণ বৈশিষ্ট্য হল একটি ভাষিক প্রতীক (linguistic sign) এবং এর দ্বারা নির্দেশিত অর্থের (meaning) মধ্যকার সম্পর্ক । একই বস্তু বা ধারণা কেন বিভিন্ন ভাষায় ভিন্ন ধরনের ধ্বনিসমষ্টি দ্বারা নির্দেশিত হয় (যেমন - একটি গৃহপালিত চতুষ্পদ প্রাণীর নাম বাংলায় গরু, ইংরেজি ভাষায় Cow কাও, ফরাসি ভাষায় Vache ভাশ্‌, ইত্যাদি কেন হয়), তার পেছনে একেকটি ভাষার বক্তাসমাজের ভেতর সমঝোতার ভিত্তিতে গড়ে ওঠা রীতিনীতি ছাড়া আর কোন কারণ নেই। মানুষের ভাষার সাথে অন্য প্রাণীদের যোগাযোগের "ভাষার" একটা বড় পার্থক্য হল ভাষার সাহায্যে মানুষ বিভিন্ন ধরনের বিষয় নিয়ে আলোচনা করতে পারে, যা প্রাণীরা পারে না। যেমন - মৌমাছিদের নাচ কেবল মধু আহরণের সুবিধার জন্যই কাজে লাগে। আর উল্লুক জাতীয় বানরদের ভাষিক দক্ষতা অন্যান্য প্রাণীদের চেয়ে বেশি হলেও বিজ্ঞানীরা দেখেছেন যে সামগ্রিকভাবে তাদের ভাষা একটি দুই বছরের মনুষ্য শিশুর ভাষার চেয়ে উন্নত নয়।

     "ভাষা হল মনের ভাব প্রকাশ করার মাধ্যম"

তাই প্রচলিত মাধ্যম গুলি (১) ধ্বনি (২) লিপি, এদুটি ছাড়া ও (৩) সাংকেতিক (৪) শারীরিক ভঙ্গিমা, যেমন:- চোখ, ঠোঁট, হাত, পা, মাথা দিয়ে ইশারা, (৫) মনের বা হৃদয়ের ভাষা, কান্না, হাসি, বিষাদ । এই মাধ্যম গুলি দিয়ে মনের ভাব প্রকাশিত হয়।


ভাষার উৎপত্তি:- বিশ্বের অনেক ধর্মেই ভাষার উৎস সম্পর্কে বলা হয়েছে। ইহুদী-খ্রিস্টান-ইসলাম ধর্মের ধারায় বলা হয়, যা পবিত্র ক্বুরআনুল কারীমে উল্লেখ আছে - وَعَلَّمَ آدَمَ الْأَسْمَاءَ كُلَّهَا ثُمَّ عَرَضَهُمْ عَلَى الْمَلَائِكَةِ فَقَالَ أَنبِئُونِي بِأَسْمَاءِ هَـؤُلَاءِ إِن كُنتُمْ صَادِقِينَ - قَالُوا سُبْحَانَكَ لَا عِلْمَ لَنَا إِلَّا مَا عَلَّمْتَنَا إِنَّكَ أَنتَ الْعَلِيمُ الْحَكِيمُ - قَالَ يَا آدَمُ أَنبِئْهُم بِأَسْمَائِهِمْ فَلَمَّا أَنبَأَهُم بِأَسْمَائِهِمْ قَالَ أَلَمْ أَقُل لَّكُمْ إِنِّي أَعْلَمُ غَيْبَ السَّمَاوَاتِ وَالْأَرْضِ وَأَعْلَمُ مَا تُبْدُونَ وَمَا كُنتُمْ تَكْتُمُونَ - আর আল্লাহ তা’আলা শিখালেন আদমকে সমস্ত বস্তু-সামগ্রীর নাম। তারপর সে সমস্ত বস্তু-সামগ্রীকে ফেরেশতাদের সামনে উপস্থাপন করলেন। অতঃপর বললেন, আমাকে তোমরা এগুলোর নাম বলে দাও, যদি তোমরা সত্যবাদী হয়ে থাক। *তারা বলল, তুমি পবিত্র! আমরা কোন কিছুই জানি না, তবে তুমি যা আমাদিগকে শিখিয়েছ (সেগুলো ব্যতীত) নিশ্চয় তুমিই প্রকৃত জ্ঞানসম্পন্ন, হেকমতওয়ালা। *তিনি বললেন, হে আদম, ফেরেশতাদেরকে বলে দাও এসবের নাম। তারপর যখন তিনি বলে দিলেন সে সবের নাম, তখন তিনি বললেন, আমি কি তোমাদেরকে বলিনি যে, আমি আসমান ও যমীনের যাবতীয় গোপন বিষয় সম্পর্কে খুব ভাল করেই অবগত রয়েছি? এবং সেসব বিষয়ও জানি যা তোমরা প্রকাশ কর, আর যা তোমরা গোপন কর! (সূরা আল বাক্বারাহ ৩১-৩৩)। মহান স্রষ্টা আল্লাহ পৃথিবীর প্রথম মানুষ আদম (আঃ)কে সব কিছুর নাম শিক্ষাদানের মাধ্যমে মূলত ভাষাজ্ঞান তথা কথা বলার ক্ষমতা দান করেন, যার মাধ্যমে তিনি আদম (আঃ) বিশ্বের যাবতীয় পশু-পাখীর উপর কর্তৃত্ব দেন, এবং আদম এই সব পশু-পাখির একটি করে নাম দেন; এটি ছিল আদমের ভাষাজ্ঞানের প্রথম বড় প্রয়োগ। পৃথিবীতে মানব জাতি সৃষ্টির বহুকাল আগেই রব্বুল আলামীন ভাষা সৃষ্টি করেছেন। তখন পর্যন্ত এই নভোমন্ডল ও ভুমন্ডল কিছুই সৃষ্টি করা হয় নি। রাসূল (সাঃ) এর হাদীসে এ সম্পর্কীয় ইঙ্গিত রয়েছে, যেমন- عَنْ عَبْدِ اللهِ بْنِ عَمْرِو بْنِ الْعَاصِ قَالَ: سَمِعْتُ رَسُولَ اللهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ، يَقُولُ: " كَتَبَ اللهُ مَقَادِيرَ الْخَلَائِقِ قَبْلَ أَنْ يَخْلُقَ السَّمَاوَاتِ وَالْأَرْضَ بِخَمْسِينَ أَلْفَ سَنَةٍ، قَالَ: وَعَرْشُهُ عَلَى الْمَاءِ "، - “ আব্দুল্লাহ ইব্নে আমর ইব্নুল আস (রাঃ) থেকে বর্ণিত তিনি বলেন, রাসূল সাঃ বলেছেন – নভোমন্ডল এবং ভূমন্ডল সৃষ্টির পঞ্চাশ হাজার বছর আগে মহান আল্লাহ সৃষ্টির তাক্বদীর লিপিবদ্ধ করেন ’’ (মুসলিম, কিতাবুল ক্বাদর, হাদীস নং- ২৬৫৩) । উক্ত হাদীসে তাক্বদীর লিপিবদ্ধ করার বিষয়টি ভাষার অস্তিত্বের প্রমাণ করে। আল্লাহ তাআ’লা তার সৃষ্টি জগতের সূচনা লগ্নে যেসব জিনিস সৃষ্টি করেন সে সবের মধ্যে কলম অন্যতম। কলম সৃষ্টি সংক্রান্ত হাদীসে আমরা প্রমাণ পাই যে তখনও ভাষা ছিল। রাসূল (সাঃ) বলেন – إن أول ما خلق الله القلم فقال أكتب قال يا ربّ ماذا أكتب قال أكتب مقادير كل شيئ حتى تقوم الساعة – “ নিশ্চয়ই আল্লাহ সর্বপ্রথম কলম সৃষ্টি করে বলেন লিখ, সে বলল, হে রব কী লিখব? তিনি বললেন কিয়ামত পর্যন্ত যা কিছু ঘটবে তার সব কিছুর তাক্বদীর লিখ ’’ (আবু নুআ’ইম ইস্পাহানী হিলওয়াতুল আওলিয়া খন্ড-০৫, পৃষ্ঠা -২৪৮)। এখানে কলমের সাথে আল্লাহর কথোপকথন ভাষার অস্তিত্বের প্রমাণ বহন করে। সুতরাং বলা চলে ভাষার সৃষ্টি এই নশ্বর জগতের সূচনা লগ্নেই। আর এটাও প্রমাণিত হলো যে, ভাষা লিখা বা বলার মাধ্যমে মনের ভাব প্রকাশ করার পদ্ধতিটা মহান আল্লাহই স্বীয় অনুগ্রহে আমাদের শিখিয়েছেন। যার দলীল আল্লাহ তাআ’লা নিজেই প্রথম অহী নাযিলের দিন দিয়েছেন اقْرَأْ وَرَبُّكَ الْأَكْرَمُ - الَّذِي عَلَّمَ بِالْقَلَمِ - عَلَّمَ الْإِنسَانَ مَا لَمْ يَعْلَمْ “পাঠ করুন আপনার সম্মানিত রবের নামে, যিনি কলমের সাহায্যে শিক্ষা দিয়েছেন, শিক্ষা দিয়েছেন মানুষকে যা সে জানত না’’(সূরা আল আ’লাক্ব ৩-৫)।

ভাষার প্রকৃতি:- সব মানুষই অন্তত একটি ভাষার সাথে ঘনিষ্ঠভাবে পরিচিত। বিভিন্ন ধ্বনি পরপর সাজিয়ে তৈরি হয় শব্দ, আর অনেক শব্দ নানা বিন্যাসে সাজিয়ে গড়া অসংখ্য সব বাক্য নিয়ে তৈরি হয় একটি ভাষা। কিন্তু কোন ভাষায় কতগুলি বাক্য হতে পারে, তার কোন সীমাবদ্ধতা নেই। ভাষার বক্তারা কতগুলি সীমিত সংখ্যক সূত্র কাজে লাগিয়ে অসীম সংখ্যক বাক্য বলতে ও বুঝতে পারেন। আধুনিক ভাষাবিজ্ঞানের পরিভাষায় এই সূত্রগুলিকে বলা হয় বক্তার মানসিক ব্যাকরণ। বক্তা যখন ছোটবেলায় ভাষা অর্জন করে, তখন তার মধ্যে এই মানসিক ব্যাকরণের বোধ গড়ে ওঠে। এই ব্যাকরণের অংশ হিসেবে আছে ভাষাটির ধ্বনিব্যবস্থা (ধ্বনিতত্ত্ব), শব্দের গঠন (রূপমূলতত্ত্ব), কীভাবে একাধিক শব্দ সংযুক্ত হয়ে পদগুচ্ছ বা বাক্য গঠন করে (বাক্যতত্ত্ব), ধ্বনি ও অর্থের মধ্যে সম্পর্ক (অর্থবিজ্ঞান), এবং ভাষার শব্দভাণ্ডার। ভাষা হল সেই ব্যবস্থা যা ধ্বনির সাথে অর্থের সম্পর্ক স্থাপন করে। ভাষা সম্পর্কে কোন মানুষের এই মানসিক বোধ, বাস্তব জীবনে তার ভাষার প্রয়োগ অপেক্ষা স্বতন্ত্র। মানুষ বাক বৈকল্যের শিকার হয়ে বা অন্য যেকোন কারণে ভাষাপ্রয়োগে ভুল করতে পারে, কিন্তু এতে তার ভাষাবোধের কিছু হয় না।

ব্যাকরণ বিভিন্ন রকম হতে পারে। বর্ণনামূলক ব্যাকরণে ভাষার বক্তার অচেতন ভাষিক জ্ঞানের একটি বিবরণ দেওয়ার চেষ্টা করা হয়। এটি ভাষার বক্তার মানসিক ব্যাকরণের একটি মডেল হিসেবে গণ্য করা যায়। বিধানমূলক ব্যাকরণে ভাষার ব্যাকরণ কী রকম হওয়া উচিত, তার বিধিবিধান দেয়ার চেষ্টা করা হয়। অনেক সময় বিদেশী ভাষা শেখানোর উদ্দেশ্যে শিক্ষামূলক ব্যাকরণ লেখা হয়।

ভাষাবিজ্ঞানীরা বিশ্বের হাজার হাজার ভাষা নিয়ে গবেষণা করে বের করেছেন যে এদের মধ্যে বহু পার্থক্য থাকলেও এই পার্থক্যের পরিমাণ সীমিত। সব ভাষার ব্যাকরণেই কিছু বিশ্বজনীন অংশ আছে। ভাষাবিজ্ঞানীরা ভাষাসমূহের এই বিশ্বজনীন বৈশিষ্ট্যগুলিকে কতগুলি নিয়মনীতির সাহায্যে ব্যাখ্যা করার চেষ্টা করছেন। এই নিয়মনীতিগুলির সমষ্টিগত নাম দেয়া হয়েছে বিশ্বজনীন ব্যাকরণ। ভাষাবিজ্ঞানীরা মনে করেন, বিশ্বজনীন ব্যাকরণ সব ভাষার ব্যাকরণের ভিত্তি হিসেবে কাজ করে এবং এর মানুষের সহজাত ভাষা অর্জন ক্ষমতার সরাসরি সম্পর্ক আছে।

শিশুদের ভাষা অর্জনের পদ্ধতি বিশ্বজনীন ব্যাকরণের অস্তিত্বের সাক্ষ্য দেয়। শিশুদেরকে জোর করে ভাষা শেখানো লাগে না। যেকোন মানব ভাষার উন্মুক্ত সংস্পর্শে আসলেই শিশুরা দ্রুত তা শিখে ফেলতে পারে। শিশুরা কতগুলি নির্দিষ্ট ধাপে ভাষা শেখে। খুব কম বয়সেই ভাষা অর্জনের প্রক্রিয়াটি শুরু হয়। চার বা পাঁচ বছর বয়সের মধ্যেই শিশুরা ভাষার সম্পূর্ণ ব্যাকরণ (এখানে ব্যাকরণ বলতে স্কুলপাঠ্য ব্যাকরণ বই নয়, ভাষার বাক্য গঠনের অন্তর্নিহিত মানসিক নিয়মগুলি বোঝানো হয়েছে) আয়ত্ত করে ফেলে। এ থেকে বোঝা যায় যে, শিশুরা বংশগতভাবেই ভাষা অর্জন ও ব্যবহারের ক্ষমতা নিয়ে জন্মায়, এবং এই ক্ষমতা বিশ্বজনীন ব্যাকরণের অংশ।

বধির শিশুরা প্রতীকী ভাষা শেখার ক্ষেত্রেও অনুরূপ দক্ষতা দেখায়। অর্থাৎ ভাষা অর্জনের ক্ষেত্রে ধ্বনি শোনা বা উৎপাদন করা পূর্বশর্ত নয়। প্রতীকী ভাষাগুলি দৃষ্টি ও ইঙ্গিতভিত্তিক হলেও এগুলি কথ্য ভাষাগুলির চেয়ে কোন অংশে অনুন্নত বা গাঠনিক দিক থেকে কম জটিল নয়।

 যদি ভাষাকে কেবলমাত্র যোগাযোগের একটি উপায় হিসেবে সংজ্ঞায়িত করা হয়, তবে এটি মানুষের জন্য সীমাবদ্ধ একটি বৈশিষ্ট্য নয়। কিন্তু মানুষের ভাষার এমন কিছু বৈশিষ্ট্য আছে, যা অন্য প্রাণীদের যোগাযোগ ব্যবস্থাগুলিতে দেখা যায় না। মানুষের ভাষার সবচেয়ে বড় বৈশিষ্ট্য হল তার সৃষ্টিশীলতা---প্রাথমিক ভাষিক এককগুলিকে সংযুক্ত করে অসীম সংখ্যক বৈধ বাক্য সৃষ্টির ক্ষমতা, যে বাক্যগুলির অনেকগুলিই হয়ত আজও কেউ বলেনি বা শোনেনি।

ভাষাবিজ্ঞানীরা ভাষা সম্পর্কে গবেষণা করে অনেকগুলি সত্য বের করেছেন, যেগুলি সব ভাষার জন্য প্রযোজ্য: যেখানেই মানুষ আছে, সেখানেই ভাষা আছে। আদিম ভাষা বলে কিছু নেই। সব মনুষ্য ভাষাই সমান জটিল এবং মহাবিশ্বের যেকোন ধারণা প্রকাশে সমভাবে সক্ষম। যেকোন ভাষার শব্দভাণ্ডারকে নতুন ধারণা প্রকাশের সুবিধার্থে নতুন শব্দ গ্রহণ করিয়ে সমৃদ্ধ করা যায়। সব ভাষাই সময়ের সাথে পরিবর্তিত হয়। সব মনুষ্য ভাষাতেই কতগুলি সসীম সংখ্যক ধ্বনি বা ইঙ্গিত থাকে যেগুলি জোড়া লাগিয়ে অর্থপূর্ণ একক বা শব্দ তৈরি করা হয়, এবং এই শব্দগুলিকে আবার জোড়া লাগিয়ে অসীম সংখ্যক সম্ভাব্য বাক্য তৈরি করা যায়। সব ভাষার শব্দ ও বাক্যগঠনের সূত্রগুলি প্রায় একই ধরনের। প্রতিটি কথ্য ভাষার বিচ্ছিন্ন ধ্বনি-একক আছে, যেগুলিকে কতগুলি ধ্বনিবৈশিষ্ট্যের মাধ্যমে সংজ্ঞায়িত করা যায়। প্রতিটি কথ্য ভাষায় স্বরধ্বনি ও ব্যঞ্জনধ্বনি আছে। সব ভাষাতেই ব্যাকরণিক ক্যাটেগরি যেমন- বিশেষ্য, ক্রিয়া, ইত্যাদি দেখতে পাওয়া যায়। সব ভাষাতেই পুং বা স্ত্রী, মানুষ, জীবিত, ইত্যাদি বিশ্বজনীন আর্থিক বৈশিষ্ট্য দেখতে পাওয়া যায়। সব ভাষাতেই না-বাচকতা, প্রশ্ন করা, আদেশ দেওয়া, অতীত বা ভবিষ্যত নির্দেশ করা, ইত্যাদির ব্যবস্থা আছে। মানুষের ভাষায় ভাষায় যে পার্থক্য, তার কোন জৈবিক কারণ নেই। যেকোন সুস্থ স্বাভাবিক মানব শিশু পৃথিবীর যেকোন ভৌগোলিক, সামাজিক, জাতিগত বা অর্থনৈতিক পরিবেশে যেকোন ভাষা শিখতে সক্ষম।

ভাষার উপাদান:- মানুষের মুখের ভাষা অনেকগুলি ধ্বনি নিয়ে গঠিত। এই ধ্বনিগুলির নিজস্ব কোন অর্থ নেই। যেমন - ক্‌, অ, প্‌, আ, ল্‌ --- এই ধ্বনিগুলি উচ্চারণ করলে কোন কিছু বুঝা যায় না। কিন্তু ধ্বনিগুলি একত্রে যখন "কপাল" শব্দ হিসেবে উচ্চারণ করা হয়, তখন একজন বাংলাভাষী লোক এদের মধ্যে অর্থ খুঁজে পান। ভাষার আরেকটি বৈশিষ্ট্য এর জটিল আন্বয়িক বা বাক্যিক ব্যবস্থা, যার নিয়মগুলি ভাষার শব্দগুলি কোন্‌টির পর কোন্‌টি কী ক্রমে বসে বিভিন্ন পদগুচ্ছ, খণ্ডবাক্য ও বাক্য গঠন করবে, তার দিকনির্দেশ দেয়।

বিশ্বের বিভিন্ন ভাষা:- ভাষাবিদদের মতে, ভাষার বৈচিত্রে পৃথিবীতে প্রায় ৩হাজার ভাষা রয়েছে। কোন কোন গবেষকদের মতে প্রায় ৮ হাজার ভাষা আছে। ঈথনোলোগ নামের বিশ্বকোষের ২০০৯ সালে প্রকাশিত সংস্করণে বলা হয়েছে, জীবিত ভাষার সংখ্যা ৬০৯০৯টি। উইকিপিডিয়ার মতে বর্তমানে ৭৩৩০টি ভাষার সন্ধান পাওয়া যায়। পৃথিবীর সব ভাষাই আল্লাহ তায়ালার দান। মানুষকে তিনি বাকশক্তি দান করেছেন। তাই ভাষার সাহায্যে মানুষ তার ভাব, কল্পনা, ইচ্ছা, স্বাধ কথা বলা- লিখার মাধ্যমে প্রকাশ করতে পারছে। আল্লাহতায়ালা এরশাদ করছেন- الرَّحْمَـنُ - عَلَّمَ الْقُرْآنَ - خَلَقَ الْإِنسَانَ - عَلَّمَهُ الْبَيَانَ “পরম করুণাময়। তিনি কুরআন শিক্ষা দিয়েছেন। তিনি মানুষকে সৃষ্টি করেছেন। তিনি ভাষা শিখিয়েছেন” (সূরা রাহমান, ১-৪)। পৃথিবীর সকল কওম বা জাতি-গোষ্ঠীর নিকট নবী-রাসূল এসেছেন। সকল নবী- রাসূল প্রত্যেক জাতির মাতৃভাষায় দাওয়াতী কাজ করেছেন। রাসূল (সাঃ) বিশুদ্ধ মাতৃভাষায় কথা বলতেন। বিশুদ্ধ মাতৃভাষায় কথা বলা সুন্নাত। বাংলা আমাদের মাতৃভাষা। এ জন্য উলামায়ে কেরামের উচিত বিশুদ্ধ বাংলা ভাষা শিক্ষা ও চর্চা করা।

বিশ্বের ১১টি সর্বাধিক প্রচারিত ভাষা হল চীনা, ইংরেজি, হিন্দি-উর্দু, স্পেনীয়, আরবী, পর্তুগীজ, রাশিয়ান, বাংলা, জাপানি, জার্মান ও ফরাসী। এই সবকটি ভাষায় কথা বলেন বিশ্বের অর্ধেক মানুষ। আশ্চর্যের বিষয় হল, বিশ্বে এত ভাষা থাকতেও হাতে গোণা কয়েকটি ভাষাতেই কথা বলেন ভুবনডাঙার মোট ৯৬ শতাংশ বাসিন্দা। সবচেয়ে বেশি ভাষার আঁতুড়ঘর দুটি দেশ। পাপুয়া নিউ গিনি, যেখানে ৮৫০টিরও বেশী ভাষা রয়েছে। অপরটি ইন্দোনেশিয়া, যেখানে ৬৭০টি ভাষা লোকমুখে ফেরে। মহাদেশের বিচারে বিশ্বের ১০০০টির মধ্যে ১৫ শতাংশ ভাষায় কথা বলা হয় দক্ষিণ ও উত্তর আমেরিকায়, আফ্রিকায় ৩০ শতাংশ, এশিয়াতেও শতাংশের হিসেব ৩০, সবচেয়ে কম ইউরোপে, সেখানে মাত্র ৩ শতাংশ।এদের মধ্যে অনেকগুলিই ভাষাই পরস্পরের সঙ্গে সংযুক্ত। আবার অনেকগুলি ভাষা আছে যেগুলি একটিই ভৌগোলিক অঞ্চলে বসবাসকারী মানুষই ব্যবহার করতেন। বংশধরদের অভাবে সেই ভাষা শেষ হয়ে গিয়েছে। হাতের কাছে উদাহরণ রয়েছে, বাস্ক, উস্কারা-যে ভাষাগুলি বক্তার অভাবে হারিয়ে গিয়েছে।

প্রতিনিয়ত ভাষা ও ভাষায় শব্দের ব্যবহার পাল্টে যাচ্ছে। অনেক ভাষা অস্তিত্ব রক্ষায় অন্যের সঙ্গে নিজেকে মিশিয়ে নিচ্ছে। যার ফলে খর্ব হচ্ছে ভাষার স্বাতন্ত্র্যতা। সমীক্ষা বলছে, প্রতি ১৫ দিনের একটি করে ভাষা মুছে যাচ্ছে পৃথিবীর বুক থেকে। কয়েকটি ভাষা অবশ্য সরকারী বদান্যতায় স্বমহিমায় ফিরেও এসেছে। যেমন ওয়েলস, মাওরির মত ভাষা সরকারী আনুকূল্য পেয়েছে। মাত্র ২ কোটি ৭৫ হাজার মানুষ মাতৃভাষায় কথা বললেও সেই ভাষাকে স্বমহিমায় বাঁচিয়ে রেখেছে আইসল্যান্ড।

মাতৃভাষা:- আরবিতে বলাহয় ‌ لغة الوطنية او لغة الأمّ স্বদেশী ভাষা বা মায়ের ভাষা, আর ইংরেজিতে বলা হয়- Mother tongue, First Language, Native language, ইত্যাদি। জন্মের পর থেকে মানুষ যে ভাষায় কথা বলে সেটিই তার মাতৃভাষা। সাধারণত মায়ের কোল থেকে এভাষা শেখা শুরু হয় তাই একে আমরা মাতৃভাষা বলি। বিস্তারিতভাবে বলতেগেলে মানুষ যে ভাষায় কথা বলতে সবচেয়ে বেশি পারদর্শী, যে ভাষাটি সে তার পিতা-মাতা বা অভিভাবকের কাছ থেকে ছোটবেলায় শিখেছে এবং ভাষাটি যে অঞ্চলে বহুল প্রচলিত, সে অঞ্চলের মানুষের মতই ভাষাটিতে কথা বলতে সক্ষম, তাকে সাধারণভাবে মাতৃভাষা বলা হয়। এছাড়াও মাতৃভাষা যেহেতু এক জন মানুষের প্রথম এবং মূল ভাষা, এ কারণেও মাতৃভাষা নামকরণ যথার্থ। মায়ের প্রতি একটা শিশুর আকর্ষণ যেমন স্বাভাবিক মাতৃভাষার প্রতি আকর্ষণও তেমনি স্বাভাবিক। এ ফিৎরাত তথা স্বভাব মহান আল্লাহ প্রদত্ব। আল্লাহর বাণী- فَأَقِمْ وَجْهَكَ لِلدِّينِ حَنِيفًا فِطْرَتَ اللَّـهِ الَّتِي فَطَرَ النَّاسَ عَلَيْهَا لَا تَبْدِيلَ لِخَلْقِ اللَّـهِ ذَلِكَ الدِّينُ الْقَيِّمُ وَلَـكِنَّ أَكْثَرَ النَّاسِ لَا يَعْلَمُونَ – “তুমি একনিষ্ঠ ভাবে নিজেকে ধর্মের উপর প্রতিষ্ঠিত রাখ। এটাই আল্লাহর প্রকৃতি, যার উপর তিনি মানব সৃষ্টি করেছেন। আল্লাহর সৃষ্টির কোন পরিবর্তন নেই। এটাই সরল ধর্ম। কিন্তু অধিকাংশ মানুষ জানে না’’ (সূরা আল রূম- ৩০)। সুতরাং যাদের মাতৃভাষা বাংলা তারা যে মহান আল্লাহর সৃষ্টিগত ভাষা বৈচিত্রের ফিৎরাতই বুকে ধারণ করে আছে তাতে কোন সন্দেহ নেই। 

মাতৃভাষা অর্জন:- মাতৃভাষা অর্জন একটি জটিল প্রক্রিয়া এবং ভাষাবিজ্ঞানীরা এর প্রকৃতি সম্পর্কে এখনও পুরোপুরি জানতে পারেননি। ছোট শিশুদের মধ্যে প্রবৃত্তিগতভাবেই কিছু বৈশিষ্ট্য থাকে যা তাদেরকে শিশু বয়সেই মাতৃভাষা অর্জনের উপযোগী করে তোলে। এই বৈশিষ্ট্যগুলির মধ্যে আছে বাগনালীর গঠন, যার মাধ্যমে শিশু তার মাতৃভাষার বিভিন্ন শব্দ উৎপাদন করে। এছাড়া শিশুদের সাধারণ ব্যাকরণিক মূলনীতিগুলি এবং বাক্যগঠনের স্তরগুলি বোঝার ক্ষমতা থাকে। শিশুরা কোন নির্দিষ্ট ভাষা শিক্ষার প্রতি আকৃষ্ট হয় না। বরং যে ভাষা তাদের আশেপাশে বলা হয়, তারা সেই ভাষাই শিখে ফেলে, এমনকি যদি তাদের পিতামাতা অন্য কোন ভাষাতে কথা বলে, তা হলেও। যেমন- আমাদের পার্শ্ববর্তী দেশ ভারতের হিন্দিভাষা বর্তমানে স্বাধীন বাংলাদেশে বিভিন্ন অশ্লীল টিভি সিনেমা ও নাটকের মাধ্যমে আমাদের শিশুদের মগজে ভাইরাসের মত ছড়িয়ে পড়ছে! প্রাথমিক ভাষা অর্জনের একটি কৌতূহলোদ্দীপক বৈশিষ্ট্য হল শিশুরা প্রথম বাক্যের গঠনের চেয়ে অর্থের উপর বেশি জোর দেয়। যেই পর্যায়ে তারা সচেতনভাবে সুসংগঠিত বাক্য বলতে আরম্ভ করে, সেই পর্যায়েই মনুষ্য শিশুরা ভাষিক দক্ষতায় অন্য জাতীয় প্রাণীদের ছাড়িয়ে যায়।

দ্বিতীয় ভাষা অর্জন:- যদিও দ্বিতীয় ভাষা অর্জন বলতে আক্ষরিকভাবে মাতৃভাষা অর্জনের পরে অপর একটি ভাষা অর্জনকে বুঝায়, প্রায়শই এই পরিভাষাটি দিয়ে বয়ঃসন্ধিকালের পরে দ্বিতীয় একটি ভাষা অর্জনের ঘটনাকে বুঝানো হয়ে থাকে। শিশুরা একাধিক ভাষা অর্জনে তেমন কোন কষ্টের সম্মুখীন হয় না। কিন্তু বয়ঃসন্ধির পরে দ্বিতীয় কোন ভাষা শিখতে মানুষকে অতিরিক্ত পরিশ্রম করতে হয় এবং প্রায়শই সেই ভাষাতে সে উচ্চ স্তরের দক্ষতা অর্জন করতে পারে না। মানুষ যদি দ্বিতীয় ভাষাটি বক্তা সম্প্রদায়ে ও তাদের শিল্প, সাহিত্য ও সংস্কৃতিতে বেশী বেশী ব্যবহার করে তবেই সে ভাষাটি সবচেয়ে সফলভাবে আয়ত্তে আনতে পারে। এছাড়া যেসমস্ত সংস্কৃতিতে দ্বিতীয় ভাষা শেখার উপর জোর দেওয়া হয়, সেখানেও দ্বিতীয় ভাষা অর্জন সহজ হয়। উদাহরণস্বরূপ আফ্রিকান বহু দেশে দ্বিতীয় ভাষা হিসেবে ফরাসি ভাষা অর্জনের ঘটনাকে উল্লেখ করা যায়।

দ্বিভাষিকতা ও বহুভাষিকতা:- দ্বিভাষিকতা বলতে দুইটি ভাষা দক্ষভাবে প্রয়োগের ক্ষমতা এবং বহুভাষিকতা বলতে দুইয়ের বেশি ভাষার দক্ষ প্রয়োগের ক্ষমতাকে বুঝায়। বিশ্বের বেশির ভাগ অঞ্চলেই দ্বিভাষিকতা প্রচলিত। যেমন- পার্শ্ববর্তী দেশ ইন্ডিয়ার অনেকেই জন্মগতভাবেই তাদের মাতৃভাষা হিন্দির পাশাপাশি সমভাবে ইংরেজি ভাষাও বলতে সক্ষম, অনুরূপভাবে জাতিসংঘ শান্তিমিশনের কল্যাণে বাংলাদেশ আর্মির সৌজন্যে সুদূর আফ্রিকার সিয়েরালিওন তাদের মাতৃভাষার পাশাপাশি বাংলাকে দ্বিতীয় অফিসিয়াল ভাষা হিসেবে বরণ করে নিয়েছে। আর এই দ্বিভাষী বা বহুভাষী মানুষদের মধ্যে বিভিন্ন ভাষার দক্ষতার তারতম্য পরিলক্ষিত হয়: কেউ হয়ত একটি ভাষায় ভাল লিখতে এবং অপরটিতে ভাল বলতে পারেন, ইত্যাদি।

ভাষার বৈচিত্রময়তায় রয়েছে জ্ঞানীদের জন্য আল্লাহ তাআ’লার নিদর্শন:- এ বিশ্ব জাহানের মানুষ, প্রকৃতি ও অন্যান্য সকল সৃষ্টির বৈচিত্রের ন্যায় ভাষার বৈচিত্রও আল্লাহ তাআ’লার মহান কুদরতের মহা-নিদর্শন। মহান আল্লাহ বলেন-وَمِنْ آيَاتِهِ خَلْقُ السَّمَاوَاتِ وَالْأَرْضِ وَاخْتِلَافُ أَلْسِنَتِكُمْ وَأَلْوَانِكُمْ إِنَّ فِي ذَلِكَ لَآيَاتٍ لِّلْعَالِمِينَ

“তাঁর আরও এক নিদর্শন হচ্ছে নভোমন্ডল ও ভূমন্ডলের সৃজন এবং তোমাদের ভাষা ও বর্ণের বৈচিত্র। অবশ্যই এতে জ্ঞানীদের জন্যে নিদর্শনাবলী রয়েছে’’ (সূরা আররূম- ২২) । আমরা যদি আল্লাহর নির্দেশ মুতাবেক গভীরভাবে চিন্তা ও গবেষণা করি তাহলে খুব সহজেই তার নিদর্শনাবলী আমাদের চোখের সামনে ফুটে উঠবে। তন্মধ্যে মানুষের ভাষা ও বর্ণের বৈচিত্রের নিদর্শন নিয়ে আলোকপাত করলে দেখা যায় যে, পৃথিবীর আনাচে কানাচে মানুষেরা হাজার হাজার ভাষা ও উপভাষায় কথা বলে। আল্লাহ রাব্বুল আ’লামীন সকল মানুষের ভাষাই বুঝেন, কিন্তু এক ভাষার মানুষ অন্য ভাষা না শিখা পর্যন্ত সেই ভাষা বুঝেনা। পৃথিবীর এবিশাল মানব গোষ্ঠীকে তিনি ভাষা বৈচিত্র দিয়ে আলাদা করতে চেয়েছেন; যাতে এক ভাষা গোষ্ঠীর মানুষ অন্য ভাষা গোষ্ঠীর মানুষকে আলাদা চিনতে পারে। গোষ্ঠীগত পরিচয় ছাড়াও মানুষের ভাষায় আরেক ধরণের সূক্ষ্ম বৈচিত্র রয়েছে যা দিয়ে প্রতিটি মানুষকে আলাদা করে চিনার সুবিধা দেয়। আর তা হলো, স্বর-বৈচিত্র। একই ভাষায় কথা বলা সত্ত্বেও স্বর-বৈচিত্র মানুষকে আলাদা করেদেয়। একজন পূর্ব পরিচিত মানুষ দৃষ্টির আড়াল থেকে কথা বললেও শুধুমাত্র তার কন্ঠ-স্বর শুনেই তাকে চিনে ফেলা যায়। পৃথিবীতে জনসংখ্যা বর্তমানে প্রায় সাড়ে সাতশ কোটি। আল্লাহ রাব্বুল আ’লামীন এই সাড়ে সাতশ কোটি লোকের প্রত্যেককে স্বতন্ত্র কন্ঠস্বর দিয়েছেন, সুবহানাল্লহ! এ সব বৈচিত্র তিনি দান করেছেন শুধু পরস্পরের পরিচিতির জন্য, মর্যাদা বা গর্ব-অহঙ্কারের জন্য নয়। মূল উদ্দেশ্য হচ্ছে জাতির কাছে সহজ পন্থায় বোধগম্য ভাষায় ইসলামের আহবান পৌছিয়ে দেয়া। এ বিষয়ে মহান আল্লাহ বলেন: يَا أَيُّهَا النَّاسُ إِنَّا خَلَقْنَاكُم مِّن ذَكَرٍ وَأُنثَى وَجَعَلْنَاكُمْ شُعُوبًا وَقَبَائِلَ لِتَعَارَفُوا إِنَّ أَكْرَمَكُمْ عِندَ اللَّـهِ أَتْقَاكُمْ إِنَّ اللَّـهَ عَلِيمٌ خَبِيرٌ -“হে মানব সম্প্রদায়, আমি তোমাদেরকে এক পুরুষ ও এক নারী থেকে সৃষ্টি করেছি এবং তোমাদেরকে বিভিন্ন জাতি ও গোত্রে বিভক্ত করেছি, যাতে তোমরা পরস্পরে পরিচিতি হও। নিশ্চয় আল্লাহর কাছে সে-ই সর্বাধিক সম্ভ্রান্ত যে সর্বাধিক পরহেযগার। নিশ্চয় আল্লাহ সর্বজ্ঞ, সবকিছুর খবর রাখেন’’(সূরা আল হুজরাত- ১৩)। জাতি,ভাষা ও বর্ণগত এত বৈচিত্র হওয়া সত্ত্বেও পরস্পরের মধ্যে মর্যাদার মাপকাঠি রেখেছেন মাত্র একটি, আর তা হলো তাক্বওয়া।   

ইসলামে মাতৃভাষার গূরুত্ব ও মর্যাদা:- মায়ের ভাষায় কথা বলা বা ভাব প্রকাশ করার নাম হলো মাতৃভাষা। মাতৃভাষাই মানুষ সর্বপ্রথম আয়ত্ব করে। তাই ভাষা হিসেবে এটিই সর্বপ্রথম স্মৃতিপটে অংকিত হয়ে যায়। এর পর আর যত ভাষাই শিখুক না কেন, প্রতিটি ভাষাই সে তার স্মৃতিপটে রক্ষিত ভাষার সঙ্গে তুলনা করে বুঝার চেষ্টা করে। আমরা বাংলাদেশী, আমাদের মাতৃভাষা বাংলা, তাই “I eat rice’’ বললে আমাদের স্মৃতিপট সহজেই অনুবাদ করে- “ আমি ভাত খাই’’এভাবে আমরা সবকিছু সহজ করে বুঝতে পারি। এই তুলনা পদ্ধতি ছাড়া অন্যভাষা শিক্ষা করা ও বুঝা খুবই দুরূহ ব্যপার। মাতৃভাষার প্রতি মানুষের এ নির্ভরতার কথা মহান আল্লাহ ভাল করেই জানেন। ইসলামের ইতিহাস পর্যালোচনা থেকে জানা যায় যে, হক্ব তথা সত্যের বিপরীতে বাতিল তথা মিথ্যা যে যুগে যে রূপ নিয়ে এসেছে তার মুকাবিলায় আল্লাহ তাআ’লা তার নবীদের সেধরণের মুজেযা দিয়ে প্রেরণ করেছেন, যেমন:- নূহ (আঃ) এর যুগ ছিল জাহাজ শিল্পের উন্নতির যুগ এজন্য তার শ্রেষ্ঠ মুজেযা ছিল তৎকালীন সর্বশ্রেষ্ঠ জাহাজ। দাউদ (আঃ) যুগে গানবাদ্য চর্চায় সুরের মূর্ছনার মাধ্যমে মানুষকে আকর্ষণের প্রবণতা, তার মুকাবিলায় আল্লাহর নবী দাউদকে এমন সুমধুর কন্ঠ দিলেন যখন তিনি যাবুর তিলাওয়াত করতেন সমুদ্রের মাছেরাসহ কিনারায় চলে আসতো ! সুলায়মান (আঃ) এর যুগছিল ধন সম্পদ এবং রাজ ক্ষমতা এর বিপরীতে সারা দুনিয়ার বাদশাহী আল্লাহ তাকে দান করলেন। মূসা (আঃ) এর যুগছিল যাদু বিদ্যার উৎকর্ষতার যুগ এর বিপরীতে তাকে দিলেন লাঠি। ঈসা (আঃ) এর যুগে চিকিৎসা বিজ্ঞানের সোনালী যুগ ছিল এর মুকাবিলায় মহান আল্লাহ তাকে এমন মুজেযা দিলেন যে তার হাতের স্পর্শে জন্মান্ধ এবং কুষ্ঠ রোগী সম্পূর্ণ সুস্থ হয়ে যেত! তদরূপ বিশ্বনবী মুহাম্মদ (সাঃ) এর যুগ ছিল সাহিত্য সাধনায় উৎকর্ষতার যুগ এর মুকাবিলায় আল-ক্বুরআনুল কারীম নামের এমন এক উজ্জ্বল অদ্বিতীয় সাহিত্য গ্রন্থ তার ওপর নাযিল করলেন ক্বিয়ামাত পর্যন্ত যার মুজেযা থাকবে অব্যয় ও অক্ষয়।এভাবে মানব জাতির হিদায়াতের জন্য তিনি যত নবী-রাসূল পৃথিবীতে পাঠিয়েছেন, প্রত্যেককে তার স্বজাতীয় ভাষায় তথা মাতৃভাষায় ওহী দিয়ে প্রেরণ করেছেন। ইসলাম মাতৃভাষাকে খুবই মর্যাদা ও গুরুত্ব প্রদান করেছে। যেহেতু নবী রাসূলগণ মাতৃভাষার মাধ্যমেই দ্বীন প্রচার করেছেন, যেমন- قال صلّى الله عليه وسلم أرسل كل نبىّ إلى أمّته بلسانها وأرسلنى الله إلى كلّ أحمر و أسود من خلقه (ابو نعيم ، حلية الأولياء) - রাসূল (সাঃ) বলেন প্রত্যেক নবীকে তার উম্মতের নিকট তাদের স্বভাষায় প্রেরণ করা হয়, আর আমাকে আল্লাহ তা’আলা তার সৃষ্টির লাল-কালো সকলের নিকট প্রেরণ করেছেন (আবু ন’আইম, খন্ড-৫, পৃষ্ঠা ১১৮)। অর্থাৎ সকল ভাষাভাষী লোকের জন্য তিনি রাসূলরূপে প্রেরিত । সেহেতু সাহাবায়ে কেরাম (রাঃ) পৃথিবীর যে ভূখন্ডেই গেছেন আগে সেখানের ভাষা শিখেছেন তারপর দ্বীনের দাওয়াতী কাজ করেছেন। যেমন- রাসূল (সাঃ) যায়েদ ইবনে সাবিত (রাঃ) সুরইয়ানী ভাষা শিক্ষা করার নির্দেশ দেন এবং এই ভাষা অল্প কিছুদিনের মধ্যে তার আয়ত্বে চলে আসে। আর বড় বড় আসমানী কিতাব সমূহও স্ব স্ব রাসূলগণের মাতৃভাষায়ই অবতীর্ণ হয়েছিল। যেমন:- হযরত মূসা (আঃ) এর জাতি কথা বলতো হিব্রু বা ইবরানী ভাষায়। এজন্য তাওরাত কিতাব অবতীর্ণ হয়েছিল ইবরানীতে। হযরত দাউদ (আঃ) এর জাতির ভাষা ছিল গ্রিক বা ইউনানী। যাবুর অবতীর্ণ হয়েছিল ইউনানী ভাষায়। হযরত ঈসা (আঃ)এর জাতির মাতৃভাষা ছিল সূরিয়ানী। তাই ইনজিল শরীফ নাযিল হয়েছিল সূরিয়ানী ভাষায়। তেমনি হযরত মুহাম্মদ (সাঃ) এর মাতৃভাষা ছিল আরবী। এজন্য কুরআন আরবী ভাষায় নাযিল হয়েছে। (আল্লামা সুয়ূতী, আল ইতকান খন্ড-১, পৃষ্ঠা-৮৭) । যাতে তারা তাদের স্বজাতির লোকদেরকে স্পষ্ট ও সহজ ভাষায় আল্লাহর দ্বীন বুঝাতে পারেন। এতে মাতৃভাষার মর্যাদা আল্লাহ তাআ’লা কর্তৃক সমুন্নত হয়েছে। ভাষা আল্লাহতায়ালার দান। আল্লাহ তাআলার সেরা নেয়ামত; তাইতো স্বাধীন বাংলার ইসলামী রেনেসাঁর কবি ফররুখ আহমদ বলেছিলেন – মাতৃভাষা বাংলা ভাষা/ খোদার সেরা দান/ বিশ্ব ভাষার সভায় তোমার/ রূপ যে অনির্বাণ । ঠিক একই সুর বেজে উঠে কবিয়াল খ্যাত কবি রামনিধিগুপ্ত রচিত কবিতার ভাষায় – নানান দেশের নানান ভাষা বিনে স্বদেশী ভাষা/ পুরে কি আশা? / কতো নদী সরোবর কী বা ফল চাতকীর? /ধারাজল বিনে কভু / ঘুচেকি তৃশা? অর্থাৎ পৃথিবীতে হাজারো ভাষা থাকা সত্ত্বেও যেমন মাতৃভাষা ছাড়া মনের আশাই অপূর্ণ থেকে যায়, ঠিক তেমনি পৃথিবীতে অজস্র সাগর-মহাসাগর, নদী-নালা, পুকুর দিঘী টৈটুম্বুরে জল থাকা সত্ত্বেও বৃষ্টির পানি ছাড়া চাতক পাখির তৃষ্ণা নিবারিত হয় না। ভাষা মনুষ্য পরিচয়ের প্রধান বৈশিষ্ট্য। ইসলাম সব ভাষাকে সম্মান করতে শেখায়; কারণ, সব ভাষাই আল্লাহর দান ও তাঁর কুদরতের নিদর্শন। তিনি অসংখ্য ভাষা সৃষ্টি করে তার কুদরতের নিদর্শন প্রকাশ করেছেন। পৃথিবীর সকল কওম বা জাতি-গোষ্ঠীতে নবী-রাসূল এসেছেন। সকল নবী-রাসূল প্রত্যেক জাতির মাতৃভাষায় দাওয়াতী কাজ করেছেন। স্বয়ং রাসূল (সাঃ) বিশুদ্ধ মাতৃভাষায় কথা বলতেন। তাই বিশুদ্ধ মাতৃভাষায় কথা বলা সুন্নাত। বাংলা আমাদের মাতৃভাষা। এ জন্য উলামায়ে কেরামের উচিত বিশুদ্ধ বাংলা ভাষা শিক্ষা ও চর্চা করা।

বিদায় হজের ভাষণে মহানবী হযরত মুহাম্মদ (সাঃ) বলেছেন, ‘কালোর ওপর সাদার প্রাধান্য নেই, অনারবের ওপর আরবের শ্রেষ্ঠত্ব নেই’ (বুখারী শরীফ)। সুতরাং কোনো ভাষাকে হেয় জ্ঞান করা যাবে না, তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য করা যাবে না এবং অবহেলা করা যাবে না; কেননা, ভাষার স্রষ্টাও মহান আল্লাহ। তাঁর সৃষ্টির অবমূল্যায়ন করা তাঁর প্রতি অসম্মান প্রদর্শনেরই নামান্তর। আল্লাহ তাআ’লা মানুষের হিদায়াতের জন্য নবী-রাসূলদের পাঠিয়েছেন। তাঁদের ধর্ম প্রচারের প্রধান মাধ্যম ছিল দাওয়াত বা মহা সত্যের প্রতি আহ্বান। আর এর জন্য ভাষার কোনো বিকল্প ছিল না। আল্লাহ তাআলা বলেন: ما أَرسَلنا مِن رَسولٍ إِلّا بِلِسانِ قَومِهِ لِيُبَيِّنَ لَهُم فَيُضِلُّ اللَّـهُ مَن يَشاءُ وَيَهدي مَن يَشاءُ وَهُوَ العَزيزُ الحَكيمُ ‘আমি প্রত্যেক রাসূলকেই তার স্বজাতির ভাষাভাষী করে পাঠিয়েছি তাদের কাছে পরিষ্কারভাবে ব্যাখ্যা করার জন্য’ (সূরা ইবরাহিম-৪)। আল্লাহ জাল্লাহ শা-নুহু আরো বলেন- فَإِنَّما يَسَّرناهُ بِلِسانِكَ لِتُبَشِّرَ بِهِ المُتَّقينَ وَتُنذِرَ بِهِ قَومًا لُدًّا - আমি ক্বুরআনকে আপনার ভাষায় সহজ করে দিয়েছি, যাতে আপনি এর দ্বারা পরহেযগারদেরকে সুসংবাদ দেন এবং কলহকারী সম্প্রদায়কে সতর্ক করেন’ (সূরা- মারইয়াম -৯৭)। এ আয়াতে কারীমাহ দুটিতে এ কথা পরিস্কার হল যে, মাতৃভাষা ছাড়া কোন কিছুই স্পষ্ট ও সহজভাবে বর্ণনা করা সম্ভব নয়, আর সাথে সাথে এটাও প্রমাণিত হলো যে, ইসলাম পৃথিবীর সকল মানুষের মাতৃভাষাকে গুরুত্ব ও মর্যাদা দেয়।

মাতৃভাষার গুরুত্ব, মর্যাদা, প্রয়োজনীয়তা, উপকারিতা ও অপরিহার্যতার আরো কিছু দিক নিম্নে তুলে ধরা হলো – 

* মাতৃভাষা জীবন ও জগতের রহস্যময়তা এবং আত্মলোকের দ্বার উদ্ঘাটনের চাবী স্বরূপ।

* মাতৃভাষা সমগ্র ভাব প্রকাশের এবং জগৎ ও জীবনকে উপলব্ধি ও উপভোগের সর্বশ্রেষ্ঠ অবলম্বন।

* মাতৃভাষা ও চিন্তাশক্তি ওতপ্রোতভাবে জড়িত। একে অন্যের পরিপূরক ও পরিপোষক। নিজেকে পরিপুষ্ট ও জাগ্রত করা এবং ব্যক্তিত্বের উম্মেষ, বিকাশ ও পূর্ণতা সাধন করা এক মাত্র মাতৃভাষায়ই সম্ভব। অন্যভাষায় তা সম্ভব নয়। কারণ আমরা যখন অন্যভাষায় কথা বলি বা লিখি, তখন আমাদের মস্তিষ্কের ক্রিয়া দ্বৈতভাবে চলতে থাকে। অর্থাৎ প্রথমে মাতৃভাষায় চিন্তা করি, তারপর অন্যভাষায় তা প্রকাশ করি। তাতে স্বতঃস্ফুর্ততা ও সহজ সাবলীলতা আসে না। অথচ ভাষার গতি স্বচ্ছ ও সাবলীল না হলে ভাব ও চিন্তার প্রকাশ গভীর এবং স্বচ্ছ হতে পারে না। মস্তিষ্ক অযথা ক্রিয়া-ক্লান্তিতে ভারাক্রান্ত হয়। ফলে আত্মপ্রকাশের গতি মন্থর ও আড়ষ্ট হয়ে আসে।

* মাতৃভাষার উপর যার ভাল দখল থাকবে, পৃথিবীর সকল বিষয়ের উপর দখল প্রতিষ্ঠা করা তার পক্ষে অতি সহজ হবে। যেমন- চীন ও জাপান উন্নতির উচ্চ শিখরে পৌঁছার অন্যতম কারণ হলো মাতৃভাষার প্রতি যথাযথ মর্যাদাদেয়া, জ্ঞান-বিজ্ঞানের প্রতিটি বিষয় তারা জাতীয় স্বার্থে মাতৃভাষায় অনুবাদ করে নিয়েছে।

* কোন জাতির কাছে তাদের মাতৃভাষায় কোন কিছু প্রচার-প্রসার করা যত সহজে সম্ভব অন্য কোন ভাষায় তা সম্ভব নয়।

* প্রত্যেক ভাষাভাষি লোকের নিকট তার মাতৃভাষা অত্যন্ত প্রিয়। মায়ের ভাষা ছাড়া তৃপ্তি সহকারে মনের ভাব প্রকাশ করা যায় না। বিদেশী ভাষায় যতই পান্ডিত্য অর্জন করা হোক না কেন, তবুও নিজের মাতৃভাষা ছাড়া নিজস্ব ভাব ও অভিব্যক্তি সর্বাঙ্গীন মাধুর্যপূর্ণ ও সুষমামন্ডিত করে প্রকাশ করা সম্ভব নয়। 

অতএব মাতৃভাষার গুরুত্ব ও মর্যাদা অপরীসীম। এ ভাষায় মানুষ অংকুরিত হয় এবং তাদের অস্তিত্ব স্বাক্ষরিত হয়। দুর্ভাগ্য এ জাতির জন্য যাদের রক্তে অর্জিত মাতৃভাষার চর্চা আজ হচ্ছে ভিনদেশী ভাষায়! 

মাতৃভাষায় জ্ঞান-বিজ্ঞান চর্চা না করার কুফল ও পরিণাম:- উপরের বর্ণনা থেকে আমরা মাতৃভাষার গুরুত্ব, মর্যাদা, প্রয়োজনীয়তা, উপকারিতা ও অপরিহার্যতা সসম্পর্কে সংক্ষেপে জানতে পারলাম এবং এর সুফল গুলোও অনুধাবন করলাম। নিম্নে এই মাতৃভাষা চর্চা না করার কুফল বর্ণনা এবং এর পরিণাম সম্পর্কে কিছু অলোকপাত করা হলো।

* মাতৃভাষায় জ্ঞান-বিজ্ঞান ও দ্বীন চর্চা না করলে আল্লাহ রাব্বুল‘আলামীনের দিক নির্দেশনা অমান্য করার শামিল। কেননা প্রত্যেক নবী রাসূলকে আল্লাহ তা’আলা মাতৃভাষায় দ্বীন বুঝাবার জন্য মানব জাতির কাছে পাঠিয়েছেন।

* মাতৃভাষায় জ্ঞান-বিজ্ঞান ও দ্বীন চর্চা না করা নবী-রাসূল (আঃ) গণের সুন্নতের খেলাফ। কেননা তারা যে তদের উম্মতের কাছে মাতৃভাষায় জ্ঞান-বিজ্ঞান ও দ্বীন চর্চা করেছেন, নিম্নোক্ত হাদীস থেকে আমরা তার প্রমাণ পাই- قال الإمام أحمد حدثنا عن عمر بن ذرّ قال قال مجاهد عن ابى ذرّ قال قال رسول الله صلى الله عليه وسلم لم يبعث الله عزّ وجلّ نبيا إلا بلغة قومه (مسند أحمد) (لم يسمع مجاهد من ابى ذرّ). –“মুজাহিদ (রঃ) বলেন আবু জার গিফারী (রাঃ) থেকে বর্ণিত তিনি বলেন রাসূল (সাঃ) বলেছেন- আল্লাহ তা’আলা কোন নবী-রাসূলকে তার স্বজাতির ভাষা ব্যতীত পাঠাননি (আহমাদ-২০৪৪১) ।

  * মাতৃভাষায় জ্ঞান-বিজ্ঞান ও দ্বীন চর্চা না করা আকাবীরগণের (দ্বীনের পূর্ববর্তী পন্ডিতগণের) কর্মেরও খেলাফ। কারণ আমরা জানি যে, ফার্সী ও উর্দ্দু ভাষার যত উলামায়ে আকাবিরীন রয়েছেন তাদের প্রত্যকেই স্ব- স্ব ভাষায় ব্যাপক অবদান রেখে গেছেন। মাতৃভাষার মাধ্যমে জ্ঞান-বিজ্ঞান ও দ্বীন চর্চা করেছেন বলেই তারা এ বিশাল অবদান রাখতে সক্ষম হয়েছেন। যে কারণে ফার্সীভাষীরা আল্লামা রুমী, শেখ সাদী ও জামীর মত বহু পন্ডিত পেয়েছে এবং উর্দ্দুভাষীরা পেয়েছে আল্লামা ইকবালের মত বহু পন্ডিত। কিন্তু আফসোস আমাদের বাংলাভাষী উলামায়ে কিরামদের মাঝে মাতৃভাষার প্রতি অবহেলার কারণে আমরা সেরকম কাউকেই পাইনি।

* মাতৃভাষায় জ্ঞান চর্চা না করলে বিপুল পরিমাণ শ্রম, মেধা ও সময়ের অপচয় হয়। তার পরও আশানুরূপ ফল পাওয়া যায় না।

* শিক্ষার্থীদের পাঠ্যপুস্তক মাতৃভাষায় না হয়ে বিদেশী ভাষায় হলে দুর্বোধ্যতার কারণে শিক্ষার্থীরা পাঠে মনযোগ সৃষ্টি করতে পারে না। ফলে পড়া-লেখা হতে পালিয়ে বেড়ানোর মানসিকতা সৃষ্টি হয়।

* কোন মানুষের মাতৃভাষায় পরিপূর্ণ দখল না থাকলে নিজ গৃহে পরবাসী’র মত থাকতে হয়।  

* মাতৃভাষায় জ্ঞান চর্চা না করলে বিশ্বসভায় নিজেদের স্বকীয় অস্তিত্ব ও পরিচিতি তুলে ধরা যায় না।

* আমাদের বাংলাদেশে আলীয়া ও কাওমী মাদ্রাসাগুলোতে প্রতিষ্ঠালগ্ন থেকেই মাতৃভাষায় শিক্ষাদান পদ্ধতি অবলম্বন না করে উর্দ্দু-ফার্সীকে মাধ্যম হিসেবে নেয়া হয়েছিল। ফলে মুসলিম জনসাধারণের নিকট ক্বুরআন-সুন্নাহর প্রকৃত শিক্ষা অনেকাংশেই অজানা রয়েগেছে। জনশ্রুতি ও লোকাচারের মাধ্যমে দ্বীন চর্চা করতে গিয়ে অনেক শিরক-বিদ’আত, কুসংস্কার এবং ভ্রান্ত আক্বীদাহ দ্বীনের মধ্যে অনুপ্রবেশ করেছে। যা আমাদের অগ্রগতিকে বহুদূর পিছিয়ে দিয়েছে। আমরা অত্যন্ত উদ্বেগের সাথে লক্ষ্য করছি যে, অনেক ক্বওমী মাদ্রাসায় এখনো উর্দ্দু-ফার্সীর মাধ্যমে দ্বীন শিক্ষাদানের প্রয়াস চালানো হচ্ছে। অথচ ভাষা হিসেবে উর্দ্দু এবং ফার্সীর কোন প্রয়োজনীয়তা যে আমাদের জাতীয় এবং ধর্মীয় জীবনে আর অবশিষ্ট নেই; এ কথা বুঝতে না পারা আমাদের অজ্ঞতা, গোঁড়ামী ও অদূরদর্শিতার প্রমাণকে আরো স্পষ্ট করছে।

শেষকথা:- অতিমাত্রায় ধার্মিকতার উদ্দেশ্যে যেমন একটি সম্প্রদায় বাংলাকে ভাষা-ভাষা মনে করে মাতৃভাষাকে তুচ্ছতাচ্ছিল্য করছে, সর্বত্র মাতৃভাষা যুদ্ধের সেরা দান তার বান্দাদের জন্য। অনুরূপভাবে তার বিপরীতে অন্য সম্প্রদায়ের পক্ষ থেকে বিপরীতে বাঙ্গালীপনা প্রদর্শন এবং নির্ক্ষম করতে গিয়ে শান্তিপূর্ণ-নীতি উপেক্ষা করে সংখ্যা গরিষ্ঠ জাতির উপর সংখ্যা লঘিষ্ঠ ধর্মাচার আচার-আচরণে চেষ্টা অপচেষ্ট লিপ্ত রয়েছে। দ্বিপক্ষীয় স্বদেশী ভাষাকে তার সমহিমায় টিকিয়ে দেখা ক্ষেত্রে ক্ষেত্রে অন্তরায়। কেবলমাত্র মাতৃভাষা দরবেশ ছাড়া জাতির জনসাধারণ-বিজ্ঞানের অনুমোদন বিচরণ করতে অক্ষম হতে চলেছে, সেহেতু ভার্সামপূর্ণ ব্যবহারই জাতিকেশ্বিক ভাষাকে বলে মনে করে উত্তর-বিজ্ঞানের বিষয়বস্তু আমাদের মাতৃভাষা বাংলা অনুবাদ করে শিক্ষা-দীক্ষার ভিন্ন স্তরে মাতৃভাষার ব্যবহার করা উচিত। আল্লাহ তা'আলা আমদেরকে মাতৃর ও সুস্পষ্ট পদ্ধতির মাধ্যমে সহজ-বিজ্ঞান ও দ্বীনচর্চা করার পরিবেশ ও তাফীকদান করুন। (আমীন)

---------------------------------------------------------------------------------------------- -------------------

       ল্যান্ড ফর্স ইনস্টিটিউট, জাহরা-কুয়েত।

                                                                                                  তারিখ ২৪/০১/২০১৭