*আজ থেকে শুরু হিজরি নববর্ষ।*
আপনি কি জানেন হিজরী ক্যালেন্ডার কীভাবে চালু হয়?
.
ইসলাম-পূর্ব আরবের নিজস্ব কোনো ক্যালেন্ডার ছিলো না। কিন্তু, তারা দিন-মাসের হিশাব রাখতো। দিন-মাসের হিশাব ছিলো চাঁদের সাথে সম্পর্কিত। তারা বছরের হিশাব করতো কোনো গুরুত্বপূর্ণ একটি বছরের ঘটনার মাধ্যমে।
যেমন, আমাদের বাপ-দাদাদের অনেকের কাছে কারো জন্মসাল জিজ্ঞেস করলে তারা কিন্তু ১৯৬০/১৯৭৩ এরকম কিছু বলেন না। তারা বলেন এভাবে- “সংগ্রামের বছর তার জন্ম/সংগ্রামের ২ বছর পর তার জন্ম/মুক্তিযুদ্ধের সময় আমার বয়স ২ বছর ছিলো’’ ইত্যাদি।
অর্থাৎ, এমন একটি গুরুত্বপূর্ণ ঘটনাকে ধরে তারা সাল গণনা করেন, যে ঘটনা মোটামুটি কমন।
আরবরাও এমনটি করতো। তারা কোনো বড়ো একটি ঘটনাকে ধরে সাধারণত বছর গণনা করতো। যে কারণে সীরাতগ্রন্থে দেখতে পাবেন যে, রাসূলুল্লাহর (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) জন্মের বছর বলতে বলা হয় ‘হাতির বছর’। অর্থাৎ, যে বছর আবরাহা হাতি নিয়ে কাবা ঘর আক্রমণ করতে এসেছিলো।
রাসূলুল্লাহর (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) সময়ও আরব তথা মুসলিমদের স্বতন্ত্র কোনো ক্যালেন্ডার ছিলো না। তখন সাল বুঝানো হতো বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ ঘটনার মাধ্যমে। যেমন: নবুওয়্যাতের দ্বিতীয় বছর, নবুওয়্যাতের দশম বছর ইত্যাদি; তবে মাসের গণনা ছিলো।
আরবের কাছে চারটি মাস ছিলো ‘হারাম মাস’। এই চার মাসে যুদ্ধ করা ঐতিহ্যগতভাবে ‘হারাম’ ছিলো। পবিত্র কুরআনে এই সম্পর্কে বলা আছে:
“তারা তোমাকে হারাম মাস সম্পর্কে, তাতে লড়াই করা বিষয়ে জিজ্ঞেস করে...।” [সূরা বাকারা ২:২১৭]
উমর (রাদিয়াল্লাহু আনহু) তখন মুসলিম বিশ্বের খলিফা। তাঁর কাছে একটি ডকুমেন্ট আসে, যে ডকুমেন্টে মাস লিখা ছিলো শাবান মাস। উমর (রাদি:) জানতে চাইলেন, এটা কোন শাবান মাস? গতো বছরের? এই বছরের? নাকি আগামী বছরের?
সাহাবীদেরকে নিয়ে তিনি মিটিং-এ বসলেন। একটি ক্যালেন্ডার নির্ধারণের প্রয়োজনীয়তা উপলব্ধি করলেন। কিন্তু, কোন ক্যালেন্ডারের অনুসরণ করবেন? তখনকার সময়ের প্রস্তাবিত ক্যালেন্ডার ছিলো দুটো:
👉 রোমান ক্যালেন্ডার
👉 পারসিয়ান ক্যালেন্ডার
এই দুটো ক্যালেন্ডারের কিছু সমস্যা ছিলো। রোমান ক্যালেন্ডার অনেক বিস্তৃত, সেই জুলকারনাইন থেকে যার সাল গণনা শুরু। আর পারসিয়ান ক্যালেন্ডারটি সম্রাট পরিবর্তনের সাথে সাথে বদলে যায়। সাহাবীরা তখন একটি স্বতন্ত্র ক্যালেন্ডার প্রণয়নের চিন্তা করলেন। [১]
এখন প্রশ্ন হলো কোন বছরকে ‘প্রাইম’ ধরা হবে? সাহাবীগণ উমরকে (রাদি:) চারটি পরামর্শ দেন।
👉 যে বছর রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) জন্মগ্রহণ করেছেন।
👉 যে বছর রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) নবুওয়্যাত পেয়েছেন।
👉 যে বছর রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) হিজরত করেছেন।
👉 যে বছর রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) ইন্তেকাল করেছেন।
সাহাবীরা দেখলেন যে, কোন বছর রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) জন্মগ্রহণ করেছেন, আর কোন বছর তিনি নবুওয়্যাত লাভ করছেন সেটাকে ‘প্রাইম’ ধরে হিশাব করাটা সহজসাধ্য হবে না (সেই ইভেন্টগুলো ছিলো অনেক দূরের)। অন্যদিকে রাসূলুল্লাহর (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) ইন্তেকালের বছরটি বিষাদের বছর। এরকম বিষাদের বছরকে ধরে ক্যালেন্ডার বানানোর ক্ষেত্রে সবাই একমত নন। থেকে গেলো শুধু রাসূলুল্লাহর (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) হিজরতের বছর।
সাহল ইবনু সা’দ (রাদিয়াল্লাহু আনহু) বর্ণনা করেন:
“লোকেরা বছর গণনায় নবীর (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) নবুওয়্যাত প্রাপ্তির দিন থেকে করেনি, তাঁর ইন্তেকালের দিন থেকেও করেনি; বরং তাঁর মদীনায় হিজরত হতে বছর গণনা শুরু করে।” [সহীহ বুখারী: ৩৯৩৪]
রাসূলুল্লাহর (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) হিজরতের বছর থেকেই যে সাল গণনা শুরু হবে, এই প্রস্তাবটি দেন আলী (রাদিয়াল্লাহু আনহু)। উমর (রাদি:) আলীর (রাদি:) প্রস্তাবটি গ্রহণ করেন। তাঁর খিলাফতের দ্বিতীয় বছরেই এই সিদ্ধান্তটি নেয়া হয়। [২]
ইসলাম-পূর্ব এবং ইসলাম-পরবর্তী মাসের নাম একই ছিলো। অর্থাৎ, উমর (রাদি:) যখন হিজরী সাল প্রবর্তন করেন, তখন মাসের নাম আগেরগুলোই ছিলো। এই মতটি আল-বিরুনী এবং আল-মাস’উদীর। [৩]
রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) হিজরত করেন সফর-রবিউল আউয়াল মাসে। তবে, ক্যালেন্ডারের প্রথম মাস হিশেবে রাখা হয় মহররম মাসকে। মহররমকে ক্যালেন্ডারের প্রথম মাস রাখার প্রস্তাব দেন উসমান (রাদিয়াল্লাহু আনহু)।
রবিউল আউয়ালকে বছরের প্রথম মাস না রেখে মহররমকে কেনো রাখা হলো? ইবনে হাজার আসক্বালানী (রাহিমাহুল্লাহ) সেটার একটি ব্যাখ্যা দেন।
হিজরতের রাস্তা উন্মুক্ত করে আকাবার দ্বিতীয় শপথ। সেটি অনুষ্ঠিত হয়েছিলো যিলহজ্জ্ব মাসে। যিলহজ্জ্ব মাসের পরবর্তী মাস, অর্থাৎ নতুন মাস হলো মহররম মাস। সেজন্য মহররম মাসকে ক্যালেন্ডারের প্রথম মাস হিশেবে নেওয়া হয়। [৪]
রাসূলুল্লাহর (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) হিজরতের ঘটনাকে কেন্দ্র করে ক্যালেন্ডারের গণনা করা হয়েছিলো বলে ক্যালেন্ডারটি ‘হিজরী ক্যালেন্ডার’/’হিজরী সাল’ নামে পরিচিত। বর্তমান (২০২২) হিজরী সাল হলো ১৪৪৪।
রেফারেন্স:
১। Mahd as-Sawab: 1/316.
২। Tareekh Al-Islam, Ad-Dhahabi, page 163.
৩। F.C. De Blois, "TA’RĪKH": I.1.iv. "Pre-Islamic and agricultural calendars of the Arabian peninsula", The Encyclopaedia of Islam, 2nd edition, X:260.
৪। Fath al-Bari: 7/268.