জিজ্ঞাসা-১২৯৯২:
আসসালামু আলাইকুম ওয়া রহমাতুল্লাহ।
মুহতারাম! আমার জানার বিষয় হলো,
➤ ইমাম আবু হানিফা র. এর ৪০ বছর যাবত ইশা'র অজু দিয়ে ফজরের সালাত আদায় এই বর্ণনার সঠিকতা কতটুকু?
তারিখ: ১৪/০৫/২৪ ঈসায়ি/ইংরেজি
মাওলানা সাইফুল ইসলাম নোয়াখালী থেকে।
জবাব: ওয়ালাইকুমুস সালাম ওয়া রহমাতুল্লাহ। নাহমাদুহু ওয়া নুসল্লি আলা রসূলিল কারিম। আম্মাবাদ -
তাসলিম ও হামদ-সানার পর প্রথম কথা হলো, পবিত্র কুরআন, হাদীস ও আসারে এ বিষয়ে মানাকিব বর্ণিত হয়নি। তবে নির্ভরযোগ্য সিরাত ও তারিখের এ বিষয়ে বর্ণনা পাওয়া যায়। যেমন,
আল্লামা জালালুদ্দীন সুয়ূতী রহঃ এর সংকলিত গ্রন্থ “তাবয়ীজুজ সাহীফাহ ফী মানাকিবিল ইমাম আবী হানীফা গ্রন্থে সনদসহ উক্ত বক্তব্যটি নকল করেছেন।
وروى الخطيب عن حماد بن قريش قال: سمعت اسد بن عمرو يقول: صلى ابو حنيفة فيما حفظ عليه صلاة الفجر بوضوء العشاء اربعين سنة، وكان عامة الليل يقرأ جميع القرآن فى ركعة واحدة، وكان يسمع بكاؤه فى الليل حتى يرحمه جيرانه، وحفظ عليه انه ختم القرآن فى الموضع الذى توفى فيه سبعين الف مرة، (تبييض الصحيفة فى مناقب الامام ابى حنفية-28)
খতীব বাগদাদী হাম্মাদ বিন কুরাইশ থেকে বর্ণনা করেন, তিনি বলেন, আমি আসাদ বিন আমর থেকে শুনেছি। তিনি বলেছেন, আমার জানা মতে ইমাম আবু হানীফা রহঃ চল্লিশ বছর পর্যন্ত ঈশার অজু দিয়ে ফজরের নামায পড়েছেন। আর তিনি স্বভাবতঃ রাতের বেলা এক রাকাতে পুরো কুরআন খতম করতেন। আর লোকেরা রাতের বেলা তার ক্রন্দন শুনতে পেতো। এমনকি প্রতিবেশীরা পর্যন্ত তার উপর দয়ার্দ্র হয়ে পড়তো তার কান্না দেখে। আর তিনি যে স্থানে ইন্তেকাল করেছেন, উক্ত স্থানে সত্তর হাজার বার কুরআন খতম করেছেন। {তাবয়ীজুজ সাহীফাহ ফী মানাকিবী ইমাম আবূ হানীফা-২৮}
এ প্রসঙ্গে তাঁর সমসাময়িক মুহাদ্দিস
আবূ সিনান ইবনে সিনান আলকূফী
বলেন-
ﻛﻨﺎ ﻧﺨﺘﻠﻒ ﺇﻟﻰ ﻋﻤﺮﻭ ﺑﻦ ﻣﺮﺓ،
ﻓﻜﺎﻥ ﺃﺑﻮ ﺣﻨﻴﻔﺔ ﻳﺼﻠﻲ ﺍﻟﻌﺸﺎﺀ
ﻭﺍﻟﻔﺠﺮ ﺑﻄﻬﻮﺭ ﻭﺍﺣﺪ
অর্থাৎ আমরা আমর ইবনে মুররার মজলিসে যাতায়াত করতাম, তখন আবূ হানীফা এশা ও ফজর একই ওযুতে আদায় করতেন। সূত্র: ফাযায়িলু আবী হানীফা, আবূল কাসিম
ইবনু আবিল আওয়াম পৃ, ৫৭
এ বিষয়ের রেওয়ায়াত নিম্নোক্ত কিতাবগুলোতে পাওয়া যাবে-
১. ফাযায়িলু আবী হানীফা আবুল কাসিম ইবনু আবীল আওয়াম, পৃ.৫৭-৬১
২. আখবারু আবী হানীফা ওয়া আসহাবিহী
কাযী আবু আব্দিল্লাহ আসসয়মারী, পৃ.৪১-৪৬
৩. তারীখু বাগদাদ ১৩/৩৫২-৩৫৭
৪. মানাকিবু আবী হানীফা মুয়াফফাক আলমাক্কী, পৃ.২০৭-২৩৩
৫. মানাকিবু আবী হানীফা হাফেয যাহাবী, পৃ. ২১-২৪
৬. উকুদুল জুমান মুহাম্মাদ ইবনু ইউসুফ আসসালেহী, পৃ.২১১-২২৩
দুই. উপরোক্ত বর্ণনাগুলির কোনোটি ইইমাম আবূ হানীফা রাহ. এর নিজের বক্তব্য হিসেবে বর্ণিত হয়নি, বরং এগুলো তাঁর বিভিন্ন শাগরিদ ও সমসাময়িক ব্যক্তিদের উক্তি, যা তাদের নিজ নিজজানাশোনা ও ধারণার উপর নির্ভরশীল। সুতরাং তাদের পরস্পরের বিবরণে পার্থক্য থাকা খুবই স্বাভাবিক।
তিন. বিশেষভাবে লক্ষণীয় যে,রেওয়ায়াতসমূহে মাগরিবের ওযুতে ফজরের নামায আদায়ের কথা বলা হয়নি; এশার ওযুতে ফজর পড়ার কথা
বলা হয়েছে। মনে রাখতে হবে সলফ এশার নামাযআমাদের মতো মাগরিবের
কিছু সময় পরেই আদায় করতেন না বরং
সাধারণত আরো বিলম্ব করে পড়তেন। বিলম্বে ঈশার নামাজ আদায় করা মুস্তাহাব। দলিল-
عَنْ أَبِي هُرَيْرَةَ، قَالَ: قَالَ النَّبِيُّ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ: لَوْلاَ أَنْ أَشُقَّ عَلَى أُمَّتِي لأَمَرْتُهُمْ أَنْ يُؤَخِّرُوا العِشَاءَ إِلَى ثُلُثِ اللَّيْلِ أَوْ نِصْفِهِ.
হযরত আবূ হুরায়রা রাঃ থেকে বর্ণিত। রাসূল সাঃ ইরশাদ করেছেন, উম্মতের কষ্ট হওয়ার ভয় যদি আমার না হত তাহলে আমি তাদেরকে আদেশ করতাম, তারা যেন ইশার নামায রাতের এক তৃতীয়াংশ বা অর্ধেক পর্যন্ত বিলম্বিত করে। {সুনানে তিরমিজী-১/২৩, হাদীস নং-১৬৭
চার. মূল সুন্নত তো সেটাই যা রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি। ওয়াসাল্লাম নিম্নোক্ত বাণীতে বলেছেন-
ﺻﻢ ﻭﺃﻓﻄﺮ ﻭﻗﻢ ﻭﻧﻢ، ﻓﺈﻥ
ﻟﺠﺴﺪﻙ ﻋﻠﻴﻚ ﺣﻘﺎ ﻭﺇﻥ ﻟﻌﻴﻨﻚ
ﻋﻠﻴﻚ ﺣﻘﺎ ﻭﺇﻥ ﻟﺰﻭﺟﻚ ﻋﻠﻴﻚ
ﺣﻘﺎ
অর্থাৎ কখনো রোযা রাখবে, আবার কখনো রোযা ছাড়া থাকবে। রাতে কিছু সময় ইবাদতে মশগুল থাকবে আর কিছু সময় ঘুমাবে। কারণ তোমার উপর রয়েছে তোমার নিজ দেহের হক, চোখের
হকএবং তোমার স্ত্রীর হক। সহীহ বুখারী, হাদীস : ১৯৭৫
কিন্তু কারো যিম্মায় অন্যের হক না থাকার কারণে অথবা খুব কম থাকার কারণে যদি সারা রাত ইবাদতে মশগুল থাকে তবে তা নিষিদ্ধও নয়; যদি এতে তার কোনো ফরয বা ওয়াজিব আমল
ছুটেনা যায় এবং কারো কোনো হক নষ্ট না হয়। সলফ তথা সাহাবী, তাবিয়ীন ও
তাবে তাবিয়ীনদের মধ্যে এ ধরনের
অনেক নজির রয়েছে।
সাহাবা-তাবিয়ীন থেকে শুরু করে
পরবর্তী যামানায় আল্লাহর নেক
বান্দাদের বিস্ময়কর ও কষ্টসাধ্য
আমল ও ইবাদত-বন্দেগীর ঘটনাবলি
এবং এ সবের শরয়ী হুকুম জানার জন্যে
নিম্নোক্তকিতাবগুলো দেখা যেতে
পারে-
১. হিলয়াতুল আওলিয়া, হাফেজ আবু
নুয়াঈম আসফাহানী
২. ইকামাতুল হুজ্জাহ আলা আন্নাল
ইকছারা ফীত তাআববুদি লাইছা বিল
বিদআহ, মাওলানা আবদুল হাই লখনবী
(১৩০৪ হি.)
৩. আলকালামুল মুফীদ ফী ইছবাতিত
তাকলীদ, মাওলানা সরফরায খান
সফদার রাহ.
৪. আলউলামাউল উযযাব, শায়খ আবদুল ফাত্তাহ আবূ গুদ্দাহ রাহ.বাকি থাকল আপনি ইমাম আবূ ইউসুফ রাহ.-এর উদ্ধৃতিতে যে ঘটনাটি উল্লেখ
করেছেন। মূলত এ ঘটনাটি চল্লিশ বছরের রেওয়ায়াতের পরিপন্থী নয়। কারণ এ ঘটনার আগেও যে তিনি সারা রাত জেগে ইবাদতে মগ্ন থাকতেন-তা এতে নাকচ করা হয়নি। বরং ঘটনার
বিবরণ থেকে বুঝা যায় যে, এ ঘটনার আগেই অনেক মানুষের মাঝে প্রসিদ্ধ ছিল যে, আবূ হানীফা রাহ. রাতে না ঘুমিয়ে ইবাদতে মশগুল থাকতেন। আর ১২০ হিজরীর আগেও যে তার এ আমল
ছিল তা তো আবূ সিনান সাঈদ ইবনে সিনান-এর উপরোল্লিখিত বক্তব্য থেকেও প্রমাণিত হয়।
সারকথা হলো, যেহেতু উল্লেখিত ঘটনা কুরআন ও হাদীস-আসারে বর্ণিত হয়নি, তাই কেউ হিংসা বা অন্য কোন কারণে বিশ্বাস না করলে অসুবিধা নেই। তবে নির্ভরযোগ্য, বিশ্বস্ত ইতিহাসবিদ, মুহাদ্দিস ও বড় বড় মুসলিম মনীষীদের থেকে ঘটনাটি বর্ণিত হয়েছে।
মহান আল্লাহ তাআলার অশেষ কৃপা যে, এক আবু হানিফাকে রাত্রি জাগিয়ে লক্ষ আবু হানিফাকে ঘুমানোর ব্যবস্থা করেছেন। নাহলে হাজার হাজার মাসয়ালার ব্যাপারে সমাধান প্রকল্পে ঘুম হারাম হয়ে যেত, যদি তিনি উসূলে ফিকহ আবিষ্কার না করতেন।
এ সম্পর্কে স্বয়ং ইমাম শাফি রহ় বলেন,
قال الإمام الشافعي: الناس عيال في الفقه على أبي حنيفة.
সমস্ত মানুষ ফিকহশাস্ত্রে ইমাম আবু হানিফা (রহ.)-এর পরিবার। সূত্র: কিতাবু মানাযিলিল আইম্মায়ে আরবা-১৭০ পৃষ্ঠা
তিনি অন্যত্র বলেন, যে ব্যক্তি ফিকহশাস্ত্র শিখতে চায় সে যেন ইমাম আবু হানিফা (রহ.)-এর ছাত্রদের আঁকড়ে ধরে।
ইবনে মুবারক (রহ.) বলেন,
وقال ابن المبارك : أبو حنيفة أفقه الناس .سير أعلام النبلاء" (6 /390-403
মানুষের মাঝে সবচেয়ে বড় ফিকহবিশারদ হলেন ইমাম আবু হানিফা (রহ.), আমি ফিকহশাস্ত্রে তাঁর মতো যোগ্য কাউকে দেখিনি। সূত্র: সিরু আলামিল নাবালা-৬/৩৯০-৪০৩
والله اعلم بالصواب