জিজ্ঞাসা-২১৭: কুরবানি কি ওয়াজিব না সুন্নাহ? এ বিষয়ে দালিলিক বিশ্লেষণ করলে উপকৃত হতাম। বর্তমান আহলে হাদিস ভাইয়েরা এটাকে ঐচ্ছিক বলতেছেন? তারিখ-০৫/০৭/২২ ঈসায়ি/ইংরেজি
সাইফুল ইসলাম, মোমেনশাহী থেকে---
জবাব: জাযাকাল্লাহু খয়রান আমার প্রিয় ভাইকে, যিনি সম্প্রতিক সময়ের একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন করেছেন। আপনার প্রশ্নকে সহজভাবে বোধগম্যের জন্য কয়েকভাগে ভাগ করছি।
প্রশ্ন: ক। কুরবানি কি ওয়াজিব না সুন্নাহ?
উত্তর: ক। এ বিষয়ে দুটি মতামত পায়।
প্রথম মত: কুরবানি ওয়াজিব। ইমাম আওযায়ি, ইমাম লাইস, ইমাম আবু হানিফা (রাহিমাহুমুল্লাহ) প্রমুখের মত এটা। আর ইমাম মালিক ও ইমাম আহমাদের একটি মতেও কুরবানি ওয়াজিব।
দ্বিতীয় মত: কুরবানি সুন্নাতে মুয়াক্কাদা বা অত্যন্ত তাকিদপূর্ণ সুন্নাহ। ইমাম মালিক ও শাফিয়ির প্রসিদ্ধ মত।
প্রশ্ন: খ। যারা কুরবানি ওয়াজিব বলেন তাদের দলিল কি?
উত্তর: খ। নিম্নে দেওয়া হলো:
v কুরআন থেকে দলিল:
আয়াত নং-০১
فَصَلِّ لِرَبِّكَ وَٱنۡحَرۡ
‘তোমার প্রতিপালকের উদ্দেশ্যে সালাত আদায় করো ও পশু কুরবানি করো। সূরা কাউসার-০২
আর আল্লাহ তায়ালা যখন কোনো ব্যাপারে নির্দেশ দেন সাধারণত সেটা পালন করা ওয়াজিবই হয়ে থাকে।
এ আয়াতের তাফসিরকারকদের মতামত:
(ক) এ আয়াতের ব্যাখ্যায় আল্লামা ইবনে কাসীর রহ. বলেন, সঠিক তাফসীর হচ্ছে- (و انحر) এর অর্থ: কুরবানী করুন। আর সালাত দ্বারা ঈদের নামায উদ্দেশ্য। এটাই যুগ যুগ ধরে বহু সালাফের কথা। হযরত আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস রাদিয়াল্লাহু আনহু,আতা, মুজাহিদ,ইকরিমা,ক্বাতাদাহ ও হাসান বসরী রহ.সহ বহু জগৎ বিখ্যাত তাফসীর বিশেষজ্ঞগণ وانحر এর অর্থ “আপনি কুরবানী করুন” করেছেন। সূত্র: তাফসীরে ইবনে কাসীর,৮/৫০৩
(খ) আল্লামা আলূসী রহ. তাফসীরে রুহুল মাআনীতে বলেন:- অধিকাংশ মুফাসসিরীনে কেরামের মতে এই আয়াতে نحر দ্বারা কুরবানী করা উদ্দেশ্য। সূত্র: তাফসীরে রুহুল মাআনী،১৪/৬৬৫,৬৬৬
(গ) ইমাম ইবনে জারীর তাবারী রহ. বলেন: فَصَلِّ لِرَبِّكَ وَانْحَرْ ﴿٢﴾ এর সঠিক অর্থ হচ্ছে হে রাসুল! আপনি আপনার নামাযকে খালিস আপনার রবের জন্য পড়ুন,Statues বা মূর্তি-গাইরুল্লাহর জন্য নয় (যেমন মুশফিকরা করে থাকে)। ঠিক তেমনিভাবে আপনার কুরবানী ও খালিস রবের নামে করুন। অন্য কোন প্রতিমা ও মূর্তির নামে নয়। সূত্র: জামিউল বায়ান ফী তা’বীলিল কুরআন লিত্তবারি,১৬/৩৬১,৩৬
এ সকল তাফসীর দ্বারা দিবালোকের ন্যায় সুস্পষ্ট হয়ে যায় যে সূরা কাউসারের ২ নং আয়াতে বর্ণিত نحر দ্বারা কুরবানী করাই উদ্দেশ্য। এ আয়াতে আল্লাহ তা’আলা কুরবানী করার নির্দেশ দিয়েছেন। আর এ নির্দেশ পালন অবশ্যই ওয়াজিব হওয়ার প্রমাণ বহন করে।
আয়াত নং-০২
وَلِكُلِّ أُمَّةٍ جَعَلْنَا مَنسَكًا لِّيَذْكُرُوا اسْمَ اللَّهِ عَلَىٰ مَا رَزَقَهُم مِّن بَهِيمَةِ الْأَنْعَامِ ۗ অর্থ:- আমি প্রত্যেক উম্মতের জন্যে কুরবানী নির্ধারণ করেছি, যাতে তারা আল্লাহর দেয়া Quadrupeds বা চতুস্পদ জন্তু যবেহ কারার সময় আল্লাহর নাম উচ্চারণ করে।… (সূরা হজ্জ-৩৪)
সুতরাং এমন আমল যা সকল উম্মতের জন্য Inevitable বা অবধারিত তা অবশ্যই ওয়াজিব হওয়ার-ই প্রমাণ বহন করে।
v হাদিস দ্বারা দলিল:
হাদিস নং-০১
«مَنْ وَجَدَ سَعَةً فَلَمْ يُضَحِّ فَلَا يَقْرَبَنَّ مُصَلَّانَا»
রাসুলুল্লাহ (ﷺ) বলেছেন, যে ব্যক্তি সামর্থ্য থাকা সত্ত্বেও কুরবানি করে না সে যেন আমাদের ঈদগাহের ধারেকাছেও না আসে। তাখরিজ: মুসনাদে আহমাদ ১৬/৪৬৬; ইবনু মাজাহ- ৩১২৩; মুসান্নাফে ইবনে আবী শাইবা-৩১২৩
নোট: হাদীসটিকে ইমাম হাকিম, ইমাম যাহাবী, ইমাম ইবনে হাজার আসকালানি রহ. ফাতহুল বারিতে হাদিসটির সনদকে সহীহ বলেছেন।
ইমাম ইবনে মাজাহ রহ. বলেন, হাদীসটি কুরবানি ছেড়ে দেওয়া ব্যক্তিদের জন্য কঠিন ধমকি। আর এমনটি হয় ওয়াজিব তরককারিদের ক্ষেত্রে।
হাদিস নং-০২
«يَا أَيُّهَا النَّاسُ عَلَى كُلِّ أَهْلِ بَيْتٍ فِي كُلِّ عَامٍ أُضْحِيَّةٌ»
মিখনাফ ইবনু মুসলিম থেকে বর্ণিত। রাসুলুল্লাহ (ﷺ) বলেছেন হে মানব সকল! প্রত্যেক পরিবারের দায়িত্ব হলো প্রতি বছর কুরবানি দেয়া। তাখরিজ: সুনানে ইবনে মাজাহ-৩১২৫
হাদিস নং-০৩
اخبرني ابو الزبير انه سمع جابر بن عبد الله يقول صلى لنا النبي صلى الله عليه وسلم يوم النحر بالمدينه فتقدم رجال فنحروا وظنوا ان النبي قد نحر فامر النبي صلى الله عليه وسلم “من كان نحر قبله ان يعيد بنحر آخر، ولا ينحروا حتى ينحر النبي صلى الله عليه وسلم (رواه مسلم رقم الحديث ١٩٦٤
হযরত জাবের রা. বলেন, রাসূল (ﷺ) মদিনাতে ঈদের নামায পড়িয়েছেন। কিছু লোক নামাযের পূর্বেই কুরবানি করে ফেলেছেন এ ধারণায় যে, হয়তো রাসূল (ﷺ)ও কুরবানি করে ফেলেছেন। তখন রাসূল (ﷺ) নির্দেশ দিলেন যারা নামাযের পূর্বে কুরবানি করেছে তারা অবশ্যই পূনরায় কুরবানি করতে হবে। তোমরা কেউ রাসূল এর পূর্বে কুরবানি করবে না। তাখরিজ: সহীহ মুসলিস, হাদিস নং ১৯৬৪
হাদিস নং-০৪
হযরত জুনদুব আল বাজালি রা. বলেন:
قال شهد رسول الله صلى الله عليه وسلم يوم اضحى ثم خطب فقال من كان ذبح قبل ان يصلي فليعد مكانها…. ومن لم يكن ذبح فليذبح بسم الله )رواه مسلم رقم ١٩٦٠(
রাসূল (ﷺ)ঈদের খুতবাতে ইরশাদ করেন, যারা নামাযের পূর্বে কুরবানি দিয়েছো তারা তার পরিবর্তে অবশ্যই পুনরায় কুরবানি করো। আর যারা তখন কুরবানি করোনি তারা আল্লাহর নামে কুরবানি করো। তাখরিজ: সহীহ মুসলিম-১৯৬০
হাদিস নং-০৫
হযরত বারা ইবনে আযেব রা. হতে বর্ণিত:
عَنْ الْبَرَاءِ بْنِ عَازِبٍ أَنَّ خَالَهُ أَبَا بُرْدَةَ بْنَ نِيَارٍ ذَبَحَ قَبْلَ أَنْ يَذْبَحَ النَّبِيُّ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ فَقَالَ يَا رَسُولَ اللَّهِ إِنَّ هَذَا يَوْمٌ اللَّحْمُ فِيهِ مَكْرُوهٌ وَإِنِّي عَجَّلْتُ نَسِيكَتِي لِأُطْعِمَ أَهْلِي وَجِيرَانِي وَأَهْلَ دَارِي فَقَالَ رَسُولُ اللَّهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ أَعِدْ نُسُكًا فَقَالَ يَا رَسُولَ اللَّهِ إِنَّ عِنْدِي عَنَاقَ لَبَنٍ هِيَ خَيْرٌ مِنْ شَاتَيْ لَحْمٍ فَقَالَ هِيَ خَيْرُ نَسِيكَتَيْكَ وَلَا تَجْزِي جَذَعَةٌ عَنْ أَحَدٍ بَعْدَك
গ্ধ. (صحيح مسلم، رقم: ৫১৮২، الشاملة)
হযরত আবু বুরদা রা. রাসূল (ﷺ)এর কুরবানির পূর্বেই সকাল-সকাল কুরবানি করে ফেলেছেন। কারণ, দিনের শেষে গোশতের আগ্রহ থাকে না। অতঃপর রাসূল (ﷺ)-কে বিষয়টি জিজ্ঞেস করলে রাসুল সালাম বলেন, অবশ্যই পুনরায় সঠিক সময়ে কুরবানি করতে হবে। তিনি বলেন, এখন আমার কাছে ছোট একটি বকরি অবশিষ্ট আছে মাত্র। তবে তা মোটাতাজা। রাসুল সালাম বললেন সেটা দিয়ে কুরবানি করো। তবে এ সুযোগটা শুধুই তোমার জন্য। অন্য কারো ক্ষেত্রে এটা প্রযোজ্য নয়। ছয় মাসের বকরি দিয়ে কুরবানি করা একমাত্র তোমার ক্ষেত্রে অনুমোদিত। তাখরিজ: সহীহ মুসলিম, হাদিস নং- ১৯৬১
হাদিস নং-০৬
عن نافع عن عبد الله بن عمر رضي الله عنه : قال ” أقام رسول الله صلى الله عليه وسلم بالمدينة عشر سنين يضحي” اخرجه الترمذي و قال هذا حديث حسن (رقم الحديث ١٥٠٧ ومسند احمد ٤٩٣৫) قال المحقق اسناده صيحح.
হযরত ইবনে ওমর রা. বলেন, রাসূল (ﷺ)মদিনা শরীফে দশ বছর অবস্থানকালে কুরবানি করে গেছেন। তিরমিজি ১৫০৭, মুসনাদে আহমদ ৪৯৩৫
নোট: ইমাম তিরমিজি রহ. হাদিসটিকে হাসান বলেছেন।
হাদিসটির ব্যাখ্যা: মুহাক্কিক শুআইব আল-আরনাউত বলেন: হাদিসটির সনদ সহীহ। নিচে মুসনাদে আহমদের টীকা উল্লেখ করা হলো:
قال شعيب الارنؤوط : في هامش مسند احمد .. إسناده ضعيف فيه حجاج بن ارطاة ، مدلس وقد عنعن ولكن و له شاهد عن ابن عمر ان النبي النبي صلى الله عليه وسلم كان ينحر يوم الاضحى بالمدينه، اخرجه النسائي عن على بن عثمان عن سعيد ابن عيسى عن المفضل عن عبد الله بن سليمان عن نافع : وهذا اسناد حسن من اجل عبد الله بن سليمان وباقي الرجال ثقات لذا قال شعيب الارنؤوط :حديث صحيح، (رقم الحديث: ٦٤٠١ من مسند احمد.
শরীয়তের মূলনীতি হচ্ছে- যে কাজ রাসূল (ﷺ)ধারাবাহিকভাবে করেছেন কোনো দিন ছাড়েননি তখন কাজটি ওয়াজিব হওয়ার প্রমাণ বহন করে।
প্রশ্ন: গ। যারা কুরবানি সুন্নাত বলেন তাদের দলিল কি?
উত্তর: গ। তাদের দলিল নিম্নরুপ:
হাদিস নং-০১
«إِذَا رَأَيْتُمْ هِلالِ ذِي الْحِجَّةِ وَأَرَادَ أَحَدُكُمْ أَنْ يُضَحِّيَ ، فَلْيُمْسِكْ عَنْ شَعَرِهِ وَأَظْفَارِهِ»
রাসুলুল্লাহ (ﷺ) বলেছেন তোমাদের মাঝে যে কুরবানি করতে চায়, যিলহয মাসের চাঁদ দেখার পর সে যেন কুরবানি সম্পন্ন করার আগে তার কোন চুল ও নাখ না কাটে। তাখরিজ: মুসলিম-১৯৭৭
এ হাদিসে ‘যে কুরবানি করতে চায়’ কথা দ্বারা বুঝা যায় এটা ওয়াজিব নয়।
হাদিস নং-০২
রাসূল (ﷺ) তার উম্মতের মাঝে যারা কুরবানি করেনি তাদের পক্ষ থেকে কুরবানি করেছেন। তার এ কাজ দ্বারা বুঝে নেয়া যায় যে কুরবানি ওয়াজিব নয়।
হাদিস নং-০৩
হযরত জাবালা বিন সুহাইম থেকে বর্ণিত:
عن جبلة بن سحيم ان رجلا سأل ابن عمر عن الاضحية أ واجبة هي؟ فقال: ضحى رسول الله صلى الله عليه وسلم والمسلمون فاعادها عليه، فقال : أتعقل؟ ضحى رسول الله صلى الله عليه وسلم والمسلمون .(اخرجه الترمذي رقم الحديث: ١٥٠٦ و قال” هذا حديث حسن صحيح” وأخرجه ابن ماجه في الأضاحي، رقم الحديث ٣١٢٤(
ইবনে ওমর রাদিয়াল্লাহু তা’আলা আনহু কে এক লোক জিজ্ঞেস করলো, কুরবানি কি ওয়াজিব? তিনি উত্তরে বললেন, রাসূল (ﷺ)কুরবানি করেছেন এবং সকল মুসলমানরাও কুরবানি করেছেন। প্রশ্নকারী বারবার জিজ্ঞেস করলে ইবনে ওমর একই কথা বারবার পুনরাবৃত্তি করলেন। উক্ত হাদিসে হযরত ইবনে ওমর রা. রাসূল (ﷺ) ও মুসলিম মিল্লাতের ধারাবাহিকভাবে কুরবানির কথা স্পষ্ট প্রমাণ করে যে এটি ওয়াজিব। একবারের জন্যও তিনি ওয়াজিব নয় বলেননি। অথচ প্রশ্নটি ছিল ওয়াজিব কি-না। হাঁ, তিনি স্পষ্ট “ওয়াজিব” না বলার কারণ হলো, যাতে কুরবানিকে ফরজ সমতুল্য মনে করা না হয়।
হাদিস নং-০৪
(سنة المسلمين سنة ابراهيم سنة المعروفه) সুন্নাতে ইব্রাহিম, সুন্নাতুল মুসলিমিন, সুন্নাতে মারুফা ইত্যাদি শব্দ উল্লেখ করা হয়েছে।
ওয়াজিব অমান্যকারীদের যুক্তি খণ্ডন:
২নং-হাদিস
রসূল তার উম্মতের মাঝে যারা কুরবানি করেননি তাতের পক্ষ থেকে কুরবানি করেছেন। যদি সবার পক্ষ থেকেই আদায় করতেন, তাহলে সামর্থবান জন্য ধমকসূচক বাক্য ব্যবহার করলেন কেন?
৩ নং-হাদিস
এ হাদিসের ব্যাখ্যায় শাইখুল ইসলাম মুফতি তাকী উসমানি হাফি. তাকমিলাতু ফাতহুল মুলহিমে বলেন:
قال شيخنا في تكملة فتح الملهم : “ظاهر جواب ابن عمر انه اراد الدلالة على الوجوب لان السائل انما سأله عن الوجوب فلو كانت الاضحية غير واجبة لنفي الوجوب صراحة ولكنه ذكر مواظبة النبي صلى الله عليه وسلم والمسلمين وهو مما يدل على الوجوب، ولم يصرح بالوجوب كي لا يظن تحتمه كتحتم الفرائض) . التكملة ج ٣ ص ٣٠٩ (
অর্থ: ইবনে উমর রা. এর জবাবে কুরবানি ওয়াজিব হওয়ারই ইঙ্গিত পাওয়া যায়। কেননা, তাঁকে কুরবানি ওয়াজিব কি-না? এ ব্যাপারে প্রশ্ন করা হয়েছিলো। যদি সত্যিই কুরবানি ওয়াজিব না-ই হতো, তবে তিনি স্পষ্ট ওয়াজিব নয় বলতে পারতেন। তিনি তা না করে রাসূল স. এর আমলের ধারাবাহিকতা উল্লেখ করেছেন, যা ওয়াজিব হওয়ার উপর প্রমাণ বহন করে। আর স্পষ্ট ওয়াজিব বলেননি যাতে কেউ ফরজ ভেবে না বসে। তাখরিজ: তাকমিলাতুল ফাতহুল মুলহিম: ৩/৩০৯
৪ নং- হাদিস
এগুলোর জবাবে স্বয়ং হাফেজ ইবনে হাজার আসকালানি রহমাতুল্লাহি আলাইহি নিজেই বলেছেন এসব হাদিসে ” سنة ” সুন্নাহ শব্দের অর্থ ফকিহদের পরিভাষার সুন্নাত নয়, যা ওয়াজিবের পরিপন্থী; বরং সুন্নাহ শব্দের অর্থ হাদিসসমূহে “তরিকা” ” الطريقة المسلوكة ” পন্থা, পদ্ধতি, নিয়ম বা তরিকা-ই উদ্দেশ্য। আর এটা ফরজ, ওয়াজিব, সুন্নত ও মুস্তাহাব সব ধরনের বিধানকে শামিল করে। তাই শব্দগুলোর বাহ্যিক অর্থ নিয়ে ওয়াজিব এর বিপক্ষে দাঁড় করানোর কোনো সুযোগ নেই। বিভিন্ন দলিলে যা ওয়াজিব প্রমাণিত সেগুলো ‘সুন্নাহ’। আর যে সব বিধান সুন্নাত বা মুস্তাহাব প্রমাণিত সেগুলোও ‘সুন্নাহ’।
ইবনে হাজার আসকালানি রহ. বলেন:
المراد بالسنة هذا في الحديثين معا “الطريقة” لا السنة بالاصطلاح التي تقابل الوجوب والطريقة اعم من ان تكون للوجوب او للندب ( فتح الباري ج ١٠ ص ٥ )
আল্লামা থানভী রহ. বলেন:
و ما في حديث البراء عن الشيخين : من ذبح بعد الصلاة فقد تم نسكه واصاب سنة المسلمين ، فلا ينافي الوجوب لان المراد سيرة المسلمين وطريقتهم ، وذلك قدر مشترك بين الواجب والسنة المصطلح عليها ومثله قوله صلى الله عليه وسلم “سنوا بهم سنة اهل الكتاب” وقوله صلى الله عليه وسلم عليكم بسنتي وسنةالخلفاء الراشدين المهديين ، ولم تكن السنة المصطلح عليها معروفة اذ ذاك وقد قال البيهقي في قول ابن عباس : الختان سنة ، أراد سنة النبيদ্ধ الموجبة .(اعلاء السنن ج ١٠ ص ٧٩٤٥ بدائع الصنائع للكاساني: ج ٦ ص ٢٦٧)
সুতরাং সুস্পষ্টভাবে প্রমাণ হয়ে গেল যে, হাদিসে “সুন্নাহ” শব্দ দিয়ে কুরবানিকে ফিকহের ভাষায় “সুন্নাত” তথা ওয়াজিব নয় বলার কোনো সুযোগ নেই। কারণ পরবর্তী ‘সুন্নাত তথা ওয়াজিব নয়’ পরিভাষাটি রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর যুগে বিদ্যমান ছিলো না; বরং সুন্নাহের অর্থ হলো: তরিকা, পদ্ধতি, সিরাত যা ফরজ-ওয়াজিব-সুন্নত এবং মুস্তাহাব সবটিকে শামিল করে।
প্রশ্ন: ঘ। বর্তমান আহলে হাদিস ভাইয়েরা এটাকে ঐচ্ছিক বলতেছেন?
উত্তর: ঘ। পূর্বসুরিরা কেউ এটাকে ঐচ্ছিক বলিনি। যেমন,
(ক) দেখুন, ইমাম মালিক ও শাফিয়ির রহ. মতে সুন্নাতে মুয়াক্কাদা। কিন্তু এ মতের প্রবক্তারা আবার বলেছেন, ‘সামর্থ্য থাকা সত্ত্বেও কুরবানি পরিত্যাগ করা মাকরুহ। যদি কোন জনপদের লোকেরা সমর্থ্য হওয়া সত্ত্বেও সম্মিলিতভাবে কুরবানি পরিত্যাগ করে তবে তাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করা হবে। কেননা, কুরবানি হলো ইসলামের একটি শিয়ার বা মহান নিদর্শন। ইবনু উসাইমিন, আহকামুল উদহিয়্যাহ, পৃ. ২৬
(খ) শাইখুল ইসলাম ইবনে তাইমিয়া রহ. এর অভিমত
আহলে হাদিস ভাইদের সর্বাধিক মান্যবর মহান ব্যক্তিত্ব, শাইখুল ইসলাম ইবনে তাইমিয়া রহমতুল্লাহি আলাইহি এর مجموعة الفتاوي এর ১২ নং খন্ডের ৯৩ নং পৃষ্ঠা খুলে দেখা যেতে পারে। তাঁর দলিলভিত্তিক শক্তিশালী মতামত হচ্ছেÑ কুরবানি করা ওয়াজিব। তিনি তাঁর এই বিখ্যাত ফতোয়ায় কুরআনের বহু আয়াতের উপর ভিত্তি করে কুরবানি ওয়াজিব সাব্যস্ত করেছেন।
তাঁর ভাষায় শুনুন :
অতঃপর ইবনে তাইমিয়া রহ. আরো বলেন,
وقد جاءت الاحاديث بالامر بها وقد خرج وجوبها قولا في مذهب احمد ، وهو قول ابي حنيفه واحد القولين في مذهب مالك او ظاهر مذهب مالك
অর্থাৎ বহু হাদিস শরীফে কুরবানি করার আদেশ দেওয়া হয়েছে। এটাই ইমাম আহমদ বিন হাম্বল রহ. এর একটি মত। এটা ইমাম আবু হানিফা রহ. এর মাযহাব এবং ইমাম মালেক এর মূল মাযহাব। অতঃপর শাইখুল ইসলাম ইবনে তাইমিয়া রাহমাতুল্লাহি আলাইহি সুস্পষ্ট ভাষায় বলেন যারা কুরবানি ওয়াজিব বলতে চায় না, তাদের পক্ষে কোনো দলিল-প্রমাণ নেই। তারা সবচাইতে বড় দলিল বলে যে হাদীসটি পেশ করেন, সেটা তাদের দলিল বহন করে না।
অতএব, নব্য আহলে হাদিস ভাইদের অনুরোধ করবো, আপনাদের মহান গুরু ও মান্যবর ব্যক্তির উপরোক্ত বয়ান ভাল করে পড়–ন! তাহলেই আপনাদের বিভ্রান্তির কারণ বুঝতে পারবেন। ইনশাআল্লাহ।
(গ) শাইখ মুহাম্মদ বিন সালেহ আল-উসাইমিন রহ. এর অভিমত
قال الشيخ ابن عثيمين رحمه الله وعندي ان التفويض الى الاراده لا ينافي الوجوب اذا قام عليه الدليل فقد قال النبي صلى الله عليه و سلم في المواقيت هن لهن اتى عليهن ، من غير اهلهن ممن يريد الحج والعمرة ، ولم يمنع ذلك من وجوب الحج والعمرة بدليل اخر . فصح تقسيم الناس فيها الى مريد و غير مريد لان الاضحيه لا تجب على المعسر. (ثم نقل الشيخ قول شيخ الاسلام ابن تيميه مفصلا وذكر جميع الادله لنفات الوجوب واجاب واحد عن واحد واتي بادلة الوجوب فاجاب عما ورد فيها حديثا عن حديث) ثم قال: هذه آراء العلماء وادلتهم سقناها ليبين شان الاضحيه واهميتها في الدين. والادله فيها متكافية ، و سلوك الاحتياط ان لا يدع مع القدره عليها لما فيها من تعظيم الله وذكره و براءة الذمة بيقين انتهي . (احكام الاضحية والزكاة ص ٤٧ (
শাইখ ইবনে উসাইমিন রহ. উপরোক্ত বক্তব্যে সুস্পষ্টভাবে বলেছেন যে, কুরবানি ওয়াজিব হওয়ার পক্ষের দলিলসমূহ প্রাধান্য পাবে। তিনি দলিলগুলোর উপর আরোপিত সব অভিযোগের জবাবও দিয়েছেন। পক্ষান্তরে যারা ওয়াজিব বলেন না, তাদের দলিলগুলো একটা একটা করে খ-নও করেছেন এবং বলেছেন, এর অধিকাংশ দলিলই দুর্বল। যেটা সহীহ সেটা কিন্তু ওয়াজিবের পরিপন্থী নয়। পরিশেষে বলেছেন, যথেষ্ট পরিমাণে দলিল উল্লেখ করলাম কুরবানির গুরুত্ব ও ইসলামের নির্দেশনা বোঝানোর জন্য। সব দলিলের বিবেচনায় অতি সাবধানতা হচ্ছেÑ সামর্থ্যবান ব্যক্তির জন্য কুরবানি না করার কোন সুযোগ নেই। ইসলামের নিদর্শন হিসাবে এটাই দাবি রাখে। (আহকামুল উযহিয়্যাহ ও যাকাত ৪৭)
নিজস্ব মত: যারা কুরবানি ঐচ্ছিক বলেন, তাদেরকে বলতে চাই, ওয়াজিব আদায়ের মধ্যে নিরাপদ। ওয়াজিবের মধ্যে সুন্নাত ও নফল আছে; কিন্তু নফল/সুন্নাতের মধ্যে ওয়াজিব নেই। আর এটা তো সামর্থবানদের ওপরও ওয়াজিব সবার প্রতি নয়। সূতরাং শরিয়তের মহা হুকুম ও শিআরে ইসলামের এ আমল উম্মাহর মধ্যে উৎসাহ দিতে হবে অনুসাহিত নয়।
তথ্য সহযোগিতায়, মুফতি মিযানুর রহমান সাঈদ ও হাফেজ মাওলানা আব্দুল মাজীদ মামুন রহমানি-এর প্রবন্ধ থেকে, আওয়ার ইসলাম.
والله اعلم بالصواب
উত্তর দিচ্ছেন, মুফতি মুহাম্মাদ আব্দুর রাজ্জাক