জাকাতে দেনা পাওনার হিসাব
মুফতি আফফান নাজীব
বিভিন্ন প্রয়োজনে মানুষ কখনও পাওনাদার হয়, আবার কখনও দেনাদার হয়। এটি জীবনের একটি বাস্তবতা। তবে দেনা-পাওনার ব্যাপারে ইসলাম মানুষকে অনেক বেশি সচেতন করেছে। একই সঙ্গে দেনা-পাওনার যথাযথ হিসাব প্রতিদিন হালনাগাদ করে রাখতে বলেছে। রাসুল (সা.) বলেন, ‘যে মুসলমানের অসিয়ত করে যাওয়ার মতো কোনো বিষয় রয়ে গেছে, তার জন্য বৈধ নয় যে, সে তা নিজের কাছে লিখিত না রেখে দুই রাত পর্যন্ত বিলম্ব করবে।’ (বোখারি : ২৭৩৮)। অতএব, সঠিকভাবে জাকাত আদায় করতে হলে দেনা-পাওনারও যথাযথ হিসাব করতে হবে। এর মধ্য থেকে কিছু পাওনা আছে, যেগুলো হাতে পাওয়ার আগেও তার জাকাত দিতে হয়; আর কিছু দেনা আছে, যেগুলো নিজের জাকাতযোগ্য সম্পদ থেকে বিয়োগ করে অবশিষ্ট সম্পদের জাকাত দিতে হয়। তাই আমাদের জানতে হবে, কোন ধরনের পাওনা-দেনার হিসেব কীভাবে করতে হবে!
পাওনা টাকার জাকাত
দুই ধরনের পাওনা টাকার জাকাত প্রতি বছরই আদায় করতে হবে। তা হলো- করজ হিসেবে প্রদানকৃত টাকা ও ব্যবসায়িক পণ্য করার বিপরীতে সৃষ্ট পাওনা। উক্ত পাওনা যদি দেনাদার স্বীকার করে অথবা স্বীকার না করলেও আপনার কাছে উক্ত পাওনার ডকুমেন্ট থাকে, তাহলে এ ধরনের ঋণের জাকাত প্রতি বছরই দিতে হবে। তবে কেউ চাইলে টাকা হাতে পাওয়ার পরও জাকাত দিতে পারবেন। সে ক্ষেত্রে যে কয় বছর জাকাত দেওয়া হচ্ছে না, তার সঠিক হিসাব রাখতে হবে। হাতে পাওয়ার পর উক্ত পাওনা থেকে অতীতের অনাদায়ী সবগুলো বছরের জাকাত দিতে হবে। এ ছাড়া অন্যান্য পাওনা টাকা প্রতিবছর জাকাত দিতে হয় না; বরং হাতে পাওয়ার পর যদি জাকাতবর্ষ পূর্ণ হয়, তখন শুধু চলতি বছরের জাকাত দিতে হবে। যেমন- উত্তরাধিকারসূত্রে পাওনা টাকা, বকেয়া বেতন, বকেয়া বাড়ি ভাড়া, যে ঋণের গ্রহীতা তার ঋণ অস্বীকার করে এবং তার কোনো প্রমাণ নেই, মোহরানার পাওনা টাকা, প্রভিডেন্ড ফান্ডে বাধ্যতামূলক জমাকৃত টাকা ইত্যাদি। (আদ্দুররুল মুখতার : ৩/২৮১)।
দেনা টাকার জাকাত
দেনা টাকা বলতে আপনার কাছে অন্যের পাওনা টাকা। এটিও বিভিন্ন ধরনের হতে পারে। যদি ঋণ গ্রহণ করা হয় অথবা ব্যবসায়িক পণ্য ক্রয়ের বিপরীতে দেনা সৃষ্টি হয়, তাহলে জাকাত হিসাব করার সময় উক্ত দুই ধরনের দেনা আপনার মোট জাকাতযোগ্য সম্পদ থেকে বিয়োগ করবেন। এরপর অবশিষ্ট সম্পদের জাকাত দেবেন। যেমন- কিস্তিতে ফ্রিজ কিনেছেন, কিন্তু এখনও কিছু টাকা পাওনা আছে অথবা গাড়ি কেনার জন্য বন্ধু থেকে কিছু টাকা ধার নিয়েছেন। এগুলো বিয়োগ করতে হবে।
জামানত বা অ্যাডভান্স মানির জাকাত কে দেবে?
দোকান বা বাসা ইত্যাদির ভাড়া দেওয়ার সময় অ্যাডভান্স মানি, সিকিউরিটি মানি, জামানত ইত্যাদি বিভিন্ন নামে অগ্রিম একমুঠে টাকা নেওয়ার প্রচলন আছে। এই টাকার জাকাত কে দেবে? এ বিষয়ে সমাধান করতে হলে আগে দেখতে হবে, উক্ত জামানতের টাকা কি চুক্তিতে নেওয়া হয়েছে! যদি অগ্রিম ভাড়া বাবদ নিয়ে থাকে, তাহলে মালিকপক্ষ এর জাকাত দেবে। আর তা না হলে ভাড়াটিয়া এর জাকাত দেবে। (অনলাইন দারুল ইফতা, বানুরি টাউন, পাকিস্তান)।
অগ্রিম ভাড়া বাবদ বোঝার উপায় হলো, জামানতের টাকা থেকে প্রতি মাসে কিছু টাকা ভাড়া হিসেবে কর্তন করা হলে তা সম্পূর্ণটা অগ্রিম ভাড়া গণ্য হবে। আর যদি প্রদত্ত জামানতের পূর্ণ টাকা চুক্তির মেয়াদ শেষে পুরোটাই ফেরত দিতে হয়, তাহলে তা অগ্রিম ভাড়া হিসেবে গণ্য হবে না। (বুহুস ফি কাজায়া ফিকহিয়্যা : ১/১০৯)।
পাওনা ঋণ জাকাত থেকে কর্তন করা যাবে?
কখনও এমন হয়, একজনকে ঋণ দিয়েছেন। লোকটি নিতান্ত গরিব। জাকাত গ্রহণের উপযুক্ত। এখন আপনার ঋণ পরিশোধ করার মতো তার সামর্থ্য নেই। এমতাবস্থায় আপনি প্রথমে তাকে জাকাতের টাকা প্রদান করবেন। তারপর আপনি তার কাছ থেকে আপনার পাওনা ঋণ উসুল করে নিতে পারবেন। কিন্তু পাওনা টাকা জাকাত থেকে কর্তন করার সুযোগ নেই। (আদ্দুররুল মুখতার : ৩/২২৬)।
বায়নার টাকার জাকাত
কোনো পণ্য কিস্তিতে কিনলে ডাউনপেমেন্ট বা বায়না হিসেবে যে টাকা দেওয়া হয়, তার জাকাত বিক্রেতা দেবে। কারণ, চুক্তির পর উক্ত টাকার মূলত বিক্রেতা মালিক হয়ে যায়।
শিল্প ঋণের জাকাত
কোনো কোম্পানি বা ব্যবসায়ী ব্যাংক থেকে লোন নিয়েছে। উদ্দেশ্য হলো, তা দিয়ে ব্যবসায়িক পণ্য ক্রয় করবে। যেমন- কোম্পানি ব্যাংক থেকে মোটা অংকের লোন নিয়ে কাঁচামাল ক্রয় করেছে। তাহলে যেহেতু উক্ত কাঁচামালের জাকাত দিতে হবে, তাই উক্ত লোনের জাকাত দিতে হবে না। নয়তো একই সম্পদে দু’বার জাকাত আবশ্যক হয়ে যায়; যা প্রমাণিত নয়।
পক্ষান্তরে যদি ঋণটা এমন হয়, তা দিয়ে জাকাতযোগ্য কোনো দ্রব্য কেনা হয়নি, তাহলে এ ক্ষেত্রে পরবর্তী ১ বছর যে পরিমাণ কিস্তি পরিশোধ করতে হবে, শুধু সে অংশটুকু জাকাতযোগ্য মোট সম্পদ থেকে বিয়োগ ধরবেন। (জাকাত : যা না জানলেই নয়)।
হারাম সম্পদের জাকাত
হারাম কোনো টাকা নিজের অ্যাকাউন্টে বা পকেটে চলে এলে তা পুরোটাই সওয়াবের নিয়ত ছাড়া দান করে দিতে হবে। যেমন- ব্যাংক ডিপোজিট থেকে প্রাপ্ত সুদ ইত্যাদি। (রদ্দুল মুহতার : ৩/২৬১)। উল্লেখ্য, সুদের চুক্তিতে কোনো অ্যাকাউন্টে টাকা সঞ্চয় বা সংরক্ষণ বৈধ নয়। (সুরা বাকারা : ২৭৮)।
লেখক : সিএসএএ, অ্যাওফি, বাহরাইন