জিজ্ঞাসা-১২৯৪০:
আসসালামু আলাইকুম ওয়া রহমাতুল্লাহ।
সম্মানিত মুফতি সাহেব,
একজন অফিসার জানতে চেয়েছেন, খতমে তারাবির তথা তারাবিহ নামাজের মধ্যে কুরআন শরীফ খতম করার রেওয়াজ কবে থেকে চালু হয়েছে।
দলিল ভিত্তিক জানালে উপকৃত হতাম। জাযাকাল্লাহু খয়রান।
তারিখ: ৩০/০৩/২৪ ঈসায়ি/ইংরেজি
মাওলানা সেলিম তালুকদার থেকে।
জবাব: ওয়ালাইকুমুস সালাম ওয়া রহমাতুল্লাহ। নাহমাদুহু ওয়া নুসল্লি আলা রসূলিল কারিম। আম্মাবাদ -
তাসলিম ও হামদ-সানার পর প্রথম কথা হলো, আমাদের সমাজে প্রচলিত খতমে তারাবি রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম থেকে সরাসরি এভাবে বর্ণিত হয়নি। তবে তিনি পবিত্র কোরআন রমজান মাসে খতম করতেন এটা প্রমাণিত। দলিল -
হাদিস নং-০১
عَنْ أَبِي هُرَيْرَةَ قَالَ: كَانَ رَسُولُ اللهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ يُعْرَضُ عَلَيْهِ الْقُرْآنُ فِي كُلِّ رَمَضَانَ، فَلَمَّا كَانَ الْعَامُ الَّذِي قُبِضَ فِيهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ عُرِضَ عَلَيْهِ مَرَّتَيْنِ،
হযরত আবূ হুরায়রা রাঃ থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের কাছে প্রতি রমজানে একবার কুরআন পেশ বা তিলাওয়াত করা হতো, তবে তার ইন্তিকালের বছর তার কাছ তা দু’বার পেশ বা তিলাওয়াত করা হয়। [ সুনানে নাসায়ী কুবরা, হাদীস নং-৭৯৩৮,সুনানে ইবনে মাজাহ, হাদীস নং-১৭৬৯]
হাদিস নং-০২
إِنَّ جِبْرِيلَ كَانَ يَلْقَاهُ فِي كُلِّ لَيْلَةٍ مِنْ رَمَضَانَ حَتَّى يَنْسَلِخَ، يَعْرِضُ عَلَيْهِ الْقُرْآنَ،
হযরত ইবনে আব্বাস রাঃ থেকে বর্ণিত, তিনি বলেনঃ হযরত জিবরাঈল আলাইহিস সালাম রমজান শেষ হওয়া পর্যন্ত প্রতি রাতে নবীজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সাথে সাক্ষাৎ করেন। তার কাছে কুরআন পেশ করেন। [সহীহ ইবনে হিব্বান, হাদীস নং-৩৪৪০]
আর খতমে তারাবি সাহাবী, তাবেঈ, সালফে সালেহীন এবং ইসলামের সম্মানিত চার ইমাম এর মতে সুন্নত বা মুস্তাহাব। দলিল -
১.সাহাবীদের আমল:
তারাবী নামাযে যেন কুরআন খতম হয়, সেজন্য হযরত উমর রাঃ প্রতি রাকাতে কত আয়াত করে পড়বে তাও নির্দিষ্ট করে আদেশ দিতেন।
عَنْ أَبِي عُثْمَانَ النَّهْدِيِّ، قَالَ: ” دَعَا عُمَرُ بْنُ الْخَطَّابِ رَضِيَ اللهُ عَنْهُ بِثَلَاثَةِ قُرَّاءٍ فَاسْتَقْرَأَهُمْ، فَأَمَرَ أَسْرَعَهُمْ قِرَاءَةً أَنْ يَقْرَأَ لِلنَّاسِ فِي رَمَضَانَ بِثَلَاثِينَ آيَةً، وَأَمَرَ أَوْسَطَهُمْ أَنْ يَقْرَأَ خَمْسًا وَعِشْرِينَ، وَأَمَرَ أَبْطَأَهُمْ أَنْ يَقْرَأَ عِشْرِينَ آيَةً “
হযরত উসমান নাহদী রহঃ বলেন, হযরত উমর রাঃ তিন ক্বারীকে ডাকলেন। তারপর তাদের কিরাত শুনলেন। দ্রুত তিলাওয়াতকারীকে আদেশ করলেন রমজানে (তারাবীর মাঝে) লোকদের (প্রতি রাকাতে) ত্রিশ আয়াত করে পড়ার, মধ্যম ধরণের তিলাওয়াতকারীকে পঁচিশ আয়াত এবং ধীরে তিলাওয়াতকারীকে বিশ আয়াত পড়ার হুকুম দিলেন। তাখরিজ: শুয়াবুল ঈমান লিলবায়হাকী, হাদীস নং-৩০০৪, সুনানুল কুবরা লিলবায়হাকী, হাদীস নং-৪২৯৫
২. তাবেয়িদের আমল:
عَنِ الْحَسَنِ، قَالَ: «مَنْ أَمَّ النَّاسَ فِي رَمَضَانَ فَلْيَأْخُذْ بِهِمُ الْيُسْرَ، فَإِنْ كَانَ بَطِيءَ الْقِرَاءَةِ فَلْيَخْتِمِ الْقُرْآنَ خَتْمَةً، وَإِنْ كَانَ قِرَاءَتُهُ بَيْنَ ذَلِكَ فَخَتْمَةٌ وَنِصْفٌ، فَإِنْ كَانَ سَرِيعَ الْقِرَاءَةِ فَمَرَّتَيْنِ»
হযরত হাসান বসরী রহঃ বলেন, যে ব্যক্তি রমজানে লোকদের (তারাবীর) ইমামতী করে, সে যেন সহজতা অবলম্বন করে। যদি তার কিরাত ধীরে ধীরে হয়, তাহলে যেন এক খতম কুরআন পড়ে। যদি মধ্যম ধরণের হয়, তাহলে দেড় খতম। আর যদি দ্রুত হয়, তাহলে দুই খতম করবে। তাখরিজ: মুসান্নাফ ইবনে আবী শাইবা-৫/২২২, হাদীস নং-৭৭৬১
৩. চার ইমাম ও তাদের অনুসারীদের আমল:
فكون الإمام يقرأ جزءا من القرآن في صلاة التراويح كل ليلة بحيث يقرأ ربعا في كل ركعة بغرض الختم في التراويح لا يعتبر بدعة، لأن الختم المذكور مستحب عند أصحاب المذاهب الأربعة،
ইমাম প্রতি রাতে তারাবীহ নামাযে কুরআনের কিছু অংশ পাঠ করেন, যেমন তিনি তারাবীহ নামায সমাপ্ত করার উদ্দেশ্যে প্রতি রাকাতে এক চতুর্থাংশ তেলাওয়াত করেন, এটি একটি বিদআত বলে বিবেচিত হয় না। কারণ এভাবে কুরআন খতম চারটি মাযহাবের অনুসারীদের নিকট মুস্তাহাব। সূত্র: ফিকহুল ইবাদাত, তারাবিহ ওয়া কিয়ামুল্লাইল-৫৬৪১৩ (ফতোয়া নং)
৪.ইমাম বুখারি আমল:
كَانَ مُحَمَّد بن إِسْمَاعِيل البُخَارِيّ إِذَا كَانَ أَوَّلُ لَيْلَةٍ مِنْ شَهْرِ رَمَضَانَ يجْتَمع إِلَيْهِ أَصْحَابه فيصلى بهم وَيقْرَأ فِي كل رَكْعَة عشْرين آيَة وَكَذَلِكَ إِلَى أَن يخْتم الْقُرْآن وَكَانَ يقْرَأ فِي السحر مَا بَين النّصْف إِلَى الثُّلُث من الْقُرْآن فيختم عِنْد السحر فِي كل ثَلَاث لَيَال
যখন রমজানের প্রথম রাত আসতো তখন মুহাম্মদ বিন ইসমাঈল বুখারী রহঃ এর বন্ধুরা তার কাছে একত্র হয়ে যেতো। তারপর তিনি তাদের নিয়ে [তারাবী] নামায পড়তেন। আর প্রতি রাকাতে তিনি বিশ আয়াত তিলাওয়াত করতেন। আর এভাবে তিনি খতম করতেন। আর যখন সেহরীর সময় হতো, তখন তিনি অর্ধেক থেকে কুরআনের এক তৃতীয়াংশ তিলাওয়াত করতেন। এভাবে সেহরীতে তিন দিনে খতম করতেন। {হাদয়ুস সারী মুকাদ্দিমা ফাতহুল বারী-৬৬}
প্রশ্ন: ক। খোলাফায়ে রাশেদিন, সাহাবা এবং তাবেয়িদের আমল গ্রহণযোগ্য তার দলিল আছে কি?
উত্তর: ক। হ্যাঁ, সাহাবা তথা খোলাফায়ে রাশেদিন তাবিয়িদের আমল গ্রহণযোগ্য। তাদেরকে অনুসরণ করতে আল্লাহ রাসুল নির্দেশ দিয়েছেন। দলিল:
হাদিস নং-০১
إِنّهُ مَنْ يَعِشْ مِنْكُمْ بَعْدِي فَسَيَرَى اخْتِلَافًا كَثِيرًا، فَعَلَيْكُمْ بِسُنّتِي وَسُنّةِ الْخُلَفَاءِ الرّاشِدِينَ الْمَهْدِيِّينَ، تَمَسّكُوا بِهَا، وَعَضّوا عَلَيْهَا بِالنّوَاجِذِ.
قال الترمذي: هَذَا حَدِيثٌ حَسَنٌ صَحِيحٌ.
কোনো সন্দেহ নেই, আমার পর যারা বেঁচে থাকবে তারা অনেক এখতেলাফ দেখতে পাবে। তখন আমার সুন্নাহ এবং হেদায়েতপ্রাপ্ত খুলাফায়ে রাশেদীনের সুন্নাহকে গ্রহণ করবে। এই আদর্শকে দৃঢ়ভাবে আঁকড়ে ধরবে এবং মাঢ়ীর দাঁত দিয়ে কামড়ে থাকবে। Ñজামে তিরমিযী, হাদীস ২৬৭৬; সুনানে আবু দাউদ, হাদীস ৪৬০৭
হাদিস নং-০২
عن عمران بن الحصين قال قال رسول الله صلى الله عليه وسلم خَيْرُ أُمَّتي قَرْنِي ثُمَّ الَّذِينَ يَلُونَهُمْ ثُمَّ الَّذِينَ يَلُونَهُمْ
অর্থঃ হযরত ইমরান বিন হুসাইন রা. থেকে বর্ণিত, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, আমার উম্মতের মধ্যে সর্বোত্তম তারা যারা আমার যুগে রয়েছে (অর্থাৎ সাহাবায়ে কেরাম)। অতঃপর তাদের পরবর্তী যুগের উম্মাত (তথা তাবেয়ীগণ)। অতঃপর তাদের পরবর্তী যুগের উম্মাত। (অর্থাৎ, তাবয়ে তাবেয়ীণ) । তাখরিজ: বুখারি-২৬৫২,২৬৫১
হাদিস নং-০৩
قال رسول الله صلي الله عليه وسلم أوحي الله يا محمد ان اصحابك عندي كالنجوم بعضها اضوأ من بعض ولكل نور فمن اخذ بشي مماهم عليه من اختلافهم فهو عندي علي الهدي – رواه الدارقطني-
অর্থঃ রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন আল্লাহ অহী পাঠিয়েছেন যে, হে মুহাম্মাদ! আপনার সাহাবীগণ আমার নিকট নক্ষত্রতুল্য, কেউ অতি উজ্জল কেউ তার চেয়ে কম, তবে সকলেরই আলো আছে। অতএব, তাদের মতবিরোধের ক্ষেত্রেও যে কোন এক পক্ষকে অনুসরণ করলেই সে অনুসারী আমার নিকট হেদায়াত প্রাপ্ত বলে গণ্য হবে।
নোট: কেননা, তাদের বিরোধ হবে ইজতেহাদী, আর সঠিক ইজতেহাদের কোন অংশকেই নিশ্চিত ভুল বলা যাবে না) হাদীসটির সনদে দুর্বলতা থাকলেও এ মর্মে আরো অনেক হাদীস থাকায় এবং হাদীসটি বিষয় বস্তু কুরআনের বিভিন্ন আয়াত ও অপরাপর হাদীস সমর্থিত হওয়ায় হাদীসটি সম্পূর্ণ গ্রহণযোগ্য)। তাফসীরে মাযহারী ২য় খন্ড পৃঃ ১১৬
সারকথা হলো, সাহাবায়ে কেরাম ও তাবেয়ি-তাবা তাবেয়িগণের এবং চার ইমামের ঐক্যমতে নিরবচ্ছিন্ন আমল দ্বারা এটি প্রমাণিত যে, রমজানে খতমে তারাবিহ জামাআতের সাথে পড়া হবে। সুতরাং এটাকে বিদআত বলার অবকাশ নেই।
والله اعلم بالصواب