আল-বুরহান ( দলিল-প্রমাণ)

আসসালামু আলাইকুম ওয়া রহমাতুল্লাহ! আমাদের ওয়েবসাইটে আপনাকে স্বাগতম। একটু নিচে দেখুন> বিষয় ভিক্তিক সাজানো রয়েছে, আপনার পছন্দ অনুযায়ী পাঠ করুন এবং পোষ্টগুলো ভালো লাগলে শেয়ার করুন আর আপনার কোন প্রশ্ন থাকলে এই নাম্বারে- ০১৬৮৭-১১৩৮৮০ হোয়াটস অ্যাপে পাঠিয়ে দিন । জাযাকাল্লাহু খাইর।

জিজ্ঞাসা-১৭২: নাভির নিচে হাত বাঁধার হাদিস শরিফ কি জাল? এ কথা কি সঠিক

No Comments

 



জিজ্ঞাসা-১৭২:  ইউটিউবে একজন বক্তার আলোচনা শুনলাম তিনি বলছেননামাজে বুকের উপর হাত বাঁধার পাঁচটি সহীহ হাদীস আছে আর নাভির নিচে হাত বাঁধার তিনটি জাল ও যয়ীফ হাদীস আছে। এ সম্পর্কে তাহকীক প্রয়োজন। তারিখ -১৫/০৬/২০২২ ঈসায়ি/ইংরেজি 


 মাওলানা আব্দুল্লাহিল কাফি- মোমেনশাহি থেকে-


জবাব:  

 ১. হযরত ওয়াইল ইবনে হুজর রা. বলেন,

رأيت النبي صلى الله عليه وسلم وضع يمينه على شماله في الصلاة تحت السرة.  أخرجه ابن أبي شيبة قال: حدثنا وكيع عن موسى بن عمير عن علقمة بن وائل عن أبيه وإسناده صحيح. قال الحافظ قاسم بن قطلوبغا في تخريج أحاديث الاختيار شرح المختار : هذا سند جيد وقال الشيخ أبو الطيب السندي في شرحه على الترمذي : هذا حديث قوي من حيث السند وقال الشيخ عابد السندي في طوالع الأنوار: رجاله كلهم ثقات أثبات اهـ  

অর্থ: আমি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে নামাযে ডান হাত বাম হাতের উপর রেখে নাভির নিচে রাখতে দেখেছি। মুসান্নাফে ইবনে আবী শায়বাহাদীস নং ৩৯৫৯। এর সনদ সহীহ।


হাফেজ কাসিম ইবনে কুতলূবুগা র.তিরমিযী শরীফের ভাষ্যকার আবুত্ তায়্যিব সিন্ধী র. ও আল্লামা আবেদ সিন্ধী র. প্রমুখ হাদীসটিকে মজবুত ও শক্তিশালী বলেছেন। এর সনদ এরূপ: ইবনে আবী শায়বা র. বর্ণনা করেছেন ওয়াকী থেকেতিনি মূসা ইবনে উমায়ের থেকেতিনি আলকামার সূত্র্রে হযরত ওয়াইল রা. থেকে। এই সনদে কোন দুর্বল রাবী  নেই।

 

এ হাদীসটি সম্পর্কে কেউ কেউ শুধু এতটুকু আপত্তি উত্থাপন করেছেন যেমুসান্নাফের কোন কোন পাণ্ডুলিপিতে এটি বিদ্যমান নেই। কিন্তু এ আপত্তি হাদীসের অনেক কিতাবের ক্ষেত্রেই চলে। তিরমিযীমুসনাদে আহমদসহীহ ইবনে হিব্বান পভৃতি কিতাব দেখুনএক পাণ্ডুলিপিতে এমন কিছু হাদীস পাওয়া যায়যা অন্য পাণ্ডুলিপিতে নেই। তিরমিযী শরীফের মুবারকপুরীআহমাদ শাকের ও শুআয়ব আরনাউতের তিন কপিতেই এ তারতম্য দেখা যায়। সুত্ররাং এটা কোন আপত্তি হতে পারে না। যারা নিজের চোখে হাদীসটি মুসান্নাফে দেখেছেন তাদের কথাই গ্রহণযোগ্য হবে।

 

২. হযরত আলী রা. বলেন,

السُّنَّةُ وَضْعُ الْكَفِّ عَلَى الْكَفِّ فِى الصَّلاَةِ تَحْتَ السُّرَّةِ. أخرجه أبو داود (في رواية ابن الأعرابي وابن داسة) ٧٥٦ وأحمد ١/١١٠ (٨٧٥) وابن أبي شيبة (٣٩٦٦) والدارقطني ١/٢٨٦ والضياء في المختارة ٢/٧٧٢ وفيه عبد الرحمن بن إسحاق الواسطي وهو ضعيف. ولكن يشهد له الحديث السابق.

 

অর্থ: নামাজে সুন্নত হলো (এক হাতের) তালু (অন্য হাতের) তালুর উপর রেখে নাভির নিচে রাখা। আবূ দাউদ শরীফহাদীস নং ৭৫৬মুসনাদে আহমদ ১খ১১০ পৃহাদীস নং ৮৭৫মুসান্নাফে ইবনে আবী শায়বাহাদীস নং ৩৯৬৬দারাকুতনী১খ২৮৬পৃযিয়া ফিল মুখতারা২খ৭৭২পৃ।

 

এর সনদে আব্দুর রহমান ইবনে ইসহাক রয়েছেন। তিনি দুর্বল। তবে প্রথম হাদীসটি এর সমর্থন করছে।

৩. হযরত আবূ হুরায়রা রা. বলেছেন,

أَخْذُ الأَكُفِّ عَلَى الأَكُفِّ فِى الصَّلاَةِ تَحْتَ السُّرَّةِ. أخرجه أبو داود (٧٥٨) وفيه عبد الرحمن المذكور.

অর্থ: নামাযে হাতের তালু অপর তালুর উপর রেখে নাভির নিচে রাখতে হবে। আবূ দাউদ শরীফহাদীস নং ৭৫৮। এতেও পূর্বোক্ত আব্দুর রহমান রয়েছেন।

 

৪. হযরত আনাস রা. বলেছেন,

 ثلاث من أخلاق النبوة تعجيل الإفطار وتأخير السحور ووضع البد اليمنى على اليسرى في الصلاة تحت السرة. أخرجه ابن حزم في المحلى تعليقا ٣/٣٠

অর্থ: তিনটি বিষয় নবীস্বভাবের অন্তর্ভুক্ত। ইফতারে বিলম্ব না করাসাহরী শেষ সময়ে খাওয়াএবং  নামাযে ডান হাত বাম হাতের উপর রেখে নাভির নিচে রাখা। ইবনে হাযমআল মুহাল্লা৩খ৩০পৃ। তিনি এর সনদ উল্লেখ করেন নি।

 

৫. হাজ্জাজ ইবনে হাসসান র. বলেন,

سمعت أبا مجلز أو سألته قال : قلت كيف يصنع قال : يضع باطن كف يمينه على ظاهر كف شماله ويجعلها أسفل من السرة . أخرجه ابن أبي شيبة في مصنفه. (٣٩٦٣)

 

অর্থ: আমি আবূ মিজলায র. (বিশিষ্ট তাবেয়ী)কে বলতে শুনেছিঅথবা হাজ্জাজ বলেছেনআমি আবূ মিজলায র.কে জিজ্ঞেস করলামকিভাবে হাত বাঁধবেতিনি বললেনডান হাতের তালু বাম হাতের তালুর পিঠে রেখে নাভির নিচে বাঁধবে। মুসান্নাফে ইবনে আবী শায়বাহাদীস নং ৩৯৬৩। এর সনদ সহীহ।

 

৬. ইবরাহীম নাখায়ী র. (যিনি তাবেয়ী ছিলেন) বলেন,

 

يضع يمينه على شماله في الصلاة تحت السرة . أخرجه ابن أبي شيبة ٣٩٦٠


অর্থ: নামাযে ডান হাত বাম হাতের উপর রেখে নাভির নিচে বাঁধবে। মুসান্নাফে ইবনে আবী শায়বাহাদীস নং ৩৯৬০  এর সনদ হাসান।

 

ইমাম বুখারীর উস্তাদ ইসহাক ইবনে রাহূয়া বলেছেন,

 

تحت السرة  أقوى في الحديث وأقرب إلى التواضع.

অর্থাৎ নাভির নিচে হাত বাঁধার হাদীস অধিক শক্তিশালী এবং বিনয়ের নিকটতর। মাসাইলুল ইমাম আহমদ ওয়া ইসহাকলি ইসহাক ইবনে মানসুর আলকাওসাজমৃত্যু ২৫১নং ২১৪ ইবনুল মুনযিরআলআওসাত৩খন্ড,২৪৩ পৃ.

[12:24 PM, 5/29/2022] Robi Rt Jalal: যেসব হাদীস দ্বারা বুকের উপর হাত বাঁধার প্রমাণ পেশ করা হয়তার একটিও সহীহ নয়। নিম্নে পর্যালোচনাসহ হাদীসগুলো তুলে ধরা হলো।

 

১. হযরত ওয়াইল রা. বলেছেন,

صليت مع رسول الله صلى الله عليه و سلم ووضع يده اليمنى على يده اليسرى على صدره )أخرجه ابن خزيمة ১/২৪৩ رقم : ৪৭৯)

আমি রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সঙ্গে নামায পড়লাম। তিনি তার ডান হাত বাম হাতের উপর রেখে বুকের উপর রাখলেন।

 

আলবানী সাহেব হাদীসটি সম্পর্কে সহীহ ইবনে খুযায়মার টীকায় মন্তব্য করেছেন:

 

إسناده ضعيف لأن مؤملا وهو ابن اسماعيل سيئ الحفظ لكن  الحديث صحيح جاء من طرق أخرى بمعناه وفي الوضع على الصدر أحاديث  تشهد له

 

অর্থাৎ এর সনদ দুর্বল। কেননা মুয়াম্মাল- তিনি ইসমাঈলের পুত- দুর্বল স্মৃতিশক্তির অধিকারী। তবে অন্যান্য সূত্র্রে এর সমার্থক বর্ণনা থাকায় হাদীসটি সহীহ। আর বুকের উপর হাত রাখার ক্ষেত্রে অনেক হাদীস রয়েছেযা এর বিশুদ্ধতার সাক্ষ্য দেয়। সহীহ ইবনে খুযায়মা১/২৪৩ হাদীস নং ৪৭৯আবুশ শায়খতাবাকাতুল মুহাদ্দিসীন বিআসবাহান২/২৮৬বায়হাকী ২/৩০হাদীস নং ২৩৩৬।

 

কিন্তু এ হাদীসটি সহীহ নয়। কারণ-


ক. এর সনদে মুয়াম্মাল ইবনে ইসমাঈল আছেন। তিনি সুফিয়ান ছাওরী থেকে এটি বর্ণনা করেছেন। মুয়াম্মালকে ইমাম বুখারী মুনকারুল হাদীস বলেছেন। তিনি একথাও বলেছেনআমি যাকে মুনকারুল হাদীস বলবোতার সূত্র্রে বর্ণনা করা বৈধ হবে না। তাছাড়া ইবনে সাদ বলেছেনثقة كثير الغلط তিনি বিশ্বস্ততবে অনেক ভুল করতেন। আবূ যুরআ রাযী বলেছেনفي حديثه خطأ كثير তার হাদীসে অনেক ভুলআবূ হাতেম রাযী বলেছেনصدوق كثير الخطأ يكتب حديثه তিনি সাদূক বা সত্যনিষ্ঠতবে  প্রচুর ভুল করতেনতার হাদীস লিপিবদ্ধ করা যায়। (আল জারহু ওয়াত তাদীল৮/৩৭৪) দারাকুতনী বলেছেনثقة كثير الخطأ তিনি বিশ্বস্ত তবে অত্যধিক ভুলের শিকার। ইবনে মাঈন এক বর্ণনায় বলেছেনসুফিয়ানের ক্ষেত্রে তিনি প্রমাণযোগ্য হওয়ার উপযুক্ত নন। (দ. তারীখে ইবনে মুহরিয১/১১৪) মুহাম্মদ ইবনে নসর বলেছেনতিনি কোন বর্ণনার ক্ষেত্রে নিঃসঙ্গ হলে ভেবে চিন্তে দেখতে হবেকেননা তার প্রচুর ভুল হত। (দ. তাহযীবুত তাহযীব) ইয়াকুব ইবনে সুফিয়ান আল ফাসাবী উল্লেখ করেছেন যেসুলায়মান ইবনে হারব বলেছেনوقد يجب على أهل العلم أن يقفوا عن حديثه ويتخففوا من الرواية عنه فإنه منكر يروي المناكير عن ثقات شيوخنا وهذا أشد فلو كانت هذه المناكير عن ضعاف لكنا نجعله له عذرا  আলেমগণের উচিৎতার হাদীস গ্রহণ করার ব্যাপারে সতর্ক থাকা ও কম করে বর্ণনা করা। কারণ তিনি আপত্তিকর হাদীস বর্ণনা করতেন আমাদের বিশ্বস্ত উস্তাদগণ থেকে। এটা খুবই অন্যায়। কারণ এসব আপত্তিকর বর্ণনা যদি দুর্বলদের থেকে হতো তবে আমরা তাকে মাযুর বিবেচনা করতাম। (আল মারিফা ওয়াত তারীখ৩/৫২) আস সাজী বলেছেনصدوق كثير الخطأ وله أوهام يطول ذكرها তিনি সাদূক বা সত্যনিষ্ঠতবে তার প্রচুর ভুল হতসেগুলোর পরিমাণ এত বেশী যে,উল্লেখ করলে আলোচনা দীর্ঘ হয়ে যাবে। (তাহযীবুত তাহযীব)

 

ইবনে হাজার আসকালানীও ফাতহুল বারী গ্রন্থে বলেছেনوكذلك مؤمل بن إسماعيل في حديثه عن الثوري ضعف  অর্থাৎ একইভাবে (সুফিয়ান) ছাওরী হতে মুয়াম্মাল ইবনে ইসমাঈলের বর্ণনায় দুর্বলতা আছে। (দ৯খ২৮৮পৃ৫১৭২ হাদীসের অধীনে)

 

তাছাড়া স্বয়ং আলবানী র.ও মুয়াম্মাল কর্তৃক বর্ণিত সহীহ ইবনে খুযায়মার দুটি হাদীসকে দুর্বল আখ্যা দিয়েছেন। হাদীস দুটির নম্বর হলো ১১০৫ ও ১১৩৬।

 

খ. মুয়াম্মালের দুজন সঙ্গী মুহাম্মদ ইবনে ইউসুফ ফিরয়াবী (আলমুজামুল কাবীর তাবারানী ২২/৩৩) ও আব্দুল্লাহ ইবনুল ওয়ালিদ (মুসনাদে আহমদ ৪/৩১৮নাসাঈহাদীস নং ৮৮৯) (দুজনই বিশ্বস্ত রাবী) সুফিয়ান রহ.থেকে হাদীসটি বর্ণনা করেছেন। কিন্তু তাদের বর্ণনায় বুকের উপর কথাটি নেই।

 

গ. আলবানী সাহেব আবুশ শায়খের উদ্ধৃতি তো দিয়েছেন। কিন্তু তার বর্ণনাটি পেশ করেন নি। অথচ উক্ত বর্ণনায় আছেرأيت رسول الله صلى الله عليه وسلم وضع يده على شماله عند صدرهঅর্থাৎ আমি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে দেখলামতিনি ডান হাতকে বাম হাতের উপর রেখে বুকের কাছে রাখলেন।

 

এ হাদীসের সনদেও মুয়াম্মাল ইবনে ইসমাঈল আছেন। তাহলে তার বর্ণনায় ইযতিরাব বা অসংগতি পাওয়া গেল। কখনও বলেছেন বুকের উপরকখনও বুকের কাছে।

 

ঘ. এ হাদীসটি মুয়াম্মাল ইবনে ইসমাঈল সুফিয়ান সাওরী থেকে বর্ণনা করেছেনঅথচ সুফিয়ান সাওরী রহ. নিজেই নাভীর নিচে হাত বাঁধতেন।

 

মুয়াম্মালের সূত্র ছাড়া এ হাদীসের আরেকটি সুত্র রয়েছে। সেটি হলো:

 

عن محمد بن حجر بن عبد الجبار بن وائل الحضرمي حدثني عمي سعيد بن عبد الجبار عن أبيه عن أمه أم يحيى عن وائل بن حجر وفيه: ثم وضع يمينه على يساره على صدره. أخرجه الطبراني في الكبير ২২/৪২ (১১৮) والبيهقي (২৩৩৫)

 

অর্থাৎ মুহাম্মদ ইবনে হুজর তার চাচা সাঈদ ইবনে আব্দুল জাব্বার থেকেতিনি  তার পিতা আব্দুল জাব্বার ইবনে ওয়াইল থেকেতিনি তার মাত্রার সুত্রে ওয়াইল ইবনে হুজর রা. থেকে বর্ণনা করেছেন যেনবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তার ডান হাত বাম হাতের উপর রেখে বুকের উপর রাখলেন। (তাবারানীমুজামে কাবীর২২/৪২ হাদীস ১১৮বায়হাকীহাদীস ২৩৩৫)

 

এ সুত্রটিও দুর্বল। তার কারণ:

 

ক. মুহাম্মদ ইবনে হুজর দুর্বল। তার সম্পর্কে ইমাম বুখারী র. বলেছেন,  فيه نظر অর্থাৎ তার ব্যাপারে আপত্তি রয়েছে। (তারীখে কাবীরনং ১৬৪) আবু আহমদ আল হাকেম বলেছেন,  ليس بالقوي عندهم অর্থাৎ তিনি মুহাদ্দিসগণের দৃষ্টিতে শক্তিশালী বর্ণনাকারী নন। (লিসান৭/৫৮) আর ইবনে হিব্বান তার আলমাজরূহীন (সমালোচিত্র রাবী চরিত) গ্রন্থে বলেছেন,

 

يروي عن عمه سعيد بن عبد الجبار عن أبيه عبد الجبار عن أبيه وائل بن حجر بنسخة منكرة منها أشياء لها أصول من حديث رسول الله صلى الله عليه و سلم وليست من حديث وائل بن حجر ومنها أشياء من حديث وائل بن حجر مختصرة جاء بها على التقصي وأفرط فيها ومنها أشياء موضوعة ليس من كلام رسول الله صلى الله عليه و سلم لا يجوز الاحتجاج به

 

অর্থাৎ মুহাম্মদ ইবনে হুজর তার চাচা সাঈদ ইবনে আব্দুল জাব্বার থেকেতিনি তার পিতা আব্দুল জাব্বার থেকেতিনি তার পিতা ওয়াইল ইবনে হুজর রা. থেকে- এই সূত্র্রে বর্ণিত আপত্তিকর একটি হাদীসের কপি থেকে হাদীস বর্ণনা করে থাকেন। এর মধ্যে কিছু হাদীস এমন আছেযার মূল তো রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম থেকে পাওয়া যায়। কিন্তু তা ওয়াইল রা. কর্তৃক বর্ণিত নয়। আর কিছু হাদীস এমন আছেযা হযরত ওয়াইল রা. থেকে সংক্ষিপ্তরূপে বর্ণিত আছে। কিন্তু মুহাম্মদ ইবনে হুজর তাতে বৃদ্ধি ঘটিয়ে বিস্তারিতরূপে পেশ করেছেন। আবার কিছু হাদীস আছে সম্পূর্ণ জাল। সেগুলো রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম থেকে প্রমাণিত নয়। তাকে (মুহাম্মদ ইবনে হুজরকে) প্রমাণস্বরূপ পেশ করা জায়েয হবে না।

 

উকায়লী ও ইবনে আদীও তার ব্যাপারে ইমাম বুখারীর মন্তব্য উল্লেখ করে তা সমর্থন করেছেন। যাহাবী মীযান ও মুগনী উভয় গ্রন্থে বলেছেন,  له مناكير অর্থাৎ তার কিছু কিছু আপত্তিকর বর্ণনা রয়েছে। আর আল মুকতানা ফী সারদিল কুনা গ্রন্থে তিনি বলেছেন ليّن অর্থাৎ দুর্বল। হায়সামী বলেছেন,  وهو ضعيف অর্থাৎ তিনি দুর্বল। (মাজমাউয যাওয়াইদ১১৭৮ ও ১৬০০৪)

 

মুহাম্মদ ইবনে হুজরের চাচা সাঈদ ইবনে আব্দুল জাব্বারও সমালোচিত্র রাবী। তার সম্পর্কে ইমাম বুখারী বলেছেন,  فيه نظر অর্থাৎ তার ব্যাপারে আপত্তি রয়েছে। ইবনে মাঈন বলেছেন,  لم يكن بثقة অর্থাৎ তিনি বিশ্বস্ত ছিলেন না।

 

খ. সাঈদ ইবনে আব্দুল জাব্বারের তিনজন সঙ্গী আছেন। এক. মুহাম্মদ ইবনে জুহাদা (মুসলিমনং ৪০১)দুই. আবু ইসহাক আস সাবিঈ (আহমদ৪/৩১৮) তিন. আলমাসউদী (আহমদনং ১৮৮৫২তাবারানী২২/৩২-৩৩) কিন্তু তাদের কারো বর্ণনাতেও বুকের উপর কথাটি নেই।

 

সুত্ররাং এটি যে মুহাম্মদ ইবনে হুজরের ভুল বর্ণনা সেটা আর বলার অপেক্ষা রাখে না। তাছাড়া বাযযার র. তার মুসনাদে একই সনদে এই হাদীস উদ্ধৃত করেছেন। সেখানে বুকের উপর কথাটির পরিবর্তে আছে-  عند صدره অর্থাৎ বুকের কাছে। (দবাযযার৪৪৮৮) সনদের দুর্বলতার পাশাপাশি এটা মতনের ইযতিরাব (অসংগতি)ও বটে।

 

 বোঝা গেলহাদীসটির কোন সনদই সহীহ নয়। সুত্ররাং তবে অন্যান্য সূত্র্রে এর সমার্থক বর্ণনা থাকায় হাদীসটি সহীহ আলবানী সাহেবের একথাও সঠিক নয়। এর সমর্থক বর্ণনাগুলোও দুর্বলযেমনটি সামনে তুলে ধরা হচ্ছে।

 

২. যারা বুকের উপর হাত রাখেন তারা তাউস রহ.এর একটি বর্ণনা দ্বারা দলিল দিয়ে থাকেন। তাউসের বর্ণনাটি আবূ দাউদ শরীফে (৭৫৯) আছে। হাদীসটি নিম্নরূপ:

 

عَنْ طَاوُسٍ قَالَ كَانَ رَسُولُ اللَّهِ -صلى الله عليه وسلم- يَضَعُ يَدَهُ الْيُمْنَى عَلَى يَدِهِ الْيُسْرَى ثُمَّ يَشُدُّ بَيْنَهُمَا عَلَى صَدْرِهِ وَهُوَ فِى الصَّلاَةِ.

 

অর্থাৎ রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম নামাযে ডান হাত বাম হাতের উপর রাখতেন। অতঃপর উভয় হাত বুকের উপর বাঁধতেন।

 

প্রকৃতপক্ষে এ হাদীস দ্বারা তাদের দলিল দেওয়ার অবকাশ নেই। কারণ এটি মুরসাল। আর মুরসাল (সূত্র বিচ্ছিন্ন)কে তারা প্রামাণ্য মনে করেন না। তদুপরি এতে সুলায়মান ইবনে মূসা নামের একজন বর্ণনাকারী আছেন। তার সম্পর্কে বুখারী র. বলেছেনعنده مناكير তার কিছু আপত্তিকর বর্ণনা আছে। ইমাম নাসাঈ বলেছেনليس بالقوي في الحديث তিনি হাদীসে মজবুত নন। ( দযাহাবীর আল কাশিফ)

 

আলী ইবনুল মাদীনী বলেছেন,  مطعون عليه তিনি সমালোচিত্র ও অভিযুক্ত রাবী। আস সাজী রহ. বলেছেন,  عنده مناكير তার কিছু আপত্তিকর বর্ণনা আছে। হাকেম আবু আহমদ বলেছেন,  في حديثه بعض المناكير তার হাদীসে কিছু কিছু আপত্তিকর বিষয় আছে। আবু হাতেম রাযী বলেছেন,  محله الصدق وفي حديثه بعض الاضطراب তিনি সাদূক বা সত্যনিষ্ঠ মানেরতবে তার হাদীসে কিছু কিছু ইযতিরাব বা অসঙ্গতি রয়েছে। ইবনুল জারূদ তাকে যুআফা গ্রন্থে উল্লেখ করেছেন। বোঝা যায়তার দৃষ্টিতেও তিনি দুর্বল ছিলেন। ইবনে হাজার আসকালানী রহ. তাকরীব গ্রন্থে লিখেছেন,  صدوق فقيه في حديثه بعض لين وخولط قبل موته بقليل তিনি সাদূক বা সত্যনিষ্ঠফকীহতার হাদীসে কিছু দুর্বলতা রয়েছে। মৃত্যুর কিছু পূর্বে তার স্মৃতিবিভম দেখা দিয়েছিল।

 

এখন বলুনএ ধরনের বর্ণনাকারীর হাদীস সহীহ হয় কীভাবেস্বয়ং আলবানী সাহেব তার সম্পর্কে আসলু সিফাতিস সালাহ গ্রন্থে (২/৫২৮) লিখেছেনصدوق في حديثه بعض لين সাদূকতার হাদীসে কিছু দুর্বলতা রয়েছে। আর ইরওয়া গ্রন্থে (৬/২৪৬) একটি হাদীস সম্পর্কে তিনি মন্তব্য করেছেন,

 

إن الحديث رجاله كلهم ثقات رجال مسلم إلا أن سليمان بن موسى مع جلالته في الفقه فقد قال الذهبي في الضعفاء : صدوق )ثم قال بعد ذكر قول البخاري والحافظ في التقريب( وعلى هذا فالحديث حسن الإسناد وأما الصحة فهي بعيدة عنه.

 

 অর্থাৎ এ হাদীসটির রাবীগণ সকলে বিশ্বস্তমুসলিমের রাবী। তবে সুলায়মান ইবনে মূসা ফিকহে উচ্চ মানসম্পন্ন ব্যক্তি হলেও যাহাবী তার সম্পর্কে স্বীয় যুুআফা গ্রন্থে বলেছেনসাদূক।

 

এরপর আলবানী সাহেব ইমাম বুখারী ও হাফেয ইবনে হাজার এর মন্তব্য উল্লেখপূর্বক বলেছেনএ হিসাবে হাদীসটি হাসান স্তরের সনদ বিশিষ্ট। এটি কোনভাবেই সহীহ হতে পারে না।

 

সারকথাঅনেক মুহাদ্দিসের দৃষ্টিতে সুলায়মানের দুর্বলতার কারণে হাদীসটি দুর্বল। হ্যাঁকিছু কিছু আলেমের দৃষ্টিতে এটি বড়জোর হাসান মানসম্পন্নকিন্তু সহীহ নয় কারও মতেই। তো একে তো হাদীসটি সহীহ নয়। তদুপরি রয়েছে এর নানা সমস্যা। যেমন (ক) এর মুরসাল হওয়া; (খ) এ অনুযায়ী সালাফ বা পূর্বসূরিগণের আমল না থাকা এবং (গ) এর আরেকটি বড় সমস্যা হলোসুলায়মান ইবনে মূসা মুদাল্লিস রাবী। যেমনটি বলেছেন ইবনে হিব্বান তার মাশাহীরু উলামাইল আমসার গ্রন্থে। ইবনে হাজার আসকালানীও তারীফু আহলিত তাকদীস বি মারাতিবিল মাওসূফীনা বিত তাদলীস গ্রন্থে তাকে মুদাল্লিস রাবীদের তালিকাভুক্ত করেছেন। আর স্বীকৃত  কথা যেমুদাল্লিস রাবী যদি عن (হতে বা থেকে) শব্দ যোগে বর্ণনা করেনতবে সেটি অবিচ্ছিন্ন সূত্র বলে বিবেচিত্র হয় না। এ হিসাবে সুলায়মান ও তাউসের মাঝে আরেকটি বিচ্ছিন্নতা সৃষ্টি হচ্ছে। যার কারণে হাদীসটি হাসান হওয়াও দুষ্কর হয়ে পড়ছে। সনদে এতসব ত্রুটি থাকা সত্ত্বেও এ হাদীস কি দলিল হিসেবে গ্রহণযোগ্য হতে পারে?

 

৩. তাদের আরেকটি দলিল হল হযরত ইবনে আব্বাস রা. এর একটি হাদীসযা বায়হাকীতে আছে। হাদীসটি এমন-

 

عَنِ ابْنِ عَبَّاسٍ رَضِىَ اللَّهُ عَنْهُمَا فِى قَوْلِ اللَّهِ عَزَّ وَجَلَّ ( فَصَلِّ لِرَبِّكَ وَانْحَرْ) قَالَ : وَضْعُ الْيَمِينِ عَلَى الشِّمَالِ فِى الصَّلاَةِ عِنْدَ النَّحْرِ.

 

অর্থাৎ আল্লাহর বাণী : فصل لربك وانحر সম্পর্কে ইবনে আব্বাস রা. বলেছেননামাযে বাম হাতের উপর ডান হাত রেখে গলার কাছে রাখা।

 

এ হাদীসের সনদে রাওহ্ ইবনুল মুসায়্যাব আছেনতিনি চরম দুর্বল রাবী। ইবনে হিব্বান তার সম্পর্কে বলেছেনতিনি বিশ্বস্ত লোকদের নামে জাল হাদীস বর্ণনা করতেনতার থেকে হাদীস গ্রহণ করা বৈধ হবে না। ইবনে আদী বলেছেনأحاديثه غير محفوظة তার হাদীস সঠিক নয়। (দতাহযীবুত তাহযীব)

 

তাছাড়া এতে ইয়াহইয়া ইবনে আবু তালিব আছেন। তিনি বিতর্কিত বর্ণনাকারী। এসব দুর্বলতার কারণেই শাওকানী সাহেব লা-মাযহাবী হওয়া সত্ত্বেও তার তাফসীর ফাতহুল কাদীরে আলী রা. ও ইবনে আব্বাস রা.এর কোন হাদীসই উক্ত আয়াতের ব্যাখ্যায় উদ্ধৃত করেন নি। হাফেজ ইবনে কাছীর রহ. আলী রা.এর ব্যাখ্যাটি উল্লেখপূর্বক বলেছেনولا يصح এটি সহীহ নয়। এ মর্মে আরো কিছু ব্যাখ্যা উদ্ধৃত করে তিনি মন্তব্য করেছেন- وكل هذه الأقوال غريبة جدا والصحيح القول الأول  এসব বক্তব্য অত্যন্ত অপরিচিত্র ও অভিনব। প্রথম ব্যাখ্যাটিই সহীহ ও সঠিক। আর প্রথম ব্যাখ্যাটি তিনি এভাবে পেশ করেছেন-

 

قال ابن عباس، وعطاء، ومجاهد، وعكرمة، والحسن: يعني بذلك نحر البُدْن ونحوها. وكذا قال قتادة، ومحمد بن كعب القرظي، والضحاك، والربيع، وعطاء الخراساني، والحكم، وإسماعيل بن أبي خالد، وغير واحد من السلف.

 

অর্থাৎ ইবনে আব্বাস রা. আতামুজাহিদইকরিমাও হাসান (বসরী) বলেছেনআয়াতের মর্ম হলোউট বা অন্য পশু কুরবানী করা। একই কথা বলেছেন কাতাদা মুহাম্মদ ইবনে কাব আলকুরাজীদাহহাকআর রাবীআতা আলখুরাসানীহাকামইসমাঈল ইবনে আবু খালিদ ও অনেক পূর্বসূরি। (দ. সূরা কাওছার এর তাফসীর)

 

আয়াতটির উক্ত সহীহ ব্যাখ্যাই অবলম্বন করেছেন আরবের বিখ্যাত আলেম লা-মাযহাবী ঘরানার লোক বাক আবু যায়দ। তিনিও হযরত ইবনে আব্বাস রা. কর্তৃক বর্ণিত গলার নিকট হাত বাঁধার হাদীসটিকে দুর্বল আখ্যা দিয়েছেন। এবং হযরত আলী রা. কর্তৃক বর্ণিত এ হাদীসটি সম্পর্কে ইবনে কাছীর রহ.এর পূর্বোক্ত মন্তব্যকেই সমর্থন করেছেন। (দ. মাজমূআ রাসাইললা-জাদীদা ফী আহকামিস সালাতপৃ. ১২১৫)

 

শুধু তাই নয়লা-মাযহাবী বন্ধুদের সংক্ষিপ্ত ব্যাখ্যাসহ কুরআনের উর্দু অনুবাদ যা সৌদি সরকারের উদ্যোগে প্রকাশিত হয়েছে সেখানেও আয়াতটির অর্থ লেখা হয়েছে اور قربانى كر   এবং কুরবানী কর। এমনিভাবে ড. মুজিবুর রহমানসদস্য বাংলাদেশ জামইয়তে আহলে হাদীসতাঁর বাংলা কুরআন তরজমায় এর অর্থ লিখেছেনএবং কুরবানী কর।

 

হযরত আলী রা. ও ইবনে আব্বাস রা. এর হাদীস দুটি সহীহ হলে এসব লা-মাযহাবী আলেম আয়াতটির এমন অনুবাদ করলেন কিভাবে?

 

৪. তাদের আরেকটি দলিল হল হযরত আলী রা. এর একটি হাদীসযা বুখারী র. এর তারীখে কাবীরে আছে। হাদীসটি হলো :

 

عَنْ عُقْبَةَ بْنِ ظَبْيَانَ عَنْ عَلِىٍّ (فَصَلِّ لِرَبِّكَ وَانْحَرْ) وَضَعَ يَدَهُ الْيُمْنَى عَلَى وَسْطِ سَاعِدِهِ عَلَى صَدْرِهِ. (رقم:২৯১১)

 

উকবা ইবনে জাবয়ান হযরত আলী রা. থেকে বর্ণনা করেন যেفصل لربك وانحر (আয়াতের ইনহার শব্দের অর্থ হলো) ডান হাত বাম হাতের বাহুর মাঝ বরাবর রেখে বুকের উপর রাখা। (দ. নং ২৯১১)

 

তিনটি কারণে এ  হাদীসটিও সহীহ নয় :

 

একহযরত আলী রা. থেকে যিনি এটি বর্ণনা করেছেনতার নাম নিয়ে বর্ণনাকারীগণ বিভিন্ন কথা বলেছেন। ইয়াযীদ ইবনে যিয়াদ ইবনে আবুল জাদ তার নাম বলেছেন উকবা ইবনে যুহায়র (عقبة بن ظهير)হাম্মাদ  ইবনে সালামা তার নাম বলেছেন উকবা ইবনে যাবয়ান (عقبة بن ظبيان)আর আব্দুর রহমান ইবনে মাহদী র. বলেছেনউকবা ইবনে সাহবান(عقبة بن صهبان)। আবার উকবা থেকে এটি  কে বর্ণনা করেছেন তা নিয়েও এযতেরাব আছে। ইয়াযীদ ইবনে যিয়াদ বলেছেন আসিম আল জাহদারীর নাম। কিন্তু হাম্মাদ ইবনে সালামা বলেছেন আসিমের পিতার নাম। মুহাদ্দিসগণের পরিভাষায় এটাকে সনদের এযতেরাব বলা হয়যা হাদীস দুর্বল প্রমাণিত হওয়ার অন্যতম কারণ। দইলালে দারাকুতনী৪খ৯৯পৃআল জারহু ওয়াত তাদীল লি ইবনে আবী হাতিম৬খ৩১৩পৃ।

 

দুইহযরত আলী রা. থেকে এ হাদীসটি একই সনদে ইবনে আবী হাতেম রহ. আল জারহু ওয়াত তাদীল গ্রন্থে উল্লেখ করেছেন। সেখানে নামাযে ডান হাত বাম হাতের উপর রাখার কথা আছেবুকের  উপর (على الصدرকথাটি  নেই। একইভাবে ইবনে আবী শায়বাও মুসান্নাফে এটি উল্লেখ করেছেনসেখানেও বুকের উপর কথাটি  নেই। দহাদীস নং ৩৯৬২।

 

তিনইমাম বুখারী র. তার আত তারীখুল কাবীর গ্রন্থে উক্ত হাদীসকে সমর্থন করেননি,  বরং সেটি উল্লেখ করার পর বলেছেন,

 

وقال قتيبة عن حميد بن عبد الرحمن عن يزيد بن أبي الجعد عن عاصم الجحدري عن عقبة من أصحاب علي عن علي رضـ : وضعها على الكرسوع. ٦/٤٣٧

 

অর্থাৎ কুতায়বা র. হুমায়দ ইবনে আব্দুর রহমানের সূত্র্রে ইয়াযীদ ইবনে আবুল জাদ থেকেতিনি আসিম জাহদারীর সূত্র্রে হযরত আলী রা. এর ছাত্র  উকবা থেকেতিনি হযরত আলী রা. থেকে বর্ণনা করেছেন যেতিনি তার হাত কব্জির  উপর রাখলেন। (দ৬খ৪৩৭পৃ) 

 

এতে বোঝা যায়তিনি এই দ্বিতীয় বর্ণনাটিকে সঠিক মনে করেছেন। এতে করে এই বর্ণনাটিও হানাফী ও সংখ্যাগরিষ্ঠ আলেমের দলিলরূপে গণ্য হবে। বুখারী শরীফে বর্ণিত আলী রা.এর আমলও এই দ্বিতীয় বর্ণনারই সমর্থক।

 

৫. তাদের পঞ্চম দলিল হযরত হুলব রা. থেকে বর্ণিত হাদীস। তাতে আছে-

 

 ... وَرَأَيْتُهُ ، قَالَ ، يَضَعُ هَذِهِ عَلَى صَدْرِهِ وَصَفَ يَحْيَى : الْيُمْنَى عَلَى الْيُسْرَى فَوْقَ الْمِفْصَلِ.

 

অর্থাৎ আর আমি তাঁকে (নবী সা.কে) দেখলামএটি বুকের উপর রাখতে। ইয়াহইয়া (ইবনে সাঈদ আল কাত্তান) এর বিবরণ দিয়েছেন- ডান হাত বাম হাতের কব্জির উপর।

 

হাদীসটি মুসনাদে আহমদে (২২৩১৩) আছে। সুফিয়ান থেকে শধু ইয়াহয়াই বুকের উপর হাত বাঁধার কথাটি উল্লেখ করেছেন। মুসনাদে আহমদে ওয়াকী র.দারাকুতনীতে ওয়াকী ও আব্দুর রহমান ইবনে মাহদী,  বায়হাকীতে (৩৬১০) আল হুসাইন ইবনে হাফস- এই তিনজন সুফিয়ান থেকে হাদীসটি বর্ণনা করেছেন। কিন্তু তাদের বর্ণনায় বুকের উপর হাত বাঁধার কথা  নেই। তিরমিযীইবনে মাজাহ ও মুসনাদে আহমদে সুফিয়ানের সঙ্গী আবুল আহওয়াস এবং মুসনাদে আহমদে ৫/২২৬ (নং ২২৩১৬) শরীক ইবনে আব্দুল্লাহ হাদীসটি সিমাক থেকে বর্ণনা করেছেন। তাঁদের বর্ণনাতেও বুকের উপর হাত বাঁধার কথা  নেই। সুত্ররাং  এটি শায বা দলবিচ্ছিন্ন বর্ণনাযা গ্রহণযোগ্য নয়। বিশেষভাবে আব্দুর রহমান ইবনে মাহদীর বর্ণনাটি এজন্য অগ্রগণ্য হওয়ার উপযুক্ত যেইমাম আহমদ বলেছেনكان يحب أن يحدث باللفظ অর্থাৎ তিনি উস্তাদের মূল শব্দে বর্ণনা করা পছন্দ করতেন। আর আবূ হাতেম রাযী বলেছেনهو أثبت من يحيى بن سعيد وأتقن من وكيع وكان يعرض حديثه على الثورى  অর্থাৎ তিনি ইয়াহইয়া ইবনে সাঈদের তুলনায় সুদৃঢ়ওয়াকীর চেয়ে মজবুত। তিনি সুফিয়ান ছাওরীর হাদীসগুলো তাঁর সামনে পেশ করে শোনাতেন।

 

তাছাড়া সুফিয়ান ছাওরী রহ. যদি এটি এভাবে বর্ণনা করে থাকেনতবে তার আমলও এ অনুযায়ী হওয়ার কথা ছিল। কিন্তু তার আমল হলো নাভীর নিচে হাত বাঁধা। (দ. আত তামহীদ২০/৭৫) বোঝা গেলতিনি হাদীসটি এভাবে বর্ণনা করেন নি।

 

আল্লামা নিমাবী র. আছারুস সুনান গ্রন্থে লিখেছেন,

 

ويقع في  قلبي أن هذا تصحيف من الكاتب والصحيح يضع هذه على هذه فيناسبه قوله: وصف يحيى اليمنى على اليسرى فوق المفصل ويوافقه سائر الروايات

 

অর্থাৎ আমার মনে হয়অনুলেখকের ভুলের কারণে এমনটি হয়েছে। সঠিক হবেعلى صدره  (বুকের উপর) এর স্থলে على هذه (এই হাতের উপর) (এ হিসেবে হাদীসটির অর্থ দাঁড়ায়- এই হাতটি এই হাতের উপর রেখেছেন- লেখক) এতে এটি পরের কথার সঙ্গেও মিলে যায়। কারণ পরে বলা হয়েছেইয়াহইয়া ডান হাত বাম হাতের কব্জির উপর রেখে দেখিয়েছেন। আর এটি তখন অন্যান্য বর্ণনাকারীদের বর্ণনার সাথেও সংগতিপূর্ণ হয়। (দপৃ ৮৭)

 

উল্লেখ্য যেইয়াহইয়া ইবনে সাঈদ থেকে এ বর্ণনাটি তার শিষ্যদের মধ্যে শুধু ইমাম আহমদই উদ্ধৃত করেছেন। এতে যদি বুকের উপর হাত রাখার কথা থাকততাহলে ইমাম আহমদ এটাকে মাকরুহ বলতেন না। অথচ হাদীসটি শোনার পর তিনি ঐ মাকরুহ হওয়ার ফতোয়া দিয়েছেন। তার প্রমাণইমাম আবু দাউদ জন্ম লাভ করেছেন ইয়াহইয়া ইবনে সাঈদের মৃত্যুর পর। আর তিনি ইমাম আহমদ থেকে নিজের শোনা মাসায়েলের যে সংকলন তৈরি করেছেনতাতে উল্লেখ রয়েছে-  وسمعته سئل عن وضعه فقال فوق السرة قليلا، وإن كان تحت السرة فلا بأس وسمعته يقول يكره أن يكون يعني وضع اليدين عند الصدر  অর্থাৎ আমি শুনেছিতাকে জিজ্ঞেস করা হলোহাত কোথায় রাখা হবেতিনি বললেননাভির সামান্য উপরে। নাভির নিচে রাখলেও কোন অসুবিধা নেই। আমি তাকে এ কথাও বলতে শুনেছি যেএভাবে অর্থাৎ বুকের কাছে হাত রাখা মাকরুহ।

 

স্বয়ং লা-মাযহাবী বন্ধুরাও এ হাদীসের উপর আমল করেন না। কারণ এর শেষাংশে বলা হয়েছে- অতঃপর ইয়াহয়া ডান হাত বাম হাতের কব্জির উপর রাখেন। এই ইয়াহয়া হলেন ইবনে সাঈদ আল কাত্তান। তিনি হাদীসটির ব্যাখ্যা করতে গিয়ে ডান হাত বাম হাতের কব্জির উপর রেখে বুঝিয়ে দিয়েছেনহাত কিভাবে বাঁধতে হয়।

 

মাম তিরমিযী র. হযরত হুলব রা. এর হাদীস উল্লেখ করে বলেছেন,

 

والعمل على هذا عند أهل العلم من أصحاب النبي صلى الله عليه وسلم والتابعين ومن بعدهم يرون أن يضع الرجل يمينه على شماله في الصلاة ورأى بعضهم أن يضعهما فوق السرة ورأى بعضهم أن يضعهما تحت السرة وكل ذلك واسع عندهم

 

অর্থাৎ সাহাবীতাবেয়ী ও পরবর্তী যুগের আলেমগণের আমল ছিল এ হাদীস অনুযায়ী। তাঁরা মনে করতেননামাযে ডান হাত বাম হাতের উপর রাখবে। তাঁদের কেউ কেউ মনে করতেন নাভির উপরে রাখবেআর কেউ  কেউ মনে করতেন নাভির নিচে রাখবে। তাঁদের দৃষ্টিতে প্রত্যেকটিরই অবকাশ আছে।

 

লক্ষ করুনইমাম তিরমিযী রহ. সাহাবায়ে কেরাম ও তাবেঈন থেকে তার নিজের যুগ পর্যন্ত আলেমগণকে দুভাগ করেছেন। এক ভাগের মত ছিল নাভির নিচে হাত বাঁধাআরেক ভাগের মত ছিল নাভির উপরে হাত বাঁধা। বুকের উপর হাত বাঁধার আমল কোথায়?  একইভাবে ইবনুল মুনযির র.ও তাঁর আল আওসাত গ্রন্থে উপরোক্ত দুই ধরনের আমল ও মতের কথাই উল্লেখ করেছেন।

 

বুকের উপর হাত বাঁধা যে পূর্বসূরিগণের আমল ছিল না তা আলবানী সাহেবের নিম্নোক্ত কথা থেকেও স্পষ্ট হয়। ইরওয়াউল গালীল গ্রন্থে তিনি বলেছেন,

 

وأسعد الناس بهذه السنة الصحيحة الإمام إسحاق ابن راهويه فقد ذكر المروزي في ( المسائل ): ( كان إسحاق يوتر بنا . . . ويرفع يديه في القنوت ويقنت قبل الركوع ويضع يديه على ثدييه أو تحت الثديين). )২/৭১)

 

অর্থাৎ এই সহীহ সুন্নতটির উপর আমল করে সর্বাধিক ধন্য হয়েছিলেন ইমাম ইসহাক ইবনে রাহূয়া। মারওয়াযী তার মাসাইলে উল্লেখ করেছেনইসহাক র. আমাদেরকে নিয়ে বেতের পড়তেন। ...... আর কুনুতে হাত তুলতেন। রুকুর পূর্বে কুনুত পড়তেন। এবং উভয় হাত বুকের উপর বা বুকের নিচে রাখতেন। (ইরওয়া২/৭১)

 

এ বক্তব্য থেকে বোঝা যায়পূর্বসূরিগণের মধ্যে তিনি শুধু ইসহাক র.কেই এর উপর আমলকারী পেয়েছেন।


উল্লেখ্য যেএই মারওয়াযী হলেন ইসহাক ইবনে মানসুর আল কাওসাজ। তার রচিত্র মাসাইলুল ইমাম আহমদ ওয়া ইসহাক গ্রন্থ থেকেই আলবানী সাহেব উদ্ধৃত অংশটুকু সংক্ষেপে উল্লেখ করেছেন। (দ. আলমাসাইলনং ৩৫৪৬৩৫৪৭) এর দ্বারা দৃশ্যত বোঝা যাচ্ছেইসহাক রহ. বুকের উপরে বা নিচে হাত রাখতেন। অথচ মারওয়াযীর এই গ্রন্থের বরাতেই আমরা ইসহাক র.এর এই বক্তব্য উল্লেখ করেছি যেনাভির নিচে হাত বাঁধার হাদীস অধিক শক্তিশালী ও বিনয়ের নিকটতর।  তার এই বক্তব্য থেকে স্পষ্ট বোঝা যায় যেতিনি নাভির নিচেই হাত বাঁধতেন। আপাতদৃষ্টিতে উভয় বর্ণনা সাংঘর্ষিক। তাহলে কী এর সমাধানএর সমাধান পাওয়া যায় মাসাইলে ইমাম আহমাদ ও ইসহাক গ্রন্থটির টীকাকারের বক্তব্যে। তিনি বলেছেনআলবানীর উদ্ধৃত কথাটির অর্থ এই নয় যেইসহাক র. নামাযে বুকের উপর হাত বাঁধতেন। বরং এর অর্থ হলোতিনি দোয়ায়ে কুনুত পড়ার সময় যে হাত ওঠাতেন তা বুক বরাবর বা বুকের নীচ পর্যন্ত ওঠাতেন। (দ. ৩৫৪৭ নং এর টীকা)

 

এ ব্যাখ্যা দ্বারা উভয় বক্তব্যের মধ্যে সুন্দরভাবে সমন্বয় সাধিত হয়। একটি হাদীসে এই ব্যাখ্যার সমর্থনও পাওয়া গেছে। হাদীসটি ইবনে আবূ শায়বা রহ. তার মুসান্নাফে উদ্ধৃত করেছেন। হাদীসটিতে হযরত আবূ হুরায়রা রা. তাকবীরে তাহরীমার সময় মানুষের হাত তোলার বিভিন্ন অবস্থার বিবরণ দিতে গিয়ে বলেছেন,

 

 منكم من يقول هكذا ورفع سفيان (بن عيينة) يديه حتى تجاوز بهما رأسه ومنكم من يقول هكذا ووضع يديه عند بطنه ومنكم من يقول هكذا يعني حذو منكبيه (رقم ২৪২২)

 

অর্থাৎ তোমাদের কেউ এমন করেসুফিয়ান (ইবনে উয়ায়না) হাত তুলে মাথার উপর নিয়ে গিয়ে দেখালেন। আর কেউ এমন করেসুফিয়ান পেট পর্যন্ত হাত তুললেনআর কেউ এমন করে অর্থাৎ কাঁধ পর্যন্ত হাত তোলে। (হা. ২৪২২) এখানে وضع يديه عند بطنه পেট বরাবর হাত তোলার কথা বলা হয়েছে। হাত বাঁধার কথা বলা হয়নি। তেমনি ইসহাক রহ. সম্পর্কে যে বলা হয়েছে,  ويضع يديه على ثدييه أو تحت الثديين এর অর্থ হবেতিনি কুনুতের সময় উভয় হাত বুক বরাবর বা বুকের নীচ পর্যন্ত ওঠাতেন।

 

তাছাড়া ঐ উদ্ধৃতিতে বুকের উপর রাখতেন শুধু এতটুকু বলা হয়নি। বরং বলা হয়েছেবুকের উপর বা নিচে রাখতেন। নিচে রাখলে তো আলবানী সাহেবের মতলব প্রমাণিত হয় না।


এটাও কম আশ্চর্যের নয় যেআলবানী সাহেব ইসহাক র.এর ঐ স্পষ্ট বক্তব্যটি উল্লেখ না করে কুনুতে হাত বাঁধার- যা আসলে হাত তোলার সাথে সম্পৃক্ত- একটি অস্পষ্ট বক্তব্যের উদ্ধৃতি টেনেছেন।

উল্লেখ্যহাত বাঁধার যে সহীহ নিয়ম পূর্বে আমরা উল্লেখ করেছিসে নিয়মে হাত বাঁধলে বুকের উপর রাখা প্রায় অসম্ভব।


আরেকটি কথালা-মাযহাবী ভাইয়েরা যেভাবে হাত বাঁধেনতাতে বুকের উপরে বাঁধা হয় নাহয় বুকের নিচে। আমি তাদের একজনকে বিষয়টি বলেছিলাম। তিনি আমার সামনে হাত বেঁধে বারবার আমার দিকে তাকাচ্ছিলেন। শেষে বললেনএটাতো কখনোই চিন্তা করিনি। আমি বললামএবার চিন্তা করুন। হাদীস বলবেন বুকের উপর হাত বাঁধারআর আমল করবেন বুকের নিচে হাত বাঁধারতা হয় না।

 নেট থেকে সূত্রঃ মাসিক আল কাউসার/আহলে মিডিয়া 

সংগ্রহে মাওলানা জালাল উদ্দিন