*স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে ভুল বুঝাবুঝি হলে করণীয়-*
- মুফতী মনসূরুল হক দা.বা.
প্রধান মুফতী ও শাইখুল হাদীস,
জামিয়া রহমানিয়া,মুহাম্মাদপুর,ঢাকা।
বর্তমান মূর্খতার যামানায় দেখা যায় স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে ভুল বুঝা-বুঝি হলেই গালি-গালাজ, মারধর এমনকি স্ত্রীকে তালাক দেয়ার ঘটনা পর্যন্ত ঘটে থাকে। এটা মারাত্মক মূর্খতা। এরূপ ক্ষেত্রে সবর-ধৈর্য, নসীহত এবং সংশোধনের রাস্তা অবলম্বন করাই শরীআতের নির্দেশ। জায়িয কাজ গুলির মধ্যে সবচেয়ে নিকৃষ্ট কাজ হল তালাক। (মিশকাত-২/২৮৩)
আমাদের সমাজে যারা দ্বীন সম্পর্কে অজ্ঞ, তারাতো মা-বাপ, স্ত্রী-সন্তানের হক সম্পর্কে কিছুই জানে না। বিবাহ করল আর স্ত্রীর পক্ষ থেকে মেযাজের খেলাফ কিছু হয়ে গেলে দিয়ে দিল তিন তালাক। হারাম করে দিল স্ত্রীকে। পরে যখন মন-মেযাজ ঠিক হল তখন দিশেহারা হয়ে ভ্রান্ত মতবাদ পন্থীদের নিকট যেয়ে কয়েক ‘শত টাকা ফি দিয়ে বিবাহ হালাল করে নিয়ে এল, আর ফতোয়া শোনাল যে, রাগের মাথায় তালাক দিলে তালাক হয় না অথবা মুখের কথায় তালাক হয় না। অথচ শরঈ মাসআলা হচ্ছে, রাগের মাথায় তালাক দিলেও তালাক পড়ে যায় এবং মুখের কথায় তালাক পড়ে যায়। (ফাতাওয়ায়ে দারুল উলুম- ৯/৯৪, ফতোয়ায়ে শামী-২/৪৬৩)
তারা আরো বলে যে, এক সাথে তিন তালাক দিলে এক তালাক গণ্য হয় ইত্যাদি। অথচ শরীআতের মাসআলা হচ্ছে, এক সাথে তিন তালাক দিলে তিন তালাকই পতিত হবে। (এলাউস সুনান-১১/৭৯, বুখারী-২/৭৯১)
এ ধরনের ভুল ফতোয়ার মাধ্যমে স্ত্রীর সাথে সারা জীবন যিনার পথ খুলে দেয়ার ব্যবস্থা করা হয়েছে। সুতরাং তালাকের পথে না গিয়ে সংশোধনের পথ অবলম্বন করতে হবে। মেযাজের খেলাফ শরীআত বিরোধী কোন কাজ যদি স্ত্রী করে ফেলে তাহলেঃ
(ক) প্রথমতঃ নসীহতের মাধ্যমে তাকে বুঝাতে হবে। আর ছোটখাটো সমস্ত ভুল ক্ষমা সুন্দর দৃষ্টিতে দেখতে হবে। আল্লাহ তা’আলা হিকমতের কারণে তাদেরকে আকল বুদ্ধি কিছুটা কম দিয়েছেন। তাই এই বিষয়টি মাথায় রেখে তাদের সাথে ক্ষমা সুলভ আচরণ করতে হবে।
(খ) নসীহতেও যদি কাজ না হয় তাহলে একই ঘরে রেখে বিছানা আলাদা করে দিতে হবে।
(গ) এই দ্বিতীয় পদ্ধতিতে কাজ না হলে তাকে এমন ভাবে হালকা শাস্তি প্রদান করতে হবে, যাতে শরীরের কোথাও যখম বা দাগ না হয়। এটা জায়িয হওয়া সত্ত্বেও কোন নবী আ. এটা করেন নাই। প্রিয় নবী সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইরশাদ করেছেনঃ আমার উম্মতের ভদ্র শ্রেণীর লোকেরা স্ত্রীকে মার-ধোর করবে না। সুতরাং নিজেকে ভদ্র শ্রেণীর অন্তর্ভুক্ত রাখার জন্য সাধ্যানুযায়ী এ থেকে বেঁচে থাকা চাই।
(ঘ) এতেও যদি কোন কাজ না হয় তাহলে উভয় পক্ষের মুরব্বীদের দ্বারা সালিশ বসাতে হবে। সালিশের মাধ্যমে এসব বিষয়ের মীমাংসা করাতে হবে।
এতেও যদি কোন কাজ না হয় অর্থাৎ এই চার স্তর অতিক্রম করার পরেও যদি কোন ফায়দা না হয় তাহলে খুব ধীরে সুস্থে , ভেবে চিন্তে মুফতীদের নিকট থেকে ফতওয়া গ্রহণ করে মাত্র এক তালাক দিতে হবে। কোন অবস্থাতেই তিন তালাক দেবে না। কেননা, শরীআত এমন কোন প্রয়োজন রাখেনি যে ক্ষেত্রে তিন তালাক দেয়া জরুরী। আর এই এক তালাক দিতে হবে স্ত্রী হায়েয থেকে পবিত্র হওয়ার পরে তার সাথে মিলিত না হয়েই। এক তালাক দিলে এক তালাক পতিত হবে। এই অবস্থায় স্ত্রী যদি নিজেকে সংশোধন করে নেয় এবং স্ত্রী কর্তব্যও তাই, তাহলে তিন হায়েয শেষ হওয়ার পূর্বে বিবাহ দোহরানো ছাড়াই এবং হিলা করা ছাড়াই শুধুমাত্র মৌখিক ভাবে বা স্বামী সুলভ আচরণের মাধ্যমে স্ত্রীকে গ্রহণ করে নিলেই স্ত্রী তার জন্য হালাল হয়ে যাবে।
আর যদি বনিবনা না হয় তাহলে এক তালাক দেয়ার পরে তিন হায়েয পার হয়ে গেলে তাদের বিবাহ ভেঙ্গে যাবে উক্ত মহিলা যেখানে ইচ্ছা বিবাহ বসতে পারবে। তাই স্ত্রীকে বিবাহ থেকে বের করার জন্য তিন তালাক দেয়ার কোন প্রয়োজন নেই। বরং এক সাথে তিন তালাক দেয়া হারাম করা হয়েছে। অবশ্য কেউ দিলে সবগুলিই পড়ে স্ত্রী সম্পূর্ণ রূপে হারাম হয়ে যাবে।
তালাকের ব্যাপারে শরীআতের মাসআলা সম্বন্ধে চরম অজ্ঞতা আমাদেরকে একটা বিভ্রান্তির মধ্যে ফেলে রেখেছে। আমাদের দেশে বর্তমানে যে তালাকের আইন প্রচলিত রয়েছে তা সম্পূর্ণ শরীআত বিরোধী। রেডিও, টি ভিতে এবং ইংরেজদের মদদপুষ্ট এনজিওরা এভাবে প্রচারণা চালাচ্ছে যে, রাগের মাথায় তালাক দিলে তালাক হয় না। মুখের কথায় তালাক হয় না। তালাক দেয়ার সাথে সাথে তা কার্যকর হয়না, বরং ৯০ দিন পার হওয়ার পরে চেয়ারম্যান সাহেব তাদের মধ্যে মীমাংসা করতে না পারলে তা কার্যকর হবে। অথচ শরীআতের মাসআলা হচ্ছে, তালাক হাসি- মুখে দিক বা রাগান্বিত অবস্থায় দিক সর্বাবস্থায় তা পতিত হবে। এবং মৌখিক দিক বা লিখিত দিক তা কার্যকর হবে। আর তালাক দেয়ার সাথে সাথেই তা কার্যকারী হয়ে যাবে। ৯০ দিনের কোন শর্ত নেই। সুতরাং নিজেকে জাহান্নামের আগুন থেকে বাঁচাতে হলে টি ভির ফতওয়া মত না চলে আল্লাহ ওয়ালা হক্বানী মুফতীদের ফতওয়া মত চলতে হবে।