রসিকতা হোক পরিমিত-১
Daily Inqilab
মাওলানা আবুল বাশার মুহাম্মাদ সাইফুল ইসলাম
০৩ আগস্ট ২০২৪, ১২:০৮ এএম | আপডেট: ০৩ আগস্ট ২০২৪, ১২:০৮ এএম
রসিকতা মানব জীবনের এক অনুষঙ্গ। কম-বেশি প্রত্যেকেই রসিকতা করে। এটা কেবল হাসিঠাট্টা স্থানীয় আত্মীয়দের জন্যই সংরক্ষিত নয়; বরং দ্বিপাক্ষিক যে-কোনো রকমের সম্বন্ধ এর ভোক্তা হতে পারে এবং হয়েও থাকে। এটা ঠিক যে, রহস্য স্থানীয় আত্মীয়দের মধ্যেই এ রকমের আদান-প্রদান বেশি হয়। অন্যান্য ক্ষেত্রে এর প্রয়োগে সামাজিক বা মানসিক কিছু না কিছু প্রতিবন্ধকতা থাকেই। কিন্তু তা সত্ত্বেও রসিকতার রস সেসব ক্ষেত্রকেও কিছু না কিছু সজীবতা দান করেই থাকে। ভাই-বোন, বন্ধু-বান্ধব, সহপাঠী, সমবয়সী ও সহকর্মীকে ছাড়িয়ে, পিতা-পুত্র, শিক্ষক-ছাত্র, নেতা-কর্মী, কর্মকর্তা-কর্মচারী তথা যে-কোনও রকমের অসম-সম্বন্ধের দু’জনকেও দেখা যায়, সময়-সুযোগ বুঝে রসিকতার রস খানিকটা আস্বাদন করে নেয়।
Pause
Unmute
Remaining Time -10:21
Close PlayerUnibots.com
তা নিতে কোনো বাধাও নেই। অন্তত স্বভাবধর্ম ইসলাম মানবপ্রকৃতির এ প্রবণতায় বাধ সাধে না। তবে হাঁ, ইসলাম যেহেতু ভারসাম্যের ধর্ম এবং সব কিছুতে পরিমিতিবোধ ও মাত্রাজ্ঞানের তালিম তার অনন্য বৈশিষ্ট্য, তাই এখানেও তার শিক্ষা হলো, তুমি রঙ্গ-রসিকতা করো ঠিক আছে, কিন্তু সাবধান মাত্রা ছাড়িয়ে যেও না। সীমার মধ্যে থাকার চেষ্টা কর। অর্থাৎ রসিকতার অনুমতিও দিয়েছে, ক্ষেত্রবিশেষে উৎসাহও দিয়েছে, কিন্তু বাড়াবাড়ি ও সীমালংঘন করতে নিষেধ করেছে।
রসিকতা করার অনুমতি যে আছে তার বড় প্রমাণ প্রিয় নবী (সা.) নিজেও কখনও কখনও রসিকতা করেছেন। হাদিসগ্রন্থসমূহে এর একাধিক দৃষ্টান্ত পাওয়া যায়। যেমন হযরত আনাস ইবনে মালিক (রা.) বর্ণনা করেন যে, একবার এক ব্যক্তি এসে নবী কারীম (সা.) এর কাছে একটা বাহনজন্তু চাইল। রাসূলুল্লাহ (সা.) বললেন, হাঁ, আমরা তোমাকে একটা উটনীর বাচ্চা দেব। লোকটি বলল, ইয়া রাসূলাল্লাহ! আমি উটনীর বাচ্চা দিয়ে কী করব? রাসূলুল্লাহ (সা.) বললেন, আরে উটেরা সব উটনীদেরই বাচ্চা নয় কি? (সুনানে আবু দাউদ : ৪৯৯৮)। প্রিয়নবী (সা.)-এর এ জাতীয় রসিকতার ঘটনা আরো আছে।
বস্তুত, রসিকতা একটা মোক্ষম দাওয়াই। এর দ্বারা মানব জীবনের বহু অবাঞ্ছিত পারিপার্শ্বিকতা সারিয়ে তোলা যায়। কোনো অনাকাক্সিক্ষত আপতনে পরিবেশে যখন গুমোট ভাব দেখা দেয়, তাকে সহজ করার জন্য হাল্কা রসিকতা খুবই কার্যকর। এ উপলক্ষে রসিকতার ব্যবহার আবহমানকাল থেকেই চলে আসছে। প্রিয় কোনো ব্যক্তি রেগে গেলে প্রথমত আমরা রসিকতা দ্বারাই তার রাগ নামানোর চেষ্টা করি। এমন কি শোকার্ত ব্যক্তির উপরও এর প্রয়োগ দেখা যায়। সম্ভবত হাস্য-পরিহাস দ্বারা সমস্যা-সমাধানের কিছু না কিছু অভিজ্ঞতা আমাদের সকলেরই আছে।
তাই এ বিষয়ে বয়ান করার বিশেষ প্রয়োজন বোধ করছি না। প্রয়োজন যেটা, তা হচ্ছে এ ব্যাপারে মাত্রাজ্ঞানের পরিচয় দেয়ার। যা আমরা অনেক সময়ই দেই না। ফলে এমন একটা সুন্দর ও সুকুমার বৃত্তি অনেক সময় বহু অনর্থের কারণ হয়ে দাঁড়ায়। যে-কোনও ভালো জিনিসেরই সুফল পাওয়ার জন্য তার নিয়মনিষ্ঠ ব্যবহার জরুরি। ব্যবহার দোষে অতি প্রিয় জিনিসও ভীষণ অপ্রীতিকর হয়ে যায়। আমরা এমন লোকও দেখেছি, যে হাস্য-পরিহাসকে একদম বরদাশত করে না। হয়ত কোনো একদিন কারো বল্গাহীন পরিহাস তাকে পরিহাসের পাত্রে পরিণত করেছিল। যা দ্বারা কেউ কখনও অপমানিত হয়, তাকে সে বরদাশত করবে কেন?
আসলে রসিকতার যথাযথ প্রয়োগ আমরা অনেকেই জানি না। এ বিষয়ে আমাদের সচেতনতার বড় অভাব। রসিকতা করতে গিয়ে আমরা সীমালংঘন করে ফেলি। যদ্বারা আমি নিজেও ক্ষতিগ্রস্ত হই এবং অন্যকেও করি ক্ষত-বিক্ষত। তা করি বলেই নবী (সা.) নিষেধাজ্ঞা জারি করেন যে, ‘তোমার ভাইয়ের সাথে বাক-বিত-া করো না এবং তার সাথে পরিহাস করো না’। এ নিষেধাজ্ঞা এজন্যই করেছেন যে, সাধারণত আমাদের রসিকতা হয় লাগামহীন। হয় তাতে মিথ্যা কথা বলি, নয়ত কাউকে আহত করি। কাউকে সমাজ চোখে হেয় করি কিংবা পৌনঃপুনিক রসিকতা দ্বারা বিরক্ত করি। এসবই কবীরা গুনাহ-মহাপাপ।
রাসূলুল্লাহ (সা.) নিজেও রসিকতা করতেন, যেমনটা পূর্বে বলা হয়েছে, কিন্তু তার রসিকতায় মিথ্যার কিছু থাকত না। একবার তো সাহাবায়ে কিরাম প্রশ্নই করে বসলেন যে, ইয়া রাসূলাল্লাহ! আপনি যে আমাদের সাথে রসিকতা করেন (অথচ এক হাদিসে আপনি আমাদেরকে এটা করতে নিষেধ করেছেন)? তিনি বললেন, হাঁ, তবে আমি (রসিকতাচ্ছলেও মিথ্যা বলি না) কেবল সত্যই বলি। (জামে তিরমিযী : ১৯৯০)।
তাঁর প্রতিটি রসিকতার প্রতি দৃষ্টিপাত করলে দেখা যাবে মিথ্যার লেশমাত্র নেই। যেমন একবার তিনি হযরত আনাস রা.-কে বলেছিলেন, ‘ওহে দু’কানওয়ালা’! (প্রাগুক্ত, হাদিস ২৩৫) কান তো মানুষের দুটিই হয়। তা সত্ত্বেও যখন কাউকে মজা করে দুকানওয়ালা বলা হবে, প্রথম যাত্রায় সে চমকেই উঠবে। কিন্তু রসজ্ঞ হলে পরক্ষণেই সে বুঝতে পারবে এর দ্বারা পরোক্ষভাবে তার প্রশংসাই করা হয়েছে যে, তুমি নিখুঁত শোন এবং বুঝতেও পারো বেশ। সত্য কথার কী অপূর্ব রসিকতা!