জিজ্ঞাসা-১২৩০৯
আসসালামু আলাই কুম, আমার প্রশ্ন: ফরজ নামাজে একামত দেওয়ার সময় মুসুল্লিগণ নামাজের জন্য কখন দাড়াবে ?মেহেরবানী করে দলীল ভিত্তিক জবাব পেলে কৃতজ্ঞ থাকব, আল্লাহ সকলকে হেফাজত করুন আমিন। তারিখ: ১৭/১০/২২ ঈসায়ি/ইংরেজি
মাওলানা আখতার হোসেন যশোর থেকে-----
জবাব: وعليكم السلام ورحمة الله وبركاته
نحمده ونصل على رسوله الكريم اما بعد بسم الله الرحمن الرحيم
তাসলিম ও হামদ-সানার পর প্রথম কথা হলো, জামাতের কাতার সোজা করা খুবই গুরুত্বপূর্ণ বিষয়, এ ব্যাপারে কারও দ্বিমত নেই। তবে ফরজ নামাজে একামত দেওয়ার সময় মুসুল্লিগণ নামাজের জন্য কখন দাঁড়াবে, এ বিষয়ে ফুকাহায়ে কেরামের কয়েকটি মত পাওয়া যায়। যা সবকটি করারই সুযোগ রয়েছে। নিম্নে দুটি ছুরত বর্ণনা করবো ইনশাল্লাহ। ونسأل الله التوفيق وهو الموفق والمعين
প্রথম ছুরত:
ذهب الجمهور إلى أنه إذا كان الإمام خارج المسجد، فلا يقوم المصلون حتى يروا الإمام وإن لم يروا الإمام، فيقومون عند نهاية الإقامة.
অর্থাৎ জমহুর (অধিকাংশ) এর মতে, ইমাম যদি মসজিদের বাহিরে থাকে, তাহলে মুসল্লিরা ইমামকে না দেখা পর্যন্ত দাঁড়াবে না। ইমামকে দেখা না গেলে ইকামতের শেষে দাঁড়াবে। দলিল:
عَنْ عَبْدِ اللهِ بْنِ أَبِي قَتَادَةَ عَنْ أَبِيهِ قَالَ قَالَ رَسُولُ اللهِ صلى الله عليه وسلم : «إِذَا أُقِيمَتْ الصَّلاَةُ فَلاَ تَقُومُوا حَتَّى تَرَوْنِي.» (صحیح البخاري ۱؍۱۸۸)
অর্থ: হজরত আনাস (রা.) বলেন, রাসূল (ﷺ) বলেছেন, যখন নামাজের ইকামত দেওয়া হবে, তখন আমাকে দেখার আগ পর্যন্ত দাড়াবেনা। তাখরিজ: বুখারি-৬৩৭; মুসলিম-৬০৪
দ্বিতীয় ছুরত: وأما إذا كان الإمام حاضراً، ففي المسألة أقوال: অর্থাৎ ইমাম যদি উপস্থিত থাকে, এ বিষয়ে কয়েকটি মতামত রয়েছে। যেমন,
فقال الحنفية عند قوله: "حَيَّ عَلَى الْفَلَاحِ".
وقال المالكية: إنه ليس في ذلك حد محدود، وإنما على قدر طاقة الناس.
وقال الشافعية: يقومون بعد فراغ المؤذن من الإقامة.
وقال الحنابلة وزفر: يقومون عند قوله: "قد قامت الصلاة".
অর্থাৎ (০১) ইমাম আবু হানিফা (রহ.) এর মতে, হাইয়া আলাস সালাহ বলার সময়।
(০২) নামাযের কোন নির্দিষ্ট সময় নেই, বরং ইকামতের শুরুতে, চলাকালীন বা শেষে উঠা নামাযীর জন্য জায়েয। আর এ কথাই বলেছেন মালেকীগণ।
(০৩) মুয়াজ্জিন যদি ইকামাত শেষ করে ফেলে তাহলে এটা বৈধ এবং শাফেঈ (রহ.) এটাই বলেছেন।
(০৪) কদ কমাতিস সালাহ বলার সময় দাঁড়াবে, এটা ইমাম আহমদ ইবনে হাব্বলির (রহ.) মতে।
আরেক মত আছে, মুয়াজ্জিন যখন হাইয়া আলাস সালাহ বললে, তখন দাঁড়ানো মুস্তাহাব। দলিল:
আসার-০১
عن أنس بن مالك أنه : إذا قيل : «قد قامت الصلاة وثب فقام»
অর্থাৎ, হযরত আনাস (রা.) থেকে বর্ণিত, যখন 'ক্বাদক্বামাতিস সালাহ' বলা হত, তখন তিনি লাফদিয়ে দাঁড়িয়ে যেতেন। তাখরিজ: সুনানে বায়হাকি-২/২০
আসার-০২
1. عن عطية قال: كنا جلوسا عند ابن عمر فلما أخذ المؤذن في الإقامة قمنا، فقال ابن عمر: «اجلسوا فإذا قال: قد قامت الصلاة فقوموا عبدالرزاق (1/506).»
অর্থ: হযরত আতিয়্যা রহ. থেকে বর্ণিত। আমরা ইবনে উমর রা. এর কাছে বসা ছিলাম। যখন মুয়ায্যিন ইকামত শুরু করল আমরা দাঁড়িয়ে গেলাম। তখন ইবনে উমর রা. বললেনঃ তোমরা বস। মুয়ায্যিন যখন قد قامت الصلاة বলবে তখন দাঁড়াবে। মুসান্নাফে আব্দুর রাজ্জাক-১/৫০৬
প্রশ্ন: ক। হাইয়া আলাস সালাহ পূর্বে কি দাঁড়ানো যাবে না?
উত্তর: ক। হ্যাঁ, অবশ্যই দাঁড়ানো যাবে। দলিল:
হাদিস নং-০১
عَنْ أَبِي هُرَيْرَةَ قَالَ أُقِيمَتْ الصَّلاَةُ فَسَوَّى النَّاسُ صُفُوفَهُمْ فَخَرَجَ رَسُولُ اللهِ صلى الله عليه وسلم صلى الله عليه وسلم فَتَقَدَّمَ وَهُوَ جُنُبٌ ثُمَّ قَالَ عَلَى مَكَانِكُمْ فَرَجَعَ فَاغْتَسَلَ ثُمَّ خَرَجَ وَرَأْسُهُ يَقْطُرُ مَاءً فَصَلَّى بِهِمْ.
আবূ হুরাইরাহ্ (রাযি.) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, (একবার) সালাতের ইক্বামাত(ইকামত/একামত) দেয়া হয়ে গেছে, লোকেরা তাদের কাতার সোজা করে নিয়েছে, আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বেরিয়ে আসলেন । --- তাখরিজ: বুখারি-৬৪০; মুসলিম-৬০৫
হাদিস নং০২
بِأَنَّ بِلَالًا كَانَ يُرَاقِبُ خُرُوجَ النَّبِيِّ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ فَأول مايراه يَشْرَعُ فِي الْإِقَامَةِ قَبْلَ أَنْ يَرَاهُ غَالِبُ النَّاسِ ثُمَّ إِذَا رَأَوْهُ قَامُوا فَلَا يَقُومُ فِي مَقَامِهِ حَتَّى تَعْتَدِلَ صُفُوفُهُمْ
হযরত বেলাল রাঃ রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের বের হবার জন্য অপেক্ষা করতেন। তিনি অধিকাংশ লোকদের দেখার পূর্বে প্রথমে দেখেই ইকামত শুরু করে দিতেন। তারপর যখন সকলে নবীকে দেখতে পেতেন, তখন তারাও দাঁড়িয়ে যেতেন। নবীজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কাতার সোজা হবার আগে স্বীয় স্থানে দাঁড়াতেন না। সূত্র: ফাতহুল বারী, দারুল ফিকির বাইরূত-৩/১৪১, আশরাফিয়া দেওবন্দ-২/১৫৩, নং-৬৩৭, উমদাতুল কারী, বাইরূত-৫/১৫৩
হাদিস নং০৩
عَنْ أَبِي هُرَيْرَةَ: «أَنَّ الصَّلَاةَ كَانَتْ تُقَامُ لِرَسُولِ اللهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ، فَيَأْخُذُ النَّاسُ مَصَافَّهُمْ، قَبْلَ أَنَّ يَقُومَ النَّبِيُّ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ مَقَامَهُ»
আবূ হুরায়রা (রাঃ) থেকে বর্ণিত যে, তিনি বলেন, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর জন্য সালাতের ইকামাত বলা হতো। তিনি আপন জায়গায় দাঁড়াবার পূর্বেই লোকেরা নিজ নিজ কাতারে দাঁড়িয়ে যেত। তাখরিজ: মুসলিম-৬০৪
আসার-০৪
وَعَن سعيد بن الْمسيب وَعمر بن عبد الْعَزِيز: إِذا قَالَ الْمُؤَذّن: الله إكبر، وَجب الْقيام، وَإِذا قَالَ: حَيّ على الصَّلَاة، اعتدلت الصُّفُوف، وَإِذا قَالَ: لَا إِلَه إِلَّا الله، كبر الإِمَام. وَذَهَبت عَامَّة الْعلمَاء إِلَى أَنه: لَا يكبر حَتَّى يفرغ الْمُؤَذّن من الْإِقَامَة
হযরত সাঈদ বিন মুসাইয়্যিব এবং উমর বিন আব্দুল আজীজ রহঃ থেকে বর্ণিত। যখন মুয়াজ্জিন আল্লাহু আকবার বলে, তখন নামাযের জন্য দাঁড়িয়ে যাওয়া আবশ্যক। আর যখন ‘হাইয়্যা আলাস সালাহ’ বলে ততক্ষণে কাতার সোজা হয়ে যাবে। আর যখন বলবে ‘লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ’ তখন ইমাম সাহেব তাকবীরে তাহরীমা বলবে। জমহুর উলামাগণ বলেন যে, তাকবীরে তাহরীমা ততক্ষণ বলবে না, যতক্ষণ না মুয়াজ্জিন ইকামত শেষ করে। তাখরিজ: উমদাতুল কারী, বাইরূত-৫/১৫৩, যাকারিয়া-৪/২১৫, ফাতহুল বারী, দারুল ফিকির বাইরূত-৩/১৪১, আশরাফিয়া দেওবন্দ-২/১৫৩
প্রশ্ন: খ। হাইয়া আলাস সালাহ/ হাইয়া আলাল ফালাহ বলার সময় দাঁড়ানো উদ্দেশ্য কি?
উত্তর: খ। এর উদ্দেশ্য সম্পর্কে নির্ভরযোগ্য ফক্বীহ লিখেছেন, “যেসব বর্ণনায় ‘হাইয়্যা আলাল ফালাহ’ এর সময় দাড়ানো যে প্রমাণ রয়েছে এর দ্বারা উদ্দেশ্য হল, এটি হল শেষ সীমা। এর পর আর বসে থাকবে না। এর দ্বারা উদ্দেশ্য এটা নয় যে, এর আগে বসে থাকতেই হবে, দাড়ানো যাবে না। বরং উদ্দেশ্য হল, সীমা নির্দিষ্টকরণ। এরপর আর বসে থাকা যাবে না। দাঁড়িয়ে পড়তে হবে।
তাইতো ইলাউস সুনানে এ বিষয়ে সকল বক্তব্য উদ্ধৃত করার পর আল্লামা তাহতাবী রহঃ এর বক্তব্য নকল করা হয়েছে-
والظاهر احتراز عن التاخير لا التقديم، حتى لو قام اول الإقامة لا بأس به (اعلاء السنن، باب وقت قيام الإمام والمأمومين للصلاة-4/328، ادارة القرآن كرتاشى)
স্পষ্ট হল এই যে, এর চেয়ে [হাইয়া আলাল ফালাহ এর চেয়ে] দেরী করা যাবে না, কিন্তু আগে করা যাবে না এমন নয়। সুতরাং কেউ যদি ইকামতের শুরুতেই দাড়িয়ে পড়ে, তাহলে এতে কোন সমস্যা নেই। সূত্র: ইলাউস সুনান-৪ খণ্ড;৩২৮পৃ.
মূলকথা, হাইয়া আলাস সালাহ বলার পর যেনো কেউ বসে না থাকে, সকলেই যেনো তার আগেই দাড়িয়ে যায়। এখানে আগে দাড়ানোকে কোনো ভাবেই আগে দাড়াবেনা,বলা বুঝানো হয়নি। সূত্র: কিতাবুন নাওয়াজেল ৩/২০৮)
প্রশ্ন: গ। ইকামতের শুরুতে বসে যাওয়া আর হাইয়া আলাস সালাহ/ফালাহ বা কাদকমাতিস সালাহ সময় দাঁড়ানো ঠিক হবে কি?
উত্তর: গ। মুয়াজ্জিন যখন ইকামত শুরু করে, তখন ইমাম বা কোনো মুক্তাদীর দাঁড়ানো থেকে বসে যাওয়া অতপর হাইয়াআলাল সালাহ/ফালাহ বা কাদকমাতিস সালাহ বলার পর দাঁড়ানোর প্রচলনটি শরীয়তসম্মত নয়। কেননা পূর্বে বর্ণিত সহীহ মুসলিমের হাদীস থেকে এ কথা সুস্পষ্ট যে, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে মসজিদে আসতে দেখলেই ইকামত শুরু হয়ে যেত এবং সাহাবায়ে কেরাম শুরুতেই দাঁড়িয়ে কাতার সোজা করতেন আর রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সোজা ইমামের জায়গায় পৌঁছে যেতেন। এমন ক্ষেত্রে মসজিদে প্রবেশ করে নবীজীর বা কোনো সাহাবীর বসে যাওয়া অতপর হাইয়াআলাস সালাহ বলার সময় দাঁড়ানোর কোনো বর্ণনা পাওয়া যায় না।
এ বিষয়ে বিখ্যাত আলেম শায়েখ ইবনে উসাইমিনকে জিজ্ঞেস করা হলে, যেমন-
وسئل الشيخ محمد بن عثيمين رحمه الله : هل ورد في السنة وقت محدد للقيام للصلاة عند الإقامة؟
فأجاب :
"لم ترد السنة محددة لموضع القيام؛ إلا أن النبي صلى الله عليه وسلم قال: (لا تقوموا حتى تروني) فمتى قام الإنسان في أول الإقامة، أو في أثنائها، أو عند انتهائها فكل ذلك جائز" انتهى.
"مجموع فتاوى ابن عثيمين" (13/8) .
শেখ মুহাম্মাদ বিন উসাইমিন, আল্লাহ তার উপর রহম করুন, তাকে জিজ্ঞাসা করা হয়েছিল: ইকামাতের সময় নামাজের জন্য দাঁড়ানোর জন্য বছরে একটি নির্দিষ্ট সময় আছে কি?
এবং তিনি উত্তর দিলেন:
সুন্নাতে দাঁড়ানোর স্থান নির্দিষ্ট করা হয়নি, কেবলমাত্র নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন: (আমাকে না দেখা পর্যন্ত উঠো না), সুতরাং যখন ব্যক্তি ইকামতের শুরুতে উঠবে, অথবা এটি চলাকালীন বা এর শেষে, সবই জায়েয। সূত্র: মাজমু’ ফাতাওয়া ইবনে উসাইমীন-১৩/৮
প্রশ্ন: ঘ। প্রধান্য মত কি?
উত্তর: ঘ। ইমাম নামাযের জন্য প্রস্ত্তত হওয়ার পরই ইকামত শুরু করা উচিত। ইমামের প্রস্ত্তত হওয়ার আগে ইকামত শুরু করা ঠিক নয়। তদ্রূপ মুসল্লিদের জন্যও আগে থেকে দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করতে থাকা ঠিক নয়; বরং মুসল্লিগণ ইকামত আরম্ভ হওয়ার সময় দাঁড়িয়ে যাবে। যাতে ইকামতের শেষ পর্যন্ত কাতার সোজা হয়ে যায় এবং ইকামত শেষ হওয়ার পর ইমাম সাহেব নামায শুরু করতে পারেন।
একথাতো পরিস্কার যে, ‘হাইয়া আলাল ফালাহ’ বলার সময় মুসল্লিগণ দাঁড়ালে ইকামত শেষ হতে হতে মুসল্লিদের কাতার ভাল করে সোজা হবে না। এক্ষেত্রে হয়তো কাতার সোজা করা ছাড়াই নামায শুরু হবে, কিংবা কাতার সোজা করার জন্য দেরী করতে হবে, যা ইকামত ও নামায শুরু করার মাঝে দেরী করিয়ে ফেলবে। যা প্রমাণিত সত্য কথা।
শেষকথা হলো, ইকামতের শুরুতে, না মাঝে, না শেষে দাঁড়াবে এটা মুস্তাহাব একটি বিষয়। এ নিয়ে বাড়াবাড়ি করা উচিত নয়। একে অপরকে অভিযোগ উত্থাপন ও ভর্ৎসনা করা বিদআত হবে। কারণ গায়রে জরুরী বিষয়কে জরুরী মনে করা বিদআত। তবে ইমাম নামাজ শুরু করার আগেই যেন কাতার সোজা হয় সে বিষয়ে সজাগ দৃষ্টি রাখতে হবে।
والله اعلم بالصواب