জিজ্ঞাসা-১২৮০৪:
আসসালামু আলাইকুম ওয়া রহমাতুল্লাহ। আফলাহ নামের অর্থ কী?আফলাহ বিনতে আব্দুল্লাহ নাম রাখা যাবে কি জানাবেন প্লিজ?
তারিখ: ১৪/১০/২৩ ঈসায়ি/ইংরেজি
মাওলানা রুকনুজ্জামান, রংপুর থেকে।
জবাব:
وعليكم السلام ورحمة الله وبركاته حمده ونصل على رسوله الكريم اما بعد بسم الله الرحمن الرحيم
তাসলিম ও হামদ-সানার পর প্রথম কথা হলো,
আপনার জিজ্ঞাসিত নামের দ্বিতীয়াংশ (বিনতে) থেকে প্রতীয়মান হচ্ছে যে, আপনি আলোচ্য নামটি কন্যা সন্তানের জন্য রাখতে চাচ্ছেন। সেই অনুসারে চয়নকৃত নামটির ব্যবচ্ছেদ ঘটানো হলো।
আপনার পছন্দসই নামটি হলো, "আফলাহ"। উৎপত্তিগত দিক বিবেচনা করে শব্দটির দুইটি অর্থ হতে পারে-
প্রথমত,
আফলাহ (أَفْلَح) একটি আরবী শব্দ। যার মূল বর্ণ হলো, ف-ل-ح (ফা, লাম, হা)। এটি فَلاَح মাসদার বা ক্রিয়ামূল হতে নিষ্পন্ন اِسْمُ التَّفْضِيْل ( তুলনাজ্ঞাপক বিশেষণ) এর সীগায়ে সিফাত। ইসমে মাছদারটির অর্থ হলো- সফলতা, উন্নয়ন, আকাঙ্ক্ষার প্রতিফলন, স্বপ্ন বাস্তবায়ন ইত্যাদি।
পবিত্র কুরআনে শব্দটি ক্রিয়া হিসেবে ব্যবহৃত হয়েছে। আল্লাহ তায়ালা বলেন,
{ قَدۡ أَفۡلَحَ مَن زَكَّىٰهَا }
অর্থাৎ, যে আআত্মশুদ্ধিতে মগ্ন হলো, সে তো নিশ্চিতভাবেই সফলকাম হয়ে গেলো। ( সূরা আশ শামস - ৯)
সহীহ বুখারীর একটি দীর্ঘ হাদীসের শেষাংশে বর্ণিত হয়েছে- মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন,
أفْلَحَ إنْ صَدَقَ
অর্থাৎ, উল্লিখিত ব্যক্তিটি যদি নিজ কথায় সত্যবাদী হয়ে থাকে, তাহলে সে পরিপূর্ণ সফলতা অর্জন করবে। ( সহীহ বুখারী - ১৮৯১)
এটি যখন ইসমে তাফদীল বা Superlative Degree তে ব্যবহৃত হবে, তখন তার অর্থ হবে, সফলতম ব্যক্তিত্ব, সবচাইতে সার্থক পুরুষ,
তবে এটি যেহেতু ইসমে তাফদীলের পুরুষ বাচক বিশেষণ, স্ত্রীবাচক নয়। তাই শুধুমাত্র পুরুষদের জন্যই এই নামটি অধিকতর উপযোগী। তবে ক্ষেত্রবিশেষে কখনো কখনো নারীদের ক্ষেত্রেও এই ছীগাহ প্রয়োগ করা হয়ে থাকে। সেইক্ষেত্রে বিশেষ বিবেচনায় মেয়েদেরকেও এই নামে নামকরণ করা যেতে পারে।
দ্বিতীয়ত,
আফলাহ ( أَفْلَةْ) শব্দটির كيفية النطق বা উচ্চারণ প্রক্রিয়া হলো, "আফলাহ"। উল্লেখ্য , শব্দটির শেষে "তা" বর্ণ থাকলেও এক্ষেত্রে "হা" উচ্চারন হবে। কারণ গোলাকার "তা" এর ক্ষেত্রে علم القراءة এর একটি মূলনীতি হলো,
التاء المربوطة تنقلب هاءً عند الوقف،
অর্থাৎ, "গোলাকার তা" বর্ণটি ওয়াকফ অবস্থায় উচ্চারণগতভাবে "হা" বর্ণতে পরিণত হয়ে যায়।
এবার আসা যাক যাক, শব্দটির অর্থ বিশ্লেষণ অংশে-
শব্দটি বাবে নাসারা'র একটি মাছদার বা ক্রিয়ামূল। মূল বর্ণ তিনটি হলো ء-ف-ل (হামযা,ফা,লাম)। এর জিনস হলো, مهموز الفاء। শেষে "গোলাকার তা" যুক্ত হয়ে এটি সংখ্যাবাচক কিংবা অতিশয়তাজ্ঞাপক মাছদারের পরিণত হয়েছে।
শব্দটির অর্থ হলো- চোখের আড়াল হওয়া, অদৃশ্য হয়ে যাওয়া, অস্তমিত হওয়া ইত্যাদি।
আল কুরআনের বর্ণনামতে, স্রষ্টার সন্ধানপিয়াসী ইবরাহীম (আ.) প্রাথমিক অবস্থায় পর্যায়ক্রমে তারকা, চন্দ্র,সূর্যকে নিজের প্রতিপালক হিসেবে ভেবে বসেছিলেন। কিন্তু দিবসের ধারাবাহিক পটপরিবর্তনে যখন এসকল নক্ষত্ররাজি ক্রমেক্রমে অস্তমিত হয়ে পড়লো, তখন তিনি বুঝতে পারলেন, এগুলো প্রকৃত রব হতে পারেনা। কারণ যিনি পালনকর্তা, তিনি সর্বময় ক্ষমতার অধিকারী। কালের আবর্তনে তিনি কখনোই বিলীন হতে পারেননা। সৃষ্টিকর্তা হলেন- অমর, অজয়, অব্যয়, অক্ষয় এক মহাবিস্ময়।
ইবরাহীম (আ.) যখন দেখলেন-
فَلَمَّاۤ أَفَلَ قَالَ لَاۤ أُحِبُّ ٱلۡـَٔافِلِینَ }
অর্থাৎ, যখন তারকা দৃষ্টির অন্তরাল হয়ে গেলো, তখন তিনি বললেন, "যারা অস্তমিত হয়ে যায়, (রব হিসেবে) আমি তাদেরকে পছন্দ করিনা। ( সূরা আল আনআম -৭৬)
সুতরাং এই বিবেচনায় أفْلَةْ (আফলাহ) শব্দের অর্থ হবে- অদৃশ্য, অস্তায়মান, ইন্দ্রিয়বহির্ভুত ইত্যাদি।
আপনি শিশুটির নামের দ্বিতীয়াংশে পিতৃনাম যোগ করে দেয়ার ইচ্ছা পোষণ করেছেন। এটি অতিউত্তম ও প্রশংসনীয় কর্ম বটে। পুরুষ সাহাবীগণের পাশাপাশি মহিলা সাহাবীয়াগণও নিজেদের পিতৃনামে পরিচিতি লাভ করতে পছন্দ করতেন। তাদের মাঝে উল্লেখযোগ্য হলেন- হযরত আয়িশা বিনতে আবূ বকর (রাযি), আসমা বিনতে ইয়াযিদ (রাযি.), হাফসা বিনতে ওমর (রাযি.), যয়নব বিনতে জাহশ (রাযি.),
প্রকাশ থাকে যে, আখিরাতের দিন প্রত্যেক ব্যক্তিকে নিজ নামের সাথে পিতৃনাম যোগ করে ডাকা হবে। সহীহ হাদীসের ভাষ্য একথারই প্রমাণ বহন করে। মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন,
إنَّكم تُدعَونَ يومَ القيامةِ بأسمائِكُم وأسماءِ آبائِكِم فأحسِنوا أسماءَكم
অর্থাৎ, কিয়ামতের দিন তোমাদেরকে নিজ নাম ও পিতার নাম ধরে ধরে ডাকা হবে। সুতরাং তোমরা সুন্দর সুন্দর নাম রাখো।( আবূ দাঊদ - ৪৯৪৮ )
সুতরাং নবজাতক সন্তানের নামের শেষাংশে পিতৃনামের সংযোজন করা হলো, রাসূলের সুন্নাহর বাস্তবিক অনুসরণের এক উজ্জ্বল প্রতীক। কারণ নবীজি স্বয়ং নিজের পরিচয় দিতেন "মুহাম্মাদ ইবনে আব্দুল্লাহ" বলে।
সারকথা হলো,
আপনার পছন্দসই নামটি একটি আরবী শব্দ। তবে আরবী শব্দস্থ বর্ণের পার্থক্যের কারণে তার অর্থের মাঝেও পার্থক্য সূচিত হয়েছে। কিন্তু বাংলা বানানে এর কোন পার্থক্য নেই।
(১) শব্দটির আরবী বানান (أفْلَحْ) "আফলাহ" হলে তার অর্থ হবে, সফলতম ব্যক্তিত্ব, সবচাইতে সার্থক মানব, স্বপ্নছোঁয়া মানুষ।
এই ব্যাখ্যাটিই সবচাইতে বেশী অর্থবহ ও সর্বাধিক তাৎপর্য সমৃদ্ধ নাম।
( ২) শব্দটির আরবী বানান (أفْلَةْ) "আফলাহ" হলে তার অর্থ হবে, invisible, অদৃশ্য, অপ্রত্যক্ষ, অস্তমিত, দৃষ্টিগোচর বহির্ভূত।
উল্লেখ্য, تَفاَؤُل বা Optimism বিবেচনায় প্রথম ব্যাখ্যাটিই অধিকতর অর্থবহ ও অত্যাধিক তাৎপর্যসমৃদ্ধ মর্ম বহন করে। সেই মোতাবেক নবজাতক শিশুটির নামের অর্থ হবে, "আল্লাহর বান্দার কন্যা (যে একজন) সফলতম ব্যক্তিত্ব।"
والله اعلم بالصواب