জিজ্ঞাসা-১২৮২১:
আসসালামু আলাইকুম ওয়া রহমাতুল্লাহ।
স্ব-স্বীকৃত সুদ ভিত্তিক ব্যাংকগুলোর ডিপিএস সহ বিভিন্ন ধরণের একাউন্টের প্রদত্ত সুদসমূহকে বিলকুল জায়েজ বলে সৈনিকদেরকে প্রকাশ্যে ফাতওয়া দিতেন আমাদের একজন আলেম। সুদী ব্যাংকের সুদ কুরআনে বর্ণিত ربوا নয় বলে তিনি উদ্ভট নানা কুযুক্তি দিয়ে সুদের বৈধতা দেন। আমরা অন্যান্য আরটি তাকে খন্ডন করলেও তিনি অটল সুদের বৈধতার পক্ষে।
তারিখ: ৩০/১০/২৩ ঈসায়ি/ইংরেজি
মাওলানা নুরুল আমিন, নীলফামারী থেকে।
জবাব:
وعليكم السلام ورحمة الله وبركاته حمده ونصل على رسوله الكريم اما بعد بسم الله الرحمن الرحيم
তাসলিম ও হামদ-সানার পর প্রথম কথা হলো,
সূদের অবৈধতা:
আল্লাহ তাআলা সুদকে সর্বতোভাবে কঠোররূপে হারাম গণ্য করেছেন এবং সুদখোরদের বিরুদ্ধে তিনি ও তাঁর রসূলের তরফ থেকে যুদ্ধ ঘোষণা করে মানবজাতিকে ভীতিপ্রদর্শন করেছেন।
তিনি বলেন:
يَا أَيُّهَا الَّذِينَ آمَنُوا اتَّقُوا اللهَ وَذَرُوا مَا بَقِيَ مِنَ الرِّبا إِنْ كُنْتُمْ مُؤْمِنِينَ (278) فَإِنْ لَمْ تَفْعَلُوا فَأْذَنُوا بِحَرْبٍ مِنَ اللهِ وَرَسُولِهِ وَإِنْ تُبْتُمْ فَلَكُمْ رُؤُوسُ أَمْوَالِكُمْ لا تَظْلِمُونَ وَلا تُظْلَمُونَ
অর্থাৎ, হে ঈমানদারগণ! তোমরা আল্লাহকে ভয় কর এবং (লোকদের নিকট) তোমাদের সুদের যা বকেয়া আছে, তা ছেড়ে দাও যদি তোমরা ঈমানদার হও। আর যদি তোমরা এরূপ না কর (সুদ না ছাড়) তবে আল্লাহ ও তাঁর রসূলের তরফ থেকে যুদ্ধ ঘোষণা কবুল করে নাও। কিন্তু যদি তোমরা তওবা কর, তবে তোমাদের মূলধন তোমাদেরই। তোমরা কারো উপর অত্যাচার করবে না এবং নিজেরাও অত্যাচারিত হবে না।
(সূরা বাক্বারাহ ২৭৮-২৭৯ আয়াত)
আবু হুরাইরা রাযিয়াল্লাহু আনহু হতে বর্ণিত; নবী করীম (ﷺ) বলেছেন,
الربا سبعون جزءا أيسرها أن ينكح الرجل أمه
‘‘সুদের বড় বড় ৭০ টা গুনাহ রয়েছে। তার মধ্যে সবচেয়ে ছোট ধরণের গুনাহ হল মায়ের সঙ্গে ব্যভিচার করা! (নাউযুবিল্লাহ)
(সুনানে ইবনে মাজাহ, হা. ২২৭৪, হাকেম ২/৩৭, মিশকাত ২৪৬ পৃঃ)
ফেরেশতার হাতে গোসল লাভকারী সাহাবী হযরত হানযালা রা. এর পুত্র হযরত আব্দুল্লাহ হতে বর্ণিত, নবী (ﷺ) বলেছেন,
درهم ربا يأكله الرجل وهو يعلم أشد عند الله من ستة وثلاثين زنية
অর্থাৎ জেনে শুনে এক দিরহাম পরিমাণ সুদ খাওয়ার গোনাহ আল্লাহর নিকট ৩৬ বার ব্যভিচার করার চেয়েও জঘন্য।
(মুসনাদে আহমদ ৫/২২৫, দারাকুত্বনী, হা. ২৯৫ , সিলসিলাহ সহীহাহ, হা. ১০৩৩, মিশকাত ২৪৬ পৃঃ)
"সুদখোরের নিন্দা বর্ণনা করতে গিয়ে আল্লাহ তাআলা বলেন:
الَّذِينَ يَأْكُلُونَ الرِّبا لا يَقُومُونَ إِلَّا كَمَا يَقُومُ الَّذِي يَتَخَبَّطُهُ الشَّيْطَانُ مِنَ الْمَسِّ ذَلِكَ بِأَنَّهُمْ قَالُوا إِنَّمَا الْبَيْعُ مِثْلُ الرِّبا وَأَحَلَّ اللَّهُ الْبَيْعَ وَحَرَّمَ الرِّبَا
অর্থাৎ, যারা সুদ খায় তারা কিয়ামতের দিন এমন ভাবে উত্থিত হবে যেমনভাবে শয়তান আসর করে মহোবিষ্ট করে ফেলা লোক উত্থিত হয়। তার কারণ এই যে, তারা বলে, ব্যবসা তো সুদের মতই! অথচ আল্লাহ ব্যবসাকে হালাল করেছেন এবং সুদকে করেছেন হারাম। (সূরা বাক্বারাহ ২৭৫ আয়াত)
হযরত জাবের রাযিয়াল্লাহু আনহু হতে বর্ণিত,
لَعَنَ رَسُولُ اللهِ ﷺ آكل الربا وموكله وكاتبه وشاهديه، وقال : هم سواء.
অর্থাৎ, আল্লাহর রসূল (ﷺ) সুদখোর, সুদদাতা, সুদের লেখক এবং সুদী লেন-দেনের সাক্ষীদ্বয়েরর উপর লা'নত করেছেন, আর বলেছেন, ‘‘তারা সকলেই সমান।’’ (মুসলিম, হা. ১৫৯৭, মিশকাত ২৪৪ পৃঃ)
তিনি আরো বলেন,
كُلُّ لَحْمٍ نَبَتَ مِنْ سُحْتٍ فَالنَّارُ أَوْلَى بِهِ
"হারাম দ্বারা সৃষ্ট শরীরের গোস্তের জন্য জাহান্নামই শ্রেয়।" (তাবরানী: মু'জামুল আউসাত, হা. ৪৪৮০)
সূদ’ এর সংজ্ঞা:
কুরআন ও হাদীসের পরিভাষায় সুদকে (ربا) ‘রিবা’ বলা হয়। এই শব্দের মূল ধাতু হল (ر ب و ) যার আভিধানিক অর্থ হল, বাড়া, বৃদ্ধি, আধিক্য, স্ফীতি প্রভৃতি। رَبَا অর্থাৎ বেড়েছে বা বৃদ্ধি পেয়েছে। ربا السويق অর্থাৎ ছাতু ঘোলার পর ফেঁপে উঠেছে। ربا في حجره অর্থাৎ সে তার কোলে প্রতিপালিত (বড়) হয়েছে। أربى الشيء সে জিনিসটাকে বাড়িয়েছে ইত্যাদি অর্থ অভিধানে উল্লেখ করা হয়েছে।
কুরআন মাজীদেও উক্ত শব্দ ‘বৃদ্ধি’র অর্থে ব্যবহিত হয়েছে। যেমন আল্লাহ তাআলা বলেন:
يَمْحَقُ اللهُ الرِّبا وَيُرْبِي الصَّدَقَاتِ
অর্থাৎ, আল্লাহ সুদকে নিশ্চিহ্ন করেন এবং সদকাহকে বৃদ্ধি করে দেন। (সূরা বাক্বারাহ ২৭৬ আয়াত)
শরীয়তের পরিভাষায় সুদের সংজ্ঞা:
১.
هو زيادة أحد البدلين المتجانسين من غير أن يقابل هذه الزيادة عوض.
অর্থাৎ, একই শ্রেণীভুক্ত দুটি জিনিসের পরস্পর আদান-প্রদান করার সময় একজনের অপরজনের নিকট এমন বেশী নেওয়া যাতে এ বেশী অংশের বিনিময়ে কোন জিনিস থাকে না। (আল বুনূকুল ইসলামিয়্যাহ বাইনান নাযারিয়্যাতি অত্তাত্ববীক্ব ৪৪ পৃঃ)
২.
ফতোয়া আলামগীরীতে সুদের নিম্নরূপ সংজ্ঞা করা হয়েছে;
الربا عبارة عن فضل مال لا يقابله عوض في معاوضة ما بمال.
অর্থাৎ, এক মালের বদলে অন্য মালের আদান-প্রদানকালে সেই অতিরিক্ত মালকে সূদ বলা হয়; যার কোন বিনিময় থাকে না। (ফতোয়ায়ে আলমগীরী ৩/১২৭)
৩.
হেদায়া গ্রন্থে সুদের সংজ্ঞা এইভাবে করা হয়েছে;
الربا هو الفضل المستحق لأحد المتعاقدين في المعاوضة الخالي من عوض شرط فيه
অর্থাৎ, লেন-দেন করার সময় সেই অতিরিক্ত মালকে সুদ বলা হয়; যা কোন একপক্ষ শর্ত অনুসারে কোন বিনিময় ছাড়াই লাভ করে থাকে। (হেদায়া, ৩/১৮০)
এই সব সংজ্ঞা থেকে বুঝা গেল যে, মূল থেকে যে পরিমাণ অংশ বেশী নেওয়া বা দেওয়া হবে সেটাকেই সুদ বলা হবে। সুতরাং সুদের সংজ্ঞা হল এইরূপ-
‘‘ঋণে দেওয়া মূল অর্থের চেয়ে সময়ের বিনিময়ে যে অতিরিক্ত অর্থ শর্ত ও নির্দিষ্টরূপে নেওয়া হয় তার নাম হল সুদ।’’
১. মূল অর্থ থেকে কিছু বৃদ্ধি,
২. সময়ের দৈর্ঘ্য অনুসারে বৃদ্ধির পরিমাণ নির্ধারণ,
৩. এবং এই লেন-দেনে বৃদ্ধি শর্ত হওয়া- এই তিন উপাদানে গঠিত বস্ত্তর নাম সুদ হবে। আর প্রত্যেক সেই ঋণের আদান-প্রদান যার মধ্যে উক্ত তিন প্রকার উপাদান পাওয়া যাবে তাকে সুদী আদান-প্রদান বা কারবার বলা হবে। এখানে দেখার বিষয় এ নয় যে, সে ঋণ ব্যবসার জন্য নেওয়া হয়েছে নাকি ব্যক্তিগত প্রয়োজন বা অভাব পূরণ করার উদ্দেশ্যে নেওয়া হয়েছে, এবং সেই ঋণ-গ্রহীতা ব্যক্তি গরীব নাকি ধনী, কোম্পানী নাকি সরকার। সে যাই হোক না কেন অনুরূপ ঋণের কারবার সুদের কারবার।
কারণ জাহিলিয়াতের যুগে এই ধরণের সুদই প্রচলিত ছিলো এবং এই ধরনের সুদেরই অবৈধতার উপর কুরআনের আয়াত অবতীর্ণ হয়েছে এবং এ ব্যাপারে নবী (ﷺ) এর কঠোর নিষেধাজ্ঞা রয়েছে ।
যেমন,
১. হযরত কাতাদাহ রাহিমাহুল্লাহ বলেন, ‘জাহেলিয়াত যুগের সুদ ছিল এই যে, এক ব্যক্তি অপর ব্যক্তিকে কোন মাল বিক্রয় করত এবং দাম মিটাবার জন্য একটি সময় নির্ধারিত করত। এবারে সেই নির্দিষ্ট সময় ও মেয়াদ পূরণ হওয়ার পর যদি ক্রেতার নিকট দাম মিটাবার মত অর্থ না হত, তাহলে বিক্রেতা তার (ক্রেতার) উপর অতিরিক্ত অর্থ চাপিয়ে দিত এবং (দাম মিটাবার) সময় আরো বাড়িয়ে দিত।
(তাফসীর ইবনে জারীর ৩/৬২)
২. হযরত মুজাহিদ রাহিমাহুল্লাহ বলেন, ‘জাহেলিয়াতের সুদ এই ছিল যে, এক ব্যক্তি কারো নিকট ঋণ করত এবং বলত, যদি তুমি আমাকে ঋণ পরিশোধে এতটা সময় দাও, তাহলে আমি তোমাকে এত এত বেশী দেব।’
(তাফসীরে ইবনে জারীর ৩/৬২)
৩. হযরত আবু বকর জাসসাস (রাহিমাহুল্লাহ) বলেন, 'জাহেলিয়াত যুগের প্রচলিত সুদ ছিল এই যে, ‘তারা একে অন্যের নিকট ঋণ গ্রহণ করত এবং আপোসে এই চুক্তি করে নিত যে, এত সময় (ঋণ রাখলে) আসল ছাড়া আরো এত টাকা বাড়তি আদায় করতে হবে।’ (আহকামুল কুরআন, ১/৮৯)
৪. ইমাম ফখরুদ্দীন রাযী রহ. এর মতে, 'জাহেলিয়াত যুগের লোকেদের মধ্যে এই রীতি ছিল যে, ‘এক ব্যক্তি কোন ব্যক্তিকে নির্দিষ্ট সময়ের জন্য টাকা ধার দিত, অতঃপর সে তার (ঋণগ্রহীতার) নিকট থেকে মাসিক হারে সুদ হিসাবে নির্দিষ্ট অঙ্কের টাকা উসুল করত। এর পর যখন ঋণ পরিশোধের নির্দিষ্ট সময়কাল শেষ হয়ে যেত, তখন ঋণগ্রহীতার নিকট থেকে আসল টাকা চাওয়া হত। সে সময় পরিশোধ করতে না পারলে তাকে পুনরায় অতিরিক্ত সময় অবকাশ দেওয়া হত এবং সেই সঙ্গে সুদের পরিমাণও দেওয়া হত বাড়িয়ে। (তফসীরে কাবীর ২/৩৫১)
উপরে উল্লিখিত সুদের সংজ্ঞা এবং জাহেলিয়াত যুগের প্রচলিত সুদী কারবার নিয়ে যদি একটু চিন্তা-ভাবনা করেন, তাহলে বুঝতে পারবেন যে, বর্তমান যুগে সুদী ব্যাংকগুলোতে যে সুদী কারবার চলছে, তা হুবহু জাহেলিয়াত যুগে প্রচলিত সুদী কারবার সমূহের অনুরূপ; যার অবৈধতার ব্যাপারে কুরআনের উল্লিখিত আয়াত নাজিল হয়েছে এবং যার অবৈধতার ব্যাপারে সারা মুসলিম উম্মাহ একমত। (ডক্টর ইউসূফ কারযবীর ফাওয়াইদুল বুনূক ৩০-৩১ পৃঃ)
জাহেলিয়াত যুগের প্রচলিত সুদকে পবিত্র কুরআন মাজীদে হারাম ঘোষণা করা হয়েছে। কিন্তু তারা উক্ত সুদকে ব্যবসার মত বৈধ ও জায়েয মনে করত; যেমন বর্তমান নব্য জাহেলিয়াত যুগের জাহেলরাও মনে করছে। নাউযুবিল্লাহ।
আল্লাহ তাআলা জাহেলিয়াত যুগের লোকদের ধারণাকে খন্ডন করে বলেন:
ذَلِكَ بِأَنَّهُمْ قَالُوا إِنَّمَا الْبَيْعُ مِثْلُ الرِّبا وَأَحَلَّ اللهُ الْبَيْعَ وَحَرَّمَ الرِّبا
অর্থাৎ তা এই জন্য যে, তারা বলে ব্যবসা তো সুদের মতই। অথচ আল্লাহ ব্যবসাকে হালাল করেছেন এবং সুদকে করেছেন হারাম। (সূরা বাক্বারাহ ২৭৫ আয়াত)
ব্যবসা এবং সুদের মধ্যে পার্থক্য:
বর্তমান সময়ে বহুল প্রচলিত সুদ ও ব্যবসার মধ্যে মৌলিক পার্থক্য হলো-
'সুদ হলো সরাসরি টাকার বিনিময়ে টাকা নেওয়া এবং প্রদত্ত টাকার চেয়ে বেশি নেওয়া শর্ত করে। আর ব্যবসা হলো টাকার বিনিময়ে পন্য নেওয়া, সরাসরি টাকা নেওয়া নয়।'
আল্লাহ তায়ালা আমাদেরকে সঠিক বুঝ দান করুক এবং সর্বপ্রকার সুদ থেকে বেচে থাকার তৌফিক দান করুক।
সারকথা হলো, পবিত্র কুরআন ও সুন্নাহ মূলনীতি বর্ণনা করেছেন, এর আলোকে কিয়ামত পর্যন্ত সকল সদস্য সমাধান হবে। সুতরাং বর্তমান সুদি ব্যাংক হালাল বলার সুযোগ নেই।
والله اعلم بالصواب
মুফতী আব্দুল হাই নাটোরী
সাবেক প্রধান মুফতী, জামিয়া ছিদ্দীকিয়া ঈশ্বরদী পাবনা।