আল-বুরহান ( দলিল-প্রমাণ)

আসসালামু আলাইকুম ওয়া রহমাতুল্লাহ! আমাদের ওয়েবসাইটে আপনাকে স্বাগতম। একটু নিচে দেখুন> বিষয় ভিক্তিক সাজানো রয়েছে, আপনার পছন্দ অনুযায়ী পাঠ করুন এবং পোষ্টগুলো ভালো লাগলে শেয়ার করুন আর আপনার কোন প্রশ্ন থাকলে এই নাম্বারে- ০১৬৮৭-১১৩৮৮০ হোয়াটস অ্যাপে পাঠিয়ে দিন । জাযাকাল্লাহু খাইর।

জিজ্ঞাসা-২৩৪: ইসলামে কৃতজ্ঞতা প্রকাশের নির্দেশনা ও এর ভাষা/পদ্ধতি কি?

No Comments

 












জিজ্ঞাসা-২৩৪:

 আসসালামু আলাইকুম। ইসলামে কৃতজ্ঞতা প্রকাশের নির্দেশনা ও এর ভাষা/পদ্ধতি কি হওয়া উচিত? অনেকে শুকরান,শুকরিয়া ধন্যবাদ, Thank ইত্যাদি শব্দের মাধ্যমে কৃতজ্ঞতা আদায় করে, কেহ কেহ আবার শুধু জাযাকাল্লাহ বলে। আমার প্রশ্ন হলো এ শব্দগুলো দ্বারা পূর্ণ কৃতজ্ঞতা আদায় হবে,? দলিলসহ জানালে উপকৃত হতাম। তারিখ-২৩/০৭/২২ ঈসায়ি/ইংরেজি


মাওলানা ইব্রাহীম খোলাহাটি দিনাজপুর থেকে----


জবাব: ওয়ালাইকুমুস সালাম ওয়া রহমাতুল্লাহ ও বারাকাতুহ। শুরুতে আপনাকে জাযাকাল্লাহ খয়র। কেননা আপনি একটি গুরুত্বপূর্ণ সওয়াল করেছেন। আমরা প্রতিটি মুহূর্তে আল্লাহর নেয়ামতরাজি ভোগ করছি ও প্রতিনিয়িত কোনো না কোনো মানুষের দ্বারা উপকৃত/সাহায্যপ্রাপ্ত হচ্ছি। যাই হোক উভয় ক্ষেত্রে আমাদের কৃতজ্ঞতা আদায় করার ইসলামে নির্দেশ দিয়েছে। আর এটা ইসলামের সুমহান শিক্ষা। আপনার প্রশ্নকে সহজভাবে বুঝার জন্য কয়েকভাবে ভাগ করছি।

 ونسأل الله التوفيق وهو الموفق والمعين


প্রশ্ন: ক। ইসলামে কৃতজ্ঞতা প্রকাশের নির্দেশনা কি?

উত্তর: ক। এ সম্পর্কে ইসলামে নির্দেশনা রয়েছে। যেমন,


পবিত্র কুরআনের বাণী -

لَئِنْ شَكَرْتُمْ لَأَزِيْدَنَّكُمْ وَلَئِنْ كَفَرْتُمْ إِنَّ عَذابِيْ لَشَدِيْدٌ.

তোমরা যদি কৃতজ্ঞতা আদায় কর তাহলে আমি অবশ্যই তোমাদেরকে আরও বাড়িয়ে দেব, আর যদি তোমরা অস্বীকার কর তাহলে আমার আজাব অবশ্যই কঠিন। -সূরা ইবরাহীম- ৭ 


وَأَمَّا بِنِعْمَةِ رَبِّكَ فَحَدِّثْ

আর তুমি তোমার প্রভুর নিআমতের কথা বলো। -সূরা দুহা -১১


وَوَصَّيْنَا الْإِنسَانَ بِوَالِدَيْهِ حَمَلَتْهُ أُمُّهُ وَهْنًا عَلَىٰ وَهْنٍ وَفِصَالُهُ فِي عَامَيْنِ أَنِ اشْكُرْ لِي وَلِوَالِدَيْكَ إِلَيَّ الْمَصِيرُ

আর আমি মানুষকে তার পিতা-মাতার সাথে সদ্ব্যবহারের জোর নির্দেশ দিয়েছি। তার মাতা তাকে কষ্টের পর কষ্ট করে গর্ভে ধারণ করেছে। তার দুধ ছাড়ানো দু বছরে হয়। নির্দেশ দিয়েছি যে, আমার প্রতি ও তোমার পিতা-মতার প্রতি কৃতজ্ঞ হও। অবশেষে আমারই নিকট ফিরে আসতে হবে। সূরা লুকমান-১৪


পবিত্র দ্বিতীয় স্তর হলো, মৌখিকভাবে আদায় করা। যেমন-


وَأَمَّا بِنِعْمَةِ رَبِّكَ فَحَدِّثْ

আর তুমি তোমার প্রভুর নিআমতের কথা বলো। -সূরা দুহা -১১


আর মৌখিকভাবে কৃতজ্ঞতা বা শুকরিয়া জানানোর সর্বোত্তম পদ্ধতি হলো প্রতিটি ক্ষেত্রে রসূল (ﷺ) এর শিখানো মাসনুন দুআগুলো পাঠ করা। যেমন-


Ø ঘুম থেকে উঠে দুআ-

اَلْحَمْدُ لِلّهِ الَّذِيْ أَحْيَانَا بَعْدَ مَا أَمَاتَنَا، وَإِلَيْهِ النُّشُوْرُ.

অর্থাৎ সকল প্রশংসা সেই মহান আল্লাহর, যিনি আমাদেরকে মৃত্যু দেয়ার পর আবার জীবন দান করলেন আর তাঁর কাছেই তো আমাদের একত্রিত করা হবে। -সহীহ বুখারী, হাদীস ৩১১২


Ø খাবার খাওয়ার পর দুআ-

اَلْحَمْدُ لِلّهِ الَّذِيْ أَطْعَمَنَا وَسَقَانَا، وَجَعَلَنَا مِنَ الْمُسْلِمِيْنَ.

অর্থাৎ সকল প্রশংসা সেই আল্লাহ তাআলার, যিনি আমাদের পানাহার করিয়েছেন এবং আমাদেরকে মুসলমানদের অন্তর্ভুক্ত করেছেন। -জামে তিরমিযী, হাদীস ৩৪৫৭; সুনানে আবু দাউদ, হাদীস ৩৮৫০


 الطَّاعِمُ الشَّاكِرُ لَهُ مِثْلُ أَجْرِ الصَّائِمِ الصَّابِرِ অর্থ: খেয়ে যে আল্লাহর শোকর আদায় করে সে ধৈর্যশীল রোযাদার ব্যক্তির সমান পুরস্কার লাভ করবে। -সুনানে ইবনে মাজাহ, হাদীস ১৭৬৫


Ø প্রস্রাব-পায়খানা সেরে বেরিয়ে আসে, তখনো আমাদের শেখানো হয়েছে কৃতজ্ঞতার দুআ-

غُفْرَانَكَ. اَلْحَمْدُ لِلّهِ الَّذِيْ أَذْهَبَ عَنِّيْ الْأَذٰى وَعَافَانِيْ.

অর্থাৎ তোমার কাছেই ক্ষমা চাই হে প্রভু! সকল প্রশংসা সেই আল্লাহর যিনি আমার কষ্টকর বস্তুগুলো সরিয়ে দিয়েছেন এবং আমাকে নিরাপদ রেখেছেন। -জামে তিরমিযী, হাদীস ৭; সুনানে ইবনে মাজাহ, হাদীস ৩০১; আমালুল ইয়াওমি ওয়াল লাইলাহ, ইবনুস সুন্নী, হাদীস ২২


প্রশ্ন: খ। আল্লাহর তাআলার কৃতজ্ঞতা প্রকাশের পদ্ধতি ও ভাষা কি?

প্রশ্ন: খ। আল্লাহর কৃতজ্ঞতা আদায়ের প্রথম স্তর হলো, তার আদেশগুলো মান্য করা এবং তার নিষেধগুলো থেকে বিরত থাকা।


 فَاذْكُرُونِي أَذْكُرْكُمْ وَاشْكُرُوا لِي وَلَا تَكْفُرُونِ

সুতরাং তোমরা আমাকে স্মরণ কর, আমিও তোমাদের স্মরণ রাখবো এবং আমার কৃতজ্ঞতা প্রকাশ কর; অকৃতজ্ঞ হয়ো না। সূরা বাকারা-১৫২         

   ব্যাখ্যা: উক্ত আয়াতে কারিমায় বলা হয়েছে যে, বান্দা আল্লাহকে স্মরণ করলে, আল্লাহ তাআলাও স্মরণ করবে। এখন প্রশ্ন হলো, বান্দা যখন আল্লাহ আল্লাহ বলবে, আল্লাহ তাআলা কি তখন বান্দা বান্দা বললে। এর সমাধান, তথা বান্দাকে স্মরণ করার কায়ফিয়াত সম্পর্কে হাকিমুল উম্মত মুজাদ্দিদে মিল্লাত শাহ আশরাফ আলী থানভি রহ বলেন,

فَاذْكُرُونِي أَذْكُرْكُمْ

  اي تذكروني بالطاعة

 اذكركم بالانعام 

অর্থাৎ তোমরা আমাকে স্মরণ কর, আনুগত্যের মাধ্যমে। আরআমি তোমাদেরকে স্মরণ করবো নিআমতরাজির/অনুগ্রহের মাধ্যমে। সূত্র: তাফসিরে বায়ানুল কুরআন অবলম্বনে

‘মুআয! আমি তোমাকে বলছি, কখনোই নামাযের পরে এ দুআটি পড়তে ভুল করো না-

اللّهُمَّ أَعِنِّيْ عَلٰى ذِكْرِكَ وَشُكْرِكَ وَحُسْنِ عِبَادَتِكَ .

হে আল্লাহ! আপনার জিকির, আপনার কৃতজ্ঞতা ও শোকর আদায় এবং সুন্দর করে আপনার ইবাদত করতে আপনি আমাকে সাহায্য করুন। -মুসনাদে আহমাদ, হাদীস ২২১১৯; সুনানে আবু দাউদ, হাদীস ১৫২৪


প্রশ্ন: গ। মানুষের কৃতজ্ঞতা প্রকাশের ভাষা কি?

উত্তর: গ। কিভাবে মানুষের উপকারে প্রতিদান দিতে হবে,তা আমাদের নবি (ﷺ) সুন্দরভাবে শিক্ষা দিয়েছেন। যেমন-হাদিসের বাণী-

عن أبي هريرة رضي الله عنه عن النبي صلى الله عليه وسلم قال: «مَنْ لمْ يشْكُر النَّاسَ لَمْ يشْكُر الله» (رواه الترمذ

অর্থ: হজরত আবু হুরাইরা (রা.) নবি (ﷺ) থেকে বর্ণনা করেন, তিনি বলেন, যে ব্যক্তি মানুষের কৃতজ্ঞাতা প্রকাশ করে না, সে আল্লাহর কৃতজ্ঞতাও আদায় করে না। তাখরিজ: জামে তিরমিজি-৪৮১১


কিভাবে মানুষের কৃতজ্ঞতা আদায় করবো, নিচে কয়েকটি হাদিস উল্লেখ করা হলো:


হাদিস নং-০১

  وَعَنْ أُسَامَةَ بْنِ زَيْدٍ رَضِيَ اَللَّهُ عَنْهُمَا قَالَ: قَالَ رَسُولُ اَللَّهِ ‏- صلى الله عليه وسلم ‏-{ "مَنْ صُنِعَ إِلَيْهِ مَعْرُوفٌ, فَقَالَ لِفَاعِلِهِ: جَزَاكِ اَللَّهُ خَيْراً.‏ فَقَدْ أَبْلَغَ فِي اَلثَّنَاءِ" } أَخْرَجَهُ اَلتِّرْمِذِيُّ, وَصَحَّحَهُ اِبْنُ حِبَّانَ

অর্থ: হযরত উসামা রা. থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ (ﷺ বলেন, তোমার প্রতি যদি কেউ কৃতজ্ঞতার আচরণ করে তখন যদি তুমি তাকে জাযাকাল্লাহ খাইরান (আল্লাহ তোমাকে উত্তম বিনিময় দান করুন) বল তাহলেই তুমি তার যথাযোগ্য প্রশংসা করলে। তাখরিজ: জামে তিরমিযী-২০৩৫; সহীহ ইবনে হিববান-৩৪১৩


হাদিস নং--০২

مَنْ أَتَى إِلَيْكُمْ مَعْرُوفًا فَكَافِئُوهُ، فَإِنْ لَمْ تَجِدُوا فَادْعُوا لَهُ، حَتَّى يَعْلَمَ أَنْ قَدْ كَافَأْتُمُوهُ.

তোমাদের প্রতি যে ব্যক্তি কোনো ভালো আচরণ করে তোমরা তার প্রতিদান দাও। যদি দেয়ার মতো কিছু না পাও তাহলে তার জন্যে দুআ করো, যাতে সে বুঝতে পরে- তোমরা তার প্রতিদান দিয়েছ। -আল-আদাবুল মুফরাদ, হাদীস ২১৬


হাদিস নং--০৩

مَنْ أُعْطِيَ عَطَاءً فَوَجَدَ فَلْيَجْزِ بِهِ، وَمَنْ لَمْ يَجِدْ فَلْيُثْنِ، فَإِنّ مَنْ أَثْنَى فَقَدْ شَكَرَ، وَمَنْ كَتَمَ فَقَدْ كَفَرَ.

কাউকে যখন উপহারস্বরূপ কিছু দেয়া হয়, তখন সে যদি এর পরিবর্তে দেয়ার মতো কিছু পায় তাহলে যেন তা দিয়ে দেয়। আর যে এমন কিছু না পাবে সে যেন তার প্রশংসা করে। কেননা যে প্রশংসা করল সেও কৃতজ্ঞতা আদায় করল। আর যে লুকিয়ে রাখল সে অস্বীকার করল। -জামে তিরমিযী, হাদীস ২০৩৪


প্রশ্ন: ঘ। অনেকে শুকরান,শুকরিয়া ধন্যবাদ, Thank ইত্যাদি শব্দের মাধ্যমে কৃতজ্ঞতা আদায় করে। আমার প্রশ্ন হলো এ শব্দগুলো দ্বারা পূর্ণ কৃতজ্ঞতা আদায় হবে?


উত্তর: ঘ। শুকরান,শুকরিয়া ধন্যবাদ, Thank ইত্যাদি শব্দগুলো দ্বারা পূর্ণ কৃতজ্ঞতা আদায় হবে না। দলিল হিসেবে উপরোক্ত ১,২ ও ৩ নং হাদিস পেশ করা যায়। অর্থাৎ কৃতজ্ঞতার সর্বনিম্ন স্তর হলো উক্ত ব্যক্তি জন্য দুআ/প্রশংসা করা।


جزاك الله خيرا জাযাকাল্লাহু খায়রান অর্থ আল্লাহ তাআলা আপনাকে উত্তম বিনিময় দান করুন। শুকরানও আরবী শব্দ। এর অর্থ তোমার কৃতজ্ঞতা জ্ঞাপন করছি। ধন্যবাদ বাংলা শব্দ। এটি প্রশংসাবাদ, সাধুবাদ বা কৃতজ্ঞতাজ্ঞাপক উক্তি। আর থ্যাংক ইউ ইংরেজি শব্দ। এর অর্থ তোমাকে ধন্যবাদ, তোমার কৃতজ্ঞতা জ্ঞাপন করছি।


এ শব্দগুলোর মধ্যে কোনটা আরবী, বাংলা বা ইংরেজি-এদিকে না তাকিয়ে শুধু এগুলোর অর্থের দিকে লক্ষ্য করলে দেখব, জাযাকাল্লাহু খায়রান বাক্যটি সবচেয়ে সারগর্ভ। কারণ এতে শুধু কৃতজ্ঞতা প্রকাশ নয়, উপকারীর জন্য কল্যাণের দুআও/কামনা আছে।


আর যদি কেউ আরও বাড়িয়ে বলে, جزاك الله خيرا في الدارين জাযাকাল্লাহু খায়রান ফিদ দারাইন (আল্লাহ দুনিয়া ও আখিরাতে তোমাকে সর্বোত্তম বিনিময় দান করুন) তাহলে তো সোনায় সোহাগা।


প্রশ্ন: ঙ। শুধু জাযাকাল্লাহ বললে কি হাদিস অনুযায়ী পূর্ণ দুআ আদায় হবে?  


উত্তর: ঙ। হ্যাঁ, ঠিকই কোনো কোনো ভাই শুধু জাযাকাল্লাহ বলে। এ শব্দ দ্বারা পূর্ণ কৃতজ্ঞতা আদায় হয় না, বরং জাযাকাল্লাহু সাথে খয়রান শব্দও বলতে হবে? দেখুন হাদিসের ভাষা হলো,


  أسامة بن زيد عن النبي صلى الله عليه و سلم أنه قال من صنع إليه معروف فقال لفاعله جزاك الله خيرا فقد أبلغ في الثناء رواه الترمذي والنسائي وابن حبان في صحيحه  

অর্থ: হযরত উসামা রা. থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ (ﷺ বলেন, তোমার প্রতি যদি কেউ কৃতজ্ঞতার আচরণ করে তখন যদি তুমি তাকে জাযাকাল্লাহ খাইরান (আল্লাহ তোমাকে উত্তম বিনিময় দান করুন) বল তাহলেই তুমি তার যথাযোগ্য প্রশংসা করলে। তাখরিজ: জামে তিরমিযী-২০৩৫; সহীহ ইবনে হিববান-৩৪১৩


সারকথা:

মুসলিম/আলেম হিসেবে দুআর ভাষা ধন্যবাদ, শুকরান, Thank ইত্যাদির পরিবর্তে প্রিয় নবির (ﷺ) মুখসৃত বাণী “জাযাকাল্লাহু খয়রান” বলাই উচিত। ( তবে যারা আরবি/দ্বীনি বুঝে না, তাদের জন্য দুটাই অর্থাৎ জাযাকাল্লাহু খয়রান + ধন্যবাদ উল্লেখ করাই শ্রেয়।)


والله اعلم بالصواب


উত্তর দিচ্ছেন, মুফতি মুহাম্মাদ আব্দুর রাজ্জাক