আল-বুরহান ( দলিল-প্রমাণ)

আসসালামু আলাইকুম ওয়া রহমাতুল্লাহ! আমাদের ওয়েবসাইটে আপনাকে স্বাগতম। একটু নিচে দেখুন> বিষয় ভিক্তিক সাজানো রয়েছে, আপনার পছন্দ অনুযায়ী পাঠ করুন এবং পোষ্টগুলো ভালো লাগলে শেয়ার করুন আর আপনার কোন প্রশ্ন থাকলে এই নাম্বারে- ০১৬৮৭-১১৩৮৮০ হোয়াটস অ্যাপে পাঠিয়ে দিন । জাযাকাল্লাহু খাইর।

আল-আহাদিসুল ফাযায়েল-০১ (১-১০০)

No Comments

 

হাদিস নং-০১

حَدَّثَنَا هَدَّابُ بْنُ خَالِدٍ الأَزْدِيُّ، وَشَيْبَانُ بْنُ فَرُّوخَ، جَمِيعًا عَنْ سُلَيْمَانَ بْنِ الْمُغِيرَةِ، - وَاللَّفْظُ لِشَيْبَانَ - حَدَّثَنَا سُلَيْمَانُ، حَدَّثَنَا ثَابِتٌ، عَنْ عَبْدِ الرَّحْمَنِ بْنِ أَبِي لَيْلَى، عَنْ صُهَيْبٍ، قَالَ قَالَ رَسُولُ اللَّهِ صلى الله عليه وسلم " عَجَبًا لأَمْرِ الْمُؤْمِنِ إِنَّ أَمْرَهُ كُلَّهُ خَيْرٌ وَلَيْسَ ذَاكَ لأَحَدٍ إِلاَّ لِلْمُؤْمِنِ إِنْ أَصَابَتْهُ سَرَّاءُ شَكَرَ فَكَانَ خَيْرًا لَهُ وَإِنْ أَصَابَتْهُ ضَرَّاءُ صَبَرَ فَكَانَ خَيْرًا لَهُ " .


৭২২৯। হাদ্দাব ইবনে খালিদ আযদী ও ফাররুখ ইবনে শায়বান (রাহঃ) ......... সুহায়ব (রাযিঃ) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ (ﷺ) বলেছেনঃ মু’মিনের অবস্থা ভারী অদ্ভুত। তাঁর সমস্ত কাজই তাঁর জন্য কল্যাণকর। মু’মিন ব্যতিত অন্য কারো জন্য এ কল্যাণ লাভের ব্যাবস্থা নেই। তাঁরা আনন্দ (সুখ শান্তি) লাভ করলে শুকরিয়া জ্ঞাপন করে, তা তাঁর জন্য কল্যাণকর হয়, আর দুঃখকষ্টে আক্রান্ত হলে ধৈর্যধারণ করে, এও তাঁর জন্য কল্যাণকর হয়।


Suhaib reported that Allah’s Messenger (ﷺ) said:

Strange are the ways of a believer for there is good in every affair of his and this is not the case with anyone else except in the case of a believer for if he has an occasion to feel delight, he thanks (God), thus there is a good for him in it, and if he gets into trouble and shows resignation (and endures it patiently), there is a good for him in it.


সহীহ মুসলিম, হাদীস নং ৭২২৯ (আন্তর্জাতিক নং ২৯৯৯)



হাদীসের ব্যাখ্যা:

ইহজগত দুঃখ-কষ্ট ও সুখ-শান্তির মিলনস্থল। প্রত্যেক ব্যক্তির এখানে যেমন সুখ আছে, তেমনি দুঃখও আছে। সমগ্র জীবন কেবল সুখে কিংবা কেবলই দুঃখে কারওই কাটে না। সেজন্যে আছে আখিরাতের জীবন। সেখানে যারা জান্নাতে যাবে তাদের কেবল সুখই সুখ। কষ্টের কোনও ছোঁয়া সেখানে নেই। অন্যদিকে জাহান্নাম কেবলই দুঃখ-কষ্টের জায়গা। সেখানে যারা যাবে, কোনও সুখের স্পর্শ তারা পাবে না। তো দুনিয়ায় যখন সুখ-দুঃখ দুইই আছে এবং প্রত্যেক ব্যক্তিকে এ দুই অবস্থাই স্পর্শ করে তখন এমন কিছু নীতি থাকা দরকার, যা অনুসরণ করলে উভয় ব্যক্তির পক্ষে কল্যাণকর হয়। এ হাদীছে সেই নীতির কথাই শিক্ষা দেওয়া হয়েছে। প্রকৃত মু'মিন ব্যক্তি সেই নীতির অনুসরণ করে বলে তার জীবনে কোনও অবস্থাই অশুভ হয় না। এজন্যই নবী কারীম সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়াসাল্লাম বিস্ময় প্রকাশ করে বলেন যে, মু'মিনের ব্যাপারটা আশ্চর্যজনক! সুখ ও দুঃখ উভয়ই তার জন্যে ভালো। আল্লাহর পক্ষ থেকে তার যদি কোনও নি'আমত লাভ হয়, যেমন জ্ঞান-বিদ্যা, সুস্বাস্থ্য, শক্তি ও ক্ষমতা, অর্থ-সম্পদ, সন্তান-সন্ততি ইত্যাদি, তবে এর জন্য সে শোকর আদায় করে। ফলে আল্লাহ তা'আলা খুশি হন। খুশি হয়ে তিনি বান্দার নি'আমত বাড়িয়ে দেন। যে নি'আমতের কারণে তার সুখ, তার থেকে তা কেড়ে নেন না; বরং আরও বেশি পরিমাণে দেন। এবং তার ক্ষতি থেকেও তাকে রক্ষা করেন। সেইসংগে শোকরের বিনিময়ে আখিরাতের ছওয়াব তো রয়েছেই। কুরআন মাজীদে ইরশাদ-


لَئِن شَكَرْتُمْ لَأَزِيدَنَّكُمْ ۖ وَلَئِن كَفَرْتُمْ إِنَّ عَذَابِي لَشَدِيدٌ


অর্থ : তোমরা সত্যিকারের কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করলে আমি তোমাদেরকে আরও বেশি দেব, আর যদি অকৃতজ্ঞতা কর, তবে জেনে রেখ আমার শাস্তি অতি কঠিন।' - ইব্রাহীমঃ ০৭ 

আবার যদি দুঃখ-কষ্ট দেখা দেয়, তবে সে সবর করে। কষ্টের কথা মানুষকে বলে বেড়ায় না এবং ভাগ্যকে দোষারোপ করে না। সে আল্লাহর ফয়সালায় সন্তুষ্ট থাকে এবং সেই কষ্ট থেকে মুক্তির জন্যে তাঁর কাছে দু'আ করে। ফলে আল্লাহ তার কষ্ট লাঘব করে দেন এবং তার ক্ষতি থেকে তাকে হেফাজত করেন। আর আখিরাতে সবরের অপরিমিত প্রতিদান তো আছেই। পক্ষান্তরে কাফিরের বেলায় ব্যাপারটা এর সম্পূর্ণ বিপরীত। সুখ ও আনন্দের সময় সে উল্লসিত হয়। অহংকার-অহমিকা প্রকাশ করে। সে নি'আমতের কদর করে না এবং তার শোকর আদায়েরও প্রয়োজন বোধ করে না। বরং সে আল্লাহপ্রদত্ত নি'আমতকে নাজায়েয কাজে ব্যবহার করে। ফলে সেই নি'আমতের সুখ ও আনন্দ তার জন্যে অশুভ পরিণাম ডেকে আনে। অনুরূপ কষ্টের সময়ও সে অস্থির হয়ে পড়ে এবং ভাগ্যকে দোষারোপ করে। ফলে এক কষ্ট তার জন্যে আরও বহু কষ্ট ডেকে আনে। এই নাশোকরি ও ধৈর্যহীনতার কুফল যেমন দুনিয়ার জীবনে তাকে ভুগতে হয়, তেমনি আখিরাতেও এর জন্য রয়েছে কঠিন শাস্তি। তাহলে দেখা যাচ্ছে কাফিরের জন্যে প্রকৃতপক্ষে সুখ ও দুঃখ কোনও অবস্থাই শুভ নয়। অপরদিকে মু'মিনের পক্ষে অশুভ নয় কোনও অবস্থাই। এ কারণেই নবী কারীম সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়াসাল্লাম বিস্ময় প্রকাশের মাধ্যমে তা ব্যক্ত করেছেন।


হাদিস নং-০২

حَدَّثَنِي عَبْدُ اللَّهِ بْنُ مُحَمَّدٍ، حَدَّثَنَا عَبْدُ الْمَلِكِ بْنُ عَمْرٍو، حَدَّثَنَا زُهَيْرُ بْنُ مُحَمَّدٍ، عَنْ مُحَمَّدِ بْنِ عَمْرِو بْنِ حَلْحَلَةَ، عَنْ عَطَاءِ بْنِ يَسَارٍ، عَنْ أَبِي سَعِيدٍ الْخُدْرِيِّ، وَعَنْ أَبِي هُرَيْرَةَ، عَنِ النَّبِيِّ صلى الله عليه وسلم قَالَ " مَا يُصِيبُ الْمُسْلِمَ مِنْ نَصَبٍ وَلاَ وَصَبٍ وَلاَ هَمٍّ وَلاَ حُزْنٍ وَلاَ أَذًى وَلاَ غَمٍّ حَتَّى الشَّوْكَةِ يُشَاكُهَا، إِلاَّ كَفَّرَ اللَّهُ بِهَا مِنْ خَطَايَاهُ ". 


রোগের কাফফারা ও ক্ষতিপূরণ এবং মহান আল্লাহর বাণীঃ যে ব্যক্তি মন্দ কাজ করবে তাকে সেই কাজের প্রতিফল দেয়া হবে।


৫২৩৯। ‘আব্দুল্লাহ ইবনে মুহাম্মাদ (রাহঃ) ......... আবু সা‘ঈদ খুদরী ও আবু হুরায়রা (রাযিঃ) থেকে বর্ণিত যে, নবী করীম (ﷺ) বলেছেনঃ মুসলিম ব্যক্তির উপর যে সকল যাতনা, রোগ-ব্যাধি, উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা, দুশ্চিন্তা, কষ্ট ও পেরেশানী আপতিত হয়, এমন কি যে কাটা তার দেহে বিদ্ধ হয়, এ সবের দ্বারা আল্লাহ তার গুনাহ সমুহ ক্ষমা করে দেন।


Narrated Abu Sa`id Al-Khudri and Abu Huraira:


The Prophet (ﷺ) said, "No fatigue, nor disease, nor sorrow, nor sadness, nor hurt, nor distress befalls a Muslim, even if it were the prick he receives from a thorn, but that Allah expiates some of his sins for that."


—সহীহ বুখারী, হাদীস নং ৫২৩৯ (আন্তর্জাতিক নং ৫৬৪১-৫৬৪২)



হাদীসের ব্যাখ্যা:

এ হাদীছ দ্বারা বোঝা যায় মু'মিন ব্যক্তির কোনওকিছুই বৃথা যায় না। সে যেকোনও দুঃখ-কষ্ট ও বালা-মসিবতে পড়ে, তাতেও পুরস্কৃত হয়। গুনাহ মাফ হয়। সে হিসেবে দুঃখ-কষ্ট তার পক্ষে এক নি'আমত ও রহমত। অবশ্য এটা নি'আমত হবে তখনই, যখন বান্দা তাতে সবর অবলম্বন করবে। সবর না করলে কষ্টের কষ্টও হল, আবার লাভও কিছু হল না। সবর না করলে কষ্ট লাঘব হবে এমন তো নয়। সুতরাং বুদ্ধিমত্তার পরিচায়ক হবে যে-কোনও কষ্ট-ক্লেশে অধৈর্য না হয়ে সবর অবলম্বন করা। তাতে কষ্ট হলেও সেই কষ্ট বৃথা যায় না। বরং পাপের বোঝা হালকা হয়। এমনকি সবর দ্বারা কষ্টও লাঘব হয়। অন্তরে যখন পুরস্কারের আশা থাকে, তখন কষ্ট বরদাশত করা সহজ হয়।


এ হাদীছে من خَطَاياهُ বলা হয়েছে। من অব্যয়টি অংশবোধক। অর্থাৎ সমস্ত গুনাহ নয়; বরং তার অংশবিশেষ মাফ হয়। 'উলামায়ে কিরাম বলেন, সগীরা গুনাহ মাফ হয়। কবীরা গুনাহ মাফের জন্য তাওবার প্রয়োজন হয়। গুনাহ অন্যের হক সংক্রান্ত হলে যে ব্যক্তির হক তার পক্ষ থেকেও ক্ষমালাভ জরুরি।


প্রকাশ থাকে যে, কষ্ট-ক্লেশ ও বালা-মসিবত দ্বারা গুনাহ মাফ হয় আর সে হিসেবে এটা এক নি'আমত বটে, কিন্তু তাই বলে আল্লাহর কাছে এ জাতীয় নি'আমত চাওয়া ঠিক নয়। অর্থাৎ এমন দু'আ করা ঠিক নয় যে, আল্লাহ তা'আলা যেন বালা-মসিবত দিয়ে গুনাহ মাফ করেন এবং আখিরাতের আযাব থেকে নিষ্কৃতি দেন। সে নিষ্কৃতি লাভের লক্ষ্যে তাওবা ও ইসতিগফার করাই বাঞ্ছনীয়। এ হাদীছে যে কষ্ট-ক্লেশের কথা বলা হয়েছে তা ওই কষ্ট-ক্লেশ, যা বান্দার চাওয়া ছাড়াই আল্লাহ তা'আলা নিজ ইচ্ছায় দিয়ে থাকেন। অর্থাৎ অনাকাঙ্ক্ষিতভাবে যে বালা-মসিবত দেখা দেয়, তাতে কর্তব্য ধৈর্যধারণ করা। এই আশায় বালা-মসিবত আকাঙ্ক্ষা করা যে, তাতে ধৈর্যধারণ করব আর গুনাহ থেকে নিষ্কৃতি পাব, এটা এক ধরনের ধৃষ্টতা। বান্দার কাজ বাহাদুরী দেখানো নয়; বরং সর্বাবস্থায় নিজ দুর্বলতা ও অক্ষমতা প্রকাশ করা। এজন্যই নবী কারীম সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়াসাল্লাম আল্লাহ তা'আলার কাছে বিপদ-আপদ না চেয়ে বরং শান্তি, সুস্থতা ও নিরাপত্তা প্রার্থনার শিক্ষা দিয়েছেন। এক হাদীছে ইরশাদ হয়েছে-


يَا أَيُّهَا النَّاسُ، لَا تَتَمَنَّوْا لِقَاءَ الْعَدُوِّ، وَاسْأَلُوا اللَّهَ الْعَافِيَةَ، فَإِنْ لَقِيتُمُوهُمْ فَاصْبِرُوا

'হে লোকসকল! তোমরা শত্রুর সাক্ষাত কামনা করো না। বরং আল্লাহর কাছে নিরাপত্তা প্রার্থনা কর। তবে যখন শত্রুর মুখোমুখি হবে, তখন সবর অবলম্বন করো।”

এ প্রসঙ্গে হযরত হাজী ইমদাদুল্লাহ মুহাজিরে মাক্কী রহ.-এর একটি ঘটনা উল্লেখযোগ্য। একদিন তিনি নসীহত করতে গিয়ে বলছিলেন, রোগ-ব্যাধিও আল্লাহর এক নি'আমত। তিনি বিষয়টা ব্যাখ্যা করে বোঝাচ্ছিলেন। ঠিক এই মুহূর্তে এক অসুস্থ ব্যক্তির পক্ষ থেকে দু'আ চাওয়া হল, যেন আল্লাহ তা'আলা তাকে আরোগ্য দান করেন। এবার তিনি কী করবেন? তিনি কি আরোগ্যের জন্য দু'আ করবেন? তবে তো নি'আমত বিলুপ্তির দু'আ করা হবে। সবাই তাকিয়ে আছে তিনি কী করেন। কিন্তু আল্লাহওয়ালাদেরকে আল্লাহ তা'আলাই পথ দেখান। সঠিক কথা তিনি তাদের অন্তরে ইলহাম করেন। সুতরাং তিনি দু'আ করলেন, হে আল্লাহ! অসুখ-বিসুখ নি'আমত বটে, কিন্তু আমরা বড় দুর্বল দুঃখ-কষ্টের নি‘আমত সহ্য করা আমাদের পক্ষে কঠিন। সুতরাং আপনি অসুস্থতার নি'আমতকে সুস্থতার নি'আমত দ্বারা বদলে দিন। সুবহানাল্লাহ, কী চমৎকার হিকমতের কথা!


হাদিস নং-০৩

وَمَا سُرِقَ مِنْهُ لَهُ صَدَقَةٌ

(মুসলিম ১৫৫২)


অর্থাৎ “তার কাছ থেকে যা চুরি হয়েছে, সেটাও তার জন্য সদকা (সাওয়াব)।”


ব্যাখ্যা:

যদি কারও সম্পদ বা জিনিস চুরি হয়ে যায়, আর সে ধৈর্যের সাথে আল্লাহর উপর ভরসা করে, তাহলে সেই হারানো জিনিসটিও তার জন্য সদকার সাওয়াবের কারণ হবে। অর্থাৎ আল্লাহ তাকে সেই ক্ষতির বিনিময়ে পুরস্কৃত করবেন।