জিজ্ঞাসা-২৮০: আসসালামু আলাইকুম,
প্রশ্নঃ পালক পুত্র এর জন্মনিবন্ধনে পিতা এবং মাতার নামের ক্ষেত্রে তার জন্মদাতা পিতা মাতার নাম না দিয়ে পালক পিতা- মাতার নাম দেয়া যাবে কিনা?
( হিন্দু বা সনাতন ধর্মাবলম্বী একটা ছেলে- মেয়ের পারিবারিক ভাবে বিবাহ হয়, বিবাহের পর সন্তান গর্ভে আসার পর উক্ত দম্পতির ডিভোর্স হয়ে যায়. মেয়ের পরিবার গরিব হওয়ায় নবজাতক সন্তানের খরচ বহন এবং উক্ত ডিভোর্সী মেয়ের বিবাহের কথা চিন্তা করে নবজাতক সন্তান কে কাউকে দিয়ে দিতে চায়,
এক মুসলিম দম্পতি নিঃসন্তান, তারা উক্ত সন্তান টি নিয়ে নেয়, )
১, সন্তান বড় হলে তার শিক্ষার ক্ষেত্রে জন্মনিবন্ধন দরকার হবে, মুসলিম ঘরে লালিত হয়ে অমুসলিম পিতা- মাতার নাম কিভাবে ব্যবহার করবে?
২, পালক পিতা- মাতা সেনা সদস্য, সেনা সদস্যের সন্তান সেনাবাহিনী থেকে যে সুবিধাগুলো পেয়ে থাকে সেগুলো উক্ত সন্তান ভোগ করতে পারবে কি?
তারিখ-২৩/০৯/২২ ঈসায়ি/ইংরেজি
হাফেজ মাওলানা আবুল কালাম আজাদ যশোর থেকে---
জবাব: وعليكم السلام ورحمة الله وبركاته
نحمده ونصل على رسوله الكريم اما بعد بسم الله الرحمن الرحيم
তাসলিম ও হামদ-সানার পর কথা হলো, ইয়াতিম-অসহায়কে লালন-পালন করা বড় ফজিলতের কাজ। যেমন,
سهل بن سعد رضي الله عنه أن النبي صلى الله عليه وسلم قال: "أَنَا وَكَافِلُ الْيَتِيمِ فِي الْجَنَّةِ هَكَذَا"، وَأَشَارَ بِالسَّبَّابَةِ وَالْوُسْطَى، وَفَرَّجَ بَيْنَهُمَا شَيْئًا
নবী করিম (ﷺ) ইরশাদ করেন, ‘আমি ও এতিমের অভিভাবক জান্নাতে দুই আঙুলের ন্যায় অতি কাছাকাছি থাকব। তাখরিজ: বুখারি-৬০০৫
নবী করিম (ﷺ) বলেন, ‘যে ব্যক্তি এতিমের খোরপোশ ও লালন-পালনের যাবতীয় দায়িত্ব গ্রহণ করে, আল্লাহ তাআলা তাকে জান্নাত দান করবেন। ’ (তিরমিজি : ১৯১৭)
আপনার প্রশ্ন আলোকে উত্তরটি কয়েকভাগ ভাগ করছি। ونسأل الله التوفيق وهو الموفق والمعين
প্রশ্ন: ক। পালক পুত্র এর জন্মনিবন্ধনে পিতা এবং মাতার নামের ক্ষেত্রে তার জন্মদাতা পিতা মাতার নাম না দিয়ে পালক পিতা- মাতার নাম দেয়া যাবে কিনা?
উত্তর: ক। আসল কথা হলো, পালক/দত্তক পিতা-মাতা প্রকৃত পিতা-মাতা হয় না। দলিল:
وَمَا جَعَلَ أَدْعِيَاءَكُمْ أَبْنَاءَكُمْ ذَٰلِكُمْ قَوْلُكُم بِأَفْوَاهِكُمْ وَاللَّهُ يَقُولُ الْحَقَّ وَهُوَ يَهْدِي السَّبِيلَ ادْعُوهُمْ لِآبَائِهِمْ هُوَ أَقْسَطُ عِندَ اللَّهِ فَإِن لَّمْ تَعْلَمُوا آبَاءَهُمْ فَإِخْوَانُكُمْ فِي الدِّينِ وَمَوَالِيكُمْ
অর্থ: তোমাদের পোষ্যপুত্রদেরকে তোমাদের পুত্র করেননি। এগুলো তোমাদের মুখের কথা মাত্র। আল্লাহ ন্যায় কথা বলেন এবং পথ প্রদর্শন করেন। তোমরা তাদেরকে তাদের পিতৃপরিচয়ে ডাক। এটাই আল্লাহর কাছে ন্যায়সঙ্গত। যদি তোমরা তাদের পিতৃ-পরিচয় না জান, তবে তারা তোমাদের ধর্মীয় ভাই ও বন্ধুরূপে গণ্য হবে। সূরা আহজাব-৪,৫
আয়াতদ্বয়ের নাযিলের প্রেক্ষাপেট:
রাসুলুল্লাহ (ﷺ) জায়েদ নামে এক সাহাবিকে দত্তক/পালতে নিয়েছিলেন। তাঁর পিতার নাম ছিল হারেসা। তাঁকে সবাই জায়েদ ইবনে মোহাম্মাদ—অর্থাত্ মোহাম্মাদের পুত্র বলে ডাকত। যা জাহিলি যুগের প্রথা ছিল। এমন পরিস্থিতে সংশোধনের জন্য আয়াতদ্বয় অবতীর্ণ হয়। পরে সবাই তাঁকে জায়েদ ইবনে হারেসা বলেই ডাকা আরম্ভ করে।
ব্যাখ্যা: অনেকে যে অপরের সন্তানকে নিজ পুত্র বলে আহবান করে, তা যদি নিছক স্নেজনিত হয়-পালক পুত্র পরিণত করার উদ্দেশে না হয়, তবে যদিও জায়েজ;কিন্তু তবুও ব্যহতঃ যা নিষিদ্ধ, তাতে জড়িত হওয়া সমীচীন নয়। অর্থাৎ লালন-পালনকারীকে সম্মান ও কৃতজ্ঞতাস্বরূপ মা-বাবা ডাকা বৈধ হলেও অনুত্তম ও অনুচিত। সুত্র: তাফসিরে রূহুল বয়ান, বায়যাবি, তাফসিরে মাআরেফুল কুরআন-১০৭০ পৃষ্ঠা, সংক্ষিপ্ত মাওলানা মহিউদ্দিন খান অনূদিত।
এ বিষয়ে হাদিস শরিফে কঠোর ধমক এসেছে-
عَنْ سَعْدٍ رَضِيَ اللَّهُ عَنْهُ، قَالَ سَمِعْتُ النَّبِيَّ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ، يَقُولُ: «مَنِ ادَّعَى إِلَى غَيْرِ أَبِيهِ، وَهُوَ يَعْلَمُ أَنَّهُ غَيْرُ أَبِيهِ، فَالْجَنَّةُ عَلَيْهِ حَرَامٌ»
রাসুলুল্লাহ (ﷺ) ইরশাদ করেন, ‘যে ব্যক্তি জেনেশুনে নিজের পিতাকে ছাড়া অন্য কাউকে পিতা বলে দাবি করে, তার জন্য জান্নাত হারাম।’ তাখরিজ: বুখারি-৪৩২৬
সুতরাং পালক পিতা-মাতাকে সম্মানসূচক বাবা-মা ডাকা জায়েজ হলেও পালক পুত্র এর জন্মনিবন্ধনে পিতা এবং মাতার নামের ক্ষেত্রে তার জন্মদাতা পিতা মাতার নাম না দিয়ে পালক পিতা- মাতার নাম দেয়া যাবে না, জায়েজ হবে না।
প্রশ্ন: খ। সন্তান বড় হলে তার শিক্ষার ক্ষেত্রে জন্মনিবন্ধন দরকার হবে, মুসলিম ঘরে লালিত হয়ে অমুসলিম পিতা- মাতার নাম কিভাবে ব্যবহার করবে?
উত্তর: খ। আমরা ইতোপূর্বে প্রমাণ করেছি যে, যেহেতু পালক/দত্তক পিতা-মাতা প্রকৃত পিতা-মাতা নয়। সুতরাং শিক্ষার ক্ষেত্রে জন্মনিবন্ধনে আপন অমুসলিম পিতা-মাতার নাম ব্যবহার করবে। এতে লজ্জা/শরমের কিছু নেই। বড় বড় সাহাবির পিতা কাফের অবস্থায় মৃত্যু হয়েছে। তারাও পিতার পরিচয় দিতে লজ্জাবোধ করেনি; হাদিসের পাতায় সেভাবে বর্ণিত হয়েছে। যেমন, হজরত আলি ইবনে আবু তালেব (রা.), ইকরামা বিন আবু জাহেল (রা.) প্রমুখ সাহাবি।
প্রশ্ন: গ। পালক পিতা- মাতা সেনা সদস্য, সেনা সদস্যের সন্তান সেনাবাহিনী থেকে যে সুবিধাগুলো পেয়ে থাকে সেগুলো উক্ত সন্তান ভোগ করতে পারবে কি?
উত্তর: গ। সাধারণত পালক সন্তানকে নিজ সন্তান বলে পরিচয় দিয়ে মিথ্যা আশ্রয় নিয়ে সরকারি খাতায় রেজিস্ট্রেশন তথা পার্ট-২ করা বৈধ হবে না। সরকারি সুয়োগ-সুবিধা যেমন, রেশন-শিক্ষা ভাতা-চিকিৎসা ইত্যাদি নেওয়া বৈধ হবে না।
তবে বাংলাদেশ সেনাবিাহিনী দত্তক সন্তানের জন্য একটি বিশেষ আইন প্রণয়ন করেছেন, যার ফলে সেনাসদস্যগণ দত্তক সন্তানের বিশেষ সুবিধা পেয়ে থাকে; যা বৈধ হবে। কেননা এখানে পিতৃ পরিচয় গোপন রাখে হচ্ছে না।
উল্লেখ্য যে, বাংলাদেশে প্রচলিত আইনে মুসলিমের জন্য পালক সন্তান প্রকৃত সন্তান হয় না। তবে বর্তমানে বাংলাদেশের উচ্চ আদালতের একটি নির্দেশের পর শুধুমাত্র হিন্দু আইনে হিন্দু পুত্র সন্তানের ক্ষেত্রে বিষয়টি আইনসিদ্ধ। আর বাংলাদেশের খ্রিষ্ট ধর্মের অনুসারীরাও শুধু অভিভাবকত্ব নিতে পারবেন।
মূলকথা হলো, অভিভাবকত্ব আর দত্তক এক বিষয় নয়। মূলত শিশু দত্তক নেওয়ার ক্ষেত্রে বাংলাদেশের আইনে কোন বিধান না থাকায় ১৯৮৫ সালের পারিবারিক আইনের মাধ্যমে কোন ব্যক্তি একটি শিশুর দায়ভার নিতে পারেন একজন অভিভাবক হিসেবে।
প্রশ্ন: ঘ। পালক সন্তানের সম্পত্তির অধিকার।
উত্তর: ঘ। পালক মা–বাবার মৃত্যুর পর তাঁদের আত্মীয়রা এসে যদি সম্পত্তি থেকে পালক সন্তানকে বঞ্চিত করেন, তাহলে আইনত তার কিছুই করার থাকে না। কারণ মুসলিম আইনে দত্তক সন্তান কোন সম্পত্তির উত্তরাধিকারী হতে পারেন না। তবে পালক পিতা-মাতা জীবিত থাকতে চাইলে পালক সন্তানকে সম্পতি হেবা বা দান করতে পারেন; অথবা মোট সম্পত্তির সর্বোচ্চ ৩ ভাগের ১ ভাগ ওসিয়ত করতে পারেন। সূত্র: তাকমিলাতু ফাতহিল কাদির-১০ খণ্ড, ১২২ পৃষ্ঠা
প্রশ্ন: ঙ। দত্তক/পালক সন্তানের সঙ্গে পর্দা করতে হবে কি?
প্রশ্ন: ঙ। আমরা শুরুতে সূরা আল আহজাবের আয়াত উল্লেখ করেছি, তাতে সুস্পষ্টভাবে বলা হয়েছে, শুধু মুখের কথায় রক্তের সম্পর্ক কায়েম হয় না। সুতরাং পালক ছেলে তার পালক মায়ের সঙ্গে এবং পালক মেয়ে তার পালক বাবার সঙ্গে মাহরাম হিসাবে গণ্য হবে না। সূত্র: আহযাব ৩৭, ৪০, তাফসীর ইবনে কাছীর
রাসূলুল্লাহ (ﷺ) পালকপুত্র যায়েদ বিন হারেছার তালাক দেওয়া স্ত্রী যয়নাব বিনতে জাহশকে বিবাহ করেছিলেন (বুখারী, মুসলিম, মিশকাত হা/৩২১১-১২ ‘ওয়ালীমা’ অনুচ্ছেদ)। এর মাধ্যমে তিনি পালক ছেলে-মেয়ে যে মাহরাম নয়, সেটা স্পষ্ট করে দিয়েছেন। বালেগ হওয়ার সাথে সাথে তাদের ক্ষেত্রে হুরমতের বিধান প্রযোজ্য হবে তথা পর্দা ফরয হয়ে যাবে।
সারকথা হলো, জন্মনিবন্ধনে পালক সন্তান তার আসল পিতামাতার নাম ব্যবহার করবে এবং শুধুমাত্র সেনাবাহিনীর জন্য দত্তক সন্তানের জন্য বিশেষ সুবিধাটি ভোগ করা জায়েজ হবে। কিন্তু সত্যকে গোপন করা যাবে না। আল্লাহ তাআলা বলেন,
Surah Al-Baqara, Verse 42:
وَلَا تَلْبِسُوا الْحَقَّ بِالْبَاطِلِ وَتَكْتُمُوا الْحَقَّ وَأَنتُمْ تَعْلَمُونَ
তোমরা সত্যকে মিথ্যার সাথে মিশিয়ে দিও না এবং জানা সত্ত্বে সত্যকে তোমরা গোপন করো না। সূরা বাকারা-৪২
والله اعلم بالصواب