০৫। পবিত্র কুরআন-সুন্নাহ ও মহান আসলাফ-আকাবিরের আমল বনাম আমাদের জিন্দেগি
(রাতে তাড়াতাড়ি ঘুমানো প্রসঙ্গে)
পবিত্র কুরআনের বাণী-
আয়াত নং-০১
وَجَعَلْنَا نَوْمَكُمْ سُبَاتًا وَجَعَلْنَا اللَّيْلَ لِبَاسًا وَجَعَلْنَا النَّهَارَ مَعَاشًا
অর্থ: আমি কি তোমাদের ঘুমকে এক ধরনের ক্লান্তি দূরকারী বিরতি, রাতকে একরকম আবরণ এবং জীবিকা অন্বেষণের জন্য দিনকে তৈরি করে দিইনি? সূরা আন-নাবা, ৯-১১
আয়াত নং-০২
فَالِقُ الْإِصْبَاحِ وَجَعَلَ اللَّيْلَ سَكَنًا وَالشَّمْسَ وَالْقَمَرَ حُسْبَانًا ۚ ذَٰلِكَ تَقْدِيرُ الْعَزِيزِ الْعَلِيمِ
অর্থ: তিনি প্রভাত রশ্মির উন্মেষক। তিনি রাত্রিকে আরামদায়ক করেছেন এবং সূর্য ও চন্দ্রকে হিসেবের জন্য রেখেছেন। এটি পরাক্রান্ত, মহাজ্ঞানীর নির্ধারণ। -সূরা আল আনআম- ৯৬
আয়াত নং-০৩
وَمِن رَّحۡمَتِهِۦ جَعَلَ لَكُمُ ٱلَّيۡلَ وَٱلنَّهَارَ لِتَسۡكُنُواْ فِيهِ وَلِتَبۡتَغُواْ مِن فَضۡلِهِۦ وَلَعَلَّكُمۡ تَشۡكُرُونَ
“তিনিই তাঁর দয়ায় তোমাদের জন্য করেছেন রাত ও দিন, যেন তাতে তোমরা বিশ্রাম করতে পার এবং তাঁর অনুগ্রহ সন্ধান করতে পার। আরও যেন তোমরা কৃতজ্ঞতাও প্রকাশ করতে পার। সূরা কসাস-৭৩
হাদিস শরিফের বাণী-
হাদিস নং-০১
(إنَّ رسولَ الله صلى الله عليه وسلم كان يكرهُ النَّومَ قَبْلَ العِشَاءِ والحَديثَ بَعْدَهَا » . (متفق عليه
অর্থ: রাসূলুল্লাহ (ﷺ) এশার নামাযের পূর্বে ঘুমানো এবং নামাযের পর অহেতুক গল্প-গুজব করাকে খুব অপছন্দ করতেন । তাখরিজ: সহিহ বুখারি-৫১৪
এশার আগে ঘুমানো মাকরূহ হওয়ার কারণ আল্লামা ইবনে হাজার আসকালানি (রহ.) বলেন, কেননা এশার পূর্বে ঘুমালে মূল ওয়াক্তই চলে যেতে পারে অথবা উত্তম ওয়াক্ত ছুটে যেতে পারে। সূত্র: ফাতহুল বারি
হাদিস নং-০২
আবদুল্লাহ ইবনে মাসউদ (রা.) বলেন, রাসূল (ﷺ) আমাদের রাতের গল্পগুজবে মত্ত হতে নিষেধ করতেন। তাখরিজ: ইবনে মাজাহ-২৪৩৫
হাদিস নং-০৩
حَدَّثَنَا مُسَدَّدٌ، قَالَ حَدَّثَنَا أَبُو الأَحْوَصِ، قَالَ حَدَّثَنَا مَنْصُورٌ، عَنْ أَبِي وَائِلٍ، عَنْ عَبْدِ اللَّهِ ـ رضى الله عنه ـ قَالَ ذُكِرَ عِنْدَ النَّبِيِّ صلى الله عليه وسلم رَجُلٌ فَقِيلَ مَا زَالَ نَائِمًا حَتَّى أَصْبَحَ مَا قَامَ إِلَى الصَّلاَةِ. فَقَالَ " بَالَ الشَّيْطَانُ فِي أُذُنِهِ ".
এক ব্যক্তি ফজর পর্যন্ত ঘুমিয়ে ছিল তার সম্পর্কে রাসূল (ﷺ) কে প্রশ্ন করা হল। রাসূল (ﷺ) বললেন :" ঐ ব্যক্তির কর্ণ-দ্বয়ে শয়তান প্রস্রাব করে দিয়েছে।" তাখরিজ: নাসায়ী -১৫৯০
হাদিস নং-০৪
عَنِ الأَسْوَدِ بْنِ يَزِيدَ ، قَالَ : سَأَلْتُ عَائِشَةَ ، عَنْ صَلاةِ رَسُولِ اللَّهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ بِاللَّيْلِ ؟ فَقَالَتْ : " كَانَ يَنَامُ أَوَّلَ اللَّيْلِ ثُمَّ يَقُومُ ، فَإِذَا كَانَ مِنَ السَّحَرِ أَوْتَرَ ، ثُمَّ أَتَى فِرَاشَهُ ، فَإِذَا كَانَ لَهُ حَاجَةٌ أَلَمَّ بِأَهْلِهِ ، فَإِذَا سَمِعَ الأَذَانَ وَثَبَ ، فَإِنْ كَانَ جُنُبًا أَفَاضَ عَلَيْهِ مِنَ الْمَاءِ ، وَإِلا تَوَضَّأَ وَخَرَجَ إِلَى الصَّلاةِ " .
আসওয়াদ ইবনে ইয়াযীদ (রাঃ) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, আমি আয়েশা (রাঃ) এর কাছে রাসূলুল্লাহ (ﷺ) এর তাহাজ্জুদ সালাত (রাতের সালাত) সম্পর্কে জিজ্ঞেস করলাম। তিনি বললেন, তিনি রাতের প্রথমাংশে ঘুমাতেন। তারপর সালাতে দাঁড়াতেন এবং সাহরীর পূর্বক্ষণে বিতর আদায় করতেন। এরপর প্রয়োজন মনে করলে বিছানায় আসতেন। তারপর আযানের শব্দ শুনে জেগে উঠতেন এবং অপবিত্র হলে সর্বাগ্রে পানি বইয়ে গোসল করে নিতেন নতুবা ওযু করতেন। তারপর সালাত আদায় করতেন। তাখরিজ: সুনানে নাসাঈ, হা/১৬৮০; মুসনাদে আহমাদ, হা/২৫৪৭৪; সহীহ ইবনে হিব্বান, হা/২৫৯৩
হাদিস নং-০৫
عَنْ سَعْدِ بْنِ هِشَامٍ ، عَنْ عَائِشَةَ : " أَنَّ النَّبِيَّ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ كَانَ إِذَا لَمْ يُصَلِّ بِاللَّيْلِ , مَنَعَهُ مِنْ ذَلِكَ النَّوْمُ ، أَوْ غَلَبَتْهُ عَيْنَاهُ , صَلَّى مِنَ النَّهَارِ ثِنْتَيْ عَشْرَةَ رَكْعَةً "
আয়েশা (রাঃ) থেকে বর্ণিত। যদি কখনো নবী (ﷺ) নিদ্রা বা প্রবল ঘুমের চাপের কারণে তাহাজ্জুদ আদায় করতে না পারতেন, তাহলে তিনি দিনে (চাশতের সময়) ১২ রাক’আত সালাত আদায় করে নিতেন। তাখরিজ: শারহুস সুন্নাহ, হা/৯৮৬; সহীহ ইবনে হিব্বান, হা/২৬৪৫
হাদিস নং-০৬
আয়েশা (রা.) বলেন, তিন ধরনের মানুষের জন্য রাত জাগার অনুমতি রয়েছে: বিয়ের রাতে নবদম্পতি, মুসাফির ও নফল নামাজ আদায়কারী। তাখরিজ: মুসনাদে আবি ইয়ালা-৪৮৭৯
হাদিস নং-০৭
রাসূল (ﷺ)বলেছেন , গভীর রাত পর্যন্ত জেগে থাকা ক্লান্তিকর ও বোঝাস্বরূপ। তাখরিজ: দারিমী , তাবারানী
হাদিস নং-০৮
সখর গামেদি (রা.) সূত্রে বর্ণিত, রাসুল (ﷺ) এ দোয়া করেছেন, ‘হে আল্লাহ, আমার উম্মতের জন্য দিনের শুরুকে বরকতময় করুন। ’ এ জন্যই রাসুল (ﷺ) কোনো যুদ্ধ অভিযানে বাহিনী পাঠানোর সময় দিনের শুরুতে পাঠাতেন। বর্ণনাকারী বলেন, সখর (রা.)-ও তার ব্যবসায়ী কার্যক্রম ভোরবেলা শুরু করতেন। এতে তাঁর ব্যবসায় অনেক উন্নতি হয়। তিনি সীমাহীন প্রাচুর্য লাভ করেন। -আবু দাউদ, হাদিস : ২৬০৬
হাদিস নং-০৯
প্রিয় নবী (ﷺ) ইরশাদ করেন, ‘সকালবেলায় রিজিকের অন্বেষণ করো! কেননা সকালবেলা বরকতময় ও সফলতা অর্জনের জন্য উপযুক্ত সময়। ’ -মাজমাউজ জাওয়ায়েদ, হাদিস : ৬২২০
হাদিস নং-১০
ফাতেমা বিনতে মুহাম্মদ (ﷺ) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, একদা রাসুল (ﷺ) আমার ঘরে এসে আমাকে ভোরবেলায় ঘুমন্ত অবস্থায় দেখলেন, তখন আমাকে পা দিয়ে নাড়া দিলেন এবং বললেন, মামণি! ওঠো! তোমার রবের পক্ষ থেকে রিজিক গ্রহণ করো! অলসদের দলভুক্ত হয়ো না। কেননা আল্লাহ সুবহে সাদিক থেকে সূর্যোদয় পর্যন্ত মানুষের মধ্যে রিজিক বণ্টন করে থাকেন। -আত-তারগিব ওয়াত তারহিব, হাদিস : ২৬১৬
*আসলাফ-আকাবেরদের আমল:
রাতে তাড়াতাড়ি ঘুমানো নবিদের সুন্নাত, যুগে যুগে সলফে সালিহীনদের আমল। (তবে কেহ কেহ অধিক অধ্যাবসায় এর কারণে রাত জেগেছেন, তাদের তাহাজ্জুদ-ফজর নামাজ কাযার প্রশ্নই ওঠে না)
Ø আমি জনৈক বুযুর্গ আলেমকে বলতে শুনেছি যে, তিনি যখন বিবাহ করেছেন। তখন শর্ত করেছেন যে, রাত দশটার পর তিনি জাগতে পারবেন না, সুতরাং সব কাজ তার আগেই সম্পূন্ন করতে হবে।
Ø হাকিমুল উম্মত শাহ আশরাফ আলি থানভী (রহ.)-এর খানকায় রাত দশটার পর কোন বাতি জ্বলতো না। এবং খানকার গেট বন্ধ হয়ে যেত। তাহাজ্জুদের সময় খোলা হত। একদিন ইংরেজ খেদাও আন্দোলনের মহাবীর শায়খুল হিন্দ আল্লামা মাহমুদুল হাসান দেওবন্দি (রহ.) থানাভবনে এসেছেন রাত দশটার পর, এসে দেখে খানকার গেট বন্ধ। তখন তিনি গেটের সামনে রাস্তায় শুয়ে পড়েন। তাহাজ্জুদের সময় হজরত থানভি রহ. এর সঙ্গে দেখা হয়। তখন তিনি অনেক লজ্জিত হন এবং বলেন হজরত আমাকে বললেই তো গেট খুলে দিতাম। এই আইন তো আপনার জন্য তৈরি করিনি। তখন শায়খুল হিন্দ রহ. বলেন, আপনি যে নিজাম করেছেন, তা আমি কিভাবে ভঙ্গ করি।
Ø হজরত থানভি রহ. বলেন, অনেক সময় রাতে (বা ঘুমানোর রুটিনের সময়) ঘুম আসে না। তখন ঘুম না আসলেই শুয়ে থাকলেই উপকার হবে।
Ø বড়পীর হজরত আব্দুল কাদির জিলানি রহ. বলেন, হে মানুষ! আল্লাহ তাআলা রাতকে ঘুমানোর জন্য আর দিনকে উপার্জনের সৃষ্টি করেছেন। সুতরাং এর বিপরীত করা উচিত নয়।
স্বাস্থ্য বিজ্ঞানের মতে রাতে দেরিতে ঘুমানোর ক্ষতি:
Ø বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার ক্যান্সারবিষয়ক গবেষণা বিভাগ ইন্টারন্যাশনাল এজেন্সি ফর রিসার্চ অন ক্যান্সারের তথ্য মতে, যখন সূর্যের আলো থাকে না তখন শরীরকে কাজ করতে বাধ্য করা বা জাগিয়ে রাখা শরীরে মেলাটনিন হরমোন তৈরিতে বাধা সৃষ্টি করে।
Ø যুক্তরাজ্যের সুবে বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্রোনোলজি বিভাগের অধ্যাপক জন রিচার্ডসন বলেন, ‘আমরা দেখেছি, যারা দেরি করে ঘুম থেকে ওঠে তারা নানা ধরনের মানসিক ও শারীরিক জটিলতায় ভোগে। তাদের গড় আয়ু নিয়মিত সকালে উঠা মানুষের চেয়ে সাড়ে ছয় বছর কম। ’ সূত্র: দৈনিক বাংলা নিউজ
Ø প্রধান পাঁচটি ক্ষতি:
Ø (১) মানসিক সমস্যার আশঙ্কা
Ø (২) চেহারায় মলিনতা
Ø (৩) কর্মোদ্যম কমে যাওয়া
Ø (৪) রোগ প্রতিরোধে সমস্যা
Ø (৫) দেহ ঘড়িতে বিশৃঙ্খলা। সূত্র: দি ডেইলি স্টার
নিরীক্ষণ:
প্রিয় বন্ধুগণ! পবিত্র কুরআন- হাদিস ও আমাদের মহান পূর্বসূরীদের আমলের সাথে সাথে একটু আমাদের আমল যাচাই-বাছাই, ওজন ও নিরক্ষণ করি। আজ থেকে দু’একশ বছর আগে খাবারের গুনগত মান বেশি ছিল এবং ভেজাল ছিল না। তাই এই দুর্বলের জামানায় আমাদের প্রয়োজন মাফিক রাতে তাড়াতাড়ি ঘুমাচ্ছি কি? আমরা হয়তো প্রয়োজনের তাগিদে ওঠছি কিন্তু আমার পরিবার-সন্তানরা ওঠতেছে কি? হায় আফসোস! আমাদের অনেকে রাত দশটার পর চ্যাটিং শুরু করে।
*আবেদন/পরামর্শ:
গভীর রাত পর্যন্ত জেগে থাকা আর ভোরে ঘুমে থাকা, এটা কাফেরদের নীতি, মুসলিমদের নয়। (তবে বিভিন্ন প্রয়োজনবশত রাত জাগা ভিন্ন কথা) নবি-সলফে সালেহীনদের মতআমরাও রাতে তাড়াতাড়ি (দশটার মধ্যে) বিছানায় যাওয়ার চেষ্টা করবো। নবি-মহান আসলাফ আকাবিরের পথেই মানবতার কল্যাণ নিহিত,বিশেষ করে মুসলমানদের। মহান আল্লাহ আমাদের নিজেদেরকে পরিবার-পরিজনকে তাড়াতাড়ি ঘুমানোর এই মৃত সুন্নাতকে জিন্দাহ করা তাওফিক দান করুন।