জিজ্ঞাসা-১২৩১৬
আসসালামুয়ালাইকুম ওয়া রহমাতুল্লাহ।
প্রশ্ন: বেশি বেশি মসজিদ নির্মাণ করা বিষয়ে শরিয়তের পক্ষ থেকে কোনো সীমানা বা কোনো শর্ত আছে কিনা? প্রতিটি ইউনিটে একটি করে মসজিদ হওয়ার ক্ষেত্রে ইসলামের নির্দেশনা কী ? যেখানে সৈনিকদের সময় সুযোগ ও দূরত্ব বিবেচনায় জুমাসহ পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ জামাতের সাথে আদায় সহজ হয়/ সম্ভব হয়/ অধিক লোক অংশগ্রহণ করতে সক্ষম হয় ।
উল্লেখ্য নিজ ইউনিটে মসজিদ না হলে পাশের মসজিদে গিয়ে তারা হয়ত জামাতে আদায় করবে না/ সময় হবে না/ মসজিদ সংক্রান্ত ফযিলত থেকেও বঞ্চিত হবে।
সেনানিবাসের বিবেচনা এবং সাধারণভাবে এভাবে বেশি বেশি মসজিদ নির্মাণ বিষয়ে ইসলামের নির্দেশনা কী? জানালে কৃতজ্ঞ থাকব। মহান আল্লাহ আপনার/আপনাদের দীনী খেদমতসমূহ কবুল করুন আমীন? তারিখ: ২৩/১০/২২ ঈসায়ি/ইংরেজি
হাফেজ মাওলানা সাজ্জাদ হোসেন নারায়ণগঞ্জ থেকে-----
জবাব: وعليكم السلام ورحمة الله وبركاته
نحمده ونصل على رسوله الكريم اما بعد بسم الله الرحمن الرحيم
তাসলিম ও হামদ-সানার পর প্রথম কথা হলো,
لأن المساجد إنما بُنِيَت لتجميع المسلمين لا لتفريقهم
অর্থাৎ মসজিদগুলো মুসলমানদেরকে একত্রিত করার জন্য নির্মিত হয়েছিল, তাদের বিভক্ত করার জন্য নয়। দুনিয়ার সমস্ত ফোকাহা-ওলামায়ে কেরামগণ। এ বিষয়ে একমত যে, ইসলাম ও মুসলমানের মধ্যে ফাটল-বিভেদ সৃষ্টির নতুন মসজিদ তৈরি হারাম। দলিল:
لَا تَقُمْ فِيهِ أَبَدًا ۚ لَمَسْجِدٌ أُسِّسَ عَلَى التَّقْوَىٰ مِنْ أَوَّلِ يَوْمٍ أَحَقُّ أَنْ تَقُومَ فِيهِ ۚ فِيهِ رِجَالٌ يُحِبُّونَ أَنْ يَتَطَهَّرُوا ۚ وَاللَّهُ يُحِبُّ الْمُطَّهِّرِينَ
অর্থ: তুমি এতে (মুনাফিকদের নির্মিত ইবাদতখানায়) কখনো দাঁড়িয়ো না (নামাজ পড়ো না)। প্রথম দিন থেকেই যে মসজিদের ভিত্তি স্থাপিত হয়েছে তাকওয়ার ওপর, সেটাই তোমার নামাজের জন্য অধিক যোগ্য। সুরা তাওবা-১০৮
এক মসজিদের কাছে অন্য মসজিদ নির্মাণ : মুফতি শফি (রহ.) লিখেছেন, বর্তমান যুগে কোনো মসজিদের কাছাকাছি অন্য মসজিদ নির্মাণ করা হলে এবং এর পেছনে যদি মুসলমানদের বিভক্ত করা ও আগের মসজিদে মুসল্লি হ্রাস করার অসৎ ইচ্ছা থাকে, তাহলে এতে মসজিদ নির্মাতার সওয়াব তো হবেই না, বরং বিভেদ সৃষ্টির কারণে সে গুনাহগার হবে। তা সত্ত্বেও শরিয়ত মতে, সে জায়গাকে মসজিদ বলা হবে এবং মসজিদের বিধিবিধান এর ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য হবে। একে ধ্বংস করা কিংবা আগুন লাগিয়ে জ্বালিয়ে দেওয়া জায়েজ হবে না। সূত্র: তাফসিরে মাআরেফুল কোরআন-৫৯২ পৃষ্ঠা, মাওলানা মহিউদ্দিন খান (রহ.) অনূদিত
দ্বিতীয় কথা হলো, পাঁচ সালাত আদায়ের লক্ষ্যে পাড়ায়-পাড়ায়, মহল্লায়-মহল্লায় ওয়াক্তিয়া মসজিদ নির্মাণ করা উত্তম। দলিল:
আয়েশা (রাঃ) হতে বর্ণিত, তিনি বলেন, أَمَرَ رَسُولُ اللهِ صلى الله عليه وسلم بِبِنَاءِ الْمَسَاجِدِ فِى الدُّورِ وَأَنْ تُنَظَّفَ وَتُطَيَّبَ. ‘রাসূলুল্লাহ (ﷺ) পাড়ায় পাড়ায় মসজিদ নির্মাণ করতে, তা পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন রাখতে এবং সুবাসিত করতে হুকুম দিয়েছেন’। তাখরিজ: তিরমিজি-৫৯৪; ইবনে মাজাহ-৭৫৯; আবু দাঊদ-৪৫৫
তৃতীয় কথা হলো, ইসলামে ওয়াক্তিয়া মসজিদ বেশি বেশি তৈরি করা কাম্য হলেও জুমুআর মসজিদ বেশি হওয়া কাম্য নয়। মসজিদে যিরার উদ্দেশ্য না নতুন ওয়াক্তিয়া/জুমুআর মসজিদ নির্মাণ করা জায়েজ আছে। তবে জুমুআর মসজিদ বেশি বেশি হওয়া ইসলামের সুমহান শিক্ষার খেলাফ। যেমন,
হাদিস নং-০১
عَنْ أَبِيهِ، وَكَانَ، مِنْ أَصْحَابِ النَّبِيِّ صلى الله عليه وسلم - قَالَ أَمَرَنَا النَّبِيُّ صلى الله عليه وسلم أَنْ نَشْهَدَ الْجُمُعَةَ مِنْ قُبَاءَ
অর্থ: আবদ্ ইবনু হুমায়দ ও মুহাম্মদ ইবনু মায্যাওয়ায়াহ (রহ.) কুবাবাসী জনৈক ব্যক্তি তাঁর পিতা জনৈক সাহাবী রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণনা করেন যে, তিনি বলেনঃ রাসূল (ﷺ) আমাদেরকে কুবা থেকে এসেও জুমুআয় হাযির হতে নির্দেশ দিয়েছেন। তাখরিজ: তিরমিজি-৫০১
ব্যাখ্যা: মদিনার দক্ষিণ-পশ্চিম কোণে অবস্থিত এই মসজিদ কুবা গ্রামে অবস্থিত। মসজিদে নববি থেকে এর দূরত্ব মাত্র পাঁচ কিলোমিটার। দেখুন, এতো দূরেও আলাদা জুমুআর অনুমতি দেননি। এতে প্রমাণিত হয়। জুমুআর মসজিদ কম হওয়া কাম্য।
হাদিস নং-০২
عَنْ عَبْدِ اللَّهِ بْنِ سَعِيدٍ الْمَقْبُرِيِّ عَنْ أَبِيهِ عَنْ أَبِي هُرَيْرَةَ عَنِ النَّبِيِّ صلى الله عليه وسلم قَالَ " الْجُمُعَةُ عَلَى مَنْ آوَاهُ اللَّيْلُ إِلَى أَهْلِهِ " . قَالَ فَغَضِبَ عَلَىَّ أَحْمَدُ بْنُ حَنْبَلٍ وَقَالَ لِي اسْتَغْفِرْ رَبَّكَ اسْتَغْفِرْ رَبَّكَ . قَالَ أَبُو عِيسَى إِنَّمَا فَعَلَ أَحْمَدُ بْنُ حَنْبَلٍ هَذَا لأَنَّهُ لَمْ يَعُدَّ هَذَا الْحَدِيثَ
অর্থ: আহমদ ইবনুল হাসান (রহঃ) কে বলতে শুনেছিঃ আমরা একদিন ইমাম আহমদ ইবনু হাম্বল (রহঃ)-এর নিকটে ছিলাম। উপস্থিত লোকজন জুমুআহ কার উপর ওয়াজিব এই সম্পর্কে আলোচনা তোলেন। কিন্তু ইমাম আহমদ এই বিষয়ে রাসূল (ﷺ)-এর বরাতে কিছু উল্লেখ করলেন না। আমি তখন বললামঃ এই বিষয়ে তো আবূ হুরায়রা রা. সূত্রে রাসূল (ﷺ) থেকে একটি হাদীস বর্ণিত আছে। ইমাম আহমদ বলেন, রাসূল (ﷺ) থেকে বর্ণিত আছে? আমি বললামঃ হ্যাঁ। (আহমদ ইবনুল হুসায়ন বলেন) হাজ্জাজ ইবনু নুসায়র (রহঃ) আবূ হুরায়রা রাদিয়াল্লাহু আনহু সূত্রে বর্ণিত যে, রাসূল (ﷺ) ইরশাদ করেন, যে ব্যক্তি (জুমুআর সালাত (নামায/নামাজ) শেষে) তার পরিবারে এসে রাত্রি যাপন করতে পারবে, তার উপর জুমুআহ জুরুরী। এই রিওয়ায়াত শুনে ইমাম আহমদ (রহঃ) আমার উপর রাগান্বিত হয়ে উঠলেন। বললেনঃ ইস্তিগফার কর, ইস্তিগফার কর। তাখরিজ: তিরমিজি-৫০২ মিশকাত ১৩৭৬
এ হাদিসেও জুমুআর মসজিদ কম হওয়ার ইঙ্গিত করে।
ইমাম তিরমিজি (রহ.) باب مَا جَاءَ مِنْ كَمْ تُؤْتَى الْجُمُعَةُ অর্থাৎ কতটুকু দূর থেকে জুমুআর জন্য আসা জরুরী পরিচ্ছেদ কায়েম করে উপরোক্ত হাদিসগুলো এনেছেন।
، وقول النبي صلى الله عليه وسلم في الحديث الصحيح إنَّ اللَّهَ يَرْضَى لَكُمْ ثَلاثًا، ويَكْرَهُ لَكُمْ ثَلاثًا، فَيَرْضَى لَكُمْ: أنْ تَعْبُدُوهُ، ولا تُشْرِكُوا به شيئًا، وأَنْ تَعْتَصِمُوا بحَبْلِ اللهِ جَمِيعًا ولا تَفَرَّقُوا، ويَكْرَهُ لَكُمْ: قيلَ وقالَ، وكَثْرَةَ السُّؤالِ، وإضاعَةِ المالِ. وفي رواية: مِثْلَهُ، غيرَ أنَّه قالَ: ويَسْخَطُ لَكُمْ ثَلاثًا، ولَمْ يَذْكُرْ: ولا تَفَرَّقُوا.
الراوي : أبو هريرة | المحدث : مسلم | المصدر : صحيح مسلم
الصفحة أو الرقم: 1715 | خلاصة حكم المحدث : [صحيح]
অর্থ: নবি (ﷺ) বলেছেন, আল্লাহ তোমাদের জন্য তিনটি বিষয়ে সন্তুষ্ট এবং তিনটি বিষয়ে অসন্তুষ্ট, তিনি তোমাদের প্রতি সন্তুষ্ট যে, তোমরা তাঁর ইবাদত কর এবং তাঁর সাথে কোন কিছুকে শরীক না কর, তোমরা সকলে মিলে আল্লাহর রজ্জুকে দৃঢ়ভাবে আঁকড়ে ধর এবং বিভক্ত না হও। এবং তোমরা তাদেরকে উপদেশ দাও যাদেরকে আল্লাহ তোমাদের উপর নিযুক্ত করেছেন।” তাখরিজ: মুসলিম-১৭১৫
আয়াত নং-০১,০২
ز وجل : ( وَاعْتَصِمُوا بِحَبْلِ اللَّهِ جَمِيعًا وَلَا تَفَرَّقُوا ) ، وقوله سبحانه : ( وَلَا تَكُونُوا كَالَّذِينَ تَفَرَّقُوا وَاخْتَلَفُوا مِنْ بَعْدِ مَا جَاءَهُمُ الْبَيِّنَاتُ )
হাদিস নং-০৪
আমার জানা মতে, রাসূল (ﷺ) এর যুগে মদিনার আশ-পাশে সাহাবায়ে কেরামগণ খণ্ড খণ্ড ওয়াক্তিয়া নামাজ আদায় করতেন। যেমন, নিম্নের হাদিস
عَنْ مُعَاذِ بْنِ رِفَاعَةَ الزُّرَقِيُّ: أَنَّ رَجُلًا، مِنْ بَنِي سَلِمَةَ يُقَالُ لَهُ سَلِيمٌ أَتَى رَسُولَ اللهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ , فَقَالَ: إِنَّا نَظَلُّ فِي أَعْمَالِنَا , فَنَأْتِي حِينَ نُمْسِي , فَنُصَلِّي فَيَأْتِي مُعَاذُ بْنُ جَبَلٍ , فَيُنَادَى بِالصَّلَاةِ , فَنَأْتِيهِ فَيُطَوِّلُ عَلَيْنَا. فَقَالَ لَهُ النَّبِيُّ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ: «يَا مُعَاذُ لَا تَكُنْ فَتَّانًا , إِمَّا أَنْ تُصَلِّيَ مَعِي , وَإِمَّا أَنْ تُخَفِّفَ عَنْ قَوْمِكَ»
হযরত মুয়াজ বিন রিফাআ যুরকী রা. থেকে বর্ণিত। বনী সালামার এক ব্যক্তি যার নাম ছিল সালীম। তিনি রাসূল (ﷺ) এর কাছে আসলেন। এসে বললেন, আমরা কাজকর্মে ব্যস্ত থাকি। সন্ধ্যায় ফিরে এসে সালাত আদায় করি। তখন মুয়াজ বিন জাবাল আসে। এসে সালাতের জন্য আহবান করে। তখন আমরা নামায পড়তে আসি। তখন মুয়াজ নামায অনেক দীর্ঘায়িত করে। [ফলে আমাদের অনেক কষ্ট হয়, এ অভিযোগ শুনে] তখন নবীজী (ﷺ) বললেন, হে মুয়াজ! ফিতনা সৃষ্টিকারী হইয়োনা, তুমি হয়তো আমার সাথে নামায পড়ো অথবা তোমার কওমের সাথে সংক্ষেপে সালাত পড়। তাখরিজ: তাহাবী শরীফ, হাদীস নং-২৩৬২, আল-মু’জামুল কাবীর লিততাবরানী, হাদীস নং-৬৩৯১
এ হাদিস থেকে প্রমাণ হয়, সাহাবারা মদিনার বিভিন্ন প্রান্তে পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ আদায় করতেন। কিন্তু জুমুআর সালাত শুধু মসজিদে নববিতেই হতো। ( আমার জানার বিপরীতে যদি কাহও নস জানা থাকে, তাহলে আমাকে জানালে কৃতজ্ঞ থাকবো)
প্রশ্ন: ক। প্রয়োজন হলে নতুন জুমুআর মসজিদ নির্মাণ করা জায়েজ হবে?
উত্তর: ক। হ্যাঁ, নিয়ত খারাপ না থাকলে যদি একটি মসজিদে মুসল্লির জায়গা সংকুলান না, তাহলে নতুন মসজিদ নির্মাণ করা জায়েজ, যদিও নিকটে হয়। সূত্র: আলমাবসূত, সারাখসী ২/১২০; বাদায়েউস সানায়ে ১/৫৮৬
প্রশ্ন: খ। এক মসজিদ থেকে অন্য মসজিদের দূরত্ব কতটুকু?
উত্তর: খ। পূর্বে উল্লেখ করেছি, যদি কোনো মসজিদে মুসল্লিদের স্থান সংকুলান না হয়, তাহলে আরেকটি মসজিদ নির্মাণের প্রয়োজনীয়তা দেখা দেয়। এ ক্ষেত্রে সতর্কতা হলো, এতটুকু দূরত্বে মসজিদ নির্মাণ করবে, যাতে এক ইমামের কিরাতের সঙ্গে অন্য মসজিদের ইমামের কিরাত সাংঘর্ষিক না হয়। তবে উভয় মসজিদের মাঝখানে যদি কেবল একটি দেয়াল থাকে, তবু উভয় স্থানে পৃথক জামাত আদায় করা বৈধ। সূত্র: ফতোয়ায়ে মাহমুদিয়া-১৪/৪১০
সারকথা হলো, আপনার প্রশ্নের আলোকে সেনানিবাসের বিবেচনা এবং সাধারণভাবে এভাবে বেশি বেশি মসজিদ নির্মাণ করা জায়েজ, অসুবিধা নেই (আর দূরত্ব যদি বেশি হয়, তাহলে আলাদা জুমাআর মসজিদ করতে তো অসুবিধা নেই, উত্তম হবে)। তবে ইসলামের শিক্ষা ও হিকমাহর দিকে লক্ষ্যে করে, জুমুআর জামাত যত বড়ই করা যাবে, ততই উত্তম। অর্থাৎ ছোট ছোট মসজিদগুলোতে জুমআ না পড়ে সকল লোক বড় মসজিদে একত্র হয়ে জুমআ আদায় করা উত্তম। যদি ইমাম-আলেম ওলামার সুযোগ থাকে, বিষয়টি কর্তৃপক্ষের নজরে আনা। যাতে জুমুআর মসজিদ বড় করে নির্মাণ করা হয়। সূত্র: আলইখতিয়ার ১/৮৯; শরহুল মুনইয়া ৫৫১; রদ্দুল মুহতার ২/১৪৪; ইমদাদুল ফাতাওয়া ১/৪৩৯; বাদায়েউস সানায়ে ১/৫৮৬
والله اعلم بالصو