০৬। পবিত্র কুরআন-সুন্নাহ ও মহান আসলাফ-আকাবিরের আমল বনাম আমাদের জিন্দেগি
(আখেরাতের প্রস্তুতি প্রসঙ্গে)
v পবিত্র কুরআনের বাণী-
আয়াত নং-০১
يَا أَيُّهَا الَّذِينَ آمَنُوا اتَّقُوا اللَّهَ وَلْتَنظُرْ نَفْسٌ مَّا قَدَّمَتْ لِغَدٍ وَاتَّقُوا اللَّهَ إِنَّ اللَّهَ خَبِيرٌ بِمَا تَعْمَلُونَ
অর্থ: মুমিনগণ, তোমরা আল্লাহ তা’আলাকে ভয় কর। প্রত্যেক ব্যক্তির উচিত, আগামী কালের জন্যে সে কি প্রেরণ করে, তা চিন্তা করা। আল্লাহ তা’আলাকে ভয় করতে থাক। তোমরা যা কর, আল্লাহ তা’আলা সে সম্পর্কে খবর রাখেন। সূরা হাশর-১৮
আয়াত নং-০২
بَلْ تُؤْثِرُوْنَ الْحَیٰوةَ الدُّنْیَاؗ وَ الْاٰخِرَةُ خَیْرٌ وَّ اَبْقٰی.
অর্থ: না, তোমরা তো দুনিয়ার জীবনকেই প্রাধান্য দিচ্ছ। অথচ পরকালের জীবন উৎকৃষ্ট ও চিরস্থায়ী। সূরা আলা-১৬-১৭
আয়াত নং-০৩
وَ اتَّقُوْا یَوْمًا تُرْجَعُوْنَ فِیْهِ اِلَی اللهِ ثُمَّ تُوَفّٰی كُلُّ نَفْسٍ مَّا كَسَبَتْ وَ هُمْ لَا یُظْلَمُوْنَ .
ভয় কর সেদিনকে, যেদিন তোমাদের ফিরিয়ে নেওয়া হবে আল্লাহ তাআলার কাছে। অতপর প্রতিটি প্রাণকে বদলা দেওয়া হবে- যা সে অর্জন করেছিল। তাদের প্রতি কোনো জুলুম করা হবে না। সূরা বাকারা-২৮১
আয়াত নং-০৪
یَعْلَمُوْنَ ظَاهِرًا مِّنَ الْحَیٰوةِ الدُّنْیَا وَ هُمْ عَنِ الْاٰخِرَةِ هُمْ غٰفِلُوْنَ .
তারা দুনিয়ার বাহ্যিক দিক খুব ভাল জানে। কিন্তু আখেরাতের ব্যাপারে গাফেল। -সূরা রূম-০৭
আয়াত নং-০৫
کُلُّ نَفۡسٍ ذَآئِقَۃُ الۡمَوۡتِ ؕ وَ اِنَّمَا تُوَفَّوۡنَ اُجُوۡرَکُمۡ یَوۡمَ الۡقِیٰمَۃِ ؕ فَمَنۡ زُحۡزِحَ عَنِ النَّارِ وَ اُدۡخِلَ الۡجَنَّۃَ فَقَدۡ فَازَ ؕ وَ مَا الۡحَیٰوۃُ الدُّنۡیَاۤ اِلَّا مَتَاعُ الۡغُرُوۡرِ ﴿۱۸۵﴾
প্রতিটি প্রাণী মৃত্যুর স্বাদ গ্রহণ করবে। আর ‘অবশ্যই কিয়ামতের দিনে তাদের প্রতিদান পরিপূর্ণভাবে দেয়া হবে। সুতরাং যাকে জাহান্নাম থেকে দূরে রাখা হবে এবং জান্নাতে প্রবেশ করানো হবে সে-ই সফলতা পাবে। আর দুনিয়ার জীবন শুধু ধোঁকার সামগ্রী। সূরা ইমরান-১৮৫
v হাদিসে নববি:
হাদিস নং-০১
عَنْ أبي يَعْلَى شَدَّادِ بْن أَوْسٍ عن النَّبيّ ﷺ قَالَ: الكَيِّس مَنْ دَانَ نَفْسَهُ، وَعَمِلَ لِما بَعْدَ الْموْتِ، وَالْعَاجِزُ مَنْ أَتْبَعَ نَفْسَه هَواهَا، وتمَنَّى عَلَى اللَّهِ رواه التِّرْمِذيُّ وقالَ: حديثٌ حَسَنٌ،
অর্থাৎ প্রকৃত বুদ্ধিমান ঐ ব্যক্তি যে নিজের নফসকে দমন করে এবং মৃত্যুর পরবর্তী জীবনের জন্য আমল করে। তাখরিজ: জামে তিরমিজি-২০৪৮,ইবনে মাজাহ
নোট: ইমাম তিরমিজি রহমতুল্লাহি বলেন হাদীসটির সনদ হাসান।
হাদিস নং-০২
قَالَ النَّبِيُّ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ, " نِعْمَتَانِ مَغْبُونٌ فِيهِمَا كَثِيرٌ مِنَ النَّاسِ, الصِّحَّةُ وَالفَرَاغُ
আল্লাহ তায়ালার দু’টি নেয়ামত সম্পর্কে বহু মানুষ ধোঁকায় পড়ে আছে। একটি হলো সুস্থতা অন্যটি হলো অবসর। তাখরিজ: ৬৪১২
হাদিস নং-০৩
ما الدنيا في الآخرة إلا مِثْل ما يجعل أحدكم أُصْبُعَهُ في اليَمِّ، فلينظر بِمَ يَرْجع
‘আখেরাত তথা পরকালের তুলনায় দুনিয়ার দৃষ্টান্ত ঐরূপ, যেমন তোমাদের কেউ সমুদ্রে আঙ্গুল ডুবায় এরপর দেখে তা কতটুকু পানি নিয়ে ফিরে এসেছে। তাখরিজ: মুসলিম-২৮৫৮
*আসলাফ-আকাবেরদের আমল:
হযরত বাহলুল (রহঃ) এর নসীহতমূলক ঘটনা: খলীফা হারুনুর রশীদের শাসনকালে হযরত বাহলুল (রহঃ) নামে আত্মহারা (মাযজুব) প্রকৃতির একজন বুযুর্গ ছিলেন। হারুনুর রশীদ এই বুযুর্গের সঙ্গে প্রায়ই হাস্য-কৌতুক করতেন। ইতি যদিও আত্মহারা প্রকৃতির ছিলেন কিন্তু কথাবার্তা অত্যন্ত গভীর জ্ঞানসম্পন্ন বলতেন। খলীফা হারুনুর রশীদ প্রহরীদের বলে রেখেছিলেন, এই বুযুর্গ যখন আমার সঙ্গে সাক্ষাতের জন্য আসবেন, তাকে আসতে দিবে, কোন প্রকার বাধা দিবে না। কাজেই যখনই তাঁর ইচ্ছে হত নির্বিঘ্নে দরবারে পৌঁছলেন তখন তাঁর হাতে একটি লাঠি দেখতে পেলেন। খলীফা হারুনুর রুশীদ হযরত বাহলুল (রহঃ) কে কিছুটা হাস্যচ্ছলে বললেনঃ বাহলুল সাহেব! আপনার নিকট আমার একটি অনুরোধ। তিনি বললেন, কি সেই অনুরোধ? হারুনুর রশীদ বললেন, আমি এই লাঠি আমানতরূপে আপনাকে দিচ্ছি। আপনি যদি আপনার চেয়ে নির্বোধ কাউকে দুনিয়াতে খুঁজে পান, তাহলে এটা আমার পক্ষে থেকে তাকে হাদীয়া স্বরূপ দিয়ে দিবেন। হযরত বাহলুল (রহ:) ঠিক আছে বলে সে লাঠি রেখে দিলেন। খলীফা হারুনুর রশীদ কৌতুক করে এ কথা বলতে চেয়েছিলেন যে, দুনিয়াতে আপনিই সবচেয়ে নির্বোধ। আপনার চেয়ে বোকা আর কেউ নেই। হযরত বাহলুল (রহঃ) সেই লাঠি নিয়ে চলে গেলেন।
এ ঘটনার কয়েক বছর পর হযরত বাহলুল (রহঃ) একদা জানতে পারলেন যে, খলীফা হারুনুর রশীদ মারাত্মক অসুস্থ হয়ে বিছানায় পড়ে আছেন। অনেক চিকিৎসা করা হচ্ছে কিন্তু কোন উপকার হচ্ছে না। তাই তিনি বাদশাহর সাথে সাক্ষাৎ করতে গেলেন। তিনি জিজ্ঞেস করলেনঃ আমীরুল মুমিনীন! কেমন আছেন? হারুবুর রুশীদ বললেন, আর কেমন আছি! সামনে সফর করতে হবে। হযরত বাহলুল (রহঃ) প্রশ্ন করলেন , কোথাকার সফর? বাদশাহ বললেন, আখেরাতের সফর । দুনিয়া থেকে বিদায় নেওয়ার সময় হয়েছে। হযরত বাহলুল (রহঃ) জিজ্ঞেস করলেন, কতদিন পর ফিরে আসবেন? হারুনুর রশীদ বললেন, ভাই এটা আখেরাতের সফর। এ সফর থেকে কেউ ফিরে আসে না। হযরত বাহলুল (রহঃ) বললেন, তাহলে আপনি আর ফিরে আসবেন না! আচ্ছা এ সফরের আরাম ও অন্যান্য ব্যবস্থাপনার জন্য কতজন সৈন্য-সামান্ত আগে প্রেরণ করেছেন? বাদশাহ বললেনঃ ভাই, তুমি আবার নির্বোধের মতো কথা বলছ। আখেরাতের সফরে কেউ সাথে যায় না। কোন বডিগার্ড, কোন সৈন্য, কোন লোক-লশকর সাথে নেওয়া যায় না। ঐ সফরে তো মানুষকে একাই যেতে হয়। হযরত বাহলুল (রহঃ) বললেন, এত দীর্ঘ সফর, তারপর সেখান থেকে আর ফিরেও আসবেন না, তা সত্ত্বেও আপনি কোন সৈন্য-সামান্ত পূর্বে পাঠালেন না। অথচ এর আগে আপনি যত সফর করেছেন, সকল সফরেই আরামের ও অন্যান্য ব্যবস্থাপনা করার জন্য আপনার পূর্বে বিরাট সৈন্যবাহিনী ও আসবাবপত্র প্রেরণ করা হত। এ সফরে কেন সেগুলো পাঠাচ্ছেন না? বাদশাহ বললেন, না ভাই, এ সফরেই এমন যে, এ সফরে সৈন্য-সামন্ত ও লোক-লশকর প্রেরণ করা যায় না।
হযরত বাহলুল (রহঃ) বললেন, জনাব বাদশাহ! অনেক দিন থেকে আপনার একটি আমানত আমার নিকট পড়ে আছে। আর তাহলো একটি লাঠি। আপনি সেই লাঠিটি আমাকে এ কথা বলে দিয়েছিলেন যে, যদি দুনিয়াতে তোমার চেয়ে বোকা কাউকে পাও তাহলে এটা আমার পক্ষ থেকে তাকে হাদীয়া স্বরূপ দিয়ে দিও। আমি অনেক খুঁজেছি কিন্তু আমি আমার চেয়ে বোকা একমাত্র আপনাকে ছাড়া অন্য কাউকে পাইনি। আর এটা এ জন্য যে, আমি দেখেছি আপনার ছোট থেকে ছোট সফর সামান্য সময়ের জন্য হলেও প্রায় মাসখানেক পূর্ব থেকে তাঁর প্রস্তুতি চলত। পানাহারের জিনিস্পত্র, তাঁবু, লোক-লশকর, বডিগার্ড সব কিছুই আপনার সফরের পূর্বে পাঠানো হত। আর এখন এত দীর্ঘ সফর এবং এমন সফর যেখান থেকে আর ফেরাও হবে না, তাঁর কোন প্রস্তুতি নেই। আপনার চেয়ে বোকা আমি দুনিয়াতে আর কাউকে দেখনি। কাজেই আপনাকে আমি আপনার দেওয়া আমানত ফিরিয়ে দিচ্ছি।
একথা শুনে খলীফা হারুনুর রশীদ কেঁদে ফেললেন এবং বললেন, বাহলুল, তুমি ঠিক বলেছ, সারাজীবন আমি তোমাকে বোকা মনে করেছি। কিন্তু আসল বুদ্ধিমানের মত কথা তুমিই বলেছ। আসলেই আমি আমার জীবন নষ্ট করেছি। কারণ, আখেরাতের এ সফরের কোন প্রস্তুতি নেইনি। সূত্র: ইসলাহি খুতুবাত, মরার আগে মরো-লেখক, আল্লামা তাকি উসমানি দা.বা.
নিরীক্ষণ:
প্রিয় বন্ধুগণ! পবিত্র কুরআন- হাদিস ও আমাদের মহান পূর্বসূরীদের আমলের সাথে সাথে একটু আমাদের আমল যাচাই-বাছাই, ওজন ও নিরক্ষণ করি। আমরা দুনিয়াতে টাকা অর্জিত করলে পারলে, মান-সম্মান অর্জন করতে পারলে, নিজের ছেলে-মেয়েকে উচ্চ শিক্ষিত করতে পারলে,তাদেরকে প্রতিষ্ঠিত করতে পারলে নিজেকে বুদ্ধিমান বা চালাক বা কামিয়াব মনে করছি। আসলেই আমরা কি বুদ্ধিমান? বুদ্ধিমান তো সে যে, আখেরাতের জন্য কিছু জোগার করে আর কামিয়াব তো সে, যে নিজেকে জাহান্নাম রক্ষা করতে পারলো।
আমার প্রিয় বন্ধুগণ! আমাদের দিবারাত্রির কর্মগুলো কোন দিকে ধাবিত করছে, জান্নাত না জাহান্নাম?
*আবেদন/পরামর্শ: হজরত থানভি রহ. বলেন, হে মুসলমান! প্রতিটি মুহূর্তে/কাজে এই খেয়াল করো যে, আমার এই কাজ আখেরাতের জন্য উপকারী না ক্ষতিকর। ইনশাল্লাহ এই খেয়াল বদ্ধমূল হয়ে গেলে, গুনাহ ছাড়া সহজ হবে। নফস ও শয়তানের ধোকায় আর কতকাল আমরা আল্লাহ/আখেরাত থেকে দূরে থাকবো। এখন তো কিছু করি, আল্লাহর দিকে ছুটি। নিশ্চয়ই তিনি আমাদেরকে তার রহমতের কোলে তুলে নিবেন। মহান আল্লাহ আমাকে ও সব মুসলমানকে তার নিজের জন্য কবুল করুন। আমিন!!