জিজ্ঞাসা-১২৭২১:
আসসালামু আলাইকুম ওয়া রহমাতুল্লাহ। আসসালামু আলাইকুম, মুহতারাম এমন কিছু স্থান রয়েছে যেখানে সবাই প্রবেশ করতে পারে না, যেমন সরকারি বিশেষ ব্যক্তিদের বাসবভন এলাকা। এসকল স্থানে অবস্থানরত সিকিউরিটি গার্ডদের উপর জুমার নামাজের হুকুম কি?এসকল স্থানে ছোট আকারে বাইরে থেকে ইমাম এনে তার ইমামতিতে জুমার নামাজ পড়ালে নামাজ হবে কি না? জুমার নামাজ সহিহ হওয়ার জন্য কি কি শর্ত রয়েছে? অনুগ্রহ করে জানাবেন।
তারিখ: ১৫ /০৮/২৩ ঈসায়ি/ইংরেজি
মাওলানা ইব্রাহীম, যশোর থেকে।
জবাব: وعليكم السلام ورحمة الله وبركاته
نحمده ونصل على رسوله الكريم اما بعد بسم الله الرحمن الرحيم
তাসলিম ও হামদ-সানার পর প্রথম কথা হলো, জুমুআর নামায সহিহ হবার জন্য বেশ কিছু শর্ত রয়েছে। যথা-
০১. শহর বা উপশহর হতে হবে। গ্রামে বা জনমানবহীন বিয়াবানে জুমআর নামায শুদ্ধ হবে না। দলিল:
হাদিস/আসার নং-০১
عَنْ عَلِيٍّ رَضِيَ اللَّهُ عَنْهُ قَالَ: «لَا جُمُعَةَ وَلَا تَشْرِيقَ إِلَّا فِي مِصْرٍ جَامِعٍ»
হযরত আলী রা. থেকে বর্ণিত। তিনি বলেছেন, শহর ছাড়া জুমআ ও ঈদের নামায নেই। তাখরিজ: মুসনাদে ইবনুল জা’দ, হাদীস নং-২৯৯০, তাহাবী শরীফ, হাদীস নং-১১৫৪, মুসান্নাফ আব্দুর রাজ্জাক, হাদীস নং-৫১৭৫, মারিফাতুস সুনান ওয়াল আছার, হাদীস নং-৬৩৩০, সুনানুল কুবরা লিলবায়হাকী, হাদীস নং-২৬১৫, মুসান্নাফ ইবনে আবী শাইবা, হাদীস নং-৫০৬৪
হাদিস/আসার নং-০২
عَنْ حُذَيْفَةَ، قَالَ: «لَيْسَ عَلَى أَهْلِ الْقُرَى جُمُعَةٌ، إِنَّمَا الْجُمَعُ عَلَى أَهْلِ الْأَمْصَارِ، مِثْلِ الْمَدَائِنِ»
হযরত হুযাইফা রা. থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, গ্রামে জুমআর নামায নেই। জুমআ হবে শহরে। যেমন মাদায়েন। তাখরিজ: মুসান্নাফ ইবনে আবী শাইবা-৫০৬০
০২. জামাআত হতে হবে এবং ইমাম ব্যতিত তিন জন মুসল্লি হতে হবে ( এটা ফিকহি হানাফির মত)। দলিল:
يَا أَيُّهَا الَّذِينَ آمَنُوا إِذَا نُودِيَ لِلصَّلَاةِ مِن يَوْمِ الْجُمُعَةِ فَاسْعَوْا إِلَىٰ ذِكْرِ اللَّهِ وَذَرُوا الْبَيْعَ ۚ ذَٰلِكُمْ خَيْرٌ لَّكُمْ إِن كُنتُمْ تَعْلَمُونَ [٦٢:٩
মুমিনগণ,জুমআর দিনে যখন নামাযের আযান দেয়া হয়, তখন তোমরা আল্লাহর স্মরণের পানে ত্বরা কর এবং বেচাকেনা বন্ধ কর। এটা তোমাদের জন্যে উত্তম যদি তোমরা বুঝ। সূরা জুমুআ-০৯
ব্যাখ্যা: এ আয়াতের : فَاسْعَوْا এর আল্লামা ইবনে কুদামা রহ বলেন,
وَجْهُ الدَّلالَةِ:
أنَّ قولَه: فَاسْعَوْا جاءَ بصيغةِ الجَمْعِ، فيَدخُلُ فيه الثلاثةُ
অর্থাৎ : فَاسْعَوْا শব্দটি জমার সিগাহ। সুতরাং এর মধ্যে তিন জন শামিল করে। সূত্র: আল-মুগনি-২/২৪৪
حَدَّثَنَا أَحْمَدُ بْنُ يُونُسَ، حَدَّثَنَا زَائِدَةُ، حَدَّثَنَا السَّائِبُ بْنُ حُبَيْشٍ، عَنْ مَعْدَانَ بْنِ أَبِي طَلْحَةَ الْيَعْمُرِيِّ، عَنْ أَبِي الدَّرْدَاءِ، قَالَ سَمِعْتُ رَسُولَ اللَّهِ صلى الله عليه وسلم يَقُولُ " مَا مِنْ ثَلاَثَةٍ فِي قَرْيَةٍ وَلاَ بَدْوٍ لاَ تُقَامُ فِيهِمُ الصَّلاَةُ إِلاَّ قَدِ اسْتَحْوَذَ عَلَيْهِمُ الشَّيْطَانُ فَعَلَيْكَ بِالْجَمَاعَةِ فَإِنَّمَا يَأْكُلُ الذِّئْبُ الْقَاصِيَةَ " . قَالَ زَائِدَةُ قَالَ السَّائِبُ يَعْنِي بِالْجَمَاعَةِ الصَّلاَةَ فِي الْجَمَاعَةِ .
আহমদ ইবনে ইউনুস ..... আবুদ-দারদা (রাযিঃ) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, আমি রাসূলুল্লাহ্ (ﷺ)কে বলতে শুনেছিঃ যখন কোন গ্রামে বা বনজঙ্গলে তিনজন লোক একত্রিত হয় এবং জামাআতে নামায আদায় না করে, তখন শয়তান তাদের উপর প্রভুত্ব বিস্তার করে। অতএব (তোমরা) অবশ্যই জামাআতের সাথে নামায আদায় কর। কেননা দলচ্যুত বকরীকে নেকড়ে বাঘে ভক্ষণ করে থাকে।
রাবী আস-সায়েব বলেন, এখানে জামাআত অর্থ জামাআতের সাথে নামায আদায় করা। তাখরিজ: সুনানে আবু দাউদ-৫৪৭; নাসায়ি-২/১০৬;মুসনাদে আহমদ-২১৭৫৮
তাহকীক: বিশুদ্ধ (পারিভাষিক হাসান)
এ এই হাদিস দ্বারা তিনজন প্রমাণিত হয়।
০৩. যোহরের সময় হতে হবে। অর্থাৎ জোহরের নামাজের পরিবর্তে জুমার নামাজ। সুতরাং জুমার নামাজ জোহরের নামাজের ওয়াক্তের মধ্যে পড়তে হবে। যোহরের ওয়াক্ত হওয়ার আগে বা যোহরের ওয়াক্ত চলে গেলে জুমার নামাজ শুদ্ধ হবে না। দলিল:
وقد أجمع المسلمون على أن الواجب في يوم الجمعة على الرجال الأحرار المقيمين هو صلاة الجمعة، وأنها تقوم مقام الظهر في ذلك اليوم،
অর্থাৎ সকল মুসলমান এ কথার ওপর একমত যে, জুমার দিনে মুকিম স্বাধীন পুরুষের অপর ওয়াজিব, তাহলো জুমার সালাত। নিশ্চয় তা জুম্মার দিনে জোহরের পরিবর্তে কায়েম করা হয়। সূত্র: ফিকহুল ইবাদাত,বাদউস সালাত- ১১৯৭৫৯ ( ফতোয়া নং)
০৪. সকলের জন্য আম অনুমতি থাকতে হবে। জুমার নামাজের অন্যতম উদ্দেশ্য হলো স্থানীয়ভাবে সকল মুসলমানকে একত্র করা। তাই ফোকাহায়ে কেরাম জুমার নামাজের জন্য সবার অনুমতি শর্ত করেছেন। দলিল:
الأئمة الثلاثة قالوا : تصح الجمعة في أي مكان يجتمع فيه العدد الذي تنعقد به الصلاة على اختلافهم في هذا العدد، سواء أكان هذا المسجد عامًا لكل من يريد الصلاة فيه، أو خاصًا بجماعة معينة. والإمام أبو حنيفة هو الذي اشترط أن يكون مسجداً عامًّا،
অর্থাৎ আইম্মায়ে সালাসা'র নিকট, জুমুয়ার সালাত সহীহ হওয়ার জন্য প্রয়োজনীয় সংখ্যক মুসল্লীর উপস্থিতি নিশ্চিত করা গেলেই, তাদেরকে নিয়ে যেকোন স্থানেই জুমুয়ার সালাত সংঘটিত করা যাবে। চাই সেই মসজিদটি সর্বসাধারণের জন্য উন্মুক্ত হোক, কিংবা তাতে প্রবেশাধিকার সংরক্ষিত থাকুক।
তবে ইমাম আবূ হানীফা রহ. বলেন, " জুমুয়ার সালাত সংঘটিত হওয়ার জন্য এমন মসজিদ হওয়া চাই, যেখানকার প্রবেশদ্বার সকলের জন্য উন্মুক্ত থাকবে।" সূত্র: ফিকহুল মুসলিম; তাহারাত ওয়াসসালাত-১৯৯৯
০৫. খুতবা দিতে হবে। জুমার খুতবা দেওয়া ফরজ এবং নামাজের অংশ। খুতবা জুমার নামাজ শুদ্ধ হবে না। দলিল:
يَا أَيُّهَا الَّذِينَ آمَنُوا إِذَا نُودِيَ لِلصَّلَاةِ مِن يَوْمِ الْجُمُعَةِ فَاسْعَوْا إِلَىٰ ذِكْرِ اللَّهِ وَذَرُوا الْبَيْعَ ۚ ذَٰلِكُمْ خَيْرٌ لَّكُمْ إِن كُنتُمْ تَعْلَمُونَ [٦٢:٩
মুমিনগণ,জুমআর দিনে যখন নামাযের আযান দেয়া হয়, তখন তোমরা আল্লাহর স্মরণের পানে ত্বরা কর এবং বেচাকেনা বন্ধ কর। এটা তোমাদের জন্যে উত্তম যদি তোমরা বুঝ। সূরা জুমাআ-০৯
এই আয়াতের মধ্যকার যিকরুল্লাহ দ্বারা প্রায় সকল মুফাসসিরদের মতে খুতবা উদ্দেশ্য । সূত্র: তাফসিরে রাযি ১/৪৪৬, তাফসিরে রুহুল মাআনি ২৮/১০২, তাফসিরে ইবনে আব্বাস রা.
হাদিস/আসার নং-০১
عن عمر بن الخطاب قال: كانت الجمعة اربعا فجعلت ركعتين من أجل الخطبة
হযরত উমর (রা.) বলেন, জুমু’আর নামায চার রাক’আত ছিল। এরপর খুতবার কারণে দুই রাক’আত করা হয়েছে। তাখরিজ: মুসান্নাফে ইবনে আবী শায়বাহ, হাদীস-৫৩৭৪
হাদিস/আসার নং-০২
عن عمر بن الخطاب أنه قال: إنما جعلت الخطبة مكان الركعتين
হযরত উমর রা. বলেন, জুমুআর খুতবাকে দুই রাকআত নামাযের স্থলাভিষিক্ত করা হয়েছে। তাখরিজ: মুসান্নাফ ইবনে আবী শায়বাহ, হাদীস-৫৩৬৭
প্রশ্ন: ক। যদি বিশেষ কারণে বা নিরাপত্তা স্বার্থে জনসাধারণের প্রবেশের অনুমতি না দেওয়া হয়, তাহলে জুমুআর নামাজ শুদ্ধ হবে কি?
উত্তর: ক। হ্যাঁ নিরাপত্তা জনিত কারণে যদি জনসাধারণকে মসজিদে প্রবেশ করার অনুমতি না দেয়া হয়, তাহলে জুমার নামাজ হবে। দলিল:
جاء في فقه المذاهب الأربعة ـ نشر أوقاف مصر ما نصه ـ الحنفية قالوا : لا يشترط في صحة الجمعة أن تكون في مسجد، إنما يشترط فيها الإذن العام من الإمام،
فلو أقام الإمام الجمعة في داره بحاشيته وخدمه تصح مع الكراهة، ولكن بشرط أن يفتح أبوابها، ويأذن للناس بالدخول فيها. ومثلها الحصن والقلعة، على أنه لا يضر إغلاق الحصن أو القلعة لخوف من العدو، فتصح الصلاة فيها مع إغلاقها متى كان مأذونًا للناس بالدخول فيها من قبل. وبناء على هذا تصح الجمعة في المؤسسات التي لا تسمح بدخولها إلا للعاملين بها، وذلك على رأي جمهور الفقهاء.
অর্থাৎ মিশরের ধর্মমন্ত্রণালয় কর্তৃক প্রচারিত "ফিকহুল মাযাহিবিল আরবায়া" ( চার মাজহাবের ফিকহ সংকলন) গ্রন্থে বলা হয়েছে, " জুমুয়ার সালাত শুদ্ধ হওয়ার জন্য মসজিদই হতে হবে, হানাফীগণ এমন কোন শর্তারোপ করেননা। বরং তাঁদের মতে শর্ত হলো, স্থানটি এমন হওয়া চাই, যেখানে সরকারের পক্ষ থেকে "ইযনে আম" তথা সর্বসাধারণের জন্য প্রবেশাধিকার উন্মুক্ত রয়েছে। সুতরাং সরকারপ্রধান যদি নিজের সহচর ও অধীনস্থ কর্মচারীদের নিয়ে নিজ বাসভবনে জুমুয়ার সালাত আদায় করেন, তাহলে তাদের এই সালাত মাকরূহসহ শুদ্ধ হবে। তবে শর্ত হলো, মুসল্লীদের জন্য প্রবেশপথ উন্মুক্ত করে দিতে হবে। দূর্গ, কেল্লা ও সংরক্ষিত স্থানের ক্ষেত্রেও একই বিধান প্রযোজ্য হবে। উল্লেখ্য যে, এসকল জায়গায় বহিরাক্রমণের আশংকা সর্বসময় প্রবল থাকে বিধায় সর্বসাধারণের প্রবেশাধিকার সংরক্ষিত রেখে তাতে জুমুয়ার সালাত আদায় করাতে কোন সমস্যা নেই।
উপরিউক্ত বর্ণনার আলোকে বলা যেতে পারে, সেই সকল স্থাপনা ও প্রতিষ্ঠানগুলোতে তৎসংশ্লিষ্ট কর্মকর্তা-কর্মচারীদের জুমুয়ার সালাত আদায় বৈধ হবে, যেখানে সর্বসাধারণের প্রবেশের অনুমতি নেই।
সংখ্যাগরিষ্ঠ ফকীহগণ এ বিষয়ে অভিন্ন মত ব্যক্ত করেছেন। সূত্র: ফিকহুল মুসলিম; তাহারাত ওয়াসসালাত-১৯৯৯
সারকথা হলো, আপনার প্রশ্নের আলোকে, এমন কিছু স্থান রয়েছে যেখানে সবাই প্রবেশ করতে পারে না, যেমন সরকারি বিশেষ ব্যক্তিদের বাসবভন এলাকা। এ সকল স্থানে ছোট আকারে বাইরে থেকে ইমাম এনে তার ইমামতিতে জুমার নামাজ পড়ালে নামাজ সহিহ হবে ।
والله اعلم بالصواب
উত্তর প্রদানে, মুফতি মুহাম্মাদ আব্দুর রাজ্জাক,
মুফতি আসাদুল ইসলাম তানয়িম