জিজ্ঞাসা-১৯০
আসসালামু আলাইকুম,আশা করি আল্লাহ আপনাদের সকলকে সু কৌশলে রেখেছেন, আপনাদের কাছে আমার একটি জিজ্ঞাসা: ঈদের নামাজে একই মাঠে একাধীক জামাত অনুষ্ঠীত হওয়ার ন্যায় জুমুআর নামাজেও কি একই মসজিদে 2/3 জামাত অনুষ্ঠীত হতে পারে ? অনুগ্রহ করে দলীল সহ কেউ জানালে উপকৃত হব।
মাওলানা আখতার হোসেন, যশোর থেকে--
উত্তর: ওয়ালাইকুমুস সালাম ওয়া রহমাতুল্লাহ ও বারাকাতুহ। এ বিষয়ে দুটি মত পাওয়া যায়।
১। প্রথম মত: আহলে হাদিসদের মতে একই মসজিদে দ্বিতীয়/একাধিক জামাত পড়া যাবে। তাদের দলিল:
হাদিস নং-০১
একদা হযরত আনাস রাযি. এমন এক মসজিদে গমন করলেন যেখানে জামাত হয়ে গিয়েছিলো। তখন তিনি সেখানে আযান ও ইকামত দিয়ে জামাতের সাথে নামায পড়লেন। ইলাউস সুনান ৪/২৪৮
হাদিস নং-০২
একদা এক ব্যক্তি এমন সময় মসজিদে এসে উপস্থিত হলেন যখন প্রিয় রাসূল (ﷺ) নামায পড়ে ফেলেছিলেন।তখন রসূল (ﷺ) উক্ত ব্যক্তিকে দেখে সাহাবীদেরকে বললেন, তোমাদের মধ্যে কেউ কি তার নামাযে সঙ্গ দিবে? তখন এক ব্যক্তি দাঁড়িয়ে তার সাথে নামায পড়লেন।
২। দ্বিতীয় মত: ফুকাহায়ে আহনাফের নিকটি একই মসজিদে একাধিক জামাত জায়েজ নেই। তাদের দলিল:
হাদিস নং-০১
عن أبي بکرۃ رضي اللّٰہ عنہ أن رسول اللّٰہ صلی اللّٰہ علیہ وسلم أقبل من نواحي المدینۃ یرید الصلاۃ، فوجد الناس قد صلوا، فمال إلی منزلہ فجمع أہلہ فصلی بہم۔ (رواہ الطبراني في الأوسط ۳؍۲۸۴ رقم: ۴۶۰۱، مجمع الزوائد ۲؍۴۵
کذا في إعلاء السنن ۴؍۲۶۶ بیروت
অর্থ: হযরত আবু বকর রাযি. থেকে বর্নিত প্রিয় রাসূলে কারীম (ﷺ) একদা মদীনার কোন এলাকা থেকে এসে জামাত পাননি।
তখন প্রিয় রাসূল (ﷺ) নিজ গৃহে প্রত্যাবর্তন করেন এবং পরিবারের লোকদেরকে নিয়ে গৃহে জামাত করেন। তাখরিজ: তাবারানি-২৪০১; মাজমাউয যাওয়াহিদ ১/১৬০, ইলাউস সুনান ৪/২৫২
হাদিস নং-০২
عن عبد الرحمن بن المجبر قال: دخلت مع سالم بن عبد اللّٰہ مسجد الجمعۃ، وقد فرغوا من الصلاۃ، فقالوا: ألا تجمع الصلاۃ؟ فقال سالم: لا تجمع صلاۃ واحدۃ في مسجد واحد مرتین۔ قال ابن وہب: وأخبرني رجال من أہل العلم عن ابن شہاب ویحییٰ بن سعید وربیعۃ واللیث مثلہ، کذا في المدونۃ الکبریٰ لمالک ورجالہ کلہم ثقات۔ (إعلاء السنن ۴؍۲۶۲ رقم: ۱۲۶۰ دار الکتب العلمیۃ بیروت)
অর্থ: হযরত আব্দুর রহমান বিন মুজাফফর রহ. থেকে বর্নিত, তিনি বলেন, একদা আমি সালিম বিন আব্দুল্লাহ বিন ওমর রাযি. এর সঙ্গে এক জামে মসজিদে গিয়ে দেখি সেখানে জামাত হয়ে গিয়েছে।
লোকেরা হযরত সালিম রাযি.-কে বললেন, আপনি কি দ্বিতীয়বার জামাত করবেন না?
সালিম রাযি. বললেন, একই মসজিদে একাধিক জামাত করা বৈধ নয়। তাখরিজ: ইলাউস সুনান-১২৪০, মুদাওয়ানাতুল কুবরা ১/৯৯
হাদিস নং০৩
’’عن الحسن قال: کان أصحاب رسول الله ﷺ إذا دخلوا المسجد، وقد صلي فیه، صلوافرادی‘‘. (المصنف لابن أبي شیبة، کتاب الصلاة، باب من قال: یصلون فرادی، ولایجمعون. مؤسسة علوم القرآن جدید ۵/۵۵، رقم:۷۱۸۸)
ছাহাবায়ে কেরামগন যখন মসজিদে প্রবেশ করে দেখতো যে নামাজ হয়ে গেছে,তখন একাকিই নামাজ আদায় করে নিতেন। তাখরিজ: মুসান্নাফে ইবনে আবি শায়বা-৭১৮৮
তবে শর্তাপেক্ষে জায়েজ আছে। আপনার প্রশ্নের জবাব পেতে প্রথমে মসজিদের শ্রেনী বিভাগ জানতে হবে।
৩। মসজিদের শ্রেণী বিভাগ। জামাত আদায়কারী মুসল্লিদের উপর ভিত্তি করে মসজিদ দুই প্রকার। যথা:
ক। স্থানীয় মসজিদ। অর্থাৎ যে মসজিদের ইমাম-মুয়াজ্জিন ও মুসল্লি নির্দিষ্ট।
এই মসজিদের হুকুম; وَيُكْرَهُ تَكْرَارُ الْجَمَاعَةِ بِأَذَانٍ وَإِقَامَةٍ فِي مَسْجِدِ مَحَلَّةٍ لَا فِي مَسْجِدِ طَرِيقٍ أَوْ مَسْجِدٍ لَا إمَامَ لَهُ وَلَا مُؤَذِّنَ (رد المحتار، كتاب الصلاة، باب الامامة-2/288
أَنَّهُ – عَلَيْهِ الصَّلَاةُ وَالسَّلَامُ – كَانَ خَرَجَ لِيُصْلِحَ بَيْنَ قَوْمٍ فَعَادَ إلَى الْمَسْجِدِ وَقَدْ صَلَّى أَهْلُ الْمَسْجِدِ فَرَجَعَ إلَى مَنْزِلِهِ فَجَمَعَ أَهْلَهُ وَصَلَّى» وَلَوْ جَازَ ذَلِكَ لَمَا اخْتَارَ الصَّلَاةَ فِي بَيْتِهِ عَلَى الْجَمَاعَةِ فِي الْمَسْجِدِ وَلِأَنَّ فِي الْإِطْلَاقِ هَكَذَا تَقْلِيلُ الْجَمَاعَةِ مَعْنًى، فَإِنَّهُمْ لَا يَجْتَمِعُونَ إذَا عَلِمُوا أَنَّهُمْ لَا تَفُوتُهُمْ.
وَأَمَّا مَسْجِدُ الشَّارِعِ فَالنَّاسُ فِيهِ سَوَاءٌ لَا اخْتِصَاصَ لَهُ بِفَرِيقٍ دُونَ فَرِيقٍ اهـ (رد المحتار، كتاب الصلاة، باب الامامة-2/288
স্থানীয় মসজিদগুলোতে যদি তাতে নির্ধারিত ইমাম থাকে, তাহলে স্থানীয় লোকজনের জন্য নিয়মিত দ্বিতীয় তৃতীয় জামাত করে নামাজ পড়া মাকরূহ। এতে করে মসজিদে প্রথম জামাতের গুরুত্ব কমে যায়।
কিন্তু কখনো কোনো যৌক্তিক কারণে স্থানীয় কতিপয় নিয়মিত মুসল্লিদের প্রথম জামাত ছুটে যায়, তাহলে তারা প্রথম জামাত যেখানে আদায় হয়েছে, তার চেয়ে একটু সরে এসে দ্বিতীয় জামাত পড়তে পারে। কিন্তু এটাকে কিছুতেই নিয়মিত অভ্যাসে পরিণত করা যাবে না।
খ। মসজিদটি যদি বাজার, পাবলিক প্লেস, রেল স্টেশন, বাসস্ট্যান্ড, এয়ারপোর্ট, লঞ্চঘাট ইত্যাদি জায়গার মসজিদ।
এই মসজিদের হুকুম : وتقلیل الجماعۃ مکروہ بخلاف المساجد التي علی قوارع الطریق؛ لأنہا لیست لہا أہل معروفون فأداء الجماعۃ فیہا مرۃ بعد أخریٰ لایؤدي إلی تقلیل الجماعات۔ (بدائع الصنائع ۱؍۳۸۰ المکتبۃ النعیمیۃ دیوبند)
এসব মসজিদে দ্বিতীয় জামাত করাতে কোন সমস্যা নেই। যদিও তাতে নির্ধারিত ইমাম থাকে। যেহেতু এখানে মুসাফির, কিংবা দ্রুত স্থানান্তর হতে হবে এমন যাত্রীগণ থাকেন, তাই এসব স্থানে দ্বিতীয় জামাত হওয়াতে কোন সমস্যা নেই।
তবে যদি নির্ধারিত ইমাম না থাকে, তাহলে সর্ব সুরতে দ্বিতীয় জামাত পড়াতে কোন সমস্যা নেই। সূত্র: রদ্দুল মুহতার কিতাবুস সালাত ২/২৮৮; কিতাবুন নাওয়াজেল ১৭/২৬৪
৪। আহলে হাদিস ভাইদের দলিলের জবাব :
প্রথম হাদিসের জবাব :
তাদের উল্লেখকৃত প্রথম হাদীস হলো, হযরত আনাস রাযি. নতুন করে আযান ও ইকামত দিয়ে জামাত করেছেন। এর থেকে বুঝে আসে যে, নিশ্চয় উক্ত মসজিদটি পথের ধারের মসজিদ হবে। অথবা এমন হবে যে, উক্ত মসজিদের পাশের লোক ব্যতীত অন্য কেউ আযান ব্যতীত জামাত করে গিয়েছে। তাই তিনি নতুন করে আযান ইকামত দিয়ে জামাত করেছেন। অন্যথায় যেহেতু হযরত আনাস রা. এঁর ঘটনায় অাযান ইকামাত আছে সেহেতু একাধিক জামাত করতে হলে আযান ইকামাত ছাড়া যাবে না। আর যারা একাধিক জামাতের প্রবক্তা তারাও কিন্তু নতুন করে আযান ইকামত দিয়ে দ্বিতীয় জামাত করার পক্ষপাতি নয়। কাজেই তা তাদের মনগড়া।
দ্বিতীয় হাদীসের জবাব : উক্ত হাদীস দ্বারা তাদের দাবীর স্বপক্ষে দলীল দেয়া ঠিক নয়। কারণ তাতে মুক্তাদী ছিলেন নফল নামায পড়নেওয়ালা। যিনি প্রিয় নাবী রাসূল (ﷺ) এঁর সাথে পূর্বে ফরয আদায় করে ফেলেছিলেন। আর এরূপভাবে জামাত করা তো হানাফীরাও জায়েজ বলেন। কিন্তু তাদের সাথে আহনাফের দ্বন্দ হলো, ভিন্নভাবে এমন ব্যক্তিদেরকে নিয়ে দ্বিতীয়বার জামাত করা যারা এখনো ফরয পড়েন নি।
এভাবে জায়েজ হওয়ার পক্ষে দলীল হিসাবে তারা কোন হাদীস দেখাতে পারবে না। বরং এর বিপরীত হানাফীদের অসংখ্য হাদীস রয়েছে।
একাধিক জামাতের ক্ষতিসমূহ:
(১) প্রিয় নবির (ﷺ)ও সাহাবায়ে কেরামের বিরোধিতা করা। কেননা তারা একাধিক জামাত করতেন না।
(২) প্রথম জামাতে শরীক না হওয়ার অভ্যাস গড়ে উঠা।
ফলে তা মানুষকে দিন দিন গাফলতির দিকে নিয়ে যাবে।
(৩) একাধিক জামাতের দ্বারা মানুষের মাঝে বাহ্যিক বিচ্ছিন্নতা দেখা দেয়। জামাতের অন্যতম উদ্দেশ্য মুসলমানদের মধ্যে ভ্রাতৃত্ববোধ পয়দা হওয়া।
৫। প্রশ্ন: একাদিক জামাত করার বিকল্প ব্যবস্থা আছে কি?
উত্তর: বাড়িতে বা মসজিদের সীমানার বাহিরে অন্য কোথাও জুমাআর দ্বিতীয় জামাত করা যেতে পারে।
করোনা ভাইরাসের প্রাদুর্ভাব এর কারনে বাড়িতে ৩/৪ জন একত্রিত হয়ে অন্যকে সেই জায়গায় আসার অনুমতি সাপেক্ষে সেখানে জুমাআর জামাত আদায় করা জায়েজ আছে।
তথ্যসূত্র: দারুল উলুম দেওবন্দের উর্দু ওয়েবসাইট অবলম্বনে।
والله اعلم بالصواب
উত্তর দিচ্ছেন, মুফতি মুহাম্মাদ আব্দুর রাজ্জাক (বগুড়া)