জিজ্ঞাসা-১২৭৮৩:
আসসালামু আলাইকুম ওয়া রহমাতুল্লাহ। সিজদায় মনে মনে কেন, জবানে নিজ ভাষায় বলা যাবে কিনা দয়া করে মাসয়ালা জানালে খুশি হব জাযাকাল্লাহু খাইরান।
তারিখ: ২৬/০৯/২৩ ঈসায়ি/ইংরেজি
মাওলানা আনোয়ার হোসেন সিলেট থেকে।
জবাব:
وعليكم السلام ورحمة الله وبركاته حمده ونصل على رسوله الكريم اما بعد بسم الله الرحمن الرحيم
তাসলিম ও হামদ-সানার পর প্রথম কথা হলো,
কোরআন হাদিসে বর্ণিত দোয়াগুলো সিজদায় পাঠ করা সকল ইমামের মতে জায়েজ।
তবে ফরজ নামাজে সেজদায় তাসবিহ ব্যতীত অন্য দোয়া না পড়াই উত্তম।
প্রশ্ন: ক। সিজদায় আরবি ভাষায় দুআ করা যাবে কি?
উত্তর: ক। প্রথম কথা হল, সকল ইমামের মতে আরবি ভাষায় দোয়া করা যাবে। তবে ফিকহি হানাফি শর্ত করেছেন, যেটা মানুষের কথার সাদৃশ্য রাখে, এমন দোয়া যেন না হয়। দলিল: ( ফিকহি হানাফির আরও দলিল খ নং প্রশ্ন উল্লেখ করা হবে ইনশাআল্লাহ)
والدعاء بما یشبہ کلامنا نحو: اللّٰھم ألبسني ثوب کذا أو أطعمني کذا أو أقض دیني أو أرزقني فلانۃ علی الصحیح؛ لأنہ یمکن تحصیلہ من العباد۔ (مراقي الفلاح)
দুনিয়াবি দোয়াঃ যেটা মানুষের কথার সাথে সাদৃশ্য রাখে,যেমন হে আল্লাহ আমাকে উমুক কাপড় দাও,ঐ খাবার দাও,ওই মহিলার সাথে বিবাহ দাও,আমার করজ শোধ করে দাও ইত্যাদি। সূত্র: মারাকিল ফালাহ-১৭৫; বাদায়েউস সানায়িআ-১/৫১৮
وفي الطحطاوي: وذکر في البحر عن المرغیناني ضابطاً: فقال الحاصل أنہ إذا دعا في الصلاۃ بما جاء عن القراٰن أو في الماثور لا تفسد صلا تہ، وإن لم یکن في القراٰن أو الماثور فإن استحال طلبہ من العباد لا یفسد وإلاَّ یفسد۔ (طحطاوي ۱۷۶، درمختار مع الماثور فإن استحال طلبہ من العباد لا یفسد وإلاَّ یفسد۔ (طحطاوي ۱۷۶، درمختار مع الشامي ۲؍۳۷۷ زکریا، شرح الوقایۃ ۱؍۱۶۴، حاشیۃ الطحطاوي ۳۲۱)
সারমর্মঃ কুরআন হাদীসে বর্ণিত দোয়া হলে নামাজের কোনো সমস্যা হবেনা।
কুরআন হাদীসে বর্ণিত দোয়া না হলে যদি সেটি "মানুষের কাছ থেকে চাওয়া সম্ভব হয়" জাতীয় দোয়া হয়, তাহলে নামাজ ভেঙ্গে যাবে।
অন্যথায় নামাজ ভেঙ্গে যাবেনা।
প্রশ্ন: খ। সিজদায় অনারবি তথা বাংলা/ইংরেজ ভাষায় দুআ করা জায়েয আছে কি?
উত্তর: খ। এ বিষয়ে ফকিহদের মধ্যে মতভেদ রয়েছে। যেমন,
১. হানাফি মাযহাবের মতে, সিজদায় আরবি ব্যতীত অন্য ভাষায় দোয়া করা মাকরূহ।
২. ইমাম মালেক এর মতে, সিজদায় আরবি ব্যতীত অন্য ভাষায় দোয়া করা হারাম।
৩. ইমাম শাফিয়ি ও আহমদ ইবনে হাম্বল রহ এর মতে শর্ত সাপেক্ষে জায়েজ। যেমন,
وقد فصل الشافعية الكلام فقالوا: الدعاء في الصلاة إما أن يكون مأثورا أو غير مأثور.
أما الدعاء المأثور ففيه ثلاثة أوجه:
أصحها، ويوافقه ما ذهب إليه الحنابلة: أنه يجوز بغير العربية للعاجز عنها، ولا يجوز للقادر، فإن فعل بطلت صلاته.
অর্থাৎ, শাফেয়ী মাজহাবের ফকীহগণ এ বিষয়ে সবিস্তারিত বিবরণ দিয়ে বলেন, "নামাজে পঠিত দুআগুলো হয়তো "মা'সূরা" তথা রাসূলের মুখনিঃসৃত বাক্যমালার সমন্বয়ে গঠিত হবে কিংবা নিজের মতো করে আল্লাহর কাছে মুনাজাত করা হবে।
দুআয়ে মা'সূরা দিয়ে প্রার্থনা করা অবস্থায় তাতে তিনটি মতামত রয়েছে। বিশুদ্ধতম মত হলো, আরবীতে অপারগ ব্যক্তি নিজভাষায় দুআ করতে পারবে। তবে আরবী ভাষায় সক্ষম ব্যক্তির জন্য তা করার অবকাশ নেই। এরূপ করলে তার নামাজ ভেঙ্গে যাবে।" হাম্বলী আলেমগণও এই মতের পক্ষে সমর্থন দিয়েছেন। সূত্র: আল-মাউসুআতুল ফিকহিয়া কুয়ুতিয়া-১১/১৭২
৪. শায়েখ ইবনে তাইমিয়া রহ এবং বর্তমান যুগে তার অনুসারী বলে দাবিদার আহলে হাদিসদের মতে আরবি এবং যেকোনো ভাষায় দোয়া করা জায়েজ।
প্রশ্ন: গ। ফিকহি হানাফি ও মালিকির দলিল কী?
উত্তর: গ। ফিকহি হানাফি ও মালিকির দলিল নিম্নরূপ:
হাদিস/আসার নং-০১
حَدَّثَنَا أَبُو جَعْفَرٍ، مُحَمَّدُ بْنُ الصَّبَّاحِ وَأَبُو بَكْرِ بْنُ أَبِي شَيْبَةَ - وَتَقَارَبَا فِي لَفْظِ الْحَدِيثِ - قَالاَ حَدَّثَنَا إِسْمَاعِيلُ بْنُ إِبْرَاهِيمَ، عَنْ حَجَّاجٍ الصَّوَّافِ، عَنْ يَحْيَى بْنِ أَبِي كَثِيرٍ، عَنْ هِلاَلِ بْنِ أَبِي مَيْمُونَةَ، عَنْ عَطَاءِ بْنِ يَسَارٍ، عَنْ مُعَاوِيَةَ بْنِ الْحَكَمِ السُّلَمِيِّ، قَالَ بَيْنَا أَنَا أُصَلِّي، مَعَ رَسُولِ اللَّهِ صلى الله عليه وسلم إِذْ عَطَسَ رَجُلٌ مِنَ الْقَوْمِ فَقُلْتُ يَرْحَمُكَ اللَّهُ . فَرَمَانِي الْقَوْمُ بِأَبْصَارِهِمْ فَقُلْتُ وَاثُكْلَ أُمِّيَاهْ مَا شَأْنُكُمْ تَنْظُرُونَ إِلَىَّ . فَجَعَلُوا يَضْرِبُونَ بِأَيْدِيهِمْ عَلَى أَفْخَاذِهِمْ فَلَمَّا رَأَيْتُهُمْ يُصَمِّتُونَنِي لَكِنِّي سَكَتُّ فَلَمَّا صَلَّى رَسُولُ اللَّهِ صلى الله عليه وسلم فَبِأَبِي هُوَ وَأُمِّي مَا رَأَيْتُ مُعَلِّمًا قَبْلَهُ وَلاَ بَعْدَهُ أَحْسَنَ تَعْلِيمًا مِنْهُ فَوَاللَّهِ مَا كَهَرَنِي وَلاَ ضَرَبَنِي وَلاَ شَتَمَنِي قَالَ " إِنَّ هَذِهِ الصَّلاَةَ لاَ يَصْلُحُ فِيهَا شَىْءٌ مِنْ كَلاَمِ النَّاسِ إِنَّمَا هُوَ التَّسْبِيحُ وَالتَّكْبِيرُ وَقِرَاءَةُ الْقُرْآنِ " .
মুআবিয়া ইবনুল হাকাম আস-সুলামী (রাযিঃ) থেকে বর্ণিত যে, তিনি বলেন, আমি রাসূলুল্লাহ (ﷺ) এর সঙ্গে নামায আদায় করেছিলাম। ইত্তবসরে আমাদের মধ্যে একজন হাঁচি দিল। আমি ইয়ারহামুকাল্লহ বললাম। তখন লোকেরা আমার দিকে আড় চোখে দেখতে লাগল। আমি বললাম আমার মায়ের পূত্র বিয়োগ হোক। তোমরা আমার প্রতি তাকাচ্ছ কেন? তখন তারা তাদের উরুর উপর হাত চাপড়াতে লাগল। আমি যখন বুঝতে পারলাম যে, তারা আমাকে চুপ করাতে চাচ্ছে, তখন আমি চুপ হয়ে গেলাম। রাসূলুল্লাহ (ﷺ) নামায শেষ করলেন, আমার মাতা-পিতা তাঁর জন্য কুরবান হোক! আমি তার মত এত সুন্দর করে শিক্ষা দিতে পূর্বেও কাউকে দেখিনি, তাঁরপরেও কাউকে দেখিনি। আল্লাহর কসম! তিনি আমাকে ধমক দিলেন না, মারলেন না, গালিও দিলেন না। বরং বললেন, নামাযে কথা কথাবার্তা বলা ঠিক নয়। বরং তা হচ্ছে- তাসবীহ, তাকবীর ও কুরআন পাঠের জন্য। তাখরিজ: মুসলিম -৫৩৭
ব্যাখ্যা: হাদিসের ব্যাখ্যা সম্পর্কে আশরাফ আলী থানবী রহ. বলেন,
قال العلامۃ التہانوي تحتہ: دل الحدیث علی أنہ لا یجوز في الصلاۃ شيء من کلام الناس، فتفرع علیہ أن الدعاء أیضاً إذا کان یشبہ کلامہم لا یجوز، وہو قول أبي حنیفۃ وأصحابہ وطاؤس وإبراہیم النخعي۔ (کذا في فتح الباري ۲؍۲۶۶، إعلاء السنن ۳؍۱۷۲ رقم: ۸۹۳ دار الکتب العلمیۃ بیروت)
থানবি রহঃ বলেন, উক্ত হাদীস দালালত করে যে নামাজের ভিতর দুনিয়াবি কথাবার্তা বলা জায়েজ নেই। সুতরাং দুনিয়াবি দোয়া যেটা মানুষের কথার সাথে সাদৃশ্য রাখে,সেটি বলাও জায়েজ নেই। সূত্র: ইলাউস সুনান-৩/১৭২; ফাতহুল বারি-৮৯৩
হাদিস/আসার নং-০২
عن عمر بن الخطاب 1 - رَضِيَ اللَّهُ عَنهُ - قال: (لا تعلَّموا رطانة الأعاجم، ولا تدخلوا على المشركين في كنائسهم يوم عيدهم؛ فإن السخطة تنْزل عليهم).
قال أبو عمر السمرقندي عامله الله بلطفه الخفي وكفَّ عنه شرَّ الأشرار وفتن الليل والنهار:
هذا اثر ظاهر إسناده الصحة.
- فقد أخرجه عبد الرزاق (1/ 411) وابن أبي شيبة (6/ 208) والبيهقي (9/ 234
অর্থাৎ, দ্বিতীয় খলিফা হযরত ওমর ইবনুল খাত্তাব (রাযি.) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, " তোমরা অনারবদের দুর্বোধ্য ভাষা রপ্ত করবেনা, এবং মুশরিকদের উৎসব পালনের দিনে তাদের উপাসনালয়ে প্রবেশ করবেনা। কারণ সে সময় তাদের উপর আল্লাহর ক্রোধ আপতিত হতে থাকে।"
আল্লামা আবু ওমর সামারকান্দি (রাহি.) বলেন, " এই আসার (সাহাবাদের বাণী) টির সনদ সহীহ।
তাখরিজ: মুসান্নেফে আব্দুর রাজ্জাক -১/৪১১; মুসান্নেফে ইবনে আবি শায়বা -৬/২০৮; বাইহাকি-৯/২৩৪
প্রশ্ন: ঘ। শায়েখ ইবনে তাইমিয়া রহ. এবং আহলে হাদিসের দলিল কী?
উত্তর: ঘ। শায়েখ ইবনে তাইমিয়া রহ. এবং আহলে হাদিসের দলিল নিম্নরূপ:
وَحَدَّثَنَا هَارُونُ بْنُ مَعْرُوفٍ، وَعَمْرُو بْنُ سَوَّادٍ، قَالاَ حَدَّثَنَا عَبْدُ اللَّهِ بْنُ وَهْبٍ، عَنْ عَمْرِو بْنِ الْحَارِثِ، عَنْ عُمَارَةَ بْنِ غَزِيَّةَ، عَنْ سُمَىٍّ، مَوْلَى أَبِي بَكْرٍ أَنَّهُ سَمِعَ أَبَا صَالِحٍ، ذَكْوَانَ يُحَدِّثُ عَنْ أَبِي هُرَيْرَةَ، أَنَّ رَسُولَ اللَّهِ صلى الله عليه وسلم قَالَ " أَقْرَبُ مَا يَكُونُ الْعَبْدُ مِنْ رَبِّهِ وَهُوَ سَاجِدٌ فَأَكْثِرُوا الدُّعَاءَ " .
আবু হুরায়রা (রাযিঃ) থেকে বর্ণিত। রাসূলুল্লাহ (ﷺ) বলেছেন, সিজদার অবস্থায়ই বান্দা তার রবের অধিক নিকটবর্তী হয়ে থাকে। অতএব, তোমরা (সিজদায়) অধিক পরিমাণ দুআ পড়বে। তাখরিজ: সহীহ মুসলিম- ৪৮২
সারকথা হলো, চার ইমামের কারও নিকট অনারাবি ভাষায় দুআ করা সরাসরি জায়েজ নয়। শুধু শায়েখ ইবনে তাইমিয়া রহ এর মতের উপর আমল করা নিরাপদ নয়।
হাদীসে যেসব বর্ণনা আছে, তা খুব বড় আলেম ও মুহাক্কেক ব্যক্তিদের কাজ। সাধারণ মানুষের প্রচলিত পদ্ধতিতেই সীমাবদ্ধ থাকা উচিত। তা না হলে মুস্তাহাব বা জায়েজ আমল করতে গিয়ে, তারা নিয়ম ভেঙ্গে ফেলবেন। তাতে নামাজ নষ্ট হওয়ারও আশংকা থেকে যায়।
والله اعلم بالصواب
উত্তর প্রদানে, মুফতি মুহাম্মাদ আব্দুর রাজ্জাক