জিজ্ঞাসা-১২৭৬৭:
আসসালামু আলাইকুম ওয়া রহমাতুল্লাহ। আচ্ছালামু আলাইকুম, মুহতারাম, যদি কোন কোন ব্যাক্তি তাঁর স্ত্রীকে তালাক দিয়ে দেন, ঐ মহিলা অন্য স্থানে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হয়েছেন, জানার বিষয় হল ঐ মহিলার প্রথম স্বামীর সন্তান তার নানা বাড়ির মায়ের সম্পত্তির অংশ পাবে কি না। আচ্ছালামু আলাইকুম ।
তারিখ: ১৯/০৯/২৩ ঈসায়ি/ইংরেজি
মাওলানা সাইফুল ইসলাম ভোলা থেকে।
জবাব:
وعليكم السلام ورحمة الله وبركاته حمده ونصل على رسوله الكريم اما بعد بسم الله الرحمن الرحيم
তাসলিম ও হামদ-সানার পর প্রথম কথা হলো, একজন নারী প্রথম সংসারের স্বামীর মৃত্যু কিংবা বিচ্ছেদের কারণে যখন দ্বিতীয় স্বামীর সাথে ঘর সংসার করা শুরু করে, তখনও কিন্তু সেই মহিলা তার প্রথম সংসারের সন্তানদের কাছেও পূর্বেকার ন্যায় মমতাময়ী মা হিসেবেই বিবেচিত হয়ে থাকেন। সেই মোতাবেক সেই নারীর পিতাও সন্তানদের কাছে পূর্বেকার ন্যায় নানা হিসেবেই বিবেচিত হবে।
মাতাপিতার দাম্পত্য জীবনের টানাপোড়েন কিংবা বিচ্ছেদের বিরূপ প্রভাব প্রথম ঘরের সন্তানদের মাঝে (মনস্তাত্ত্বিকভাবে পড়লেও) বিধানগতভাবে নানা-নাতির সম্পর্কের মাঝে কোন প্রকার ফাটল সৃষ্টি করবেনা।
এবার আসা যাক, মীরাস বা উত্তরাধিকার প্রাপ্তি প্রসঙ্গে! নাতীর মীরাসপ্রাপ্তির বিষয়টি একটু ব্যাখ্যা সাপেক্ষ।
(১) সে যদি মেয়ের ঘরের নাতী হয়ে থাকে, তাহলে সেই নাতী তার নানার থেকে সরাসরি মীরাসী সম্পত্তি লাভ করবেনা। কারণ
নানার সাথে নাতীর উত্তরাধিকার প্রাপ্তির কোন যোগসূত্র নেই। কারণ উভয়ের মাঝে আত্মীয়তার সম্পর্ক স্থাপনে নারীর (তথা মায়ের) উপস্থিতি রয়েছে। ইলমুল ফারায়েযের পরিভাষায় তাঁকে جَدٌّ فَاسِد বলে। এই প্রকার جَدّ এর সংজ্ঞা হলো নিম্নরূপ-
الجد الفاسد : هو من تتوسط بينه و بين الميت أنثى مثل أبي الأم، و أبي أبي الأم، و هو من ذوي الأرحام. ( معجم المصطلحات الفقهية٦٧٩/ ١)
অর্থাৎ, এই প্রকার ব্যক্তি হলেন তিনি, যার সাথে আত্মীয়তা স্থাপনে নারীর উপস্থিতি রয়েছে। যেমন- মাতামহ বা নানা। কারণ নানার সাথে নাতীর সম্পর্ক স্থাপনে মায়ের যোগসাজশ বা মধ্যস্থতা রয়েছে। অনুরূপভাবে প্রমাতামহ বা পরনানার ক্ষেত্রেও একই বিধান প্রযোজ্য। তারা যাবিল আরহামের অন্তর্ভুক্ত। ( ফিকহি পরিভাষার অভিধান- ৬৭৯/১)
উল্লেখ্য যে جَدّ فاسِد (মাতামহ) বা নানার থেকে নাতীগণ সরাসরি মীরাস লাভ করে থাকেনা। বরং মায়ের ভায়া হয়ে তারা মীরাসী সম্পত্তি পেয়ে থাকে। অর্থাৎ, নানার কন্যা হিসেবে মা প্রথমে সম্পত্তি প্রাপ্য হবেন। তারপর মায়ের সন্তান হিসেবে প্রথম ঘরের ও দ্বিতীয় ঘরের সন্তানগণ তাঁর মৃত্যুর পর আল কুরআনের বিধান মোতাবেক সমহারে উত্তরাধিকার সম্পদ লাভ করবেন।
ইস্তাম্বুল ইউনিভার্সিটির শরীয়াহ ফ্যাকাল্টির ডীন প্রফেসর ড. আব্দুল আযীয বায়ান্দার ( হাফি.) বলেন,
الأبناء يرثون أمهم سواء بقيت زوجة لأبيهم أم تزوجت بعد الطلاق منه أو بعد وفاته، فهي أمهم في كل وقت، فإن ماتت يرثها أبناؤها جميعا سواء الذين من زوجها الأول أو الثاني، حيث لا فرق بينهم بالنسبة لها، كما أنه لا فرق بين إن كان مصدر تركتها ما ورثته من زوجها الأول أم الثاني، ذلك أن الميراث يعد من وسائل التملك الصحيح. ( مركز بحوث الدين والفطرة)
অর্থাৎ, সকল সন্তানগণ তার মায়ের ওয়ারিশ হিসেবে মীরাসী সম্পত্তি লাভ করবে। এক্ষেত্রে তার জন্মদানকারী পিতার সাথে মায়ের বৈবাহিক সম্পর্ক বলবৎ থাকুক, কিংবা (মৃত্যু /তালাকের কারণে) না থাকুক- এবিষয়টি বিবেচ্য নয়। কারণ নিজের জন্মদাতা পিতার সাথে সেই নারীর সম্পর্ক থাকলেও তিনি তার মা, না থাকলেও তিনিই তার মা। সুতরাং সেই নারী মৃত্যুর পর তার উভয়ঘরের সন্তানগণ সমহারে মায়ের সম্পত্তির ওয়ারিশ বলে গণ্য হবে। অর্থাৎ মায়ের মৃত্যুর পর প্রত্যেক সন্তানই তাঁর মায়ের ওয়ারিস হয়ে থাকে।
فلو لم تترك المتوفاة من الورثة غيرهما فإنهما يرثان كل التركة مناصفة بينهما.
দুই ঘরের দুই সন্তান রেখে যদি মা ইন্তিকাল করেন। আর কোন ওয়ারিশ যদি বিদ্যমান না থাকে, তাহলে উভয় সন্তান অর্ধেক অর্ধেক করে সমুদয় সম্পত্তির ওয়ারিশ হবে।
(২) পক্ষান্তরে নাতী যদি ছেলের ঘরের হয়ে থাকে, তাহলে সেই নাতী তার দাদার থেকে সরাসরি মীরাসী সম্পত্তি লাভ করবে। তবে শর্ত হলো, তার পিতা কিংবা চাচাদের কেউ জীবিত না থাকতে হবে। পিতা যদি জীবিত থাকে, তাহলে প্রথমে পিতা দাদার ওয়ারিশ হবে, তারপর ছেলে পিতার ওয়ারিশ হবে। এই প্রকার দাদাকে ইলমে ফারায়েজের পরিভাষায় جَدّ صَحِيْح বলে।
এই প্রকার جَدّ এর সংজ্ঞা দিতে গিয়ে ইলমুল ফারায়েজের জগদ্বিখ্যাত কিতাব سراجي في الميراث এ বলা হয়েছে-
والجد الصحيح هو الذي لا تدخل في نسبته إلى الميت أم
অর্থাৎ, এই প্রকার ব্যক্তি হলেন তিনি, যার সাথে আত্মীয়তা স্থাপনে মায়ের উপস্থিতি নেই। যেমন- পিতামহ বা দাদা। কারণ দাদার সাথে নাতীর সম্পর্ক স্থাপনে পিতার যোগসাজশ বা মধ্যস্থতা রয়েছে। আর পিতা হলেন পুরুষ, নারী নন।অনুরূপভাবে পরদাদার ক্ষেত্রেও একই বিধান প্রযোজ্য।
তবে এজাতীয় অনাথ অসহায় বালকদেরকে স্বাবলম্বী করার ক্ষেত্রে ইলমে ফিকহের উজ্জ্বল নক্ষত্র আল্লামা সালেহ আল ফাউযান ( রাহি.) একটা গুরুত্বপূর্ণ পরামর্শ দিয়েছেন। তিনি বলেন,
أن يوصي لهم الجد قبل وفاته بالثلث من تركته أو أقل، وهذا في حال أن يكون له مال كثير، وهذه الوصية أوجبها بعض العلماء واستحبها كثيرون.
ودليل هذا قوله تعالى: (كُتِبَ عَلَيْكُمْ إِذَا حَضَرَ أَحَدَكُمُ الْمَوْتُ إِنْ تَرَكَ خَيْرًا الْوَصِيَّةُ لِلْوَالِدَيْنِ وَالأَقْرَبِينَ بِالْمَعْرُوفِ حَقًّا عَلَى الْمُتَّقِينَ) البقرة/١٨٠.
(التحقيقات المرضية في المباحث الفرضية» لفضيلة الشيخ صالح الفوزان)
অর্থাৎ, দাদাজান যদি বিপুল ধনৈশ্বর্যের মালিক হয়ে থাকেন, তাহলে তিনি মৃত্যুর আগেই তার সমুদয় সম্পত্তির এক তৃতীয়াংশ সীমারেখার মাঝে একটি পরিমাণ তার এই অসহায় নাতীর নামে ওয়াসিয়ত বা উইল করে যাবেন। কারণ প্রতিটি ব্যক্তি নিজ সম্পদের সর্বোচ্চ একতৃতীয়াংশ পরিমাণ সম্পত্তির ওয়াসিয়ত করার অধিকার রাখে। কতক ফকীহগণ এই ওয়াসিয়াত করাকে নিম্নোক্ত আয়াতের আলোকে অবশ্য কর্তব্য বলে অভিমত ব্যক্ত করেছেন। আবার কেউকেউ এটিকে মুস্তাহাব বলেছেন। আল্লাহ তায়ালা বলেন -
তোমাদের কারো যদি মৃত্যুর সময় ঘনিয়ে আসে,তাহলে সে যদি অঢেল সম্পত্তি রেখে যায়, তাহলে তার জন্য আবশ্যক হলো যে, সে যেন নিজ পিতামাতা এবং নিকটাত্মীয়গণের জন্য অসিয়ত করে যায়। মুত্তাকী ব্যক্তিদের জন্য এটি অবশ্যকর্তব্য। ( সূরা বাক্বারা - ১৮০)
আলোচ্য আয়াতের ব্যাখ্যায় আল্লামা মুহাম্মাদ বিন সালেহ আল উসাইমিন ( রাহি.) বলেন,
من فوائد الآية: وجوب الوصية للوالدين والأقربين لمن ترك مالًا كثيرًا؛ لقوله تعالى: (كتب عليكم)؛ واختلف العلماء ﵏ هل هذا منسوخ بآيات المواريث أم هو محكم، وآيات المواريث خَصَّصَتْ؟ على قولين؛ فأكثر العلماء على أنه منسوخ؛ ولكن القول الراجح أنه ليس بمنسوخ؛ لإمكان التخصيص؛ فيقال: إن قوله تعالى: (للوالدين والأقربين) مخصوص بما إذا كانوا وارثين؛ بمعنى أنهم إذا كانوا وارثين فلا وصية لهم اكتفاءً بما فرضه الله لهم من المواريث؛ وتبقى الآية على عمومها فيمن سوى الوارث ... ( التحقيقات المرضية في المباحث الفرضية لفضيلة الشيخ صالح الفوزان - ٦٥ ، ١٢٥،)
আয়াতের প্রারম্ভিক অংশ থেকেই বিধানটির আবশ্যিক অপরিহার্যতা অনুমিত হয়। তবে অধিকাংশ মুফাসসিরগণ মনে করেন, সূরা নিসার ১১নং আয়াত তথা আয়াতুল মীরাসের মাধ্যমে এই আয়াতের অসিয়তের বিধানটি মানসুখ (রহিত) হয়ে গিয়েছে। কিন্তু গ্রহণযোগ্য মত হলো, আয়াতের বিধানটির কার্যকারিতা আজো বলবৎ রয়েছে। তবে মীরাসের আয়াতটির মাধ্যমে এই আয়াতের ব্যাপকতায় খানিকটা সংকোচন এসেছে মাত্র, আর কিছু নয়। সুতরাং উভয় আয়াতের মাঝে تطبيق বা সমন্বয় সাধন করে এভাবে বলা যেতে পারে যে, পিতামাতা সহ যে সকল নিকট আত্মীয় মীরাসের আয়াতের মাধ্যমে উত্তরাধিকার লাভ করবেন, তাদের জন্য অসীয়ত করা চলবেনা। কারণ মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন,
عن أنس بن مالك ان رسول الله صلى الله عليه وسلم : إنَّ اللَّهَ قد أعطى كلَّ ذي حقٍّ حقَّهُ ألا لا وصيَّةَ لوارِثٍ ( رواه ابن ماجه - ٢٢١١)
অর্থাৎ, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন, আল্লাহ তায়ালা প্রত্যেক ব্যক্তির যথাযথ প্রাপ্য (আয়াতুল মীরাসের মাধ্যমে) বুঝিয়ে দিয়েছেন। সুতরাং ওয়ারিশদের জন্য আলাদাভাবে আর অসিয়ত করা যাবেনা ( সুনানে ইবনে মাজাহ -২২১১)
কিন্তু যে সকল ব্যক্তিবর্গ ওয়ারিশ নন, কিন্তু অত্যন্ত ঘনিষ্টতম নিকটাত্মীয়, তাদের জন্য অসিয়ত করার বিধান অদ্যবধি বলবৎ আছে।
আর সেই অসিয়াতের সীমারেখা সমুদয় সম্পত্তির এক তৃতীয়াংশের মাঝেই সীমাবদ্ধ রাখা চাই। এপ্রসঙ্গে মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন,
الثُّلُثُ؛ وَالثُّلُثُ كَثِيرٌ - أَوْ كَبِيرٌ - إِنَّكَ أَنْ تَذَرَ وَرَثَتَكَ أَغْنِيَاءَ، خَيْرٌ مِنْ أَنْ تَذَرَهُمْ عَالَةً يَتَكَفَّفُونَ النَّاسَ ( متفق عليه)
অর্থাৎ, সা'দ বিন ওয়াক্কাস একবার প্রচণ্ড রোগে আক্রান্ত হয়ে শয্যাশায়ী হয়ে পড়েন। তখন মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তাকে দেখতে গেলে তিনি নবীজির কাছে সমুদয় সম্পত্তি অসিয়ত করে দেয়ার মনোবাসনা প্রকাশ করলেন। তখন নবীজি বলেছিলেন, "অসিয়ত যদি করতেই হয়, তাহলে অসিয়তের পরিমাণ এক তৃতীয়াংশের মাঝে সীমিত রাখবে। বরং এই এক তৃতীয়াংশ পরিমাণও ঢের বেশী হয়ে যায়। কারণ তুমি নিজের উত্তরাধিকারীদেরকে দারিদ্রের কষাঘাতে জর্জরিত পরমুখাপেক্ষী না বানিয়ে নির্মুখাপেক্ষী স্বাবলম্বী অভাবমুক্ত করে রেখে যাওয়াটা হলো সর্বাধিক উত্তম।" (সহীহ বুখারী - ১২৯৫, সহীহ মুসলিম - ৪১০১)
সেই মোতাবেক নাতী যেহেতু নিকটাত্মীয়, কিন্তু ওয়ারিশদের তালিকাভুক্ত নয়, তাই তার অনুকূলে নানাজান অসিয়ত করে যেতে পারেন।
সারকথা হলো, উক্ত মহিলার উভয়ঘরের কোন সন্তানই তাদের নানার থেকে সরাসরি উত্তরাধিকার লাভ করবেনা। বরং নানার ওয়ারিশ হিসেবে তাদের মা প্রথমে উত্তরাধিকার সম্পদ লাভ করবেন। পরবর্তীতে মায়ের তিরোধানের পর ওয়ারিশ হিসেবে উভয়ঘরের সন্তানগণ সমহারে উত্তরাধিকার লাভ করবেন। প্রথম সংসারের স্বামী বিচ্ছেদের কারণে প্রথম ঘরের সন্তানগণ স্বীয় জননী হতে প্রাপ্য মীরাস থেকে বঞ্চিত হবেনা।বরং উভয়পক্ষই সমহারে মীরাসের হকদার হবে। তবে মায়ের জীবদ্দশায় সরাসরি নানার থেকে তারা মীরাস লাভ করবেনা। তবে নানা চাইলে নাতীর অনুকূলে অসীয়ত করে যেতে পারবে। আলোচ্য মাসআলার ক্ষেত্রে বরং তা একাধারে উত্তম, কল্যাণকর, প্রশংসনীয় ও ইতিবাচক কর্মও হবে বটে।
والله اعلم بالصواب
উত্তর প্রদানে, মুফতি মুহাম্মাদ আব্দুর রাজ্জাক