ইমাম আবু হানিফা রহঃএর হাদিস শাস্ত্রে তার অবদান ও লিখিত কিতাব।
-------------------------------------
আমাদের অনেক ভাই নাজেনে বলে ইমাম আবু হানিফা রহঃ হাদিস জানতেন না তাঁর কোনো লিখিত হাদিস গ্রন্হ নেই, তাদের উদ্দেশ্যে পোস্ট।
ইমামে আযম
ইমাম আবু হানিফা
উপাধি ইমাম আযম
জন্ম নোমান বিন সাবিত
সেপ্টেম্বর ৫, ৬৯৯ খ্রিস্টাব্দ/ শাবান ৪, ৮০ হিজরী
কুফা, উমাইয়া খিলাফত
মৃত্যু ১৪ জুন ৭৬৭ (বয়স ৬৭)/ ১৫০ হিজরী
বাগদাদ আব্বাসীয় খিলাফত
মৃত্যুর কারণ কারাগারে নির্যাতন (কারো মতে বিষপ্রয়োগ)
জাতীয়তা কুফী
জাতিভুক্ত পারসিক (ফার্সি)
যুগ হিজরী প্রথম শতাব্দী
পেশা হানাফি ফিকহের ইমাম
সম্প্রদায় ইমাম মুহাম্মদ, ইমাম আবু ইউসুফ
মাজহাব স্বতন্ত্র মুজতাহিদ
মূল আগ্রহ ফিকহ
উল্লেখযোগ্য ধারণা কিয়াস, ইসতিহসান
লক্ষণীয় কাজ হানাফি মাযহাব প্রতিষ্ঠা, ফিকহশাস্ত্রের উন্নয়ন
যাদের দ্বারা প্রভাবিত হয়েছেনঃ হাম্মাদ বিন আবু সুলাইমান আল-আশআরী
আনাস ইবনে মালেক
আলক্বামা
ইবরাহিম নাখায়ী
যাদেরকে প্রভাবিত করেছেনঃ ইমাম শাফিঈ,ইমাম মুহাম্মদ
ইমাম আবু ইউসুফ
ইমাম যুফার
ইমাম ত্বাহাবী
ইরাকের বাগদাদে অবস্থিত আবু হানিফা মসজিদ
নোমান ইবনে সাবিত ইবনে যুতা ইবনে মারযুবান (৬৯৯ — ৭৬৭/ ৮০ — ১৪৮ )(: نعمان بن ثابت بن زوطا بن مرزبان), উপনাম ইমাম আবু হানিফা নামেই অত্যধিক পরিচিত, ছিলেন ফিকহশাস্ত্রের একজন প্রখ্যাত বিশেষজ্ঞ এবং হিজরী প্রথম শতাব্দীর একজন গুরুত্বপূর্ণ ইসলামী ব্যক্তিত্ব। ইসলামী ফিকহের সর্বাধিক প্রসিদ্ধ ও পরিচিত চারটি সুন্নি মাযহাবের একটি “হানাফি মাযহাব”-এর প্রধান ব্যক্তিত্ব ছিলেন তিনি।
জন্ম, নাম ও বংশধর
উমাইয়া খলিফা আবদুল মালিক ইবনে মারওয়ানের রাজত্বকালে ইমাম আবু হানিফা ইরাকের কুফা নগরীতে জন্মগ্রহণ করেন। তার ছয় বছর বয়সে আবদুল মালিক মৃত্যুবরণ করেন। ষোল বছর বয়সে তিনি পিতার সাথে হজ্জে গিয়েছিলেন তার পিতা সাবিত বিন যুতা কাবুল, আফগানিস্তানের একজন ব্যবসায়ী ছিলেন। তার পিতার বয়স যখন ৪০ বছর তখন আবু হানিফা জন্মগ্রহণ করেন। বংশধরের দিক থেকে তাকে অ-আরবীয় বলে ধরা হয়ে থাকে কারণ তার দাদার নামের শেষে যুতা। প্রখ্যাত মুসলিম ইতিহাসবিদ খতীবে বাগদাদী আবু হানিফার নাতি ইসমাইল বিন হামাদের বক্তব্য থেকে আবু হানিফার বংশ ব্যাখা দেন। অন্য আরেক ইতিহাসবিদ হামাদ আবু হানিফাকে পারসিক বংশ্বদ্ভূত বলে দাবি করেন। আবু হানিফার বংশ নিয়ে অনেক ব্যাখ্যা পাওয়া যায় তবে সবচেয়ে বেশি পরিচিত ও নির্ভরযোগ্য মত হলো তিনি কাবুলের পারসিক বংশদ্ভূত।
শিক্ষা
প্রথমত তিনি কুফা শহরেই ইলমে কালাম শিক্ষা করেন। ২০ বছর বয়সে তিনি ইলমে দ্বীন শিক্ষার প্রতি মনোনিবেশ করেন। ইলমে আদব ও ইলমে কালাম শেখার পর তিনি ইলমে ফিকহ অর্জনের জন্য সমকালীন ফকিহ ইমাম হাম্মাদ (রহ.)-এর শিক্ষাগারে অংশগ্রহণ করেন। ইমাম হাম্মাদ (রহ.) ছিলেন তার বিশেষ ওস্তাদ। তিনি ছাড়াও তার গুরুজনের সংখ্যা ছিল প্রায় চার হাজার।
প্রাথমিক জীবন বা ব্যবসায়িক জীবন
ইমাম আবু হানিফার রহ. প্রাথমিক জীবন কেমন ছিল এ বিষয়ে ঐতিহাসিকগণ বেশীকিছু উদ্ধৃত করেননি। তিনি ছিলেন একজন প্রসিদ্ধ কাপড় ব্যবসায়ী। ইমাম আবু হানিফার পৈত্রিক পেশা ছিল কাপড়ের ব্যবসা। ইরান থেকে শুরু করে ইরাক, সিরিয়া ও হেজায পর্যন্ত বিস্তৃত অঞ্চলব্যপী বিপুল পরিমণ মুল্যবান রেশমী কাপড়ের আমদানী ও রফতানী হতো। পৈত্রিক এই ব্যবসার সুবাদেই তিনি প্রচুর বিত্তের মালিক ছিলেন। তৎকালীন বিশিষ্ট ওলামাগণের মধ্যে সম্ভবত তিনিই ছিলেন প্রথম ব্যক্তি যিনি রাস্ট্রীয় পৃষ্টপোষকতা বা বিত্তবানদের হাদীয়া-তোহফা প্রাপ্তির পরোয়া না করে নিজ উপার্জনের দ্বারা জীবিকা নির্বাহ, এলেমের সেবা এবং তার নিকট সমবেত গরীব শিক্ষার্থীদের যাবতীয় ব্যয়ভার নির্বাহ করার ব্যবস্হা করতেন। ১৬ বছর বয়সে তিনি পিতৃহারা হন। পিতা ছিলেন একজন প্রতিষ্ঠিত ব্যাবসায়ী । তার মৃত্যুর পর এই ব্যাবসার দায়িত্ব নিতে হয় যুবক ইমাম আবু হানিফাকে। (আল ফিকহুল আকবার, ভূমিকা, ইমাম আবু হানিফার জীবন ও কর্ম, ইসলামিক ফাউণ্ডেশন)।
তার অসামান্য দক্ষতা ও নিষ্ঠায় ব্যাবসা প্রসারিত করার পাশাপাশি কাপড় তৈরির এক কারখানা স্থাপন করেন। যা কিছু দিনের মধ্যেই অনন্য হয়ে ওঠে। ব্যবসায় তার সততার পরিচয় পেয়ে দিগ্বিদিক থেকে লোকেরা তার দোকানে ভিড় জমাতেন। এভাবে তিনি জন মানুষের কাছে ব্যাপকভাবে পরিচিত লাভ করলেন। ইমাম শাবী রহ. তাকে ইলমের ব্যাপারে উৎসাহিত করার আগ পর্যন্ত তিনি এ ব্যবসাকেই নিজের ক্যারিয়ার হিসেবে নিয়েছিলেন। (উসুলুদ্দিন ইনদা আবি হানিফা, পৃষ্ঠা- ৬৬)
ব্যবসা জীবন থেকে শিক্ষা জীবনে পদার্পণ
কিশোর বয়স থেকেই ইমাম সাহেব পিতার ব্যবসার কাজে যোগ দিয়েছিলেন। ব্যবসায়ীক কাজেই তাকে বিভিন্ন বাজার ও বাণিজ্য কেন্দ্রে যাতায়াত করতে হতো। ঘটনাচক্রে একদিন ইমাম শাবীর রহ. সাথে তার সাক্ষাত হয়ে যায়। প্রথম দর্শনেই ইমাম শাবী আবু হনীফার নিষ্পাপ চেহারার মধ্যে প্রতিভার স্ফুরণ লক্ষ করেছিলেন।
তিনি জিজ্ঞেস করলেন, হে বৎস! তুমি কি কর? এ পথে তোমাকে সব সময় যাতায়াত করতে দেখি? ইমাম সাহেব জবাব দিলেন, আমি ব্যবসা করি। ব্যবসার দায়িত্ব পালনার্থেই ব্যবাসায়ীদের দোকানে দোকানে আমাকে যাওয়া-আসা করতে হয়। ইমাম শাবী রহ. পুনরায় জিজ্ঞেস করলেন, এটা তো তোমার লেখাপড়ার বয়স। কোন আলেমের শিক্ষায়তনেও কি তোমার যাতায়াত আছে? আবু হানিফা সরলভাবেই জবাব দিলেন, সেরূপ সুযোগ আমার খুব কমই হয়। কিছুক্ষণ আলাপ-আলোচনার মাধ্যমেই ইমাম শাবী আবু হানিফাকে জ্ঞানার্জনে মনোযোগী হওয়ার প্রতি আগ্রহী করে তুললেন। ইমাম আবু হানিফা বলেন, ইমাম শাবীর রহ সেই আন্তরিকতাপূর্ণ উপদেশবাণী গুলো আমার অন্তরে গভীরভাবে রেখাপাত করল এবং এরপর থেকেই আমি বিপনীকেন্দ্রগুলোতে আসা-যাওয়ার পাশাপাশি বিভিন্ন শিক্ষা কেন্দ্রেও যাতায়াত শুরু করলাম। এ সময় আবু হানিফার রহ. বয়স ছিল উনিশ বা বিশ বছর।(আল ফিকহুল আকবার, ভূমিকা, ইমাম আবু হানিফার জীবন ও কর্ম,ইসলামিক ফাউণ্ডেশন)
হাদিসশাস্ত্রের শিক্ষা গ্রহণ
ফিকাহ অধ্যায়নের এরপর তিনি হাদিস শিক্ষার জন্য তদানিন্তন হাদিস বেত্তাদের খিদমতে হাজির হন এবং শিক্ষা লাভ করেন। তখনও কোন প্রনিধান যোগ্য হাদিস গ্রন্থ সংকলিত হয়নি। কোন একজন মুহাদ্দিস সকল হাদিসের হাফিজ ছিলেন না। প্রথমে তিনি কুফায় অবস্থানরত মুহাদ্দিসদের থেকে হাদিস শেখেন। এরপর তিন বসরা যান। সেখানে হজরত কাতাদাহ রহ.-এর খিদমতে হাজির হন এবং হাদিসের দরস হাসিল করেন। তারপর ইমাম আবু হানিফা রহ. হজরত শুবা রহ.-এর দরসে যোগ দেন। তাকে হাদিস শাস্ত্রে ‘আমিরুল মুমিনিন’ বলা হয়। কুফা ও বসরার পর ইমাম আবু হানিফা হারামাইন শরিফাইন এর দিকে দৃষ্টিপাত করেন । প্রথমে তিনি মক্কা গেলেন এবং সেখানে তিনি হাদিসবিদ হজরত আতা ইবনে আবু রিবাহ রহ. -এর দরবারে যান এবং দরসে শামিল হয়ে শিক্ষা অর্জন করেন। ১১৫ হিজরিতে আতা রহ. ইন্তেকাল করলে তিনি মক্কায় চলে আসেন এবং হজরত ইকরামা রহ. -এর কাছ থেকেও হাদিসের সনদ লাভ করেন। (আল ফিকহুল আকবার, ভূমিকা, ইমাম আবু হানিফার জীবন ও কর্ম, ইসলামিক ফাউণ্ডেশন)
সাহাবিদের দর্শন
উম্মতের সর্বসম্মতিক্রমে ইমাম আবু হানিফা (রহ.) একজন তাবেই ছিলেন। আল্লামা ইবনে হাজার মক্কী (রহ.) বলেন, ‘ইমাম আবু হানিফা (রহ.) নিম্নে উল্লেখিত সাহাবিদের সাক্ষাৎ লাভ করেন:
হজরত আনাস ইবনে মালেক (রা.) (ওফাত: ৯৩ হিজরি),
আবদুল্লাহ ইবনে আবী আওফা (রা.) (ওফাত: ৮৭ হিজরি),
সহল ইবনে সা’আদ (রা.) (ওফাত: ৮৮ হিজরি),
আবু তোফায়েল (রা.) (ওফাত: ১১০ হিজরি),
আবদুল্লাহ ইবনে জুবায়দি (রা.) (ওফাত: ৯৯ হিজরি),
জাবের ইবনে আবদুল্লাহ (রা.) (ওফাত: ৯৪ হিজরি) এবং
ওয়াসেলা ইবনুল আসকা (রা.) (ওফাত: ৮৫ হিজরি)।
ফিকহ শাস্ত্রের আবিষ্কারক
ইমাম আবু হানিফা (রহ.) ফিকহ শাস্ত্রের আবিষ্কারক ছিলেন।[৮] ফিকহ ও ইসলামী আইন সংকলন ও সম্পাদনার জন্য তিনি ৪০ জন ফকিহ নিয়ে এক আইনজ্ঞ কাউন্সিল প্রতিষ্ঠা করেন। ওই যুগে যেসব মাসয়ালা-মাসায়িল সংকলন হয়েছিল, তার সংখ্যা ১২ লাখ ৭০ হাজারের ঊর্ধ্বে। ফিকহ শাস্ত্রে তার অবদানের ব্যাপারে ইমাম শাফেয়ি (রহ.) বলেন, ‘ফিকহ শাস্ত্রের সব মানুষ ছিলেন আবু হানিফার (রহ.) পরিবারভুক্ত। ‘(আছারুল ফিকহিল ইসলামী)।
ইমাম মালেক (রহ.) বলেন, ‘আবু হানিফা (রহ.) এমন এক ব্যক্তি, তিনি যদি ইচ্ছা করতেন, এই স্তম্ভটিকে সোনা প্রমাণিত করবেন, তবে নিঃসন্দেহে তিনি তা করতে সক্ষম। ‘ (জামিউ বয়ানিল ইলম) ।
তাই ইমাম আবু হানিফার (রহ.) নামযুক্ত মাসয়ালাগুলো ও মাযহাব দ্রুত সারা পৃথিবীতে ছড়িয়ে পড়ে।
হাদিস শাস্ত্রে অবদান
ইমাম আবু হানিফা (রহ.) হাদিস শাস্ত্রে অতুলনীয় জ্ঞানের অধিকারী ছিলেন। তিনি চার হাজার শাইখ থেকে হাদিস সংগ্রহ করেছেন। (আস সুন্নাহ, উকূদুল জামান)।
ইমাম বোখারির অন্যতম ওস্তাদ মক্কী বিন ইব্রাহীম (রহ.), যাঁর সনদে ইমাম বুখারি (রহ.) বেশির ভাগ ‘সুলাসিয়াত’ হাদিস বর্ণনা করেছেন। এই মক্কী বিন ইব্রাহীম ইমাম হানিফা (রহ.)-এর ছাত্র। তিনি ইমাম আবু হানিফা (রহ.) সম্পর্কে বলেন, ‘আবু হানিফা তার সময়কালের শ্রেষ্ঠ আলেম ছিলেন। ‘ (মানাকেবে ইমাম আজম রহ.) । আবিদ ইবনি সালিহ বলেন, ‘ইমাম আবু হানিফা (রহ.) হাদিসের নাসিখ ও মানসুখ নির্ণয়ের ব্যাপারে খুব সতর্ক ছিলেন। ‘ ইমাম আবু হানিফা (রহ.) তার শহরে যেসব হাদিস পৌঁছেছে তার মধ্যে রাসুল (সা.)-এর তিরোধানের সময়কার সর্বশেষ আমল কী ছিল সেসব তার মুখস্থ ছিল।
ইয়াহিয়া ইবনে নাসর বলেন, ‘একদিন আমি ইমাম আবু হানিফা (রহ.)-এর ঘরে প্রবেশ করি। সেখানে তার কিতাব ভরপুর ছিল। আমি জিজ্ঞাসা করলাম এগুলো কী? তিনি বললেন, এগুলো সব হাদিসের কিতাব, যার মধ্যে আমি সামান্য কিছু বর্ণনা করেছি, সেগুলো ফলপ্রদ- (আস সুন্নাহ, উকদু জাওয়াহিরিল মুনীকাহ)
কাজীর পদ প্রত্যাখান
আব্বাসীয় বংশের আল-মনসুর আবু হানিফাকে রাজ্যের প্রধান বিচারপতি হিসেবে নিয়োগের প্রস্তাব দেন কিন্তু স্বাধীনভাবে থাকার জন্য তিনি প্রস্তাব প্রত্যাখান করেন। তার পরীবর্তে তার ছাত্র আবু ইউসুফকে প্রধান বিচারপতির দ্বায়িত দেওয়া হয়। প্রস্তাব প্রত্যাখানের ব্যাপারে আবু ইউসুফ আল মনসুরকে ব্যাখা দেন তিনি নিজেকে এই পদের জন্য উপযুক্ত মনে করছেন না। আল-মনসুরের এই পদ প্রস্তাব দেওয়ার পেছেনে তার নিজস্ব কারণ ছিল, আবু হানিফা প্রস্তাব প্রত্যাখান করার পর মনসুর তাকে মিথ্যাবাদী হিসেবে অভিযুক্ত করেন। এই অভিযোগের ব্যাখ্যায় আবু হানিফা বলেন, “আমি যদি মিথ্যাবাদী হই তাহলে প্রস্তাব প্রত্যাখান করার ব্যাপারে আমার মতামত সঠিক, কারণ কিভাবে আপনি প্রধান বিচারপতির পদে একজন মিথ্যাবাদিকে বসাবেন।” এই ব্যাখার উত্তরে আল-মনসুর আবু হানিফাকে গ্রেফতার করেন ও তাকে নির্যাতন করে কারাগারে বন্দি করে রাখা হয়। এমনকি বিচারকরা সিদ্ধান্ত নিতেন কে তার সাথে দেখা করতে পারবে।
মৃত্যু
সালে আবু হানিফা কারাগারে মৃত্যুবরণ করেন। তার মৃত্যুর কারণ পরিষ্কার নয়। কেউ কেউ বলেন আবু হানিফা আল মনসুরের বিরুদ্ধে সশস্ত্র বিদ্রোহের চেষ্টা করেন এ জন্য তাকে জেলখানার ভেতর মৃত্যুদন্ড দেওয়া হয়। এটা বলা হয়ে থাকে যে, আবু হানিফার জানাযায় অনেক লোক সমাগম হয়েছিল। ইতিহাসবিদ খাতিবের পক্ষে বলা হয় তার জন্য লোকজন মৃত্যুর ২০ দিন পর্যন্ত প্রার্থনা করেছিল। পরবর্তীতে, অনেক বছর পর বাগদাদের পাশে আধামিয়াতে আবু হানিফ মসজিদ নামে একটি মসজিদ প্রতিষ্ঠা করা হয় আবু হানিফার নামে।
১৫০৮ সালে সাফাভি সম্রাজ্যের শাহ ইসমাইল আবু হানিফা ও আব্দুল কাদের জিলানীর মাজার এবং অন্যান্য সুন্নি নিদর্শন ধ্বংস করে দেন। ১৫৩৩ সালে উসমানীয়রা পুনরায় ইরাক দখল করে ও মাজারসহ অন্যান্য সুন্নি নিদর্শন পুনর্নির্মাণ করে।
ইমাম আবু হানিফা-র মর্যাদা সম্পর্কে মনীষীদের অভিমত
ইমাম শাফি-র মতে: যে ব্যক্তি ফেকাহর জ্ঞান অর্জন করতে চায়, সে যেন ইমাম আবু হানিফা এবং তার ছাত্রদের সান্নিধ্য লাভ করে। কারণ ফেকাহর ব্যাপারে সকলেই আবু হানিফা-র মুখাপেক্ষী। ইমাম আবু ইউসুফ ইউসুফ বলেন, ইমাম আবু হানিফা কেবলমাত্র কারাগারে বসেই ১২ লক্ষ ৯০ হাজারের অধিক মাসয়ালা লিপিবদ্ধ করেছেন’ ।
ইমাম আবু হানিফা (রহ.) রচিত গ্রন্থাবলী
ইমাম আবু হানিফা (রহ.) -এর বহু গ্রন্থ অনারব মুসলিম দেশে পাওয়া যায়। তার নিজের লেখা কোন কিতাব নেই। কোন সূত্র ছাড়াই তার রচিত গ্রন্থের অধিকাংশই পৃথিবীর বিভিন্ন মিউজিয়ামে ও গ্রন্থাগারে পাণ্ডুলিপি আকারে সংরক্ষিত রয়েছে। কয়েকটি মুদ্রিত হয়েছে। কয়েকটির একাধিক শরাহ রচিত হয়েছে । এখানে তার পরিচিত ২০টি প্রসিদ্ধ গ্রন্থের নাম উল্লেখ করা হলো-
১. আল-ফিকাহুল আকবর।
২. আল-ফিকাহুল আবসাত।
৩. কিতাব আল আলিম অয়াল মুতাআল্লিম।
৪. আল-অসিয়া।
৫. আর-রিসালা।
৬. মুসনাদে আবি হানিফা ।
৭. অসিয়া ইলা ইবনিহি হাম্মাদ।
৮. অসিয়া ইলা তিল মিজিহি ইউসুফ ইবনে খালিদ।
৯. অসিয়া ইলা তিল মিজিহি আল কাজী আবি ইউসুফ।
১০. রিসালা ইলা উসমান আল বাত্তি।
১১. আল কাসিদা আল কাফিয়া (আননুমানিয়া)।
১২. মুজাদালা লি আহাদিদ দাহ রিন।
১৩. মারিফাতুল মাজাহিব।
১৪. আল জাওয়াবিত আস সালাসা।
১৫. রিসালা ফিল ফারাইয।
১৬. দুআউ আবি হানিফা।
১৭. মুখাতাবাতু আবি হানিফা মাআ জাফর ইবনে মুহাম্মদ।
১৮. বাআজ ফতোয়া আবি হানিফা।
১৯. কিতাবের মাক সুদ ফিস সারফ।
২০. কিতাবু মাখারিজ ফিল হিয়াল।
ইমাম আবু হানীফা রহঃ কি কোন কিতাব লিখে যাননি?
প্রথমেই ইমাম আবু হানীফা রহঃ-এর ইলমী মাকাম সম্পর্কে কিঞ্চিত ধারণা থাকলে এ উদ্ভট প্রশ্নটির উত্তরটি সহজ হয়ে যাবে।
১.
ﻗﺎﻝ ﺷﻴﺦ ﺍﻹﺳﻼﻡ ﻳﺰﻳﺪ ﺑﻦ ﻫﺎﺭﻭﻥ – ﻛﺎﻥ ﺍﺑﻮ ﺣﻨﻴﻔﺔ ﻧﻘﻴﺎ ﺗﻘﻴﺎ ﺯﺍﻫﺪﺍ ﻋﺎﺑﺪﺍ ﻋﺎﻟﻤﺎ ﺻﺪﻭﻕ ﺍﻟﻠﺴﺎﻥ ﺍﺣﻔﻆ ﺍﻫﻞ ﺯﻣﺎﻧﻪ، ( ﻣﻨﺎﻗﺐ ﺍﺑﻰ ﺣﻨﻴﻔﺔ ﻟﻤﺤﻤﺪ ﺿﻤﻴﺮﻯ )
শাইখুল ইসলাম ইয়াযিদ বিন হারুন বলেন, ইমাম আবু হানীফা রহঃ অত্যন্ত মুত্তাকী, পবিত্র সাধক, ইবাদত গুজার, আলিম, সত্যভাষী, এবং সমসাময়িক সকলের চেয়ে হাদীসের বড় হাফেজ ছিলেন। (মানাকেবে ইমাম আবু হানীফা রহঃ, মুহাম্মদ জমিরী রচিত)
২.
ﻗﺎﻝ ﺍﻟﺤﻔﻆ ﺍﺑﻮ ﻧﻐﻴﻢ ﺍﻹﺳﻔﺤﺎﻧﻰ ﻋﻦ ﻳﺤﻴﻰ ﺑﻦ ﻳﺼﺮ ﺑﻦ ﺣﺠﺮ – ﺩﺧﻠﺖ ﻋﻠﻰ ﺍﺑﻰ ﺣﻨﻴﻔﺔ ﺭﺡ ﻓﻰ ﺑﻴﺖ ﻣﻤﻠﻮﻛﺘﻬﺎ، ﻓﻘﻠﺖ – ﻣﺎ ﻫﺬﻩ؟ ﻗﺎﻝ ﻫﺬﻩ ﺍﺣﺎﺩﻳﺚ ﻛﻠﻬﺎ، ﻭﻣﺎ ﺣﺪﺛﺖ ﺑﻪ ﺍﻻ ﺍﻟﻴﺴﻴﺮ ﺍﻟﺬﻯ ﻣﻨﺘﻔﻎ ﺑﻪ – ( ﺍﻟﺨﻴﺮﺍﺕ ﺍﻟﺤﺴﺎﻥ 211- ﺑﺤﻮﺍﻟﺔ ﻣﻨﺎﻗﺐ ﺍﺑﻰ ﺣﻨﻴﻔﺔ ﻟﻠﻤﺮﻗﻒ ﺍﻟﻤﻜﻰ 85- )
হাফেজ আবু নুয়াইম ইসফাহানী রহঃ ইয়াহইয়া বিন নাসর বিন হাজার-এর সূত্রে বর্ণনা করেন, আমি কিতাবে ভরপুর একটি গৃহে ইমাম আবু হানীফা রহ-এর নিকট প্রবেশ করলাম। তাঁকে জিজ্ঞাসা করলাম, এ কিতাবগুলো কিসের? উত্তরে তিনি বললেন, এ সবই হাদীসের কিতাব। এর সামান্য কিছুই আমি বর্ণনা করেছি, যার থেকে যথেষ্ট পরিমাণে উপকৃত হওয়া যায়। (আল খাইরাতুল হিসান, ২১১)
৩.
ﻗﺎﻝ ﻳﺤﻴﻰ ﺑﻦ ﻧﺼﺮ ﺳﻤﻌﺖ ﺍﺑﺎ ﺣﻨﻴﻔﺔ ﺭﺡ ﻳﻘﻮﻝ – ﻋﻨﺪﻯ ﺻﻨﺎﺩﻳﻖ ﻣﻦ ﺍﻟﺤﺪﻳﺚ ﻣﺎ ﺍﺧﺮﺟﺖ ﻣﻨﻬﺎ ﺍﻻ ﺍﻟﻴﺴﻴﺮ ﺍﻟﺬﻯ ﻳﻨﺘﻘﻊ ﺑﻪ – ( ﻋﻘﻮﺩ ﺍﻟﺠﻮﺍﻫﺮ ﺍﻟﻤﻨﻴﻔﺔ – 1/23 ، ﻣﻨﺎﻗﺐ ﺍﺑﻰ ﺣﻨﻴﻔﺔ ﻟﻠﻤﺮﻓﻖ ﺍﻟﻤﻜﻰ 85- )
ইয়াহইয়া বিন নাসর রহঃ বলেন, আমি ইমাম আবু হানীফা রহঃ-কে বলতে শুনেছি যে, তিনি বলেন, আমার নিকট হাদীসের সিন্দুক আছে। আমি তা থেকে উপকারজনক অল্প কিছুই প্রকাশ করেছি। {উকুদুল জাওয়াহিরুল মুনীফাহ, ১/২৩)
✡ হাদীস শাস্ত্রে ইমাম আবু হানীফা রহঃ
মুহাদ্দ্দিসীনে কিরামের এরকম অসংখ্য বর্ণনা প্রমাণ করে ইমাম আবু হানীফা রহঃ-এর কাছে হাদীসের এক বিশাল ভান্ডার ছিল। তিনি সেসব হাদীসের আলোকেই ফাতওয়া প্রদান করতেন। আর তার ছাত্ররা তা লিপিবদ্ধ করতো। তারপর তাকে পরে দেখিয়ে ভুলত্রুটি শুধরে নিতেন।
হাদীসের ভান্ডার থাকা ব্যক্তিত্ব কোন কিতাব সংকলন করেননি। পৃথিবী বিখ্যাত এমন ফক্বীহের কোন লিখিত কিতাব নেই এমন দাবী করাটা আহমকী ছাড়া কিছু নয়।
মৌলিকভাবে তার রচিত কিতাবকে দুইভাবে ভাগ করা যায়। তথা-
১. তার সহস্তে সংকলিত কিতাব।
২-ছাত্রদের দ্বারা লিখিত কিতাব। অর্থাৎ তিনি বলতেন, আর তার ছাত্ররা তা লিপিবদ্ধ করতেন। যেহেতু তার কথাই ছাত্ররা লিখতেন, তাই সেসব কিতাবও তার লিপিবদ্ধ করাই বলা যায় নির্ধিদ্ধায়।
✡ স্বহস্তে লিখা কিতাব
১. কিতাবুল আসার
ﻗﺎﻝ ﺍﻟﺤﺴﻦ ﺑﻦ ﺯﻳﺎﺩ ﻗﺪ ﺍﻧﺘﺨﺐ ﺍﺑﻮ ﺣﻨﻴﻔﺔ “ ﻛﺘﺎﺏ ﺍﻷﺛﺎﺭ ” ﻣﻦ ﺍﺭﺑﻌﻴﻦ ﺃﻟﻒ ﺣﺪﻳﺚ، ( ﺍﻟﺨﻴﺮﺍﺕ ﺍﻟﺤﺴﺎﻥ 211- ﺑﺤﻮﺍﻟﺔ ﻣﻨﺎﻗﺐ ﺍﺑﻰ ﺣﻨﻴﻔﺔ ﻟﻠﻤﺮﻗﻰ 84- )
হাসান বিন যিয়াদ রহঃ বলেন, ইমাম আবু হানীফা রহঃ চল্লিশ হাজার হাদীস থেকে বাছাই করে “কিতাবুল আসার” নামক গ্রন্থটি সংকলন করেন। (আল খাইরাতুল হিসান, ২১১)
ﻗﺎﻝ ﺍﻟﺸﻴﺦ ﺍﺑﻮ ﺍﻟﻮﻓﺎ ﺍﻭﻝ ﻛﺘﺎﺏ ﺃﻟﻒ ﻓﻰ ﺍﻟﺤﺪﻳﺚ ﺍﻟﻨﺒﻮﻯ ﻭﺍﺛﺎﺭﻩ ﻣﺮﺗﺒﺎ ﻋﻠﻰ ﺍﻷﺑﻮﺍﺏ ﻛﺘﺎﺏ ﺍﻷﺛﺎﺭ ﻟﻼﻣﺎﻡ ﺍﻷﻋﻈﻢ – ( ﻋﻠﻢ ﺍﻟﻤﺴﻠﻤﻴﻦ – 5/291 )
শায়েখ আবুল ওয়াফা রহঃ বলেন, রাসূল সাঃ-এর হাদীস ও আসারে সাহাবাকে বিভিন্ন অধ্যায়ে সুবিন্যস্ত করে সর্ব প্রথম কিতাব হল ইমাম আযম রহঃ রচিত “কিতাবুল আসার”। (ইলমুল মুসলিমীন, ৫/২৯১)
২. মুসনাদে ইমাম আবু হানীফা রহঃ।
এ কিতাবটি বর্তমানে পৃথিবী বিখ্যাত হাদীস বিশারদ আল্লামা মোল্লা আলী ক্বারী রহঃ-এর তাহকীকসহ বর্তমানে পাওয়া যায়।
৩. আল ফিক্বহুল আকবার I
এ গ্রন্থটিও মোল্লা আলী ক্বারী রহঃ-এর ব্যাখ্যাসহ মার্কেটে পাওয়া যায়। এছাড়াও তার রচিত গ্রন্থাবলী হলঃ
৪. রিসালাতু আল-আলিম ওয়াল মুতাআল্লিম।
৫. রিসালাতু ইলা উসমান আল-বাত্তী।
৬. কিতাবু আর রাদ্দু আলাল ক্বাদরিয়া
৭. আল ইলমু শারকান ও গারবান ওয়া বাদান ওয়া কারবান।
এছাড়াও আরো অনেক গ্রন্থের নাম ওলামাদের বক্তব্যে এসেছে। এছাড়াও ইমাম আযম রহঃ-এর লিখা আরো গ্রন্থ ছিল ফিক্বহের উপর। কিন্তু মূলত তাতারী বর্বরতা “বায়তুল হিকমাহ” রাজকীয় গ্রন্থাগার ও বাগদাদ নগরী ধ্বংসের সময় এ অমূল্য কিতাবসমূহর পান্ডুলিপি দুর্লভ ও বিরল হয়ে পড়ে।
✡ ছাত্রদের দ্বারা লিখিত কিতাব
ইমাম বুখারী যেমন তার সংকলিত বুখারী শরীফের পান্ডুলিপি লিখিয়েছেন তার ছাত্র মুহাম্মদ বিন ইউসুফ ফারাবরী রহঃ-এর দ্বারা।তারপর থেকে বর্তমানে পাওয়া বুখারী শরীফ মূলত মুহাম্মদ বিন ইউসুফ ফারাবরী রহঃ-এর লিখিত বুখারী শরীফের নাম। অথচ কিতাব বলা হয় ইমাম বুখারী রহঃ-এরই। কারণ এর মূল সংগ্রাহক হলেন ইমাম বুখারী রহঃ। যদিও লিখেছেন তার ছাত্র ফারবরী। তারপরও তা ইমাম বুখারী রহঃ-এর নামেই পরিচিতি পেয়েছে। অধিকাংশ মানুষ লিপিবদ্ধকারী ফারাবরী রহঃ-এর নামই জানে না। তেমনি ইমাম আবু হানীফা রঃ-এর বলা ও উদ্ভাবন করা মাসআলাই তার ছাত্র ইমাম আবু ইউসুফ রহঃ, ইমাম মুহাম্মদ রহঃ, ইমাম হাসান বিন যিয়াদ রহঃ, ইমাম কারখী রহঃ, তাদের কিতাবে সংকলিত করেছেন। তাই তাদের রচিত কিতাব মূলত ইমাম আবু হানীফা রহঃ-এর লিখিত কিতাবই।
ﻭﺍﻟﻠﻪ ﺍﻋﻠﻢ ﺑﺎﻟﺼﻮﺍﺏ
ইমাম আবু হানীফা (রহঃ) ও একটি বাস্তব ঘটনা:-
✝ ইমাম আবু হানীফা (রহঃ) কে যারা সমালোচনার চোখে দেখে, হানাফী মাযহাবের যারা সমালোচনা করে, তারা সেটা না জেনে, না বুঝেই করে থাকে। অথবা ষড়যন্ত্রমুলকভাবে করে থাকে। ইতোপূর্বে এমন ঘটনা অনেক ঘটেছে। তেমনি এক ঘটনা ঘটেছিল ইমাম আবু হানীফা (রহঃ) এর সমসাময়িক আরেকজন বিখ্যাত ইমাম, ইমাম আওযা’ঈ (রহঃ) এর সাথে। ঘটনাটি উল্লেখ করছি।
✝ বিশ্ববিখ্যাত মুহাদ্দিস আব্দুল্লাহ বিন মুবারক (রহঃ) বলেন, আমি ইমাম আওযা’ঈ (রহঃ) এর সাথে দেখা করতে শাম দেশে যাই, শাম দেশের বৈরুত নগরীতে তাঁর সাথে আমার দেখা হয়। তিনি আমাকে দেখে বললেন-
يا خراساني من هذا المبتدع الذي خرج بالكوفة يكنى أبا حنيفة؟
হে খুরাসানী, কুফা নগরীর এ বেদআতী কে, যাকে আবু হানীফা বলা হয়? ইবনুল মুবারক (রহঃ) বলেন, আমি তাঁর কথার কোন উত্তর না দিয়ে বাড়ী ফিরে এসে আবু হানীফা (রহঃ) এর কিতাব নিয়ে বসি এবং তিনদিন ধরে তাঁর কিতাব থেকে বিভিন্ন মাসআলা লিপিবদ্ধ করি। তৃতীয় দিন আবার আমি ইমাম আওযা’ঈ (রহঃ) এর নিকট যাই। ইমাম আওযা’ঈ (রহঃ) মসজিদের আযান দিতেন এবং নিজেই ইমামতি করতেন। তিনি আমাকে দেখে বললেন, তোমার হাতে এটি কী কিতাব? আমি তাঁর হাতে কিতাবটি তুলে দিলাম। তিনি ঐ সকল মাস’আলাগুলো দেখতে লাগলেন যে মাস’আলা গুলোর ক্ষেত্রে আমি লিখেছিলামঃ قال النّعمان অর্থাৎ নু’মান বলেছেন। (এখানে ইবনুল মুবারক আবু হানীফা না লিখে উনার নাম নুমান লিখেছিলেন।)
✝ ইমাম আওযা’ঈ (রহঃ) আযানের সময় হয়ে যাওয়ায় আযান দিতে গেলেন এবং তারপর আবার তা দেখতে থাকেন। এমন সময় নামাজের সময় হয়ে গেলে কিতাবটি জামার পকেটে রেখে নামাজ আদায় করেন। নামাজ শেষে আমার নিকট এসে বললেন, ”হে খুরাসানী, এ নুমান বিন সাবিত কে?” আমি উত্তরে বললাম, তিনি ইরাকের এক শায়েখ, যার সাথে আমার দেখা হয়েছিল। (এখানে তিনি আবু হানীফা নামটি উল্লেখ করলেন না।)
ইমাম আওযা’ঈ (রহঃ) তখন বললেন,
هذا نبيل من المشايخ، اذهب فاستكثر منه.
ইনি তো একজন শ্রেষ্ঠ শায়েখ। তাঁর নিকট তুমি যাও এবং তাঁর থেকে অধিক ইলিম অর্জন কর।
আমি তখন বললাম,
هذا أَبُو حنيفة الذي نهيت عنه.
উনিই হচ্ছেন সেই আবু হানীফা যার ব্যাপারে আপনি নিষেধ করেছিলেন!!
ইবনুল মুবারক (রহঃ) বলেন, পরবর্তীতে ইমাম আওযা’ঈ এর সাথে মক্কা শরীফে ইমাম আবু হানীফা (রহঃ) এর সাক্ষাত হয়েছিল। তখন তাদের উভয়ের মধ্যে ঐ মাস’লাগুলো নিয়ে আলোচনা হলো। ইমাম আবু হানীফা (রহঃ) তাকে মাস’আলাগুলোর ব্যাখ্যা ভালভাবে বুঝিয়ে দিলেন। ইবনুল মুবারক বলেন, ইমাম আবু হানীফার নিকট থেকে সরে আসার পর আমি ইমাম আওযা’ঈ (রহঃ)’কে জিজ্ঞেস করলাম, ইমাম আবু হানীফা (রহঃ)’কে কেমন দেখলেন? তিনি জবাব দিলেন,
استغفر الله- لقد كنت في غلط ظاهر- الزم الرجل فانه بخلاف ما بلغني عنه-
আমার ভুল ধারণার জন্য আল্লাহর নিকট ক্ষমা প্রার্থনা করছি। সত্যিই আমি বড় ভুলের মধ্যে ছিলাম। তুমি তাঁর সঙ্গ কখনো ত্যাগ করবে না। মূলত তাঁর সম্পর্কে আমাকে যা জানানো হয়েছে, তা বাস্তবতার সম্পূর্ণ বিপরীত।
✝ রেফারেন্সঃ-
১) আসারুল হাদীসঃ ১২৪
২) তারীখু বাগদাদঃ ১৩/৩৩৮
৩) তারীখু দিমাশকঃ ৩২/৩৯৯
✝ ইমাম আওযা’ঈ এর নিকট যে বা যারা ইমাম আবু হানীফা (রহঃ) এর বিরুদ্ধে অপপ্রচার করেছিল, এদের উত্তরসূরী, এদের গোষ্ঠী আজো আছে। আমাদেরকে নানাভাবে তাঁর বিরুদ্ধে, হানাফী মাযহাবের বিরুদ্ধে মনকে বিষিয়ে তোলার জন্য দিনরাত কাজ করে চলেছে। এদেরকে চিনে রাখুন।
এরা ধোঁকাবাজ।
এরা ষড়যন্ত্রকারী।
এরা সত্য গোপনকারী।
এদের বিরুদ্ধে নিজে সচেতন হোন এবং সচেতনতা গড়ে তুলুন। পড়ে ভালো লাগল তাই শেয়ার না করে পারলাম না।
ইমাম আবু হানিফা রহ. এর বিরুদ্ধে আলবানী সাহেবের বিভ্রান্তিকর তথ্যের জবাব। (পর্ব-১)
[বি:দ্র: আমাদের এই আলোচনাগুলো বেশ কয়েকটি পর্বে প্রকাশিত হবে। আলোচনা যদি দীর্ঘ হয়, তবে এর উপর একটি বই প্রকাশের নিয়ত আছে। আলোচনা দীর্ঘ হওয়ার জন্য কোন পাঠক বিরক্ত হবেন না বলে আশা রাখি।]
মূল আলোচনা শুরুর পূর্বে ভূমিকা হিসেবে কয়েকটি বিষয় উল্লেখ করবো।
ইমাম আবু হানিফা রহ. একজন বিখ্যাত তাবেয়ী। কোন মুসলমানের নিকট ইমাম আবু হানিফা রহ. এর পরিচয় উল্লেখের কোন প্রয়োজন নেই।
আল্লাহ পাক ইমাম আবু হানিফা রহ. কে এমনভাবে কবুল করেছেন, তার খেদমতকে এমনভাবে গ্রহণযোগ্যতা প্রদান করেছেন, দীর্ঘ তের শ’ বছর যাবৎ প্রায় দুই তৃতীয়াংশ মুসলমান তার ফিকহ অনুসরণ করছে।
কারও মর্যাদা ও গ্রহণযোগ্যতা প্রমাণের জন্য এর চেয়ে বড় কোন দলিলের প্রয়োজন আছে বলে মনে হয় না। সাহাবায়ে কেরাম সত্যের মাপকাঠি, আদল ও ইনসাফের চূড়ায় অবস্থান করা সত্ত্বেও একটা শ্রেনি সাহাবায়ে কেরামকে বিভিন্ন অভিযোগে অভিযুক্ত করে।
এমনকি শিয়ারা কয়েকজনকে সাহাবী ব্যতীত আর সবাইকে কাফের ও মুরতাদ বলে থাকে। সাহায়ে কেরামের মর্যাদায় আঘাত করার জন্য তারা বিভিন্ন ধরণের হাদীস ও ঘটনা বানিয়েছে। এগুলো মানুষের কাছে গ্রহণযোগ্য করতে জাল ঘটনা ও হাদীসগুলোর বিভিন্ন সনদ বানিয়েছে।
বাহ্যিকভাবে সনদগুলো দেখলে মনে হয়, সিল-সিলাতুয যাহাব বা স্বর্ণ দিয়ে তৈরি। অর্থাৎ এই সনগুলোতে কোন দুর্বল বা অভিযুক্ত বর্ণনাকারী থাকে না। এই জন্য হাদীস বিশারদগণ একটা হাদীস সহীহ হওয়ার জন্য সনদ সহীহ হওয়ার পাশাপাশি হাদীসের মূল বক্তব্য বা মতন বিশুদ্ধ হওয়ার শর্তারোপ করেছেন।
শুধু সনদ সহীহ হলেই হাদীস সহীহ হয় না, হাদীসের মূল বক্তব্য বা মতনও সহীহ হওয়া জরুরি। সুতরাং হাদীসের সনদ বিশুদ্ধ হলেও তার মতন যদি বিশুদ্ধ না হয়, তবে এই হাদীসগুলো কখনও সহীহ সাব্যস্ত হবে না। যারা হাদীস জাল করতে পারে, তাদের জন্য সনদ জাল করা অসম্ভব কিছু নয়।
সুতরাং হাদীস বা কোন বর্ণনা বিশ্লেষণের জন্য উক্ত বক্তব্যের সনদ ও মতন উভয়টি বিশুদ্ধ হওয়া আবশ্যক।
শিয়ারা সাহাবায়ে কেরামের নামে কুৎসা রটালে সাহাবাদের মর্যাদায় সামান্য প্রভাবও পড়ে না। বরং যারা এগুলো করে থাকে, তাদের মর্যাদা কমে থাকে।
একইভাবে যারা বড় বড় ইমামের নামে কুৎসা বর্ণনা করে, তারা ইমামের কোন ক্ষতি করতে পারবে না, ইমামের অনুসারীদেরও কোন ক্ষতি হবে না, একজন পূণ্যবান ব্যক্তির নামে মিথ্যাচার ও অপবাদের কারণে ঐ ব্যক্তির আমল নষ্ট হবে।অন্যের নামে অপবাদ দেয়ার কারণে নিজে গোনাহের মাঝে লিপ্ত হবে।
যারা সাহাবায়ে কেরামের সমালোচনা করছে, তারা সাহাবীদের কোন ক্ষতি করতে পারবে না, আল্লাহর নিকট তাদের মর্যাদা কমাতে পারবে না। তারা এতটুকু হয়তো করতে পারবে, একজন নির্দোষ ব্যক্তিকে অপবাদ দেয়ার মাধ্যমে নিজেকে কলুষিত করবে, নিজের আমলনামা কালো করবে।
একইভাবে যারা বড় বড় ইমামদের সমালোচনায় লিপ্ত, তারাও ইমামদের বিশেষ কোন ক্ষতি করতে পারবে না, আল্লাহ পাকের নিকট তাদের মর্যাদাও কমবে না। বরং যে এই ধরণের হীন কর্মে লিপ্ত হবে, তার আমলনামায় গোনাহের পরিমাণ বাড়তে থাকবে।
দ্বিতীয় বিষয় হলো, প্রত্যেক যুগে বাতিল সাধারণ মানুষকে বিভ্রান্ত করার জন্য কিছু চমকপ্রদ শ্লোগান নিয়ে হাজির হয়। এদের শ্লোগান, বড় বড় উপাধি ও বাহ্যিক সূরত বা আকৃতি দেখে তাদেরকে চেনা যায় না। হক্বপন্থী উলামায়ে কেরাম কখনও বাতিলের উপাধি ও বাহ্যিক সূরত দিয়ে বিশ্লেষণ করেন না।
গোলাম আহমদ কাদিয়ানীর ছবি যারা দেখেছেন, তারা হয়তো বলবেন, এতো যামানার কুতুব, এ লোক কাফের হয় কি করে? বিশাল দাড়ি, মাথায় পাগড়ি।
একজন সাধারণ মানুষ এতো বড় একজন হুজুরকে কাফির বলা তো দূরে থাক, তার সম্পর্কে কোন কু-ধারণা করতেও দ্বিধা-বোধ করবে।
আহলে কুরআন নামে আরেকটা গ্রুপ আছে। এদের নাম নিয়ে যদি একটু চিন্তা করেন, এদেরকে কখনও বাতিল বলতে পারবেন না।
আহল শব্দের অর্থ হলো, পরিবার। আহলে কুরআন অর্থ হলো যারা কুরআনের একনিষ্ঠ অনুসারী। প্রত্যেক মুসলমান কুরআনের একনিষ্ঠ অনুসারী হওয়ার জন্য চেষ্টা করে থাকে। সুতরাং আহলে কুরআন হওয়া তো প্রশংসনীয় একটা ব্যাপার।
আমরা বলবো, এটা হলো, তাদের বাহ্যিক শ্লোগান। কিছু মানুষকে ধোকা দেয়ার জন্য তারা এই চমৎকার নামটি গ্রহণ করেছে। এরা মূলত: আহলে কুরআন বলে রাসূল স. এর হাদীস অস্বীকার করে থাকে। সুতরাং এরা মুনকীরে হাদীস। এতো বড় জঘন্য কাজ করে, অথচ এদের নামটা চমৎকার। আমাদের দেশে কবরপূজারী-মাজারপূজারী পীর-ফকিরদের অভাব নেই।
এই বেদআতী গোষ্ঠী যখন তাদের পীরের নাম লেখে, নামের শুরুতে অর্ধেক পৃষ্ঠা শুধু পীরের উপাধি থাকে।
এই উপাধি গুলো দেখে যদি এইসমস্ত ভণ্ডদেরকে গাউসে আজম, কুতুব ইত্যাদি মনে করা শুরু করি, তাহলে এর চেয়ে নির্বুদ্ধিতা আর কী হতে পারে? আমাদের বক্তব্যের মূল উদ্দেশ্য হলো, আমরা বাতিলের চেহারা, শ্লোগান বা উপাধি দেখে ভুলি না। আমরা তাদেরকে বাস্তবতার নিরিখে বিশ্লেষণ করে থাকি।
সে কোন শ্লোগান নিয়ে এসেছে, সেটা মূখ্য বিষয় নয়, সে কী করছে, সেটাই মূল বিষয়। কারও নামের শুরুতে শায়খ, শাইখুল ইসলাম, যুগশ্রেষ্ঠ মুহাদ্দিস (মুহাদ্দিসুল আসর), মুজাদ্দিদ ইত্যাদি উপাধি দেখলেই আমরা তার প্রতি আবেগী হয়ে তার বাতিল বক্তব্য ও মতবাদকে শ্রদ্ধা করতে শুরু করি না। বরং কুরআন-সুন্নাহের আলোকে বিশ্লেষণ করে দেখি, তার এই উপাধির পিছে আদেৌ কোন বাস্তবতা আছে কি না। ইংরেজদের সময়ে ভারত উপ-মহাদেশে আহলে হাদীস নামে একটা ফেরকার জন্ম হয়েছে। এদের শ্লোগানও খুবই চমকপ্রদ। আমরা হাদীসের অনুসারী। পৃথিবীর সকল মুসলমানই তো রাসূল স. এর হাদীস অনুসরণ করে। একজন মুসলমান সে যে স্তরেরই হোক না কেন, অবশ্যই সে মনে-প্রাণে রাসূল স. এর হাদীস অনুসরণ করে থাকে। সবাই যখন রাসূল স. এর হাদীস অনুসরণ করছে, তাহলে এরা আহলে হাদীস নামে নতুন দল সৃষ্টি করলো? আহলে কুরআনদের মতো এদেরও একটা উদ্দেশ্য আছে। সাধারণ মানুষকে হাদীস অনুসরণের কথা বলে তাদেরকে ফিকহ ও উসুলে ফিকহ থেকে বিমুখ করে। ফিকহকে বাতিল করার জন্য এদের এই গ্রুপিং।
আরবে নতুন একটা দলের সৃষ্টি হয়েছে সালাফী নাম ধারণ করে। সালাফ শব্দের অর্থ হলো, পূর্ববতী ব্যক্তিগণ। এখন পূর্ববর্তী ব্যক্তির মাঝে যেমন পূণ্যবান, যেমন সাহাবায়ে কেরাম, তাবেয়ীন, তাবে-তাবেয়ীন রযেছেন, তেমনি মিথ্যা নবুওয়াতের দাবীদার মুসাইলামাতুল কাযযাব, সাহাবীদের যুগে খারেজী, কাদেরিয়া মতবাদ, পরবর্তীতে জাহমিয়া, মুরজিয়া ও মুজাসসিমা আবির্ভাব হয়েছে। এখন, তারা সালাফ দ্বারা যদি পূণ্যবান ব্যক্তিদের অনুসরণ উদ্দেশ্য নেয়, তাহলে পৃথিবীর অন্য সকল মুসলমান সালাফে-সালেহীনের অনুসরণ করে থাকে। নতুন করে গ্রুপিং করে, কিছু চমকপ্রদ শ্লোগান দেযার কোন অর্থ নেই। তাদের এই নতুন মতবাদ সৃষ্টির প্রযোজন হলো কেন? তারা পূর্ববতীদের অনুসরণ দ্বারা নির্দিষ্ট একটি গ্রুপকে উদ্দেশ্য নিয়েছে। এই দলটি মুজাসসিমা নামে প্রসিদ্ধ। তাবেয়ীদের যুগে এই মুজাসসিমাদের উদ্ভব হয়। ভ্রান্ত এই ফেরকার বক্তব্যগুলো সরাসরি প্রচার করলে মানুষ গ্রহণ করবে না, তাই একে নতুন নাম দিয়ে, নতুন মোড়কে কিছু চমকপ্রদ শ্লোগান দিয়ে মানুষকে খাওয়ানোর চেষ্টা করা হচ্ছে। সুতরাং আমাদের নিকট কারও বাহ্যিক শ্লোগান বা নামের কোন মূল্য নেই। আমরা বাস্তবতা বিশ্লেষণ করে থাকি। সকল হক্বপন্থী উলামায়ে কেরামের বৈশিষ্ট্য হলো, তারা উপাধি, শ্লোগানের পরিবর্তে মূল কাজ ও বাস্তবতাকে গুরুত্ব দিয়ে থাকেন।
উক্ত বিষয়গুলো আমাদের পরবর্তী আলোচনায় ইনশাআল্লাহ সহায়ক হবে। এবার মূল আলোচনা শুরু করা যাক।
ইমাম আবু হানিফা রহ. এর জীবনী সম্পর্কে লিখিত গ্রন্থাবলী:
১. ইমাম আবু হানিফা রহ. এর জীবনী ও ফযিলত সম্পর্কে সর্বপ্রথম পৃথক কিতাব রচনা করেন, আহমাদ ইবনুস সালত (মৃত: ৩০৮ হি:)
২. এরপর বিখ্যাত মুহাদ্দিস ইমাম ত্বহাবী রহ.