মদীনার এক সম্ভ্রান্ত ঘরে জন্ম নিলেন এক শিশু। ইলম অনুরাগী পরিবারের সন্তান হয়েও সেই শিশুটির মনে স্বপ্ন ছিল সে বড় হয়ে গায়ক হবে! দুশ্চিন্তায় পড়ে গেলেন মা। কচি মন। তাকে শুধু নিষেধ করলেই তো হবে না, বরং বুঝিয়ে বলতে হবে পরম আদরে। মা তাই বেছে নিলেন ভিন্ন পন্থা। আদরের পুত্রকে কাছে ডেকে মাথায় হাত বুলিয়ে বললেন, “ বাবা, ভালো গায়ক হতে গেলে তো সুমিষ্ট কণ্ঠের পাশাপাশি দেখতেও সুশ্রী হতে হবে। কিন্তু দেখো, তোমায় একদম গায়কদের মতো দেখাচ্ছে না যে! ” মায়ের কাছে এ কথা শুনে পুত্রের মাথা থেকে গায়ক হবার ভূত দূর হলো।
পুত্রের বয়স যখন ছয়, তখন থেকেই মা তাকে আলেমদের মতো পোশাক পরিয়ে মাথায় পাগড়ি বেঁধে দিতেন। যেন ছেলের মনে আলেম হবার বাসনাই লালিত হয়।
সেই শিশুটি বড় হয়ে ইসলামী জ্ঞানের জগতের এক উজ্জ্বল নক্ষত্রে পরিণত হন! তাঁর নাম- ইমাম মালিক রাহিমাহুল্লাহ!
চলুন জেনে নিই অন্য একজন মায়ের কথা। যিনি তাঁর শিশুপুত্রকে উদ্দেশ্য করে বলেছিলেন, “ হে মুহাম্মদ! আমরা দরিদ্র, অসহায় মানুষ। আমি আমার জীবনের সমস্ত শখ আহ্লাদ তোমার জন্য বিসর্জন দিলাম। আমি চাই তুমি একজন আলেম হয়ে মুসলিম উম্মাহর খেদমত করো। ”
শিশুমনে দাগ কাটে সে কথা। ইলমের সাধনায় নিজেকে সঁপে দিলেন তিনি। মাত্র ১৫ বছর বয়সে মক্কার হারাম শরীফের মুফতির কাছ থেকে তিনি পেয়ে যান ফতোয়া দেবার সুপারিশ। কে সেই বালক? আর কেউ নন, ইলমপিপাসু আরেক ইমাম, ইমাম আশ-শাফেঈ রহিমাহুল্লাহ।
আর্থিক দীনতার দরুন ইলমের মজলিসে বালক শাফে'ঈ যখন যেতেন, কাপড় থাকতো ধুলিমলিন। শিক্ষক তাকে তেমন একটা খেয়াল করতেন না। ছোট্ট মন আহত হলো। মা কে এসে জানালেন সে কথা। সেই মহিয়সী মা কি জবাব দিয়েছিলেন তা কি আমরা জানি? তিনি পুত্রকে উত্তমরূপে নসীহাহ দিলেন, “ বাবা, তোমার কাজ তো জ্ঞানার্জন করা। কেউ তোমার দিকে খেয়াল না দিলেই বা কি আসে যায়! তুমি শুধু শুনে যাবে উস্তাদ কী শেখাচ্ছেন। ”
সালাফদের জীবনী পাঠ করলে এমন আরো অনেক উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত পাওয়া যাবে। যেখানে একেকজন হাদীস বিশারদ, ফিক্বহ প্রণেতা কিংবা ইলমের অনুসন্ধানী ব্যক্তিত্বের অনুপ্রেরণা হিসেবে তাঁদের মায়েরা বিশেষ ভূমিকা রেখেছিলেন। বর্তমানে পশ্চিমা সংস্কৃতির প্রভাবে আমরা ভুলতে বসেছি নারীর এই মহান দায়িত্বের কথা।
একজন শিশু নরম একতাল কাদামাটির ন্যায়। তাকে যে আকৃতিতে রূপ দেয়া হবে, সেভাবেই সে গড়ে উঠবে। গর্ভে থাকাকালীন মায়ের জীবনাচার শিশুর উপর ভীষণভাবে প্রভাব ফেলে। মায়ের গর্ভ হতে পৃথিবীতে ভূমিষ্ঠ হবার পরবর্তী সময় থেকে তারুণ্যে পদার্পণ করবার পূর্ব পর্যন্ত সবচাইতে বেশি সময় সে কাটায় নিজের মায়ের সাথে। সেদিক দিয়ে চিন্তা করলে শিশুর উত্তম তারবিয়ত গঠনে মা যেভাবে ভূমিকা রাখতে পারেন, সে সুযোগ বোধকরি অন্য আর কারো অতোটা হয়ে ওঠে না। কিন্তু আজ আমরা তা ভুলতে বসেছি। চোখ ধাঁধানো ক্যারিয়ার অর্জন কিংবা আরেকটু স্বাচ্ছন্দ্যে জীবন অতিবাহিত করবার ব্যবস্থা করতে গিয়ে আমাদের উম্মাহর ভবিষ্যৎ সম্বন্ধে আমরা অবহেলা করে ফেলছি।
তার ফলাফল হিসেবে আজকের প্রজন্ম ভোগবাদী এ সমাজের স্রোতে গা ভাসিয়েছে। অসুস্থ ট্রেন্ডে অভ্যস্ত হয়ে যাওয়া, পশ্চিমা সমাজের চাকচিক্যময় জগতের মোহে হারিয়ে যাওয়া যেন খুব স্বাভাবিক হয়ে দাঁড়িয়েছে। আমরা প্রায়ই এসব নিয়ে হতাশায় নিমজ্জিত হই। কিন্তু এ সমস্যার মূল অনুসন্ধান করে তা গোড়া থেকে উপড়ে ফেলার প্রয়াসে তৎপর হতেই যেন আমাদের বড্ড অনীহা। একজন মা-ই পারেন শিশুর অন্তরের গহীনে একজন আদর্শ মানুষ হিসেবে নিজেকে গড়ে তুলবার স্বপ্ন জাগিয়ে তুলতে। তাকে ছোটকাল থেকেই শোনাতে হবে খলীফা উমর (রা.) এর ন্যায়বিচারের কথা, আবু বকর (রা.) এর প্রজ্ঞা, আলী (রা.) এর জ্ঞান ও শৌর্যবীর্যের, এবং উসমান (রা.) এর দানশীলতার কথা। উম্মুল মুমিনীন আয়েশা (রা.), খাদিজা (রা.) এর বিদূষিতার কথা তাদের জানাতে হবে। তাহলে তার কাছে সুপারহিরো হবেন তাঁরাই। নিজের জীবনকে তাঁদের রঙে রাঙানোর ইচ্ছে লালন করে সে বেড়ে উঠবে ধীরে ধীরে।
হযরত লোকমান হাকীমের স্বীয় সন্তানকে দেয়া উপদেশসমূহের আলোকে শিশুদের নিম্নোক্ত শিক্ষা দেয়ার উপর বিশেষ গুরুত্বারোপ করতে হবে:
১. শিরকের বিরুদ্ধে সচেতন করা এবং তা থেকে বিরত রাখা।
২. আল্লাহর সিফাত সম্বন্ধে সঠিক ধারণা দেয়া। তিনি যে সূক্ষ্মাতিসূক্ষ্ম কাজ সম্বন্ধেও অবগত আছেন, তা তাদের মনে দৃঢ়মূল করে দেয়া। এটি তাদের অন্তরে তাকওয়ার অনুভূতি সৃষ্টি করবে।
৩. মা-বাবার সেবা করা।
৪. ছোটবেলা থেকেই নামাজে অভ্যস্তকরণ।
৫. যাকাত, দান সাদাকাহ ইত্যাদিতে অনুপ্রাণিত করা ও দুঃস্থ মানবতার সেবায় তাদের উদ্বুদ্ধ করা।
৬. সৎকাজের দিকে মানুষকে আহ্বান করা এবং অসৎ কাজ হতে বিরত রাখবার ব্যাপারে সোচ্চার করা।
৭. অন্যায় ও অসত্যের বিরুদ্ধে ন্যায় ও সত্যের প্রতিষ্ঠার কাজে প্রতিবন্ধকতা এলে তা মোকাবেলায় ধৈর্যের অনুপ্রেরণা দান।
৮. মানুষের প্রতি মনোযোগী, বিনয়ী হওয়া। অহংকারী না হওয়া।
৯. উত্তম আখলাকের অধিকারী হওয়া। মার্জিত, মধ্যম পন্থা অবলম্বন করা।
১০. মানুষের সাথে বিনয়ের সাথে কথা বলতে অভ্যস্ত হওয়া।
বর্তমান এ সমাজে একজন সন্তানকে উত্তম মানুষ হিসেবে গড়ে তোলা খুবই চ্যালেঞ্জিং একটি বিষয়। ধৈর্যের সঙ্গে এ কাজের আঞ্জাম দেয়ার জন্য নিজেকে প্রয়োজনে বিশেষভাবে প্রশিক্ষিত করতে হবে। দ্বীনি ইলম অর্জন করে নিজেকে একজন মানুষ গড়ার কারিগর হিসেবে প্রস্তুত করতে হলে শুদ্ধ নিয়তের মাধ্যমে এখন থেকেই সংকল্পবদ্ধ হতে হবে। যাতে করে নিজের অন্য সকল লক্ষ্যের পাশাপাশি জাতির ভবিষ্যৎ কাণ্ডারী গঠনের কারিগর হতে পারা নিজের অন্যতম মিশন হয়ে দাঁড়ায়।
গ্রন্থ সহায়তা:
১. আদর্শ সমাজ গঠনে নারী- শামসুন্নাহার নিজামী
গড়ে তুলি অগ্রপথিক
~ সাবিহা সাবা