জিজ্ঞাসা-১২৮৫৩:
আসসালামু আলাইকুম ওয়া রহমাতুল্লাহ। সম্মানিত মুফতি সাহেব,
প্রশ্নঃ সংসারের বড় ছেলে মানে সকল দায়িত্ব তার, বণ্টনে সে কম নিতে হবে, ভালো অংশ ছোটদের জন্য, সবচেয়ে খারাপ অংশটি তাকে নিতে হবে, কষ্টের কাজ তার আর ছোটদের জন্য ছাড়, সে আর্থিকভাবে একটু ভালো থাকলে এবং তার ছোটরা একটু কম স্বচ্ছল হলে বাবা-মা সন্তানদের কিছু দিতে গিয়ে এটা মনে করে বড়কে কম দেয়া/ বঞ্চিত করা যে- ওর তো আছে, তাছাড়া ও বড়, ছোটকে দেই- কারণ ও ছোট.... ইত্যাদি
এভাবে বড় হওয়ার কারণে বাবা-মা তাকে বিভিন্ন ক্ষেত্রে কম দেয়া/ ছাড় দেয়া/ সহ্য বেশি করানো/ বঞ্চিত করা .. কি শরিয়তের দৃষ্টিতে আইনানুগ অধিকার রয়েছে? কিংবা বড় ছেলে কি এসব বৈসম্য মানতে বাধ্য?
নাকি এটা শুধু মানবিকতা ও নৈতিকতার খাতিরে বাধ্য? যদি বড় এক্ষেত্রে বাবা-মার বৈসম্যে কষ্ট পায় এবং তাদের সাথে আন্তরিক সম্পর্ক না রাখে, বাহ্যিক সম্পর্ক (মাসিক খরচ দেয়ার) বজায় রাখে , তাহলে সে গুনাহগার হবে কিনা?
বাবা-মার জন্য এটা শরিয়তের দৃষ্টিতে আইনি অধিকার রয়েছে কি ?
তারাও কি এতে গুনাহগার হবেন ?
বড় ছেলের জন্য এখন কী করণীয়?
উল্লেখিত বিষয়গুলোর দলীল ভিত্তিক সমাধান পেশ করলে কৃতজ্ঞ থাকব।
মহান আল্লাহ আপনার মঙ্গল করুন আমীন।
তারিখ: ২৮/১১/২৩ ঈসায়ি/ইংরেজি
হাফেজ মাওলানা সাজ্জাদ নারায়ণগঞ্জ। থেকে।
জবাব:
وعليكم السلام ورحمة الله وبركاته حمده ونصل على رسوله الكريم اما بعد بسم الله الرحمن الرحيم
তাসলিম ও হামদ-সানার পর প্রথম কথা হলো, সন্তানদেরকে হেবা বা দানের ক্ষেত্রে সমতার ব্যাপারে ইমামদের মধ্যে মতভেদ রয়েছেন।
প্রথম মত: সমতা রক্ষা করা মুস্তাহাব। যেমন,
التسوية في الهبة بين الأولاد مستحبّة، قال به جمهور الفقهاء من الحنفية، والمشهور عند المالكيّة، والمعتمد عند الشافعية، واستدلوا بحديث النعمان بن بشير رضي الله عنهما:
অর্থাৎ। সন্তানদের মাঝে দান করার ক্ষেত্রে সমতা রক্ষা করা মুস্তাহাব। এ মতের জমহুরদের মধ্যে ফুকাহায়ে আহনাফ, মালিক ও শাফি। তাদের দলিল নিচের হাদিস:
হাদিস/আসার-০১
لما روى الإمام مالك عن عائشةَ رضي الله تعالى عنها زَوجِ النَّبِيِّ صلى الله عليه وسلم "أن أَبا بَكرٍ الصِّدِّيقَ كانَ نَحَلَها جَادَّ عِشْرِينَ وَسْقًا مِن مَالِهِ بِالغَابَةِ" [الموطأ 4/ 1089]
،উম্মুল মুমেনীন হজরত আয়েশা (রাযি.) এর রেওয়াত। সেখানে বিধৃত রয়েছে যে, "আবু বকর ( রাযি.) বনাঞ্চলের তার নিজস্ব ভূসম্পত্তি হতে বিশ ওয়াসাক পরিমাণ অস্থাবর সম্পত্তি আয়েশা (রাযি.) কে বিশেষভাবে প্রদান করেছেন।" ( মুয়াত্তা মালেক -১০৮৯/৪)
হাদিস/আসার নং-০২
بأن أبا بكر قد أعطى عائشة جذاذ عشرين وسقاً من سائر أولاده،
অর্থাৎ যে আবু বকর (রা.) তার সমস্ত সন্তানদের থেকে আয়েশাকে বিশ ওয়াসক বেশি দিয়েছিলেন। সূত্র: আলইসতিজকারুল জামিউ লিমাজাহিবি ফুকাহায়াল আমসার-২২ খণ্ড;২৯৫ পৃষ্ঠা
দ্বিতীয় মত: সমতা রক্ষা করা ওয়াজিব। যেমন,
التسوية بين الأولاد في الهِبة واجبة، والمفاضلة حرام، وهو المشهور عند الحنابلة، والظاهريّة، واستدلوا بظاهر حديث النعمان بن بشيرٍ رضي الله عنهما أيضًا، وقالوا: إن أمر النبيّ ﷺ لوالد النّعمان بالتسوية بين أولاده في الهبة يقتضي الوجوب.
অর্থাৎ সন্তানদের মাঝে দান করার ক্ষেত্রে সমতা রক্ষা ওয়াজিব এবং কম বেশি করা হারাম। আর এটা ফিকহি হাম্বলি ও আহলে জাহেরদের সুপ্রসিদ্ধ মত। দলিল -
عَنْ عَامِرٍ، قَالَ: سَمِعْتُ النُّعْمَانَ بْنَ بَشِيرٍ رَضِيَ اللَّهُ عَنْهُمَا، وَهُوَ عَلَى المِنْبَرِ يَقُولُ: أَعْطَانِي أَبِي عَطِيَّةً، فَقَالَتْ عَمْرَةُ بِنْتُ رَوَاحَةَ: لاَ أَرْضَى حَتَّى تُشْهِدَ رَسُولَ اللَّهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ، فَأَتَى رَسُولَ اللَّهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ، فَقَالَ: إِنِّي أَعْطَيْتُ ابْنِي مِنْ عَمْرَةَ بِنْتِ رَوَاحَةَ عَطِيَّةً، فَأَمَرَتْنِي أَنْ أُشْهِدَكَ يَا رَسُولَ اللَّهِ، قَالَ: «أَعْطَيْتَ سَائِرَ وَلَدِكَ مِثْلَ هَذَا؟»، قَالَ: لاَ، قَالَ: «فَاتَّقُوا اللَّهَ وَاعْدِلُوا بَيْنَ أَوْلاَدِكُمْ»، قَالَ: فَرَجَعَ فَرَدَّ عَطِيَّتَهُ
আমির (রহ.) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, আমি নু‘মান ইবনু বাশীর (রাঃ)-কে মিম্বরের উপর বলতে শুনেছি যে, আমার পিতা আমাকে কিছু দান করেছিলেন। তখন (আমার মাতা) আমরা বিনতে রাওয়াহা (রাঃ) বলেন, রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম)-কে সাক্ষী রাখা ব্যতীত সম্মত নই। তখন তিনি রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম)-এর নিকট আসলেন এবং বললেন, আমরা বিনতে রাওয়াহার গর্ভজাত আমার পুত্রকে কিছু দান করেছি। হে আল্লাহর রাসূল! আপনাকে সাক্ষী রাখার জন্য সে আমাকে বলেছে। তিনি আমাকে জিজ্ঞেস করলেন, তোমার সব ছেলেকেই কি এ রকম করেছ? তিনি বললেন, না। রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) বললেন, তবে আল্লাহকে ভয় কর এবং আপন সন্তানদের মাঝে সমতা রক্ষা কর। [নু‘মান (রাঃ)] বলেন, অতঃপর তিনি ফিরে গেলেন এবং তার দান ফিরিয়ে নিলেন। তাখরিজ: সহীহ বুখারি-২৫৮৭, ই’লাউস সুনান- ৫২৭৭
প্রশ্ন: ক। বিশেষ কারণে কোন সন্তানকে বেশি দান করা যাবে কি?
উত্তর: ক। অবশ্য সন্তানদের মধ্যে কেউ যদি পিতামাতার অধিক অনুগত হয় এবং তাদের খেদমত ও দেখাশোনার প্রতি অধিক যত্নবান হয় অথবা ইলম-আমল, তাকওয়া ও পরহেযগারিতে কোনো সন্তান অধিক অগ্রগণ্য হয় সেক্ষেত্রে পিতামাতা খুশি হয়ে তাকে কিছু বেশি দিতে চাইলে তা জায়েয।
তাছাড়া গরীব, অসুস্থ বেশি সম্পদ, বিশেষ প্রয়োজনেও জায়েজ এবং অবাধ্য সন্তানকে কম দেওয়া যাবে। দলিল-
أما إن كانت الزيادة في العطية لسبب معين؛ كالتميّز بفضيلة من الفضائل أو حالٍ من الأحوال، كأن يكون أحد الأبناء فقيرًا جدًا، أو مريضًا، أو يحتاج إلى مال للتعليم، ونحو ذلك من الأسباب فعندئذٍ تجوز المفاضلة ولا بأس بها.
অর্থাৎ, একজন ব্যক্তির কোন একজন সন্তান যদি অতি দরিদ্র হয়ে থাকে, কিংবা কঠিন কোন রোগে আক্রান্ত হয়ে থাকে, কিংবা শিক্ষা অর্জনের জন্য অতিরিক্ত অর্থের প্রতি মুখাপেক্ষী হয়ে থাকে, এজাতীয় যৌক্তিক কোন কারণকে কেন্দ্র করে সেই সন্তানকে বর্ধিত আকারে সম্পত্তি প্রদান করলে, সেক্ষেত্রে সন্তানদের মধ্যকার সম্পত্তি বন্টনের ক্ষেত্রে তারতম্য কিংবা হ্রাস-বৃদ্ধি ঘটানো যাবে, তাতে কোন সমস্যা নেই।
واستثنى العلماء الولد العاقّ من العدل بين الأبناء في الأعطيات، لما روى الإمام مالك عن عائشةَ رضي الله تعالى عنها زَوجِ النَّبِيِّ صلى الله عليه وسلم "أن أَبا بَكرٍ الصِّدِّيقَ كانَ نَحَلَها جَادَّ عِشْرِينَ وَسْقًا مِن مَالِهِ بِالغَابَةِ" [الموطأ 4/ 1089]، قال الإمام ابن حجر رحمه الله: "ولم يكره التفضيل كما لو أحرم فاسقاً لئلا يصرفه في معصية، أو عاقاً، أو زاد أو آثر الأحوج، أو المتميز بنحو فضل كما فعله الصديق مع عائشة رضي الله تعالى عنهما" [تحفة المحتاج 6/ 308].
অর্থাৎ,শরীয়াহ বিশেষজ্ঞগণের মতে, সন্তানদেরকে উপঢৌকন প্রদানের ক্ষেত্রে সাম্যতা বজায় রাখার বিষয়টি থেকে অবাধ্য সন্তানের বিষয়টি ব্যতিক্রম হিসেবে দেখেছেন। এর স্বপক্ষে প্রমাণ হলো, মুয়াত্তা মালেকে বর্ণিত উম্মুল মুমেনীন হজরত আয়েশা (রাযি.) এর রেওয়াত। সেখানে বিধৃত রয়েছে যে, "আবু বকর ( রাযি.) বনাঞ্চলের তার নিজস্ব ভূসম্পত্তি হতে বিশ ওয়াসাক পরিমাণ অস্থাবর সম্পত্তি আয়েশা (রাযি.) কে বিশেষভাবে প্রদান করেছেন।" ( মুয়াত্তা মালেক -১০৮৯/৪)
ইমাম ইবনে হাজার ( রাহি.) বলেন, সন্তানদের মাঝে তারতম্য করা মাকরূহ বা অপছন্দনীয় নয়। যেমন অন্যায়পথে অর্থব্যায়ের সুযোগ বন্ধ করে দেয়ার উদ্দেশ্যে কোন পিতা নিজের পাপাচারী সন্তানকে সম্পদপ্রাপ্তি থেকে বঞ্চিত করে দিলেন। অথবা নিজের অবাধ্যচারী সন্তানকে কিঞ্চিত প্রদান করলেন। অন্যদিকে অধিক মুখাপেক্ষী সন্তানকে একটু বর্ধিত আকারে প্রদান করলেন। অথবা আবু বকর (রাযি.) কর্তৃক আয়েশা (রাযি.) বিশেষ উপঢৌকন প্রদানের ন্যায় কোন সন্তানকে বিশেষভাবে কিছু প্রদান করলেন, তাহলে এতে কোন সমস্যা নেই। ( তুহফাতুল মুহতাজ -৩০৮/৬)
সারকথা হলো, উপরোক্ত কারণে সম্পদ কম বেশি দেওয়া জায়েয আছে, আর উপযুক্ত কারণ না থাকে, তাহলে পিতা-মাতার এ কাজ ঠিক হচ্ছে না। এজন্য আল্লাহর কাছে দায়ি থাকবেন। কেননা আদর সোহাগের বেলাও সমতার কথা এসেছে। দলিল-
عن أنس ، رضي الله عنه، ( أن رجلا كان جالسا مع النبي صلى الله عليه وسلم فجاء بني له فقبله وأجلسه في حجره ثم جاءت بنية فأخذها فأجلسها إلى جنبه، فقال النبي صلى الله عليه وسلم: فهلا عدلت بينهما )
জনৈক আনসারী সাহাবিকে রাসুল (সা.) ডাকলেন। ইতোমধ্যে ওই সাহাবির এক পুত্রসন্তান তার কাছে এলো। তিনি তাকে চুমু খেয়ে বুকে জড়িয়ে নিলেন এবং কোলে বসালেন। কিছুক্ষণ পর তার এক কন্যাসন্তানও সেখানে উপস্থিত হলো। তিনি তার হাত ধরে নিজের কাছে বসালেন। এটি লক্ষ করে রাসুল (সা.) বললেন, উভয় সন্তানের প্রতি তোমার আচরণ অভিন্ন হওয়া উচিত ছিল। তোমরা নিজেদের সন্তানদের মাঝে সমতা রক্ষা কর। এমনকি চুমু দেওয়ার ক্ষেত্রেও। তাখরিজ: মুসান্নাফ আবদুর রাযযাক : হাদিস ১৬৫০১
এ কারণে সন্তান মনে কষ্ট পেতেই পারে, সন্তান গুনাহগার হবে না, তবে বাহ্যিক সম্পর্ক রাখতে হবে।
وَإِن جَاهَدَاكَ عَلَىٰ أَن تُشْرِكَ بِي مَا لَيْسَ لَكَ بِهِ عِلْمٌ فَلَا تُطِعْهُمَا ۖ وَصَاحِبْهُمَا فِي الدُّنْيَا مَعْرُوفًا ۖ
পিতা-মাতা যদি তোমাকে আমার সাথে এমন বিষয়কে শরীক স্থির করতে পীড়াপীড়ি করে, যার জ্ঞান তোমার নেই; তবে তুমি তাদের কথা মানবে না এবং দুনিয়াতে তাদের সাথে সদ্ভাবে সহঅবস্থান করবে। সূরা লুকমান-১৫
والله اعلم بالصواب