জিজ্ঞাসা-১২৮৫৯:
আসসালামু আলাইকুম ওয়া রহমাতুল্লাহ। একজন জানতে চেয়েছেন একটি ছেলে একটি হিন্দু মেয়ের সাথে অবৈধ সম্পর্ক করে বিবাহ করেছে । হিন্দু মেয়েটি এখন মুসলিম হয়েছে । এখন ছেলের বাবা মা এবং পরিবারের অন্যান্য সদস্যরা এই বিবাহ মানতে চাচ্ছে না । এখন ছেলের এবং পরিবারের সদস্যদের করোনীয় কি? দলিল সহ জানালে উপকৃত হব। জাঝাকাল্লাহ।
তারিখ: ০৬/১২/২৩ ঈসায়ি/ইংরেজি
মাওলানা আসাদ ঢাকা থেকে।
জবাব:
وعليكم السلام ورحمة الله وبركاته حمده ونصل على رسوله الكريم اما بعد بسم الله الرحمن الرحيم
তাসলিম ও হামদ-সানার পর প্রথম কথা হলো, আপনার প্রশ্নকে সহজ ভাবে বোঝার জন্য তিনটি অংশে জবাব দেওয়া হবে ইনশাআল্লাহ।
ক। অবৈধ সম্পর্ক করে বিবাহ করেছে ।
জবাব: বিবাহ বহির্ভূত সম্পর্ক তথা অবৈধ সম্পর্ক ইসলামে হারাম তাই ঐ ছেলেটির এই কারণে কবিরা গুনাহ হয়েছে। তওবা করে না থাকলে তওবা করা জরুরী।
খ। হিন্দু মেয়েটি এখন মুসলিম হয়েছে ।
জবাব: প্রথম কথা হল, কোন অমুসলিমকে মুসলমান বানানো অনেক বড় সওয়াবের কাজ। তাই ছেলেটি সেই সওয়াবের ভাগি হবে।
দ্বিতীয় কথা হল, হিন্দু মেয়েটি যদি বিবাহর পরে মুসলমান হয়, তাহলে বিবাহ পুনরায় পড়াতে হবে।
গ। এখন ছেলের বাবা মা এবং পরিবারের অন্যান্য সদস্যরা এই বিবাহ মানতে চাচ্ছে না।
জবাব: নির্দোষ কোন স্ত্রীকে পিতা-মাতার চাপে বা আদেশে তালাক দেওয়া জায়েজ নয় ( এ বিষয়ে জিজ্ঞাসা-১২৫১৮ নং শিরোনামে মাসয়ালাটি বিস্তারিত আলোচনা হয়েছে)। দলিল -
لا شك أن الوالدين هما أحق الناس بالبر والطاعة والإحسان والمعاملة الحسنة ، وقد قرن الله سبحانه الأمر بالإحسان إليهما بعبادته حيث قال : ( وَقَضَى رَبُّكَ أَلا تَعْبُدُوا إِلا إِيَّاهُ وَبِالْوَالِدَيْنِ إِحْسَاناً ) الإسراء/23 .
وطاعة الوالدين واجبة على الولد فيما فيه نفعهما ولا ضرر فيه على الولد ، أما ما لا منفعة لهما فيه ، أو ما فيه مضرة على الولد فإنه لا يجب عليه طاعتهما حينئذ .
এতে কোন সন্দেহ নেই যে পিতামাতার আনুগত্য, দয়া এবং উত্তম আচরণের সবচেয়ে বেশি যোগ্য।
পিতা-মাতার আনুগত্য সন্তানের জন্য বাধ্যতামূলক যেটি তাদের উপকার করে এবং সন্তানের ক্ষতি করে না, এতে তাদের কোন উপকার হয় না বা যা সন্তানের জন্য ক্ষতিকর সে ক্ষেত্রে তাদের আনুগত্য করা বাধ্যতামূলক নয়। কেননা আনুগত্য কেবল ভাল বিষয়ে। দলিল:
হাদিস নং-০১
عن النبي عليه الصلاة والسلام أنه قال : " إنما الطاعة في المعروف
নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন: "আনুগত্য কেবল ভাল জিনিসের মধ্যে।" তাখরিজ: বুখারি ৭২৫৭
হাদিস নং-০২
দ্বিতীয় কথা হলো, স্বামী স্ত্রী বিচ্ছেদের মাধ্যমে ব্যভিচারের লিপ্ত হওয়ার ও নানা ফিতনার আশঙ্কা রয়েছে। যা নিম্নের হাদিস থেকে প্রমাণিত হয়:
، عَنْ جَابِرٍ، قَالَ قَالَ رَسُولُ اللَّهِ صلى الله عليه وسلم " إِنَّ إِبْلِيسَ يَضَعُ عَرْشَهُ عَلَى الْمَاءِ ثُمَّ يَبْعَثُ سَرَايَاهُ فَأَدْنَاهُمْ مِنْهُ مَنْزِلَةً أَعْظَمُهُمْ فِتْنَةً يَجِيءُ أَحَدُهُمْ فَيَقُولُ فَعَلْتُ كَذَا وَكَذَا فَيَقُولُ مَا صَنَعْتَ شَيْئًا قَالَ ثُمَّ يَجِيءُ أَحَدُهُمْ فَيَقُولُ مَا تَرَكْتُهُ حَتَّى فَرَّقْتُ بَيْنَهُ وَبَيْنَ امْرَأَتِهِ - قَالَ - فَيُدْنِيهِ مِنْهُ وَيَقُولُ نِعْمَ أَنْتَ " . قَالَ الأَعْمَشُ أُرَاهُ قَالَ " فَيَلْتَزِمُهُ " .
আবু কুরায়ব মুহাম্মাদ ইবনুল আ’লা ও ইসহাক ইবনে ইবরাহীম (রাহঃ) ... জাবির (রাযিঃ) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন রাসূলুল্লাহ (ﷺ) বলেনঃ ইবলীস পানির উপর তার আরশ স্থাপন করে তার বাহিনী প্রেরণ করে। তাদের মধ্যে তার সর্বাধিক নৈকট্যপ্রাপ্ত সেই যে সর্বাধিক ফিতনা সৃষ্টিকারী। তাদের একজন এসে বলে, আমি অমুক অমুক কাজ করেছি। সে বলে, তুমি কিছুই করনি। অতঃপর অন্যজন এসে বলে, অমুকের সাথে আমি সকল প্রকার ধোঁকার আচরণই করেছি। এমনকি তার থেকে তার স্ত্রীকে বিচ্ছিন্ন না করা পর্যন্ত আমি তাকে ছেড়ে দেই নি। অতঃপর শয়তান তাকে তার নিকটবর্তী করে নেয় এবং বলে হ্যাঁ, তুমি একটি বড় কাজ করেছ। বর্ণনাকারী আ’মাশ বলেন, আমার মনে হয়, তিনি বলেছেনঃ অতঃপর শয়তান তাকে তার বুকের সাথে জড়িয়ে নেয়। তাখরিজ: সহীহ মুসলিম, হাদীস নং ৬৮৪৬
তৃতীয় কথা হলো, বিনা কারণে কোন মুসলমানকে কষ্ট দেওয়া হারাম। দলিল:
وَالَّذِينَ يُؤْذُونَ الْمُؤْمِنِينَ وَالْمُؤْمِنَاتِ بِغَيْرِ مَا اكْتَسَبُوا فَقَدِ احْتَمَلُوا بُهْتَانًا وَإِثْمًا مُّبِينًا
যারা বিনা অপরাধে মুমিন পুরুষ ও মুমিন নারীদেরকে কষ্ট দেয়, তারা মিথ্যা অপবাদ ও প্রকাশ্য পাপের বোঝা বহন করে। সূরা আহযাব -৫৭
চতুর্থ কথা হলো, স্ত্রীর সাথে সদাচরণ করা নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। দলিল:
وَعَاشِرُوهُنَّ بِالْمَعْرُوفِ
আর তোমরা স্ত্রীদের সঙ্গে সদাচারণ কর। (সূরা নিসা ১৯)
ব্যাখ্যা: বিনা কারণে তাকে তালাক দেওয়া সদাচরণের অন্তর্ভুক্ত নয়।
পঞ্চম কথা হলো, পিতা-মাতার আদেশ মান্য করা জরুরি;কিন্তু তারা যদি অন্যায় আদেশ করে, তাহলে তা পালন করা হারাম। কেননা, ইসলামের শিক্ষা হল,
لا طاعة لمخلوق في معصية الخالق
অর্থাৎ আল্লাহর প্রতি অবাধ্যতা যেখানে আসবে, সেখানে সৃষ্টির আনুগত্য করা যাবে না। সৃষ্টির আনুগত্যের সীমারেখা বর্ণনা করতে গিয়ে রাসূলসাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন,
فَإِنْ أُمِرَ بِمَعْصِيَةٍ، فَلَا سَمْعَ وَلَا طَاعَةَ
অর্থাৎ অসৎকাজে আনুগত্য নয় ;আনুগত্য কেবলমাত্র সৎকাজের ক্ষেত্রেই হতে হবে। (সহীহ বুখারী, হাদীস নং ৭১৪৫)
এ বিষয়ে শায়েখ ইবনে তায়মিয়া রহ কে জিজ্ঞেস করা হলে, তিনি বলেন,
قال شيخ الإسلام ابن تيمية رحمه الله في الاختيارات ص 114 : " ويلزم الإنسان طاعة والديه في غير المعصية ،وإن كانا فاسقين ... وهذا فيما فيه منفعة لهما ، ولا ضرر عليه " اهـ .
والطلاق من غير سببٍ يبيحه يكرهه الله تعالى ، لما فيه من هدر لنعمة الزوجية ، وتعريض الأسرة للضياع والأولاد للتشتت ، وقد يكون فيه ظلم للمرأة أيضا ، وكون الزوجة كانت خادمة في الماضي ليس سببا شرعيا يبيح الطلاق ، لاسيما إذا كانت مستقيمة في دينها وخلقها.
অর্থাৎ “একজন ব্যক্তির অবাধ্যতা ব্যতীত অন্যান্য বিষয়ে তার পিতামাতার আনুগত্য করা আবশ্যক, যদিও তারা অনৈতিক হয়… এটি বিভিন্ন ক্ষেত্রে প্রযোজ্য যা তাদের জন্য উপকারী এবং তার কোন ক্ষতি নেই।
বৈধ কারণ ছাড়া বিবাহ বিচ্ছেদ আল্লাহ তাআলা ঘৃণা করেন, কারণ এটি বিবাহের আশীর্বাদকে নষ্ট করে এবং পরিবারকে ক্ষতির সম্মুখীন করে এবং সন্তানদের ছত্রভঙ্গ করে দেয়, এবং এটি মহিলার প্রতি অন্যায্যও হতে পারে, এবং অতীত একটি বৈধ কারণ নয় যা বিবাহবিচ্ছেদের অনুমতি দেয়, বিশেষ করে যদি সে তার ধর্মীয় প্রতিশ্রুতি এবং নৈতিকতায় ন্যায়পরায়ণ হয়।
وعلى هذا ، لا تجب طاعة الوالدين في طلاق هذه الزوجة ولا يعتبر هذا من العقوق لهما ،
এর ভিত্তিতে, এই স্ত্রীকে তালাক দেওয়ার ক্ষেত্রে পিতামাতার আনুগত্য করা বাধ্যতামূলক নয়, এবং এটি তাদের অবাধ্য বলে বিবেচিত হয় না। সূত্র: আল-ইখতিয়ারাত-১১৪
সারকথা হলো, এখন ছেলের জন্য করণীয় হল, মেয়েটিকে ধার্মিক করে তোলা এবং সুখময় দাম্পত্য জীবন গড়া এবং পরিবারের সদস্যদের দায়িত্ব হল মেয়েটিকে মেনে নেওয়া, যেহেতু বিবাহ হয়েছে, মেয়ের জীবনকে তো আর নষ্ট করা যায় না।
নব মুসলিমা এই বোনটি তাদের পিতা-মাতা বা স্বজাতির কাছে ফিরে গেলে দীন-ধর্ম আর টিকাতে পারবে না। তাই এই নওমুসলিমের দীন-ঈমানের হেফাজতের জন্য পরিবারের উচিত তাকে মেনে নেওয়া। কোন মুসলিম অপর মুসলিমকে বিপদে ঢেলে দিতে পারে না।
والله اعلم بالصواب