আল-বুরহান ( দলিল-প্রমাণ)

আসসালামু আলাইকুম ওয়া রহমাতুল্লাহ! আমাদের ওয়েবসাইটে আপনাকে স্বাগতম। একটু নিচে দেখুন> বিষয় ভিক্তিক সাজানো রয়েছে, আপনার পছন্দ অনুযায়ী পাঠ করুন এবং পোষ্টগুলো ভালো লাগলে শেয়ার করুন আর আপনার কোন প্রশ্ন থাকলে এই নাম্বারে- ০১৬৮৭-১১৩৮৮০ হোয়াটস অ্যাপে পাঠিয়ে দিন । জাযাকাল্লাহু খাইর।

মোটিভেশন ক্লাস -২৪: ইসলামে পরিবেশ সংরক্ষণ

No Comments

 



ইসলামে পরিবেশ সংরক্ষণ

- জসিম বিন আখতার 

 ভূমিকা :- মহান রব্বুল আ’লামীন পবিত্র ক্বুরআনুল কারীমে ঘোষণা করেন - ظَهَرَ الْفَسَادُ فِي الْبَرِّ وَالْبَحْرِ بِمَا كَسَبَتْ أَيْدِي النَّاسِ لِيُذِيقَهُمْ بَعْضَ الَّذِي عَمِلُوا لَعَلَّهُمْ يَرْجِعُونَ – “মানুষের কৃত কর্মের কারণে স্থলে ও সমুদ্রে বিপর্যয় ছড়িয়ে পড়েছে , যার ফলে তাদেরকে কোন কোন কর্মের শাস্তি তিনি আস্বাদন করান যাতে তারা ফিরে আসে ” ( সূরা আররূম – ৪১) । পরিবেশ বর্তমান সময়ের সর্বাধিক আলোচিত বিষয় । একবিংশ শতাব্দীর শুরুতে এসে এটি একটি আন্তর্জাতিক ইস্যুতে পরিণত হয়েছে । পরিবেশের প্রতিটি জীব ও জড় একে অন্যের প্রতি গভীর ভাবে নির্ভরশীল । কোন একটির অস্তিত্বে টান পড়লে তার প্রভাব অন্যটির উপর পতিত হয় । মানব সভ্যতার অস্তিত্ব ও বিকাশ সাধনের জন্য পরিবেশের ভারসাম্য পূর্ণ সহাবস্থান অতীব জরুরী । কেননা পরিবেশের ভারসাম্যহীনতায় আজকের আধুনিক বিশ্ব বিপর্যস্ত । বন্যা ,ভূমিকম্প , ঝড় ,জলোচ্ছাস , টাইফুন , টর্নেডো , এসিড বৃষ্টি , খরা এবং ভূমিধ্বসের মত প্রাকৃতিক বিপর্যয়ের হাত থেকে প্রযুক্তি বিদ্যায় সমৃদ্ধ উন্নত বিশ্বও রেহাই পাচ্ছে না । গ্রীণহাউজ ইফেক্ট,কার্বনডাই অক্সাইড নিসরণ এবং সূর্যের অতিবেগুণী রশ্মির প্রভাবে ওজোন স্তরে তারতম্য,শব্দ বায়ু পানি দূষণ ও অর্সেনিক সহ নানাবিধ বিপর্যয়ের মুখোমুখি আজকের সভ্যতা গর্বী বনী আদম । আজ সারাবিশ্বের বিজ্ঞানীরা “ পরিবেশ দূষণ রোধ করুন ” “ বৃক্ষ নিধন বন্ধ করুন ” “গাছ লাগান পরিবেশ বাঁচান” ইত্যাদি শ্লোগানে মেতে উঠেছেন । বিশ্বব্যাপী চলছে পরিবেশ বিপর্যয়ের হাত থেকে পরিত্রাণের উপায় ও পন্থা উদ্ভাবনের নিরলস প্রচেষ্টা । কানাডার মন্ট্রিল চুক্তি, ব্রাজিলের রিওডি জেনিরো আর্থ সামিট ১৯৯২ , মেক্সিকোর কানকুন ধরিত্রি সম্মেলন তারই অংশ বিশেষ । জনগণকে পরিবেশ বিষয়ে সচেতন করে তোলার জন্য সংশ্লিষ্ট দেশের সরকার বিভিন্ন সেমিনার, সিম্পোজিয়াম ,গবেষণা , বিজ্ঞাপন প্রভৃতিতে কোটি কোটি টাকা খরচ করছে । এর ফলে বন ও পরিবেশ বিষয়ক একটি পৃথক মন্ত্রণালয় গঠিত হয়েছে এবং এটি একটি স্বতন্ত্র সাবজেক্ট হিসেবে ইউনিভার্সিটির পাঠ্য করা হয়েছে । অথচ ভাবতেই অবাক লাগে যে আজকের যুগে সৃষ্ট পরিবেশ বিপর্যয় ও দূষণের মত একটা বিরাট সমস্যাকে প্রায় দেড় হাজার বছর পূর্বে ইসলাম অনুভব করেছে এবং এর সংরক্ষণ তথা সমাধানের উপায়ও বলে দিয়েছে ।

পরিবেশ সম্পর্কে আজকের মানুষ যতটুকু জ্ঞান রাখে তার ছিটে ফোটাও যখন ছিল না সেই পূঁতিগন্ধময় পরিবেশের আবরণ ভেদ করে যিনি ঊষার আলো ছড়ালেন তিনিই আমাদের প্রিয় নবী মুহাম্মদ (সাঃ) । উম্মী নবী ক্বুরআনুল কারীমের শিক্ষার আলোকে নিজের অনুপম চরিত্র ও আদর্শের মাধ্যমে বিশ্ববিবেককে জানালেন পরিবেশ সংরক্ষণের কৌশল , দীক্ষা দিলেন সুস্থ ও সুন্দর পরিবেশ গঠনের । বৃক্ষ রোপনকে সদকায়ে জারিয়া ঘোষণা দিলেন , মক্কা ও মদীনার বিশেষ এলাকাকে সংরক্ষিত এলাকা হিসেবে ঘোষণা করে উদ্ভিদ গাছপালা কর্তন এবং জীব জন্তু হত্যা নিষেধ করে পরিবেশগত ভারসাম্য রক্ষায় তার দূর দৃষ্টিরই পরিচয় দিয়েছিলেন । যখন মানুষের কল্পনায় Society for prevention of cruelty to animals বা পশু ক্লেশ নিবারণ সমিতির কথা উদ্ভব হয়নি তখন মহানবী ( সাঃ ) জীব জন্তুকে কষ্ট থেকে নিষ্কৃতি দিতে মানব জাতির দৃষ্টি আকর্ষণ করে বলেন “ সওয়ারীর পশু ক্লান্ত হয়ে গেলে তার উপর থেকে নেমে পড় ” । রাসূলের প্রজ্ঞা ও দূরদর্শিতা আজকের আধুনিক বিশ্বেও বিস্ময়কর ! আল্লাহ প্রদত্ত গাইড বুক আল-ক্বুরআনের মাধ্যমে তিনি যে নৈতিক বিপ্লব সাধন করেছিলেন যা পরিবেশ সংরক্ষণের নিয়ামক শক্তি , তা আজকাল শুধু নয় ,কিয়ামত পর্যন্ত পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষায় পথ নির্দেশ দানে সক্ষম । 

 পরিবেশের সংজ্ঞা :- পরিবেশের আরবী আভিধানিক প্রতিশব্দ بيئة , আর ইংরেজিতে Environment , পরিবেশ সম্পর্কিত বিদ্যাকে বলাহয় Ecology বা বস্তু বিজ্ঞান । পরিভাষায় – ড. মাহমুদ সালেহ আদেলী তার الإسلام البيئة নামক গ্রন্থে বলেন – মানব মন্ডলীকে বেষ্টন করে আল্লাহ রাব্বুল আলামীনের যে সৃষ্টি জগৎ তাকেই পরিবেশ বলা হয় । সুতরাং পরিবেশ বলতে পৃথিবীর সব কিছু যা ভূ পৃষ্ঠ থেকে বায়ুমন্ডলের ওজোনস্তর পর্যন্ত বিস্তৃত – আলো- বাতাস, মাটি -পানি , মেঘ - কুয়াশা,বন-জঙ্গল,পাহাড়-পর্বত,সাগর-নদী , মানব নির্মিত সকল প্রকার অবকাঠামো এবং গোটা উদ্ভিদ ও প্রাণী জগৎ সমন্বয়ে যা সৃষ্ট তাই পরিবেশ ।

 পরিবেশের প্রকারভেদ :- প্রথমত দুই প্রকার : 

  ১. Natural Environment. ২. Human Environment.

ড. মাহমুদ সালেহ আদেলী বলেন তিন প্রকার , উপরোক্ত দুইটি সহ তৃতীয়টি হলো – Biological Environment. 


পরিবেশ সম্পর্কে আল্লাহ রব্বুল আলামীনের বাণী -وَاذْكُرُوا إِذْ جَعَلَكُمْ خُلَفَاءَ مِنْ بَعْدِ عَادٍ وَبَوَّأَكُمْ فِي الْأَرْضِ تَتَّخِذُونَ مِنْ سُهُولِهَا قُصُورًا وَتَنْحِتُونَ الْجِبَالَ بُيُوتًا فَاذْكُرُوا آلَاءَ اللَّهِ وَلَا تَعْثَوْا فِي الْأَرْضِ مُفْسِدِين – “তোমরা স্মরণ কর, যখন তোমাদেরকে আদ জাতির পরে প্রতিনিধি করেছেন; তোমাদেরকে পৃথিবীতে ঠিকানা দিয়েছেন । তোমরা নরম মাটিতে অট্টালিকা নির্মাণ কর এবং পর্বত গাত্র খনন করে প্রকোষ্ঠ নির্মাণ কর । অতএব আল্লাহর অনুগ্রহ স্মরণ কর এবং পৃথিবীতে অনর্থ সৃষ্টি করো না ’’ (সূরা আরাফ-৭৪) । 


আল্লাহ তাআ’লা তার সৃষ্টি কুলের মাঝে কেবল মানব জাতিকে ভূ পৃষ্ঠে তার প্রতিনিধিত্ব প্রদান করে শ্রেষ্ঠত্বের মর্যাদা দিয়েছেন বিবেক বুদ্ধি চিন্তা শক্তি ও জ্ঞানের নিয়ামত দ্বারা পরিবেশের সকল বস্তু সামগ্রীর উপরে শ্রেষ্ঠত্ব ও কর্তৃত্ব প্রদান করেছেন । যেমন আল্লাহর বাণী -وَلَقَدْ كَرَّمْنَا بَنِي آدَمَ وَحَمَلْنَاهُمْ فِي الْبَرِّ وَالْبَحْرِ وَرَزَقْنَاهُمْ مِنَ الطَّيِّبَاتِ وَفَضَّلْنَاهُمْ عَلَى كَثِيرٍ مِمَّنْ خَلَقْنَا تَفْضِيلًا – “নিশ্চয়ই আমি আদম সন্তানকে মর্যাদা দান করেছি, আমি তাদেরকে স্থলে ও জলে চলাচলের বাহন দান করেছি; তাদেরকেউত্তম জীবনোপকরণ প্রদান করেছি এবং তাদেরকে অনেক সৃষ্ট বস্তুর উপর শ্রেষ্ঠত্ব দান করেছি ’’ (সূরা ইসরা-৭০) । 

এই মানুষের মধ্যে তিনটি উপাদান রয়েছে : ১। জৈবিক 

     ২। মনস্তাত্তিক 

     ৩। পরিবেশগত ।

 আর মানুষের তৈরী বাড়ী-ঘর, আসবাব-পত্র, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, রীতি-নীতি ইত্যাদি মানব পরিবেশের অন্তর্ভুক্ত। পরিবেশ ও মানব জীবন অবিচ্ছেদ্য বন্ধনে আবদ্ধ। পরস্পরের নির্ভরশীলতা, সংঘাত ও একাত্মতার চিত্র সভ্যতার সেই সূচনা লগ্ন থেকেই বিদ্যমান।


 এই পরিবেশ উন্নয়ন ও সংরক্ষণ করার নির্দেশ আল্লাহ তাআ’লা দিয়েছেন আজ থেকে প্রায় দেড় হাজার বছর আগে 

  “তার কারণ এই যে, ذَلِكَ بِأَنَّ اللَّهَ لَمْ يَكُ مُغَيِّرًا نِعْمَةً أَنْعَمَهَا عَلَى قَوْمٍ حَتَّى يُغَيِّرُوا مَا بِأَنْفُسِهِمْ وَأَنَّ اللَّهَ سَمِيعٌ عَلِيمٌ

আল্লাহ কখনও পরিবর্তন করেন না, সে সব নেয়ামত, যা তিনি কোন জাতিকে দান করেছিলেন, যতক্ষণ না সে জাতি নিজেই পরিবর্তিত করে দেয় নিজের জন্য নির্ধারিত বিষয়। বস্তুতঃ আল্লাহ শ্রবণকারী, মহাজ্ঞানী ’’ (সূরা আনফাল - ৫৩) । 

অন্যত্র আল্লাহ বলেন - أَلَمْ تَرَوْا أَنَّ اللَّهَ سَخَّرَ لَكُمْ مَا فِي السَّمَاوَاتِ وَمَا فِي الْأَرْضِ وَأَسْبَغَ عَلَيْكُمْ نِعَمَهُ ظَاهِرَةً وَبَاطِنَةً وَمِنَ النَّاسِ مَنْ يُجَادِلُ فِي اللَّهِ بِغَيْرِ عِلْمٍ وَلَا هُدًى وَلَا كِتَابٍ مُنِيرٍ – “তোমরা কি দেখ না আল্লাহ নভোমন্ডল ও ভূ-মন্ডলে যা কিছু আছে, সবই তোমাদের কাজে নিয়োজিত করে দিয়েছেন এবং তোমাদের প্রতি তাঁর প্রকাশ্য ও অপ্রকাশ্য নেয়ামতসমূহ পরিপূর্ণ করে দিয়েছেন? এমন লোক ও আছে; যারা জ্ঞান,পথনির্দেশ ও উজ্জ্বল কিতাব ছাড়াই আল্লাহ সম্পর্কে বাকবিতন্ডা করে ’’ (সূরা লুকমান - ২০) । 


এ জন্য রাসূল (সাঃ) প্রত্যেক মানুষকে তাদের নিজ নিজ দায়িত্ব সঠিক ভাবে ক্ষমতার আলোকে পালনের নির্দেশ দিয়ে বলেন-

عَبْدَ اللَّهِ بْنَ عُمَرَ، يَقُولُ: سَمِعْتُ رَسُولَ اللَّهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ يَقُولُ: «كُلُّكُمْ رَاعٍ، وَكُلُّكُمْ مَسْئُولٌ عَنْ رَعِيَّتِهِ، الإِمَامُ رَاعٍ

وَمَسْئُولٌ عَنْ رَعِيَّتِهِ، وَالرَّجُلُ رَاعٍ فِي أَهْلِهِ وَهُوَ مَسْئُولٌ عَنْ رَعِيَّتِهِ، وَالمَرْأَةُ رَاعِيَةٌ فِي بَيْتِ زَوْجِهَا وَمَسْئُولَةٌ عَنْ رَعِيَّتِهَا ، وَالخَادِمُ رَاعٍ فِي مَالِ سَيِّدِهِ وَمَسْئُولٌ عَنْ رَعِيَّتِهِ» قَالَ: - وَحَسِبْتُ أَنْ قَدْ قَالَ - «وَالرَّجُلُ رَاعٍ فِي مَالِ أَبِيهِ وَمَسْئُولٌ عَنْ رَعِيَّتِهِ، وَكُلُّكُمْ رَاعٍ وَمَسْئُولٌ عَنْ رَعِيَّتِهِ»  

- আব্দুল্লাহ ইব্ন উমর (রা.) বলেন আমি রাসূলুল্লাহ (সাঃ) কে বলতে শুনেছি , তোমরা সকলেই রক্ষণা-বেক্ষণকারী এবং তোমাদের প্রত্যেককেই অধীনস্থদের (দায়িত্ব) সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করা হবে । ইমাম একজন দায়িত্বশীল ব্যক্তি ,তাকে তার অধীনস্থদের সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করা হবে । নারী তার স্বামীর গৃহের কর্ত্রী তাকে তার অধীনস্থদের সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করা হবে । খাদেম তার মনিবের সম্পদের রক্ষক , তাকেও তার মনিবের ধন-সম্পদ সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করা হবে । ইব্ন উমর (রা.) বলেন , আমার মনে হয় রাসূল (সাঃ) আরো বলেছেন : পুত্র তার পিতার সম্পদের রক্ষক এবং এগুলো সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করা হবে । তোমরা সবাই রক্ষণাবেক্ষণকারী এবং সবাইকে তাদের অর্পিত দায়িত্ব সম্পর্কে প্রশ্ন করা হবে ( বুখারী –কিতাবুল জুমুআ) । 


আর এই পরিবেশ সম্পর্কে সচেতনতাই পরিবেশ সংরক্ষণের নিয়ামক শক্তি । এই শক্তির মাধ্যমে দায়িত্বানুভূতি জাগিয়ে তোলা আবশ্যক । এই পরিবেশ বিপর্যয়ের অন্যতম কারণ সম্পর্কে আল্লাহর বাণী - ظَهَرَ الْفَسَادُ فِي الْبَرِّ وَالْبَحْرِ بِمَا كَسَبَتْ أَيْدِي النَّاسِ لِيُذِيقَهُمْ بَعْضَ الَّذِي عَمِلُوا لَعَلَّهُمْ يَرْجِعُونَ – “মানুষের কৃত কর্মের কারণে স্থলে ও সমুদ্রে বিপর্যয় ছড়িয়ে পড়েছে , যার ফলে তাদেরকে কোন কোন কর্মের শাস্তি তিনি আস্বাদন করান যাতে তারা ফিরে আসে ”( সূরা আররূম – ৪১) । 


পৃথিবীর পরিবেশকে আল্লাহ মানুষের অনুগত করে দিয়েছেন তার মানে এই নয় যে , সে যা ইচ্ছা তাই করে বেড়াবে বরং এখানে কিছু Restriction বা সীমা রেখা দেয়া হয়েছে , যেমন : ফাসাদ সৃষ্টি করা যাবে না , মহান আল্লাহ বলেন - وَإِذَا تَوَلَّىٰ سَعَىٰ فِي الْأَرْضِ لِيُفْسِدَ فِيهَا وَيُهْلِكَ الْحَرْثَ وَالنَّسْلَ وَاللَّـهُ لَا يُحِبُّ الْفَسَادَ “যখন ফিরে যায় তখন চেষ্টা করে যাতে সেখানে অকল্যাণ সৃষ্টি করতে পারে এবং শস্যক্ষেত্র ও প্রাণনাশ করতে পারে। আল্লাহ ফাসাদ ও দাঙ্গা-হাঙ্গামা পছন্দ করেন না ’’ (সূরা বাক্বারা - ২০৫) । 

 

আল্লাহর সীমারেখায় অবস্থানের আর লঙ্ঘনের দৃষ্টান্ত নুমান ইব্ন বাশীর বর্ণিত হাদীসে রাসূল (সাঃ) বলেন – নৌযানে আরোহী দুই দলের দৃষ্টান্ত নিম্নরূপ - عن نعمان بن بشير (رضـ ) قال قال رسول الله صلى الله عليه وسلم مثل المدهن فى حدود الله و الواقع فيها مثل قوم استهموا السفينة فصار بعضهم فى أسفلها و صار بعضهم فى أعلاها فكان الذى فى أسفلها يمر بالماء على الذين فى أعلاها فتأذوا به فأخذ فأسا فجعل ينقر أسفل السفينة فأتوه فقالوا ما لك قال تأذيتم بى و لابد لى من الماء فإن أخذوا على يديه أنجوه و نجوا أنفسهم و إن تركوه أهلكوا و أهلكوا أنفسهم (رواه البخارى) - “আল্লাহর প্রতিষ্ঠিত আইন সম্পর্কে উদারনীতি পোষণকারী এবং উহার সীমালঙ্ঘনকারী লোকদের দৃষ্টান্ত হচ্ছে সেই লোক সমষ্টির ন্যায় যারা এক খানি নৌকায় আরোহন করার জন্য লটারী ধরেছে এবং উহার ফল অনুযায়ী কিছুলোক উহার উপরিভাগে আরোহন করে আর কিছু লোক বসে উহার নীচের তলায় । নীচের দিকে যারা ছিল তারা পানি নিয়ে উপরের তলায় উপবিষ্ট লোকদের নিকট দিয়ে যাতায়াত করত । ইহাতে উপরের তলায় লোকদের ভারী কষ্ট অনুভূত হতো । উহা দেখে নীচের তলার লোকদের মধ্য থেকে একজন কুড়াল নিয়ে নৌকার তলায় ছিদ্র করতে শুরু করল । এ সময় উপর তলার লোকজন তার নিকট এসে প্রশ্ন করল তুমি এটা কী করছ ? সে উত্তর দিল তোমরা আমার যাতায়াতের দরুন কষ্ট অনুভব কর , অথচ আমার পানি না হলেই চলে না । এরূপ অবস্থায় উপরি ভাগের লোকেরা যদি তার হাত ধরে নৌকা ছিদ্র করা বন্ধ করে দেয় তবে তারা সে লোককে ধ্বংসের হাত থেকে বাঁচাতে পারে এবং নিজেরাও ধ্বংসের হাত থেকে বাঁচতে পারে । আর তাকে যদি এরূপ অবস্থায় ছেড়ে দেয়া হয় তবে তারা নিজেরাও ধ্বংস হবে এবং অন্য লোকদেরও ধ্বংস করে ছাড়বে ’’ ।  

এভাবে অনেক বিষয় রয়েছে যেগুলো পরিবেশ সংরক্ষণের প্রকাশ্য ইঙ্গিত বহন করে । অপরদিকে রাসূল (সাঃ) এর আদেশ নিষেধও হুদুদুল্লাহর এর মধ্যে গণ্য – যেমন : ইবনে মাজাহ নামক হাদীস গ্রন্থে বর্ণিত - أن رسول الله صلى الله عليه وسلم مر بسعد و هو يتوضأ فقال ما هذا أسرف – فقال أفى الوضوء إسراف قال نعم وإن كنت على نهر جار (مسند أحمد) “রাসূল (সাঃ) একদা সাদ ইবনে আবি ওয়াক্বাস (রাঃ) এর পাশদিয়ে গমন করছিলেন এমতাবস্থায় যে সাদ (রাঃ) অযু করছিলেন, অতপর রাসূল (সাঃ) বলেন এ কী অপচয়! অতপর সাদ (রাঃ) বলেন অযুর মধ্যেও কি অপচয় হয় ? রাসূল (সাঃ) বলেন হ্যাঁ যদিও প্রবাহিত নদীর পানিতে অযু কর ’’ । 


পরিবেশ সংরক্ষণে অপচয় রোধ করাও একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় যে ব্যাপারে ইসলাম হাজার বছর পূর্বেই আলোকপাত করেছে , এ হাদীসটি তার উজ্জ্বল প্রমাণ । পরিবেশের উন্নয়ন ও সংরক্ষণে আল্লাহর এ বাণী বিশেষ ভাবে উল্লেখ করা যায় - لَهُ مُعَقِّباتٌ مِن بَينِ يَدَيهِ وَمِن خَلفِهِ يَحفَظونَهُ مِن أَمرِ اللَّـهِ إِنَّ اللَّـهَ لا يُغَيِّرُ ما بِقَومٍ حَتّى يُغَيِّروا ما بِأَنفُسِهِم وَإِذا أَرادَ اللَّـهُ بِقَومٍ سوءًا فَلا مَرَدَّ لَهُ وَما لَهُم مِن دونِهِ مِن والٍ -“ তাঁর পক্ষ থেকে অনুসরণকারী রয়েছে তাদের অগ্রে এবং পশ্চাতে, আল্লাহর নির্দেশে তারা ওদের হেফাযত করে। আল্লাহ কোন জাতির অবস্থা পরিবর্তন করেন না, যে পর্যন্ত না তারা তাদের নিজেদের অবস্থা পরিবর্তন করে। আল্লাহ যখন কোন জাতির উপর বিপদ চান, তখন তা রদ হওয়ার নয় এবং তিনি ব্যতীত তাদের কোন সাহায্যকারী নেই ’’ (সূরা রাদ - ১১) । সুতরাং আমাদের পরিবেশ আমাদেরকেই সংরক্ষণ করতে হবে । 


 বিশ্ব পরিবেশ সংরক্ষণের লক্ষ্যে পৃথিবীতে অনেক সংগঠন সংস্থা গঠিত হয়েছে, যেমন -

*** International Union for Conservation of Nature (IUCN) 1948. 

*** The World Wild Life Fund – 1961.

*** The United Nations Environmental Program (UNEP) 1972. এই সংস্থা বিশ্ব পরিবেশের মান ঠিক রাখার জন্য ১৯৮০ সালে World Conservation Strategy নামক পরিকল্পনা পেশ করে । বর্তমান বিশ্ব পরিবেশ সংরক্ষণের চাহিদা পূরণে এই Strategy গূরুত্বপূর্ণ সহযোগিতা করছে ।


অথচ ভাবতে অবাক লাগে প্রায় দেড় হাজার বছর আগে পরিবেশ সংরক্ষণের বিষয়টিকে মুহাম্মদ (সাঃ) তার কর্মতৎপরতায় প্রকাশ ঘটিয়েছেন । মক্কা – মদীনা উভয়টি সংরক্ষিত এলাকা । সেখানে প্রাণী হত্যা ,গাছপালা কর্তন অধ্যাবধি নিষিদ্ধ ।

 হযরত আব্বাস ইবনে তামীম তার চাচা থেকে বর্ণনা করেন রাসূল (সাঃ) বলেন - إن إبراهيم حرم مكة و دعا لأهلها و إنى حرمت المدينة كما حرم إبراهيم مكة (متفق عليه). -“ইবরাহীম (আঃ) মক্কাকে পবিত্র ঘোষণা করেছেন এবং এর অধিবাসীদের জন্য দুআ’ করেছেন আর আমি মদীনাকে পবিত্র ঘোষণা করলাম যেমন ইবরাহীম (আঃ) মক্কাকে পবিত্র ঘোষণা করেছেন ’’ (বুখারী – মুসলিম)। 

এছাড়াও পরিবেশ সংরক্ষেণের জন্য রাসূল (সাঃ) বদ্ধ পানিতে মলমূত্র ত্যাগ করতে নিষেধ করেছেন ।



উপসংহার :- উপরের আলোচনায় যে বিষয়টি অত্যন্ত পরিস্কার ভাবে বুঝা যায় আজকের বিশ্ব “ গাছ লাগাও পরিবেশ বাঁচাও ’’ নামে যে আহব্বান নতুন করে নিয়ে এসেছে এটা ইসলামের পরিবেশ সংরক্ষণ বিষয়ক দেড় হাজার বছরের পুরোনো আহব্বানেরই নব সংস্করণ মাত্র । অথচ এসকল আহব্বানকে পাশ কাটিয়ে বাগের হাটের রামপালে নামমাত্র কয়লাভিত্তিক তাপ বিদ্যুৎ উৎপাদনের নামে প্রতিবেশী দেশের ইন্ধনে একটা বিশেষ মহলের স্বার্থে আমাদের স্বাধীন বাংলাদেশের সৌন্দর্যের আধার সুন্দরবনকে ধ্বংসের মহাপরিকল্পনা করা হচ্ছে যা আমাদের পরিবেশ সংরক্ষণের পরিবর্তে পরিবেশকে ধ্বংসের ভাগাড়ে পরিণত করবে । এ যেন ফারাক্বা নামক মরণ ফাঁদের মত দ্বিতীয় কোন মরণ ফাঁদ তৈরী হচ্ছে আমাদের দেশের জীববৈচিত্র নষ্টের জন্য । তাই সচেতন দেশপ্রেমিকদের উচিত ইসলামের পরিবেশ সংরক্ষণ ব্যবস্থার আলোকে আমাদের দেশের পরিবেশ সংরক্ষণের ব্যপারে বিশ্ব মিডিয়ায় সম্প্রচারের মাধ্যমে সংশ্লিষ্ট মহলকে পরিবেশ ধ্বংসাত্মক মূলক রামপাল কয়লাভিত্তিক তাপ বিদ্যুৎ কেন্দ্র নির্মাণ পরিত্যাগে বাধ্য করা । আমাদের স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশের পরিবেশ সংরক্ষণের নিমিত্তে গঠিত হয়েছে “ বাপা ’’ বা বাংলাদেশ পরিবেশবাদী আন্দোলন । যার শ্লোগান হওয়া উচিত এমন “ দেশ আমাদের সুতরাং এর পরিবেশ সংরক্ষণের দায়িত্বও আমাদের ’’। এদেশের পরিবেশ ঠিক রাখার জন্য দেশের জলজ স্থলজ বনজ সকল পরিবেশে আল্লাহ ও তার রাসূলের বিধান ক্বায়েম এর কোন বিকল্প নেই ।  


(জাহরা –কুয়েত তারিখ ১১/০৮/২০১৬)