আল-বুরহান ( দলিল-প্রমাণ)

আসসালামু আলাইকুম ওয়া রহমাতুল্লাহ! আমাদের ওয়েবসাইটে আপনাকে স্বাগতম। একটু নিচে দেখুন> বিষয় ভিক্তিক সাজানো রয়েছে, আপনার পছন্দ অনুযায়ী পাঠ করুন এবং পোষ্টগুলো ভালো লাগলে শেয়ার করুন আর আপনার কোন প্রশ্ন থাকলে এই নাম্বারে- ০১৬৮৭-১১৩৮৮০ হোয়াটস অ্যাপে পাঠিয়ে দিন । জাযাকাল্লাহু খাইর।

জিজ্ঞাসা-১২৭৫১: নামাজে তেলাওয়াতের তারতিব রক্ষা করা কি জরুরি?

No Comments

 












জিজ্ঞাসা-১২৭৫১: 

আসসালামু আলাইকুম ওয়া রহমাতুল্লাহ।  আসসালামু আলাইকুম। মুহতারাম নামাজে সূরা পাঠ এর কোন ক্রমধারা আছে কিনা। কোরআনের একটি আয়াতে বলা হয়েছে তোমাদের জন্য যা সহজ তা পাঠ কর।  فاقراوا ما تيسر من القران

এখন কেউ যদি প্রথমে সূরা নাস পড়ে শেষে অন্য সূরা পড়ে এটা ঠিক হবে কিনা? কোরআনের সূরা গুলোর যে বিন্যাস, সেটা কি হিসেবে? আমরা জানি সুরা আলাকের প্রথম পাঁচ আয়াত সর্বপ্রথম অবতীর্ণ হয়েছে। অথচ সে আয়াতগুলোকে রাখা হয়েছে শেষের দিকে। কোরআনের শুরু শেষ ধারাবাহিকতা কিসের ভিত্তিতে নির্ধারিত? নামাজে এই ধারাবাহিকতায় রক্ষার বাধ্যবাধকতা আছে কিনা?


তারিখ:  ০৭/০৯/২৩ ঈসায়ি/ইংরেজি                       

 মাওলানা জিয়াউল হক নোয়াখালী  থেকে।


 জবাব

وعليكم السلام ورحمة الله وبركاته حمده ونصل على رسوله الكريم اما بعد بسم الله الرحمن الرحيم 


তাসলিম ও হামদ-সানার পর  প্রথম কথা হলো, (ক)  সালাত আদায়কালে আল কুরআনের সূরাগুলোতে বিদ্যমান  ক্রমধারার পরম্পরতা ( তারতীব) বজায় রাখার বিধান।


সালাতে কিরাআতের ক্ষেত্রে কুরআনে বিদ্যমান ধারাবাহিকতা বজায় রেখে  তিলাওয়াত করা বাঞ্চনীয়। এই ধারাবাহিকতা লঙ্ঘন করাকে ইলমে ফিকহ এর পরিভাষায় تَنْكِيْسْ (তানকীস) বলে।  ইচ্ছাকৃতভাবে এর ব্যত্যয় ঘটালে তা মাকরূহ হবে। "তানকিস" এর ব্যখ্যা করতে গিয়ে আবু উবায়দা (রাযি.) বলেন, 


أنه يقرأ سورة، ثم يقرأ بعدها أخرى هي قبلها في النظم.

অর্থাৎ,  প্রথম রাকায়াতে একটি সূরা পাঠ করার পর দ্বিতীয় রাকায়াতে তার পূর্ববর্তী অন্য কোন একটি সূরা পাঠ করা।

  হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে মাসঊদ (রাযি.) এর কাছে এজাতীয় ব্যক্তির প্রসঙ্গে জানতে চাওয়া হলে তিনি বললেন, 

ذلك منكوس القلب

অর্থাৎ, সে হলো বিকৃত হৃদয়ের অধিকারী। এটা বিগড়ে যাওয়া মানসিকতার লক্ষণ।  (মু'জামে ত্ববরানী-৮৮৬৪)

  

ফাতাওয়ায়ে শামী'তে  বলা হয়েছে, 

يجب الترتيب في سور القرآن، فلو قرأ منكوساً أثم، لكن لا يلزمه سجود السهو؛ لأن ذلك من واجبات القراءة لا من واجبات الصلاة، (الدر المختار وحاشية ابن عابدين ١/ ٤٥٧)

অর্থাৎ, কুরআনের সূরাগুলোর মাঝে তিলাওয়াতের ক্ষেত্রে ধারাবাহিকতা রক্ষা করা আবশ্যক। যদি সেটা না করে আগপিছ  করা হয়, তাহলে তিলাওয়াতকারী গোনাহগার হবে। তবে এর দ্বারা সিজদায়ে সাহূ আবশ্যক হবেনা। কারণ নামাজের সাথে ওতোপ্রোতভাবে জড়িত সালাত সংশ্লিষ্ট ওয়াজিব তরক করলে সিজদায়ে সাহু দেয়া লাগে। কিন্তু সূরার ধারাবাহিকতা সরাসরি নামাজ সংশ্লিষ্ট বিষয় নয়। বরং তা কিরাআতের সাথে সম্পর্কিত তিলাওয়াতের আবশ্যিক বিষয়। 


   তবে অনিচ্ছাকৃত ধারাবাহিকতা লঙ্ঘণ হয়ে গেলে তাতে কোন সমস্যা নেই। ফাতাওয়ায়ে শামীতে বলা হয়েছে।

إن التنكيس أو الفصل بالقصيرة إنما يكره إذا كان عن قصد، فلوسهواً فلا،  ( الدر المختار وحاشية ابن عابدين ١/ ٥٤٧)

অর্থাৎ, সালাতে তিলাওয়াতকালে সূরার মাঝে আগপিছ ঘটানো অথবা উভয় রাকাতের তিলাওয়াতের মাঝে সামান্য কিছু বাদ রাখা কিংবা ছোট কোন সূরার বাদ রাখা তখনই মাকরূহ হবে, যখন তা ইচ্ছাকৃত হবে। তবে অনিচ্ছাকৃত হলে তাতে কোন সমস্যা নেই। ( রদ্দুল মুহতার ১/৫৪৭)


(খ) প্রথম রাকাতেই সূরা নাস পড়ে ফেললে দ্বিতীয় রাকায়াতে করণীয়।


শাফেয়ী মাযহাব মতে, প্রথম রাকা'তে সূরা নাস পড়ে ফেললে দ্বিতীয় রাকায়াতে সূরা বাকারা'র প্রথম অংশ থেকে পড়বে। এপ্রসঙ্গে আল্লামা নববী বলেন, 


قال النووي رحمه الله: ": والسنة أن يقرأ على ترتيب المصحف متواليًا، فإذا قرأ في الركعة الأولى سورة قرأ في الثانية التي بعدها متصلة بها.  حتى لو قرأ في الأولى: ( قل أعوذ برب الناس ) يقرأ في الثانية من أول البقرة،.(كذا في المجموع شرح المهذب ٣/٣٧٥)

অর্থাৎ,  তিলাওয়াতের ক্ষেত্রে সুন্নাহসম্মত পদ্ধতি হলো, আল-কুরআনে বিদ্যমান ধারাবাহিকতা বজায় রাখা। প্রথম রাকায়াতে একটি সূরা তিলাওয়াত করা হলে দ্বিতীয় রাকায়াতে তৎসংলগ্ন পরবর্তী সূরা পাঠ করা উত্তম। তবে কেউ যদি প্রথম রাকায়াতেই  সূরা নাস পড়ে ফেলে, তাহলে সেপরবর্তী রাকায়াতে সূরা বাকারা'র শুরুর অংশ থেকে তিলাওয়াত করবে। ( মাজমু' শরহুল মুহাজ্জাব- ৩/৩৭৫)


মালেকী ফিকহের প্রথিতযশা পুরোধাব্যক্তিত্ব আল্লামা মুহাম্মাদ বিন আহমাদ বলেন, 


من قرأ في الركعة الأولى بسورة الناس، فقراءة ما فوقها في الركعة الثانية أولى من تكرارها ( كذا في حاشية الدسوقي على الشرح الكبير ١/٢٤٢

অর্থাৎ,  প্রথম রাকায়াতেই কেউ সূরা নাস পড়ে ফেললে, পরবর্তী রাকায়াতে পুনরায় সূরা নাস পড়ার চাইতে তার পূররবর্তী অংশ হতে পড়া উত্তম। (শরহুল কাবীরের দাসুকীর টিকা সংযোজনী- ১/২৪২)


তবে হানাফী ফিকহবেত্তাগণের মতামত এক্ষেত্রে কিঞ্চিত ব্যখ্যা সাপেক্ষ। সাধারণ ফরয সালাতে এরূপ ঘটনার সম্মুখীন হলে দ্বিতীয় রাকাতেও পুনরায় সূরা নাস-ই পড়বে।

এপ্রসঙ্গে আল্লামা ইবনুল আবেদীন শামী আল-হানাফী বলেন,

فإن اضطر بأن قرأ في الأولى - {قل أعوذ برب الناس} [الناس: 1]- أعادها في الثانية لأن التكرار أهون من القراءة منكوسًا،( رد المحتار ٥٤٦/١)

অর্থাৎ, কেউ যদি এমন বিরূপ পরিস্থিতির সম্মুখীন হয় যে, প্রথম রাকায়াতেই সূরা নাস পড়ে ফেলে, তাহলে সে দ্বিতীয় রাকায়াতে দ্বিতীয় রাকাতেও পুনরায় সূরা নাস-ই পড়বে। কারণ একই সূরার পুনরাবৃত্তি ধারাবাহিকতা লঙ্ঘন করে সূরা পাঠ থেকে সহজতর। ( রদ্দুল মুহতার-৫৪৬/১)


 কিন্তু ফরজ ব্যতিরেকে সুন্নাত ও নফল নামাজে এরূপ পরিস্থিতির সম্মুখীন হলে অন্য যেকোন সূরা তিলাওয়াত করে নিবে। কারণ তিলাওয়াতে ধারাবাহিকতা রক্ষার অপরিহার্যতার বিধান শুধুমাত্র ফরজ সালাতের ক্ষেত্রেই প্রযোজ্য। অন্যান্য নফল ও সুন্নাত নামাজের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য নয়।  


 কিন্তু যদি খতম তারাবী কিংবা সালাতের মাঝেই পুরো কুরআন কারীম খতম করা হয়, এবং প্রথম রাকায়াতে সূরা নাস পড়া হয়, তাহলে দ্বিতীয় রাকায়াতে সূরা বাকারা হতে তিলাওয়াত করবে।

এপ্রসঙ্গে আল্লামা ইবনুল আবেদীন শামী আল-হানাফী বলেন, 

من يختم القرآن في الصلاة إذا فرغ من المعوذتين في الركعة الأولى يركع ثم يقرأ في الثانية بالفاتحة وشيء من سورة البقرة، لأن النبي صلى الله عليه وسلم قال: «خير الناس الحال المرتحل»، أي الخاتم المفتتح اهـ 


(গ) প্রশ্নঃ   আল্লাহ তায়ালার বাণী,  فاقرؤوا ما تيسر من القرآن এর দাবী হলো- কুরআনের ধারাবাহিকতার দিকে লক্ষ্য না রেখে যেখান থেকেই সহজ অনুভূত হবে, সেখান থেকেই তিলাওয়াতের অবকাশ থাকা। অন্যথায় زيادة على كتاب الله তথা আল্লাহর কিতাবের মাঝে অতিরিক্ত সংযোজন করা  হয়ে যায়। যা কখনোই কাম্য নয়।


উত্তরঃ বর্ণিত আয়াতটি মূল বিধানটি তার সার্বজনীন ব্যাপকতার উপর বহাল নেই। বরং لا صلاة إلا بفاتحة الكتاب ( সূরা ফাতিহা ব্যতিত নামাজ হবেনা) খবরে মাশহুরের মাধ্যমে তার عمومية বা ব্যাপকতাকে খানিকটা সংকুচিত করা হয়েছে। উসূলে ফিকহের পরিভাষায় তাকে عام مخصوص منه البعض বলে। এই জাতীয় শব্দের বিধান বর্ণনা করতে গিয়ে উসুলে ফিকহের কালজয়ী গ্রন্থ "উসুলুশ শাশী" প্রণেতা আল্লামা নিযামুদ্দীন শাশী বলেন, 

وأما العام الذي خص عنه البعض فحكمه أنه يجب العمل به في الباقي مع الاحتمال فإذا أقام الدليل على تخصيص الباقي يجوز تخصيصه بخبر الواحد أو القياس إلى أن يبقى الثلث بعد ذلك لا يجوز فيجب العمل به

অর্থাৎ,  যেই ব্যাপক শব্দটিকে খানিক বিশেষায়িত করা হয়েছে, তার বিধান হলো, অবশিষ্টাংশের মাঝেও  সংকোচনের সম্ভাবনা বলবৎ রেখে সেই অনুযায়ী আমল করা আবশ্যক হবে। যখন কোন খবরে ওয়াহিদ কিংবা বুদ্ধিবৃত্তিক দলীলের সাহায্যে প্রমাণিত হবে যে, এই শব্দটির ব্যাপকায়নের মাঝেও আরো সংকোচন প্রয়োজন, তখন তাকে আরো বেশী খাস বা বিশেষায়িত করা যাবে। এই অবকাশ ততক্ষন পর্যন্ত বলবৎ থাকবে, যতক্ষণ পর্যন্ত আরবী বহুবচনের সর্বনিম্ন সংখ্যা তিন একক বহাল থাকে।


এই মূলনীতি মোতাবেক  এই আয়াতের ব্যাপকতাকে-  হাদীসে রাসূল, আসারে সাহাবা,আমালে মুতাওয়ারেসের মাধ্যমে আরো খানিকটা খাস বা বিশেষায়িত করা হয়েছে। যার ফলে  আল কুরআনের সহজপাঠ্য জায়গা হতে তিলাওয়াতের উপর আরেকটি শর্ত জুড়ে দেওয়া হয়েছে। সেটি হল, তিলাওতের ক্ষেত্রে ধারাবাহিকতা বজায় রাখা। 


(ঘ) আল-কুরআনে বর্তমান সূরাসমূহের তারতীবের ( ক্রমধারার) আদ্যোপান্ত বিশ্লেষণ।


দ্বিতীয় কথা হলো, তারতিব তিন প্রকার–

ক) কোরআনের শব্দসমূহের তারতিব অর্থাৎ,কোরআনের শব্দসমূহ যেভাবে আছে সেভাবে রাখা; আগ-পর না করা।


খ) আয়াতসমূহের তারতিব অর্থাৎ,আয়াতসমূহ আগ-পর না করা।

যেহেতু এই দুই প্রকারের তারতিব স্বয়ং রাসূলুল্লাহ ﷺ সরাসরি ওহীর মাধ্যম পেয়েছিলেন এবং সাহাবায়ে কেরামকে বাতলে দিয়েছিলেন, তাই এক্ষেত্রে ইজতিহাদের কোন সুযোগ নেই; বরং ইচ্ছাকৃতভাবে এই দুই প্রকারের তারতিব বিশেষত নামাজে লঙ্ঘন করা হারাম; রক্ষা করা ওয়াজিব। এ ব্যাপারে কারো দ্বিমত নেই। (আল-ইতক্কান ১/১৭৫ মানাহিলুল ইরফান ১/২৮২,২৮৩)


গ) সূরাসমূহের তারতিব। এটি লঙ্ঘন করা হারাম নয় তবে সাহাবায়ে কেরামের অনুসৃত-পদ্ধতি পরিপন্থী। কেননা এটা সত্য যে, সূরাসমূহের তারতিবের ব্যাপারে কিছু সূরার ক্ষেত্রে রাসূলুল্লাহ ﷺ এর সরাসরি দিক-নির্দেশনা পাওয়া যায়। আবার কিছু সূরার  ক্ষেত্রে পাওয়া যায় না। যার ফলে সাহাবায়ে কেরামের কাছে বিদ্যমান লিখিত-কোরআনের ‘সূরাসমূহের তারতিবে’ (শব্দ ও আয়াতসমূহের নয়) ভিন্নতা ছিল। যেমন আবদুল্লাহ ইবনে মাসউদ রাযি. এর তারতিব (ধারাক্রম), উবাই ইবনে কাব রাযি. এর তারতিব উসমান রাযি. এর কর্তৃক সংকলিত কোরআনের তারতিব থেকে আলাদা ছিল। তবে উসমান রাযি. কর্তৃক সংকলিত কোরআন মাজীদের তারতিবই সাহাবায়ে কেরামের কাছে সর্বশেষ সবচেয়ে বেশি সমাদৃত হয়েছিল। যে তারতিবের বিরোধিতা ওই সব সাহাবাও করেন নি, যাদের কাছে ভিন্ন তারতিব ছিল। আর এই তারতিবই বর্তমান মুসলিম উম্মাহর কাছে বিদ্যমান। এ কারণেই ওলামায়েকেরাম বলেন, সূরাসমূহের বর্তমান এই তারতিব রক্ষা না করা করা হারাম নয় তবে সাহাবায়ে কেরামের অনুসৃত-পদ্ধতি পরিপন্থী বিধায় মাকরূহ। (আল মাদখাল ফী দিরাসাতিল কোরআন ৩২৬,৩২৭)

তথ্য সহায়তায়, কুরআনের জ্যোতি .কম


সারকথা হলো, ফিকহি হানাফির মতে, ইচ্ছা করে সূরার তারতিব এর খেলাফ করা মাকরুহ। অর্থাৎ নামাজ হয়ে যাবে মাকরুহর সাথে।

আর অন্যান্য ইমামদের মতে মাকরুহ নয়, তবে ইচ্ছে করে করা অনুত্তম। 

উল্লেখ্য যে, নামাজের মধ্যে সূরার তারতিব রক্ষা করা ফরজ নামাজের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য, নফলের জন্য নয়। 


  والله اعلم بالصواب

উত্তর প্রদানে মুফতি মুহাম্মাদ আব্দুর রাজ্জাক