জিজ্ঞাসা-২৩০: নারীদের ঈদের নামাজে অংশগ্রহণ এর বিধান কি?
তারিখ-০৯/০৭/২২ ঈসায়ি
মাওলানা মোঃ আব্দুর রহমান বগুড়া থেকে
জবাব: এ বিষেয়ে আল-বুরহানে জিজ্ঞাসা-২০৫ শিরোনামে আলোচনা করা হয়েছে। সেটা দেখে নেওয়ার জন্য অনুরোধ করছি।
প্রথম কথা হলো, নারীদের জন্য জামাতের সঙ্গে নামাজ আদায় করা ওয়াজিব/জরুরি নয়। হানাফি মাজহাব মতে, যদি কোনো নারী ঈদের নামাজ পড়ে তবে তা নফল হবে। আর নফল নামাজ জামাআতে পড়া মাকরূহ। সুতরাং ফেতনার আশংকায় নারীদের ঈদের নামাজ আদায় করাও মাকরূহ। বর্তমানে সালাফি/আহলে হাদিসদের মতে সুন্নাত। ইমাম শাফির রহ. মত এটাই।
প্রশ্ন: ক। বর্তমান যামানায় নারীদের জামাতের সঙ্গে নামাজ পড়ার বিধান কি?
উত্তর: ক। হজরত ওমর ইবনুল খাত্তাব (রা.) নিজ খেলাফত আমলে যখন মহিলাদের পরিবর্তিত অবস্থা দেখেন এবং ফিতনার। আশঙ্কাও দিন দিন বাড়তে থাকে, তখন উম্মুল মুমিনিন
আয়েশা (রা.), ইবনে মাসউদ ও ইবনুজ জুবায়ের (রা.)সহ বড় বড় সাহাবায়ে কেরাম নারীদের মসজিদে না আসার আদেশ জারি করলেন। যেমন,
হাদিস নং-১
عن عبد الله بن سويد الأنصاري عن عمته امرأة أبي حميد الساعدي : أنها جاءت النبي صلى الله عليه و سلم فقالت : يا رسول الله صلى الله عليه و سلم إني أحب الصلاة معك فقال : قد علمت أنك تحبين الصلاة معي و صلاتك في بيتك خير من صلاتك في حجرتك و صلاتك في حجرتك خير من صلاتك في دارك و صلاتك في دارك خير من صلاتك في مسجد قومك و صلاتك في مسجد قومك خير من صلاتك في مسجدي فأمرت فبني لها مسجد في أقصى شيء من بيتها و أظلمه فكانت تصلي فيه حتى لقيت الله عز و جل
আব্দুল্লাহ বিন সুয়াইদ আল আনসারী রাঃ তার চাচা থেকে বর্ণনা করেন যে, আবু হুমাইদ আস সায়িদী এর স্ত্রী রাসূল (ﷺ) এর কাছে এসে বললেনহে আল্লাহর রাসূল! নিশ্চয় আমি আপনার সাথে নামায পড়তে পছন্দ করি। তখন নবীজী (ﷺ) বললেন-আমি জেনেছি যে, তুমি আমার সাথে নামায পড়তে পছন্দ কর। অথচ তোমার একান্ত রুমে নামায পড়া উত্তম তোমার জন্য তোমার বসবাসের গৃহে নামায পড়ার চেয়ে। আর তোমার বসবাসের গৃহে নামায পড়া উত্তম তোমার বাড়িতে নামায পড়ার চেয়ে। আর তোমার বাড়িতে নামায পড়া উত্তম তোমার এলাকার মসজিদে নামায পড়ার চেয়ে। আর তোমার এলাকার মসজিদে নামায পড়া উত্তম আমার মসজিদে [মসজিদে নববীতে] নামায পড়ার চেয়ে। তারপর তিনি আদেশ দিলেন তার গৃহের কোণে একটি রুম বানাতে। আর সেটিকে অন্ধকারচ্ছন্ন করে ফেললেন। তারপর সেখানেই তিনি নামায পড়তেন মৃত্যু পর্যন্ত। তাখরিজ: সহীহ ইবনে খুজাইমা, হাদীস নং-১৬৮৯; ইলাউস সুনান-৩/২৬।
আসার-০১
عَنْ عَمْرَةَ بِنْتِ عَبْدِ الرَّحْمَنِ أَنَّهَا أَخْبَرَتْهُ أَنَّ عَائِشَةَ زَوْجَ النَّبِىِّ -صلى الله عليه وسلم- قَالَتْ لَوْ أَدْرَكَ رَسُولُ اللَّهِ -صلى الله عليه وسلم– مَا أَحْدَثَ النِّسَاءُ لَمَنَعَهُنَّ الْمَسْجِدَ كَمَا مُنِعَهُ نِسَاءُ بَنِى إِسْرَائِيلَ. قَالَ يَحْيَى فَقُلْتُ لِعَمْرَةَ أَمُنِعَهُ نِسَاءُ بَنِى إِسْرَائِيلَ قَالَتْ نَعَمْ.
অর্থ: আয়েশা (রা) বলেন. “যদি রাসূলুল্লাহ (ﷺ) জানতেন যে, মহিলারা কি অবস্থা সৃষ্টি করেছে , তা হলে বনী ইসরাইলের মহিলাদের যেমন নিষেধ করা হয়েছিল, তেমনি এদেরও মসজিদে আসা নিষেধ করে দিতেন । (রাবী) ইয়াহইয়া ইবন সায়ীদ (র) বলেন, আমি আমরাহ (রা) কে জিজ্ঞেস করলাম, তাদের কি নিষেধ করা হয়েছিল ? তিনি বললেন , হ্যাঁ ।” তাখরিজ: বুখারী-৮৩১ ই.ফা.
বুখারি শরিফের ব্যাখ্যাকার আল্লামা বদরুদ্দিন আইনি (রহ.) এ হাদিসের ব্যাখ্যায় লিখেছেন, ‘আয়েশা (রা.)-এর এই মন্তব্য তো রাসুলুল্লাহ (ﷺ)-এর দুনিয়া থেকে বিদায়ের কিছুদিন পরের নারীদের সম্পর্কে। অথচ আজকের যুগের নারীদের উগ্রতা আর বেহায়াপনার হাজার ভাগের এক ভাগও সে যুগে ছিল না। তাহলে এ অবস্থা দেখে তিনি কী মন্তব্য করতেন?’ (উমদাতুল কারি : ৬/১৫৮)
এখন আমরা চিন্তা করে দেখতে পারি যে আল্লামা বদরুদ্দিন আইনি (রহ.) নিজ যুগ তথা হিজরি নবম শতাব্দীর নারীদের সম্পর্কে এ কথা বলেছেন। তাহলে আজ হিজরি পঞ্চদশ শতাব্দীতে সারা বিশ্ব যে অশ্লীলতা আর
উলঙ্গপনার দিকে ছুটে চলেছে, বেপর্দা আর
বেহায়াপনার আজ যে ছড়াছড়ি, মেয়েরা যখন পুরুষের পোশাক পরছে, পেট-পিঠ খুলে রাস্তাঘাটে বেড়াচ্ছে, ঠিক সে মুহূর্তে অবলা মা-বোনদের সওয়াবের স্বপ্ন দেখিয়ে মসজিদে আর ঈদগাহে টেনে আনার অপচেষ্টা বোকামি ছাড়া কিছুই নয়।
আসার-০২
عن أبي عمرو الشيباني أنه رأى بن مسعود يخرج النساء من المسجد ويقول أخرجن إلى بيوتكن خير لكن
অর্থ: আবু আমর শায়বানি (রহ.) বলেন, আমি আবদুল্লাহ ইবনে মাসউদ (রা.)-কে দেখেছি, তিনি জুমার দিন নারীদের মসজিদ থেকে বের করে দিতেন এবং বলতেন, আপনারা বের হয়ে যান। আপনাদের ঘরই আপনাদের জন্য উত্তম। তাখরিজ: আল মুজামুল কাবির-৯৪৭৫
আসার নং-০৩
হজরত জুবায়ের ইবনুল আওয়াম (রা.) তাঁর পরিবারের কোনো নারীকে ঈদুল ফিতর ও ঈদুল আজহার নামাজে যেতে দিতেন না। মুসান্নাফে ইবনে আবি শায়বা-৫৮৪৬
নোট: হাদিসটির সনদ সহিহ
আসার নং-০৪
হজরত ইবনে ওমর (রা.) তাঁর স্ত্রীদের ঈদগাহে বের হতে দিতেন না। মুসান্নাফে ইবনে আবি শায়বা-৫৮৪৫
নোট: হাদিসটির সনদ সহিহ
প্রশ্ন: খ। নারীদের মসজিদে গমন নিয়ে ফিকাহবিদদের মতামত কি?
উত্তর: খ। প্রথমদিকের কিছু ওলামায়ে কেরাম বৃদ্ধাদের জন্য মাগরিব ও এশার সময় ফিতনামুক্ত হওয়ার কারণে মসজিদে যাওয়ার অনুমতি দিয়েছেন। পরবর্তী ফিকাহবিদরা ফিতনার ব্যাপকতার কারণে যুবতী ও বৃদ্ধা সবার জন্য সব নামাজে ঘর থেকে বের হতে নিষেধ করেছেন। সূত্র: শরহুস সগির : ১/৪৪৬, আল মাজমু : ৪/১৯৮, আল মুগনি : ২/১৯৩
হানাফি মাজহাবের বিখ্যাত গ্রন্থ ‘বাদায়েউস সানায়ে’ তে বলা হয়েছে যে যুবতী নারীদের মসজিদে যাওয়া ফিতনা। সূত্র: বাদায়েউস সানায়ে : ১/১৫৬
.
আল্লামা ইবনে নুজাইম মিসরি ও আল্লামা হাসকাফি.(রহ.) বলেন, বর্তমান যুগে ফিতনার ব্যাপক প্রচলন হওয়ায় ফতোয়া হলো, সব নারীর জন্যই সব নামাজ মসজিদে গিয়ে জামাতে আদায় করা মাকরুহে তাহরিমি। সূত্র:
আল বাহরুর রায়েক : ১/৬২৭-৬২৮, আদ্দুররুল মুখতার : ১/৩৮০
সারকথা কথা হলো, এ কথা সত্য যে রাসূল (ﷺ)-এর যুগে নারীরা ঈদের জামাতে শরিক হত, উলামায়ে মুতাআখখেরীনদের (পরবর্তী) ফতওয়া হলো, বর্তমানে যুবতী হোক অথবা বৃদ্ধা উভয়ের জন্যই প্রত্যেক নামাজের জামাতে উপস্থিত হওয়া মাকরূহ তাহরীমী ফিৎনা প্রকাশ পাওয়ার কারণে । সূত্র: তাতার খানিয়া ১ম জিলদ, পৃষ্ঠা-৬২৮, খুলাছাতুল ফতওয়া ১ম জিলদ, পৃষ্ঠা-১৫৫, বাদায়েউস সানায়ে ১ম জিলদ, পৃষ্ঠা-১৫৭
প্রশ্ন: গ। যদি পর্দার সাথে/ঘরোয়াভাবে নারীর ইমামতিতে ঈদের জামাত আদায় করে, তাহলে কি কোন অসুবিধা?
উত্তর: গ। কোন কোন এলাকায় দেখা মহিলারা বাড়িতে ঈদের জামাত আদায় করে। প্রথম কথা হলো, এ বিষয়ে ওলামায়েকেরাম একমত যে, কোন মহিলার জন্য কোন পুরুষের ইমাম হওয়া জায়েয নেই। এতে পুরুষের নামায বাতিল বলে গণ্য হবে। দলিল; ফাতাওয়া লাজনাতিত দাইমা ৭/৩৯১
দলিল:
হাদিস নং-০১
জাবের ইবনে আব্দুল্লাহ রাযি. থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ ﷺ আমাদের উদ্দেশ্যে দেয়া এক খুতবায় বলেছেন,أَلَا لَا تَؤُمَّنَّ امْرَأَةٌ رَجُلًا
খবরদার কোন মহিলা যেন পুরুষের ইমাম না হয়। (ইবনে মাজাহ ১০৭১)
হাদিস নং-০২
রাসূলুল্লাহ ﷺ বলেছেন, لَنْ يُفْلِحَ قَوْمٌ وَلَّوْا أَمْرَهُمْ امْرَأَةً
ঐ সম্প্রদায় কখনো সফলকাম হতে পারে না, যারা কোন মহিলাকে তাদের বিষয়াদির নেতা নিযুক্ত করে। (বুখারী ৪০৭৩ নাসাঈ ৫২৯৩)
যেহেতু ইমামতি এক প্রকারের নেতৃত্ব, তাই তাদের এ পদে নিযুক্ত করা হারাম।
দ্বিতীয় কথা হলো, মহিলা মহিলার ইমামতি করতে পারবে কিনা?
এ বিষয়ে অগ্রবর্তী হানাফী ইমামগণ মহিলাদের নামাযে মহিলার ইমামতিকে মকরূহ বলে গণ্য করেছেন। আল-মারগিনানী লিখেন:
ويكره للنساء أن يصلين وحدهن الجماعة، لأنها لا تخلو من ارتكاب المحرم وهو قيام الإمام وسط الصف فيكره كالعراة؛ فإن فعلن قامت الإمام وسطهن؛ لأن عائشة فعلت كذلك، وحمل فعلها الجماعة على ابتداء الإسلام، ولأن في التقدم زيادة الكشف.
‘কেবল মহিলাদের জামা‘আতে নামায আদায় করা মাকরূহ; কারণ সে হারাম কাজে লিপ্ত হওয়া থেকে মুক্ত নয়। আর তা (হারাম কাজ) হল: মধ্য কাতারে ইমাম দাঁড়ানো। অতএব উলঙ্গদের জামা‘আতের ন্যায় মহিলাদের জামা‘আতও মাকরূহ। যদি তারা তা করে তবে ইমাম মাঝখানে দাঁড়াবেন; কারণ ‘আয়িশা (রা) তেমনটি করেছিলেন। নামাযে তাঁর ইমামতিকে ইসলামের প্রাথমিক যুগের অনুমোদন বলে চালিয়ে দেয়া যায়। তাছাড়া মহিলারা সামনে গেলে অত্যধিক উন্মোচনের সম্ভাবনা থাকে।
ইবনু ‘আবিদীন একটু এগিয়ে বলেছেন: ويكره تحريما جماعة النساء ولو في التراويح ‘মহিলাদের জামা‘আত মাকরূহ তাহরীমী, যদিও তা হয় তারাবীহ নামাযের জামা‘আত।
আল-আতরাযী আরেকটু এগিয়ে বলেছেন, মহিলাদের জামা‘আত বিদ‘আহ।
মালিকী মাযহাব: ইবনু রুশ্দ আল-হাফীদ জোর দিয়ে বলেছেন যে, মালিকী মাযহাব মতে মহিলাদের স্বতন্ত্র জামা‘আত ও তাতে মহিলার ইমামতি বৈধ নয়।
মূলকথা: মহিলার ইমামতি মাকরূহে তাহরীমী তথা নাজায়েয। তারাবীর/ঈদের নামাযের জামাতেরও একই হুকুম।
দলিল:
হাদিস/আসার-০১
হযরত আলী রা. বলেন- لاَ تَؤُمّ الْمَرْأَةُ.
কোনো মহিলা যেন ইমামতি না করে। তাখরিজ: মুসান্নাফে ইবনে আবী শায়বা, বর্ণনা ৪৯৯৪
হাদিস/আসার-০২
অন্য এক বর্ণনায় এসেছে ইবনে আউন রাহ. বলেন-
كَتَبْتُ إلَى نَافِعٍ أَسْأَلُهُ، أَتَؤُمّ الْمَرْأَةُ النِّسَاءَ؟ فَقَالَ : لاَ أَعْلَمُ الْمَرْأَةَ تَؤُمّ النِّسَاءَ.
আমি নাফে রাহ.-কে পত্রলিখে জিজ্ঞেস করলাম- কোনো মহিলা কি অন্য মহিলাদের ইমামতি করতে পারবে? (উত্তরে) নাফে রাহ. বললেন, ‘আমার জানামতে কোনো মহিলা অন্য মহিলাদের ইমামতি করতে পারবে না। তাখরিজ: মুসান্নাফে ইবনে আবী শায়বা, বর্ণনা ৪৯৯৫
সূত্র: কিতাবুল আছার, ইমাম মুহাম্মাদ, বর্ণনা ২১৭; তাবয়ীনুল হাকায়েক ১/৩৪৮; ফাতহুল কাদীর ১/৩০৬; বাদায়েউস সানায়ে ১/৩৮৭; আলইখতিয়ার ১/২১০; আলবাহরুর রায়েক ১/৩৫১; আদ্দুররুল মুখতার ১/৫৬৫
শেষ কথা হলো, যেসব ইমাম নারীদের জামাতে/ঈদের নামাজ পড়ার পক্ষে বলেছেন, সবাই শর্তাসাপেক্ষে ছিল। আর বর্তমান জামানায় সেই শর্ত পূরণ করা দুষ্কর। শর্তগুলো ২০৫ নং মাসয়ালা দেখে নিন। অতত্রব হানাফি মাজহারের ফতোওয়াই অধিক যুক্তিযুক্ত।
والله اعلم بالصواب
উত্তর দিচ্ছেন, মুফতি মুহাম্মাদ
আব্দুর রাজ্জাক (বগুড়া)