জিজ্ঞাসা-১২৬১১:
আসসালামু আলাইকুম ওয়া রহমাতুল্লাহ।
১। বাংলাদেশের জমিতে উশরের হুকুম কী?
২। উশরের নেসাব কী?
৩। কোন কোন পণ্যে উশর দিতে হয়?
এ ক্ষেত্রে কুরআন ও হাদীসের নির্দেশনা কি?
তারিখ: ০৩/০৬/২৩ ঈসায়ি/ইংরেজি
মাওলানা শহিদুল ইসলাম খুলনা থেকে।
জবাব: وعليكم السلام ورحمة الله وبركاته
نحمده ونصل على رسوله الكريم اما بعد بسم الله الرحمن الرحيم
তাসলিম ও হামদ-সানার পর প্রথম কথা হলো, আপনার প্রশ্নকে সহজ ভাবে বোঝার জন্য তিন ভাগে ভাগ করছি।
প্রশ্ন: ১। বাংলাদেশের জমিতে উশরের হুকুম কী?
উত্তর: ১। বাংলাদেশী জমি সমূহের বিধান নিম্নরূপ :
যেসব জমি বর্তমানে মুসলমানদের মালিকানাধীন রয়েছে এবং যুগ যুগ ধরে ক্রমাগতভাবে মুসলমানদের মালিকানায় ছিল। মাঝে কোনো অমুসলিমের হস্তগত হয়েছে বলে নিশ্চিতভাবে জানা না যায় এসব জমি ওশরী হিসেবে গণ্য।
অমুসলিমদের মালিকাধীন সকল প্রকার জমি খারাজি হিসেবে গণ্য হবে।
যেসব জমি অমুসলিমদের হাত থেকে ক্রয়সূত্রে কিংবা অন্য যেকোনোভাবে মুসলমানদের মালিকানায় এসেছে সেগুলো খারাজী বলে বিবেচিত হবে। সূত্র: মারকাজুল ফিকরিল ইসলামি বাংলাদেশ- ১৭/৩০৬/৭০৪১
প্রশ্ন: ২। উশরের নেসাব কী?
উত্তর: ২। ওশর এর নিসাব
ওশর এর নিসাব আছে কী নেই, এ ব্যাপারে দুটি মত আছে। ইমাম আবু হানিফা রহ. এর মতে ওশর ফরয হবার জন্য নির্ধারিত কোনো নিসাব নেই। দলীল হলো, নবীজী স. এর হাদীস ও পবিত্র কুরআনের আয়াতের আম বর্ণনা কোনো পরিমাণ নির্ধারণ করছে না। আর এতে গরীবদের উপকারও রয়েছে। তাই ওশর ফরয হবার জন্য কোনো পরিমাণ নেই। যেমনটি বলা হয়েছে হিদায়ায়।
فى قليل ما اخرجته الارض و كثيره العشر (هداية مع فتح القدير 2/242
অর্থাৎ, জমীনে কম বেশি যা-ই উৎপাদিত হবে, তাতে ওশর আসবে।
তবে, সাহেবাইন ও আইম্মায়ে সালাসার মতে পাঁচ ওয়াসাক থেকে কম পরিমাণ হলে, তার উপরে ওশর আসবে না। দলীল হলো, নবীজী স. এর হাদীস:
عن أبي سعيد الخدري رضي الله عنه : عن النبي صلى الله عليه و سلم قال ليس فيما أقل من خمسة أوسق صدقة (صحيح البخارى : كتاب الزكوة : باب ليس فيما دون خمسة أوسق صدقة : 1/201)
অর্থাৎ, নবী স. বলেন, পাঁচ ওয়াসাকের নিচে কোনো সদকা (ওশর) নেই।
উক্ত হাদীসের জবাবে ফুকাহায়ে আহনাফ বলেন,
১. পাঁচ ওয়াসাকের নিচে সদকা নেই মানে হল, পাঁচ ওয়াসাকের কম হলে তা বায়তুল মালে জমা দেয়া জরুরী নয়। কিন্তু আয়াত ও হাদীসের আম অর্থ দ্বারা বুঝা যাচ্ছে, ঐ সম্পদের মালিক এমনিতে গরীবদের সদকা করে দিবে। বায়তুল মালে দিবে না।
সুতরাং হাদীসের অর্থ দাঁড়ায়,
ليس فيما أقل من خمسة أوسق صدقة تؤدى الى بيت المال (معارف السنن : 5/212
২. এ হাদীসে ওশরের কথা আলোচনাই করা হয় নি। বরং, ব্যবসায়ীদের লভ্যাংশের উপর কখন যাকাত ফরয হবে, তা বর্ণনা করা হয়েছে। যেমনটি বলা হয়েছে আল বাহরুর রায়েকে।
وتأويل مرويهما أن المنقى زكاة التجارة ؛ لأنهم كانوا يتبايعون بالأوساق ، وقيمة الوسق أربعون درهما (البحر الرائق : كتاب الزكوة : باب العشر : 2/415)
৩. এ হাদীসটি তৎকালীন আরবে প্রচলিত عرية (বিশেষ এক প্রকার সদকা, যাতে কোনো বৃক্ষের শুধু ফল খাবার জন্য গরীবদেরকে নির্দিষ্ট সময় পর্যন্ত অনুমতি দেয়া হয়) এর ক্ষেত্রে প্রযোজ্য। অর্থাৎ, عرية তথা عطية কৃত বৃক্ষ থেকে যাকাত আদায়কারী যাকাত উসুল করবে না যদি তা পাঁচ ওয়াসাক থেকে কম হয়। আর যদি বেশি হয় তবে যাকাত আদায় করবে। (معارف السنن 5-212)
বিস্তারিত জানতে দেখুন تحفة الالمعى لسعيد احمد بالنبورى 2-532-534))
বিদগ্ধ মুহাদ্দিস আল্লামা সাঈদ আহমদ পালনপুরী দা.বা. আশ্চর্য প্রকাশ করেছেন এ কথার উপর যে, ওশর ফরয হবার জন্য যদি পরিমাণ নির্দিষ্ট থাকত, তাহলে তারাবীর নামায বিশ রাকাত –এটা যেমন মুতাওয়াতির সূত্রে বর্ণিত হয়ে এল, এ বিষয়টিও কেন মুতাওয়াতির সূত্রে বর্ণিত হলো না? অথচ, আরব রাষ্ট্র থেকে নিয়ে হাজার বছর ধরে বিভিন্ন রাষ্ট্রে মুসলিম শাসকরা শাসন করেছেন। সুতরাং বুঝা গেল যে, ওশর ফরয হওয়ার জন্য কোনো নিসাব নেই।
পাঁচ ওয়াসাক এর পরিমাণ কী?
বর্তমান সময়ে পাঁচ ওয়াসাক এর পরিমাণ কী এ ব্যাপারে বেশ কিছু মতভেদ আছে।কয়েকটি মত হলো এই যে,
১. আল্লামা সাঈদ আহমদ পালনপুরী দা.বা. এর মতে ৯৭৬ কিলো ৮০০ গ্রাম। (তুহফাতুল আলমায়ী ২/৫৩৩)
২. ডক্টর হিবাতুজ জুহাইলী এর মতে ৬৫৩ কেজি।
৩. ডক্টর আব্দুল্লাহ বিন মুহাম্মদ তাইয়্যার এর মতে ৬৭৫ কেজি। (জাদীদ ফিকহী মাসায়েল ২/৬১-৬২)
৪. মাওলানা আবুল ফাতাহ মুহাম্মদ ইয়াহইয়া এর মতে তিনটি : ক. ২১ মণ ৮ ছটাক খ. ২৫ মণ ৫ ছটাক গ. ২৭ মণ
উল্লিখিত পরিমাণের দিকে তাকালে আমরা সর্বোচ্চ পরিমাণ দেখি ১০৮০ কেজি, আর সর্বনিম্ন পরিমাণ দেখি ৬৫৩ কেজি।
انفع للفقراء হিসেবে আমরা ৬৫৩ কেজির বর্ণনাটির উপর আমল করতে পারি। কিংবা মুহাক্কিক পালনপুরী দ.বা এর তাহকীকের উপর নির্ভর করে ৯৭৬ কিলো ৮০০ গ্রামের উপর ফতোয়া দেয়া যায়।
প্রশ্ন: ৩। কোন কোন পণ্যে উশর দিতে হয়?
উত্তর: ধান, চাল, গম,ভুট্টা, খেজুর, বাদাম, যব, মশুরি, সিমের বিচি, ছোলা ইত্যাদি কিংবা আম, জাম, কাঁঠাল, কলা, পেয়ারা, আনারস, লিচু, নারিকেল, তরমুজ, সুপারি ইত্যাদি কিংবা শশা, গাজর, মুলো, শালগম, ক্ষিরা, লাউ, কুমড়ো, কদু, করল্লা, বেগুন, পুঁই শাক, পালং শাক, আলু ইত্যাদির উপরও যাকাত ( উশর) ফরয হয়। সূত্রঃ বাকারা - ২৬৭, সূরা আল আনআম - ১৪১- বিস্তারিত- আল জামিউ লি আহকামিল কুরআন, ইমাম কুরতুবী, খণ্ড- ২, পৃষ্ঠা ২০৮- ২১২, খণ্ড-৪, পৃষ্ঠা- ৬৪- ৭৩ সহ অন্যান্য তাফসির গ্রন্থ
এক কথায় জমিতে উৎপাদিত ঘাস লতাপাতা ব্যতিত সকল ফসলের ওশর দিতে হবে।
সারকথা হলো, বাংলাদেশের জমি ক ওশরি জমি কি না বিভিন্ন মতামত থাকলে বিশুদ্ধ মতামত হলো বাংলাদেশের জমি ওশরি জমি। কমপক্ষে পাঁচ ওসক ( প্রায় ২৫ মণ) পরিমাণ ফসল উৎপন্ন না হলে ফসলের যাকাত ফরজ হবে না।
বৃষ্টি, প্রবাহিত ঝরনার পানি বা (সেচ ছাড়া) স্বাভাবিক অনার্দ্রতা থেকে যে ফসল উৎপন্ন হয়, তার উপর দশভাগের এক ভাগ এবং সেচ দ্বারা উৎপন্ন ফসলে বিশ ভাগের এক ভাগ উশর দেয়া ওয়াজিব’।
والله اعلم بالصواب
উত্তর প্রদানে, মুফতি মুহাম্মাদ আব্দুর রাজ্জাক