জিলহজ্জ মাসের ফজিলত ও আমল
হিজরি সনের সর্বশেষ মাস জিলহজ্জ। এটি ফজিলতপূর্ণ একটি মাস। ইসলামের অন্যতম রুকন হজ্জ এ মাসেই সম্পাদন করা হয়। এ মাসের ৮ তারিখ থেকে হজ্জের কার্যক্রম শুরু হয়। এই দিনে হাজীগণ মক্কা থেকে মিনাতে গমন করেন। ৯ তারিখে মিনা থেকে আরাফার ময়দানে গমন করেন। তাই এ দিনকে يوم العرفة বা আরাফার দিন বলা হয়। আরাফার দিন বছরের মধ্যে সর্বোত্তম দিন। সমগ্র বিশ্বের মুসলমানগণ আল্লাহ তায়ালাকে খুশি করার জন্য হযরত ইব্রাহিম ও হযরত ইসমাইল (আঃ) প্রবর্তিত কুরবানি এ মাসের ১০, ১১, ১২ তারিখে করে থাকেন। জিলহজ্জ মাস চারটি হারাম মাসের অন্যতম। হারাম মাসগুলো যথাক্রমে মহররম, রজব, জিলক্বদ ও জিলহজ্জ। এ মাসগুলোতে জাহিলী যুগেও যুদ্ধ-বিগ্রহ বন্ধ ছিল। আল্লাহ তায়ালা উম্মতে মুহাম্মদি (সাঃ) এর জন্যেও এই বিধান বহাল রেখেছেন।
জিলহজ্জ মাসের ফজিলতঃ জিলহজ্জ মাসের প্রথম দশ দিন মুসলমানদের জন্য অত্যন্ত ফজিলতপূর্ণ দিন, এ বিষয়ে আমরা অনেকেই সচেতন নই। আল্লাহ তায়ালা কুরআনুল কারীমে এ মাসের প্রথম দশ দিনের শপথ করেছেন। যেমন,
والفجر وليال عشر والشفع والوتر
১। ফজর বা প্রভাতের শপথ।
এখানে ফজর দ্বারা প্রত্যেক দিনের প্রভাতকাল উদ্দেশ্য। কারণ, প্রভাতকাল বিশ্বে এক মহাবিপ্লব আনয়ন করে এবং আল্লাহ তায়ালার অপার কুদরতের দিকে পথ প্রদর্শন করে।
কারো মত, জিলহজ্জ মাসের দশ দিনের প্রভাতকাল উদ্দেশ্য।
২। দশ রাত্রির শপথ,
আব্দুল্লাহ ইবনে আব্বাস, কাতাদা ও মুজাহিদ প্রমুখ তাফসিরবিদদের মতে, এতে জিলহজ্জের দশ দিন বুঝানো হয়েছে। عَنِ ابْنِ عَبَّاسٍ، قَالَ قَالَ رَسُولُ اللَّهِ صلى الله عليه وسلم " مَا مِنْ أَيَّامٍ الْعَمَلُ الصَّالِحُ فِيهِنَّ أَحَبُّ إِلَى اللَّهِ مِنْ هَذِهِ الأَيَّامِ الْعَشْرِ " . فَقَالُوا يَا رَسُولَ اللَّهِ وَلاَ الْجِهَادُ فِي سَبِيلِ اللَّهِ فَقَالَ رَسُولُ اللَّهِ صلى الله عليه وسلم " وَلاَ الْجِهَادُ فِي سَبِيلِ اللَّهِ إِلاَّ رَجُلٌ خَرَجَ بِنَفْسِهِ وَمَالِهِ فَلَمْ يَرْجِعْ مِنْ ذَلِكَ بِشَيْءٍ " . قَالَ أَبُو عِيسَى حَدِيثُ ابْنِ عَبَّاسٍ حَدِيثٌ حَسَنٌ صَحِيحٌ غَرِيبٌ .
ইবনু আব্বাস (রাঃ) থেকে বর্ণিত। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, যিলহজ্জ মাসের প্রথম দশ দিনে নেক আমল করা আল্লাহর নিকট যত বেশি প্রিয় আর কোন দিনের আমল তাঁর নিকট তত প্রিয় নয়। সাহাবীগণ বললেন, ইয়া রাসুলুল্লাহ! আল্লাহর পথে জিহাদও কি তদাপেক্ষা প্রিয় নয়? রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেনঃ না। আল্লাহর পথে জিহাদও তদাপেক্ষা অধিক প্রিয় নয়। তবে ঐ ব্যক্তি ছাড়া, যে ব্যক্তি নিজের প্রাণ ও সম্পদ নিয়ে আল্লাহর পথে বের হয়ে গেল এবং কোন কিছুই আর ফিরে এলো না (সম্পদও শেষ হলো, সেও শহিদ হলো)। (বুখারী-৯১৮, আবু দাউদ-২৩৬৮, ইবনে মাজাহ-১৭২৭, তিরমিজি-৭৫৬, ইফা)
والشفع والوتر
৩। শপথ জোড় ও বেজোড়ের। বেজোড় বলতে জিলহজ্জের ৯ তারিখ আর জোড় বলতে জিলহজ্জের দশ তারিখ তথা কুরবানির দিনকে বুঝানো হয়েছে।
অন্য হাদিসে এসেছে, افضل ايام الدنيا العشر يعني عشر ذى الحجة দুনিয়ার সবচেয়ে ফজিলতপূর্ণ দিন হলো জিলহজ্জের মাসের প্রথম এ দশ দিন। (সহীহ তারগিব)
অন্য একটি যয়ীফ হাদিসে বর্ণিত হয়েছে, আনাস ইবনে মালিক (রাঃ) বলেছেন, জিলহজ্জ মাসের প্রথম ১০ দিন এক হাজার দিনের সমান আর বিশেষত আরাফার দিন দশ হাজার দিনের সমান। (বায়হাকি, শুয়াবুল ঈমান)
যয়ীফ হাদিসে বর্ণিত হয়েছে,
عَنْ أَبِي هُرَيْرَةَ، عَنِ النَّبِيِّ صلى الله عليه وسلم قَالَ " مَا مِنْ أَيَّامٍ أَحَبُّ إِلَى اللَّهِ أَنْ يُتَعَبَّدَ لَهُ فِيهَا مِنْ عَشْرِ ذِي الْحِجَّةِ يَعْدِلُ صِيَامُ كُلِّ يَوْمٍ مِنْهَا بِصِيَامِ سَنَةٍ وَقِيَامُ كُلِّ لَيْلَةٍ مِنْهَا بِقِيَامِ لَيْلَةِ الْقَدْرِ " . قَالَ أَبُو عِيسَى هَذَا حَدِيثٌ غَرِيبٌ
আবু হুরায়রা (রাঃ) থেকে বর্ণিত। রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, এমন কোন দিন নাই যে দিনসমূহের ইবাদত আল্লাহর নিকট যিলহজ্জ মাসের দশ দিনের ইবাদত অপেক্ষা অধিক প্রিয়। এর প্রতিটি দিনের সিয়াম এক বছরের সিয়ামের সমতুল্য। এর প্রতিটি রাতের ইবাদত লায়লাতুল কদরের ইবাদতের সমতুল্য। (ইবনু মাজাহ-১৭২৮, তিরমিজী-৭৫৬, ইফা)
ইমাম আবু ঈসা (রহঃ) বলেন, এই হাদীসটি হাসান-গারীব।
ইবনে হাজার আসকালানী (রহ) বলেছেন, জিলহজ্জ মাসের প্রথম দশ দিনের ক্ষেত্রে যা স্পষ্ট, তা হচ্ছে এখানে মূল ইবাদতগুলোর সমন্বয় ঘঠেছে। যেমনঃ সালাত, সিয়াম, সদকা, হজ্জ ও কুরবানী যা অন্যান্য সময় আদায় করা হয় না।
উলামায়ে কেরাম বলেন, জিলহজ্জ মাসের প্রথম দশ দিন সবচেয়ে ফজিলতপূর্ণ দিন। আর রমজান মাসের শেষ দশ রাত সবচেয়ে ফজিলতপূর্ণ রাত।
আরাফার দিনের দোয়া সর্বোত্তম দোয়া। যেমন, হাদিস শরীফে বর্ণিত হয়েছে عَنْ عَمْرِو بْنِ شُعَيْبٍ، عَنْ أَبِيهِ، عَنْ جَدِّهِ، أَنَّ النَّبِيَّ صلى الله عليه وسلم قَالَ " خَيْرُ الدُّعَاءِ دُعَاءُ يَوْمِ عَرَفَةَ وَخَيْرُ مَا قُلْتُ أَنَا وَالنَّبِيُّونَ مِنْ قَبْلِي لاَ إِلَهَ إِلاَّ اللَّهُ وَحْدَهُ لاَ شَرِيكَ لَهُ لَهُ الْمُلْكُ وَلَهُ الْحَمْدُ وَهُوَ عَلَى كُلِّ شَيْءٍ قَدِيرٌ " . قَالَ هَذَا حَدِيثٌ حَسَنٌ غَرِيبٌ مِنْ هَذَا الْوَجْهِ . وَحَمَّادُ بْنُ أَبِي حُمَيْدٍ هُوَ مُحَمَّدُ بْنُ أَبِي حُمَيْدٍ وَهُوَ أَبُو إِبْرَاهِيمَ الأَنْصَارِيُّ الْمَدَنِيُّ وَلَيْسَ هُوَ بِالْقَوِيِّ عِنْدَ أَهْلِ الْحَدِيثِ .
আমর ইবন শুআয়ব তৎপিতা, তৎপিতামহ থেকে বর্ণিত যে, নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেনঃ সর্বোত্তম দু’আ হল আরাফা দিনের দু’আ। আমি এবং আমার পূর্ববর্তী নবীগণ যা বলেছেন তাই সবচেয়ে মঙ্গলজনকঃ لاَ إِلَهَ إِلاَّ اللَّهُ وَحْدَهُ لاَ شَرِيكَ لَهُ لَهُ الْمُلْكُ وَلَهُ الْحَمْدُ وَهُوَ عَلَى كُلِّ شَيْءٍ قَدِيرٌ
একমাত্র আল্লাহ ছাড়া কোনো হক ইলাহ নেই, তাঁর কোন শরীক নেই, রাজত্ব তাঁরই, সমস্ত প্রশংসাও তাঁরই আর তিনি সব কিছুর উপর ক্ষমতাবান (তিরমিজী, হাদিস নম্বর-৩৫৮৫) এভাবে আমরা দেখছি যে, জিলহজ্জ মাসের এ দশটি দিন মুমিনের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ দিন। এদিন গুলোকে অবহেলায় নষ্ট করার চেয়ে দুর্ভাগ্য আর কিছুই হতে পারে না। প্রত্যেক মুমিনের চেষ্টা করা দরকার এদিন গুলোতে বেশি বেশি নেক আমল করার।
জিলহজ্জ মাসের আমলসমূহঃ
১। ফরজ ও নফল সালাতগুলো গুরুত্বের সাথে আদায় করাঃ ফরজ ও ওয়াজিবসমূহ সময়মত সুন্দর ও পরিপূর্ণভাবে আদায় করা, যেভাবে নবী করীম সাঃ করেছেন। সকল ইবাদতসমূহ তার সুন্নাত, মোস্তাহাব ও আদব সহকারে আদায় করা।
২। বেশি বেশি নেক কাজ করা। হাদিস শরীফে বর্ণিত হয়েছে, রাসুলুল্লাহ (সাঃ) বলেছেন, জিলহজ্জ মাসের দশ দিনের চেয়ে আল্লাহর নিকট অধিক মর্যাদাময় কোন দিন নেই এবং নেক আমল করার জন্য এগুলোর চেয়ে বেশি প্রিয় দিন নেই। অতএব তোমরা এ দিনগুলোতে বেশি বেশি তাসবিহ (সুবহানাল্লাহ), তাহমিদ (আলহামদুলিল্লাহ), তাহলিল (লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ) ও তাকবির পাঠ করবে। (বায়হাকি, তাবারানি)
অন্য বর্ণনায় এসেছে, বেশি বেশি তাহলিল, তাকবির ও আল্লাহর জিকির করবে। (বায়হাকি,তাবারানি)
৩। প্রথম নয় দিন রোজা রাখাঃ জিলহজ্জ মাসের প্রথম নয় দিন রোজা রাখা গুরুত্বপূর্ণ আমল।
৪। আরাফার দিন রোজা রাখাঃ শরীয়ত প্রণেতা যেগুলো উত্তম বলেছে, সেগুলোই মোস্তহাব। যেমনঃ সোমবার ও বৃহস্পতিবার রোজা রাখা। প্রতি মাসে তিন দিন রোজা রাখা। জিলহজ্জ মাসের রোজা ও আরাফার দিনের রোজা। রাসুলুল্লাহ (সাঃ) বলেছেন,
عَنْ أَبِي قَتَادَةَ، أَنَّ النَّبِيَّ صلى الله عليه وسلم قَالَ " صِيَامُ يَوْمِ عَرَفَةَ إِنِّي أَحْتَسِبُ عَلَى اللَّهِ أَنْ يُكَفِّرَ السَّنَةَ الَّتِي قَبْلَهُ وَالسَّنَةَ الَّتِي بَعْدَهُ
আবু কাতাদা (রাঃ) থেকে বর্ণিত। নাবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেনঃ আরাফা দিবসের সিয়াম সম্পর্কে আমি আল্লাহর কাছে আশা করি যে, তিনি এর মাধ্যমে পূর্ববর্তী বছর এবং পরবর্তী বছরের গুনাহসমূহের কাফফারা করে দিবেন। (ইবনু মাজাহ ১৭৩০, মুসলিম, তিরমিজী-৭৪৭, ইফা)
৫। তাকবির পাঠ করাঃ তাকবির দুই প্রকারঃ
ক. জিলহজ্জের চাঁদ দেখার পর মাগরিব থেকে ১০ জিলহজ্জ পর্যন্ত যেকোন সময় যতবার ইচ্ছা তাকবির পাঠ করা।
খ। জিলহজ্জের ৯ তারিখের ফজর থেকে ১৩ তারিখের আসর পর্যন্ত প্রত্যেক ফরজ সালাতের পরে কমপক্ষে একবার তাকবির পাঠ করা ওয়াজিব।
الله اكبر الله اكبر لا اله الا الله والله اكبر الله اكبر ولله الحمد.
৬। আরাফার দিনের দোয়াঃ আরাফার দিন বছরের সর্বশ্রেষ্ঠ দিন। এই দিনে আল্লাহ তায়ালা অসংখ্য বান্দাকে ক্ষমা করেন। এ জন্য এই দিনে আল্লাহ তায়ালার নিকট বেশি বেশি দোয়া করা।
৭। হজ্জ ও উমরা সম্পাদন করা। সামর্থ্যবানগণ হজ্জ ও উমরা সম্পাদন করবে। আল্লাহ রাব্বুল
আলামীন কুরআনুল কারীমে বলেছেন,
وَ لِلّٰہِ عَلَی النَّاسِ حِجّ الۡبَیۡتِ مَنِ اسۡتَطَاعَ اِلَیۡہِ سَبِیۡلًا ؕ وَ مَنۡ کَفَرَ فَاِنَّ اللّٰہَ غَنِیٌّ عَنِ الۡعٰلَمِیۡنَ
এবং সামর্থ্যবান মানুষের উপর আল্লাহর জন্য বায়তুল্লাহর হজ্জ করা ফরজ। আর যে ব্যক্তি এই নির্দেশ মেনে চলতে অস্বীকার করে, তার জেনে রাখা উচিত, আল্লাহ বিশ্ববাসী কারো মুক্ষাপেক্ষী নন। (আলে ইমরান-৯৭)
৮। কুরবানি করা। আল্লাহ তায়ালা সুরাতুল কাউছারে বলেছেন,
فصل لربك وانحر
আপনি আপনার প্রতিপালকের উদ্দেশ্যে সালাত আদায় করুন এবং কুরবানি করুন।
৯। চুল, দাড়ি ও নখ ইত্যাদি না কাটা। হাদিস শরীফে বর্ণিত হয়েছে,
عَنْ أُمِّ سَلَمَةَ، عَنِ النَّبِيِّ صلى الله عليه وسلم قَالَ " مَنْ رَأَى هِلاَلَ ذِي الْحِجَّةِ وَأَرَادَ أَنْ يُضَحِّيَ فَلاَ يَأْخُذَنَّ مِنْ شَعْرِهِ وَلاَ مِنْ أَظْفَارِهِ " . قَالَ أَبُو عِيسَى هَذَا حَدِيثٌ حَسَنٌ صَحِيحٌ .
উম্মু সালামা রাদিয়াল্লাহু আনহা থেকে বর্ণিত যে। রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, যে ব্যক্তি কুরবানী করার ইচ্ছা রাখে জিলহজ্জ মাসের চাঁদ দেখার পর সে যেন তার চুল ও নখ না কাটে। (সহীহ, ইবনু মাজাহ-৩১৪৯, তিরমিজী-১৫২৯, ইফা, ইসলামিক ফাউণ্ডেশন )
সংকলক,
মাওলানা মোহাম্মদ আব্দুল মোমেন
ইন্টারপ্রেটার, ব্যানব্যাট-১, ইউনিসফা মিশন, সুদান।