জিজ্ঞাসা-২১৮: আসসালামুয়ালাইকুম মুহতারাম শায়েখ এর নিকট জানতে চাই কুরবানী র সাথে আকিকা দেওয়া র কি কোন দলীল আছে? তারিখ-০৬/০৭/২২ ঈসায়ি/ইংরেজি
মাওলানা আখতারুজ্জামান ঢাকা থেকে-
জবাব: ওয়ালাইকুমুস সালাম ওয়া রহমাতুল্লাহ ও বারাকাতুহ। আল্লাহ তাআলা আপনাকে নিরাপদে ও শান্তিতে রাখুন। আপনি একটি কমন ও গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন করেছেন, কুরবানি আসলেই এ শ্রেণীর মানুষকে এ নিয়ে প্রপাগাণ্ডা চালায়। আপনার প্রশ্নকে সহজভাবে বোঝার জন্য কয়েকভাবে ভাগ করছি।
ونسأل الله التوفيق وهو الموفق والمعين
প্রশ্ন: ক। এ বিষয়ে ইমামদের মতামত কি?
উত্তর: ক। হানাফি মাযহাব এবং এক বর্ণনা মতে, এটি ইমাম আহমাদের মতে কুরবানির সাথে আকিকা দেওয়া যাবে। তাছাড়া এটি হাসান বসরি, মুহাম্মদ বিন সিরিন ও কাতাদা প্রমুখের অভিমত।
প্রশ্ন: খ। কুরবানীর সাথে আকিকা দেওয়া র কি কোন দলীল আছে?
উত্তর: খ। হ্যাঁ, দলিল তো অবশ্যই আছে। এখন প্রশ্ন হলো শরিয়তের দলিল কয়টি? আহলে সুন্নাত ওয়াল জামাতের মতে দলিল চারটি। (কুরআন,হাদিস,ইজমা ও কিয়াস) কিন্তু কিছু সুবিধাবাদী লোক আছে। যারা তাদের মতের বিরুদ্ধে গেলে কিয়াসকে অস্বীকার করে। আবার বিভিন্ন সময় মানে। যাই হোক দলিল নিম্নে দেওয়া হলো:
আসার নং-০১
বিখ্যাত তাবেয়ী ইমাম ‘আতা ইবনে আবী রাবাহ রাহ. এর ফতোয়াটিই সম্ভবত বিজ্ঞজনের যথেষ্ট হবে।তিনি বলেছেন, উট ও গরু সাতজনের পক্ষ হতে কুরবানী হতে পারে।আর এতে শরীক হতে পারে কুরবানীকারী, তামাত্তু হজ্বকারী এবং হজ্বের ইহরাম গ্রহণের পর হজ্ব আদায়েঅপারগ ব্যক্তি। তাখরিজ: আসসুনান, সায়ীদ ইবনে মানসূর-আল কিরা লি-কাসিদি উম্মিল কুরা, পৃ. ৫৭৩
সুতরাং প্রমাণিত হলো কুরবানির সাথে আকিকাও দেওয়া যাবে,সমস্যা নেই।
আসার নং-০২
হিশাম ও ইবনে সিরিন থেকে বর্ণিত আছে তারা উভয়ে বলেন: তার পক্ষ থেকে কোরবানী করলে সেটা আকিকা হিসেবে যথেষ্ট হবে। সূত্র: আল-মুসান্নাফ-৫/৫৩৪
আসার নং-০৩
কাতাদা থেকে বর্ণিত আছে তিনি বলেন: আকিকা হিসেবে জবাই করা না হলে সেটা যথেষ্ট হবে না। সূত্র: আল-মুসান্নাফ-৫/৫৩৪
তাবেয়িদের কথা, কর্ম, আমল, ফতোয়া আমাদের দলিল। যারা বুখারি বুখারি করে, তারা বুখারি খুলে দেখুক, হাজার হাজার তাবেয়িদের বাণী, ফতোয়া বুখারি ভরা, বিশ্বাস না হলে প্রথম পৃষ্টা খুলেই দেখুন, বাংলা আরবি দেখুন।
প্রশ্ন: গ। কুরবানি ও আকিকা কি একই জিনিস?
উত্তর: গ। হ্যাঁ, কুরবানি ও আকিকা একই জিনিস। আকীকাও এক ধরনের কুরবানী। দলিল: হাদীস শরীফে আকীকার উপরও ‘নুসুক’ শব্দের প্রয়োগ হয়েছে। আর এখানে ‘নুসুক’ অর্থ কুরবানী। হাদীসের আরবী পাঠ এই-
سئل رسول الله صلى الله عليه وسلم عن العقيقة، فقال : لا أحب العقوق كأنه كره الاسم، قالوا يا رسول الله! نسألك عن أحدنا يولد له، فقال : من أحب منكم أن ينسك عن ولده فليفعل، على الغلام شاتان مكافأتان، وعلى الجارية شاة.
তাখরিজ: আলমুসান্নাফ, আব্দুর রাযযাক : ৭৯৬১; আলমুসনাদ, আহমদ : ৬৭১৩, ৬৭২২; আসসুনান, আবু দাউদ (আকীকা অধ্যায়) ২৮৪২; আসসুনান, নাসায়ী : ৭/১৬২, ১৬৩; আলমুসান্নাফ, ইবনে আবী শাইবা ১২/৩২৪-২৪৭২৭; আলমুসতাদরাক, হাকিম, ৫/৩৩৭-৭৬৬৬
سئل رسول الله صلى الله عليه وسلم عن العقيقة، فقال : لا يحب الله العقوق، من ولد له منكم ولد فأحب أن ينسك عنه فليفعل.
তাখরিজ:আলমুসান্নাফ, ইবনে আবী শাইবা ১২/৩২১, হাদীস : ২৪৭২২; আলমুয়াত্তা, ইমাম মালিক, আকীকা অধ্যায়, হাদীস : ৬৫৮
আকীকাও যখন এক প্রকারের কোরবানী তখন একটি গরু বা উট দ্বারা একাধিক ব্যক্তির (সাত জন পর্যন্ত)
আলাদা-আলাদা কুরবানী আদায় হওয়ার হাদীসগুলো থেকে কুরবানী
আকীকা একত্রে আদায়ের অবকাশও প্রমাণিত হয় এটা শরীয়তের পক্ষ হতে প্রশস্ততা যে,গরু বা উটের ক্ষেত্রে একটি ‘জবাই’ সাত জনের সাতটি জবাইয়ের স্থালাভিষিক্ত গণ্য হয়।একারণে একটি উট বা গরু সাত জনের পক্ষে যথেষ্ট হয়।
সহীহ মুসলিমে সাহাবী জাবির ইবনে আব্দুল্লাহ রা. থেকে বর্ণিত হয়েছে,‘আমরা হজ্বের ইহরাম বেঁধে আল্লাহর রাসূল (ﷺ)এর সাথে বের হলাম। তিনি আমাদেরকে আদেশ করলেন যেন প্রত্যেক উট ও গরুতে সাতজন করে শরীক হয়ে কুরবানী করি।’-সহীহ মুসলিম, কিতাবুল হজ্ব, হাদীস : ১৩১৮/৩৫১
خرجنا مع رسول الله صلى الله عليه وسلم مهلين بالحج، فأمرنا رسول الله صلى الله عليه وسلم أن نشترك في الإبل والبقر، كل سبعة منا في بدنة.
অন্য বর্ণনায় আছে, নবী (ﷺ)বলেছেন,(একটি) গরু সাতজনের পক্ষ হতে এবং (একটি) উট সাতজনের পক্ষ হতে (কুরবানী করা যাবে)।’
البقرة عن سبعة والجزور عن سبعة.
-আস-সুনান, আবু দাউদ, হাদীস : ২৮০১, কিতাবুল আযাহী
সারকথা, ‘নুসুক’ বা কুরবানীর ক্ষেত্রে শরীয়তের প্রতিষ্ঠিত মূলনীতি এই যে, ছাগল, ভেড়া ও দুম্বার ক্ষেত্রে একটি ‘জবাই’((اراقة الدم দ্বারা একটি কুরবানী আদায় হলেও উট ও গরুর ক্ষেত্রে একটি ‘জবাই’ দ্বারা সাতটি কুরবানী আদায় হতে পারে। অর্থাৎ এখানে ‘জবাইয়ে শরীক হওয়া’ও (সর্বোচ্চ সাত জনের) কুরবানী আদায়ের পক্ষে যথেষ্ট। আকীকাও যেহেতু ‘নুসুক’ বা কুরবানী তাই এ মূলনীতিতে আকীকাও শামিল থাকবে। সুতরাং ‘একটি পশু জবাই’ করা দ্বারা যেমন তা আদায় হবে, তেমনি নির্ধারিত নিয়মে ‘জবাইয়ে শরীক হওয়ার’ (شركة في دم) দ্বারাও তা আদায় হবে।
সারকথা হলো, কুরবানি ও আকিকা একই নুসুক, একই রকম বিধান। আর ধরুন,একজন ব্যক্তি একটি ছাগল/ভেড়া নিজের জন্য কুরবানি করলো আরেকটি ছাগল/ভেড়া ছেলের জন্য আকিকা করলো। এতে সমস্যা নেই। আমরা জানি গরু/মহিষ/উটে সাতটি ভাগ দেওয়া যায়। এখন যদি কোন ব্যক্তি দুটি ভাগ নিয়ে একটি নিজের কুরবারি ও অপরটি আকিকা দিলে সমস্যা কোথায়। অর্থাৎ একটি সাতটি ছাগলের সমান।
ঘ। কিয়াস দ্বারা দলিল:
(১) এ দুটো আমলের মাধ্যমে উদ্দেশ্য হচ্ছে পশু জবাই করার মাধ্যমে আল্লাহ্র নৈকট্য হাছিল করা। তাই একটি অপরটির মধ্যে অন্তর্ভুক্ত হতে পারে। যেমনিভাবে তাহিয়্যাতুল মাসজিদ (মসিজদে প্রবেশের নামায) ফরয নামাযের মধ্যে ঢুকে যেতে পারে।
(২) ইবনে আবু শাইবা (রহঃ) "আল-মুসান্নাফ" গ্রন্থে (৫/৫৩৪) বলেন: হাসান থেকে বর্ণিত আছে তিনি বলেন: কেউ যদি ছেলের পক্ষ থেকে কোরবানী করে তাহলে সেটা আকিকা হিসেবে যথেষ্ট হবে।
হিশাম ও ইবনে সিরিন থেকে বর্ণিত আছে তারা উভয়ে বলেন: তার পক্ষ থেকে কোরবানী করলে সেটা আকিকা হিসেবে যথেষ্ট হবে।
কাতাদা থেকে বর্ণিত আছে তিনি বলেন: আকিকা হিসেবে জবাই করা না হলে সেটা যথেষ্ট হবে না।
(৩) আল-বুহুতি (রহঃ) "শারহু মুনতাহাল ইরাদাত" গ্রন্থে (১/৬১৭) বলেন: "যদি আকিকার সময় ও কোরবানীর সময় একত্রে পড়ে; অর্থাৎ কোরবানীর দিনগুলোতে শিশু জন্মের সপ্তম দিন বা অনুরূপ কোন দিন পড়ে এবং তার আকিকা করা হয় তাহলে সেটা কোরবানী হিসেবে যথেষ্ট হবে। কিংবা যদি কোরবানী করা হয় তাহলে সেটা আকিকা হিসেবে যথেষ্ট হবে। যেমনিভাবে যদি ঈদের দিন ও জুমার দিন একই দিনে পড়ে তখন একটার জন্য গোসল করলে অপরটার গোসল হিসেবে যথেষ্ট হবে এবং যেমনিভাবে তামাত্তু হজ্জকারী কিংবা ক্বিরান হজ্জকারী যদি কোরবানীর দিন একটি ভেড়া জবাই করে সেটা হজ্জের ফরয হাদি ও কোরবানী হিসেবে যথেষ্ট হবে।"
আরও বলেন: "যদি আকিকা ও কোরবানী একই সময়ে পড়ে এবং একটি পশু জবাই করার মাধ্যমে উভয়টির তথা আকিকা ও কোরবানীর নিয়ত করা হয় তাহলে উভয়টি আদায় হয়ে যাবে‑ ইমাম আহমাদের সুস্পষ্ট উক্তির আলোকে।" সূত্র: কাশ্শাফুল ক্বিনা-৩/৩০
(৪) এ অভিমতটি শাইখ মুহাম্মদ বিন ইব্রাহিম (রহঃ)ও মনোনীত করেছেন। তিনি বলেন: যদি কোরবানী ও আকিকা একত্রে পড়ে এবং পরিবারের কর্তার কোরবানী করার দৃঢ় সংকল্প থাকে এবং তিনি পশু জবাই করেন তাহলে এ পশু কোরবানীর পশু এবং এর মধ্যে আকিকাও ঢুকে পড়বে।
এক্ষেত্রে কিছু কিছু আলেমের কথায় পাওয়া যায় যে, উভয় জবাই একই ব্যক্তির পক্ষ থেকে: অর্থাৎ কোরবানী ও আকিকা নবজাতকের পক্ষ থেকে হতে হবে। আর কিছু কিছু আলেমের মতে, তা শর্ত নয়। যদি পিতা কোরবানী করেন তাহলে কোরবানী পিতার পক্ষ থেকে, আর আকিকা ছেলের পক্ষ থেকে।
সারকথা: যদি কোরবানীর পশুকে কোরবানী ও আকিকার নিয়তে জবাই করা হয় তাহলে সেটা জায়েয হবে। সূত্র: ফাতাওয়াস শাইখ মুহাম্মদ বিন ইব্রাহিম -৬/১৫৯
তথ্য সহযোগিতায় মাসিক আল কাউসার
والله اعلم بالصواب
উত্তর দিচ্ছেন, মুফতি মুহাম্মাদ আব্দুর রাজ্জাক (বগুড়া)