জিজ্ঞাসা -১২৩৪৮:
আসসালামু আলাইকুম
একটি মাসয়ালা সম্পর্কে জানতে চাই, আমার ইউনিট থেকে বি কোম্পানি দলগত এক্সারসাইজের করতে সেনানিবাস থেকে ১২/১৫ কিলোমিটার দূরে ১০দিনের জন্য অবস্থান করছে,
আমার জানামতে কসর হবেনা, বাকি বিজ্ঞ আলেমদের দৃষ্টি আকর্ষণ করছি, স্বল্প সফরের ক্ষেত্রে কসরের বিধানের কোনো সহীহ হাদিস অথবা দলীল আছে কি না?
মাওলানা মোঃকামরুল হাসান
যশোর থেকে
জবাব: ওয়ালাইকুমুস সালাম ওয়া রহমাতুল্লাহ। نحمده ونصلي على رسوله الكريم اما بعد
তাসলিম ও হামদ-দরুদের পর কথা হলো,
اختلَفَ العُلماءُ في مدَّة الإقامةِ,اختَلف أهلُ العِلمِ في مِقدارِ مَسافةِ السَّفرِ الذي تُقصَرُ فيه الصَّلاةُ على أقوالٍ عِدَّة، أقواها قولان:
কতটুকু দূরত্ব হলে এবং কয়দিন অবস্থান করলে মুসাফির হবে, এ বিষয়ে আইম্মায়ে মুজতাহিদগণের মধ্যে মতভেদ রয়েছে। সূত্র: উমদাতুল কারি-৭/১২৫
অধিকাংশ ওলামাদের মতে মুসাফির শর্ত হলো ৭৮/৮০/১০০ কিলোমিটার দূরে সফর করতে হবে।
তবে ইমাম ইবনে তাইমিয়া রহ. শায়েখ ইবনে উসাইমিন রহ. এবং বর্তমানে তাদের (আহলে হাদিস) অনুসারীদের মতে কোন দূরত্ব শর্ত নাই যেকোনো সফরে কসর পড়া যাবে। যেমন, তিনি বলেন,
“যারা যে কোন ধরনের সফরে ক্বসর (সালাত সংক্ষিপ্ত) করা ও রোযা ভঙ্গ করাকে শরিয়তসম্মত মত দিয়েছেন, বিশেষ কোন সফরের সাথে নির্দিষ্ট করেননি। সূত্র: শাইখুল ইসলাম ‘আল-ফাতাওয়া’ গ্রন্থে (২৪/১০৬)
ফুকাহায়ে আহনাফের মতে ১৫ দিনের কম হলে ৪৮ মাইল বা ৭৮ (প্রায়) কিলোমিটার দূরে হলে সে মুসাফির হিসেবে গণ্য হবে।
প্রশ্ন: ক। ৪৮ মাইল অথবা ৭৮ কিলোমিটার দূরে গেলে মুসাফির হবে এ বিষয়ে হানাফিদের দলিল কি?
উত্তর: ক। এ বিষয়ে হানাফিদের দলিল হলো নিম্নের হাদিস।
হাদিস নং -০১
হজরত ইবন আব্বাস রা থেকে বর্ণিত, রাসুলুল্লাহ ﷺ বলেছেন,
يَا أَهْلَ مَكَّةَ ، لا تَقْصُرُوا الصَّلاةَ فِي أَدْنَى مِنْ أَرْبَعَةِ بُرُدٍ
হে মক্কাবাসী! চার বারীদের কমে কসর করবে না। তাখরিজ: দারা কুতনি ১/৩৮৭
হাদিস নং-০২
وَكَانَ ابْنُ عُمَرَ، وَابْنُ عَبَّاسٍ رَضِيَ اللَّهُ عَنْهُمْ، يَقْصُرَانِ، وَيُفْطِرَانِ فِي أَرْبَعَةِ بُرُدٍ وَهِيَ سِتَّةَ عَشَرَ فَرْسَخًا
ইবনে উমর রাযি এবং ইবনে আব্বাস রাযি চার বারীদ সফরের সময় কসর পড়া এবং রোযা ভাঙ্গার কথা বলেছেন। আর সেটি হল, ১৬ ফরসখ। তাখরিজ: বুখারি-১০৮৬, নামায কসর করা অধ্যায়
ব্যাখ্যা:
এক ফরসখ তিন মাইল হয়ে থাকে। সুতরাং প্রত্যেক বারীদ হয় ১২ মাইল। আর চার বারীদকে ১২ দিয়ে গুণ দিলে কিংবা ষোল ফরসখকে তিন দিয়ে গুণ দিলে হয় ৪৮ মাইল। অতএব, সফরের দূরত্ব দাঁড়াচ্ছে ৪৮ মাইল। সূত্র: কামুসুল ফিকহ ২/৩১৪ আল ফিকহুল ইসলামী ওয়া আদিল্লাতুহু ১/৭৫
হাদিস নং-০৩
عن عمر رضي الله عنه قال: تقصر الصلاة في مسيرة ثلاث ليال
উমার রা. বলেন, তিন রাতের দূরত্বে সালাত সংক্ষিপ্ত করা হবে। তাখরিজ: ফিকহুস সুনান, হাদীস নং ৯৩৩
নোট:
মুহাম্মাদ কিতাবুল হাজ্জ-এ সহীহ সনদে সুওয়াইদ ইবন গাফলাহ থেকে অনুরূপ মতামত সঙ্কলিত করেছেন)। [তাবারি, তাহযীবুল আসার, হাদীস-১২৫৯; মুসান্নাফ ইবন আবী শাইবা, হাদীস-৮১৩০]
ব্যাখ্যা: একজন ব্যক্তি সাধারণত একদিনে ১৬ মাইল হাঁটতে পারে। তিন দিয়ে গুণ করলে ৪৮ মাইল হয়।
হাদিস নং-০৪
عن علي بن ربيعة الوالبي قال: سألت عبد الله بن عمر رضي الله عنهما إلى كم تقصر الصلاة؟ فقال: أتعرف السويداء؟ قال: قلت: لا ولكني سمعت بها. قال: هي ثلاث ليال قواصد فإذا خرجنا إليها قصرنا الصلاة
কসরের দূরত্ব
তাবিয়ি আলী ইবন রাবীআহ ওয়ালিবি বলেন, আমি আব্দুল্লাহ ইবন উমার রা.কে জিজ্ঞাসা করলাম, কতদূরে সালাত সংক্ষিপ্ত (কসর) করতে হয়? তিনি বলেন, তুমি কি ‘সুওয়াইদা' নামক স্থান চেন? আমি বললাম, না, তবে আমি তার নাম শুনেছি। তিনি বলেন, স্থানটির দূরত্ব এখান থেকে তিন রাতের স্বাভাবিক চলার পথ। যদি আমরা সেই স্থানের উদ্দেশ্যে বের হই তাহলে সালাত সংক্ষেপ করি। তাখরিজ: ফিকহুস সুনান, হাদীস নং ৯৩২
নোট:
(মুহাম্মাদ কিতাবুল আসারে সহীহ সনদে)। [মুহাম্মাদ, কিতাবুল আসার, হাদীস-১৯২]
হাম্বলী মাযাবের অনুসারী বিখ্যাত আলেম শায়েখ বিন বাজ রহ. কে সফরের দূরত্ব সম্পর্কে জিজ্ঞেস করলে, তিনি বলেন,
هل صحيح أن المسافر يقصر الصلاة مهما طالت مدة السفر ولو بلغت سنينًا؟ أم أن هناك زمنًا محددًا ينتهي فيه القصر؟ وما حكم السفر فيمن يسافر للدراسة أو العمل خارج بلده، هل الصحيح أنه يقصر حتى يرجع من الدراسة أو العمل؟
ج: السنة للمسافر أن يقصر الصلاة في السفر تأسيًا بالنبي ﷺ، وعملًا بسنته إذا كانت المسافة ثمانين كيلو تقريبًا أو أكثر،
অর্থাৎ ৮০ কিলোমিটার বা তার চেয়ে বেশি হলে মুসাফির হবে। সূত্র: মাজমাউল ফাতওয়া
প্রশ্ন: খ। ১৫ দিনের কম হলে মুসাফির হবে এর দলিল কি?
উত্তর: খ। যেমন,
হাদিস/আসার নং-০১
عن ابن عمر رضي الله عنهما: إذا كنت مسافراً فوطنت نفسك على إقامة خمسة عشر يوماً فأتمم الصلاة وإن كنت لا تدري فاقصر
ইবন উমার রা. বলেন, তুমি যদি মুসাফির হও এবং ১৫ দিন অবস্থানের সিদ্ধান্ত গ্রহণ কর তাহলে সালাত পূর্ণ করবে। আর যদি তুমি না জান যে কতদিন থাকবে তাহলে সালাত সংক্ষেপ (কসর) করবে।
নোট:
তাহাবি ইবন আব্বাস ও ইবন উমার থেকে অনুরূপ মত সঙ্কলন করেছেন)। [মুহাম্মাদ, কিতাবুল আসার, হাদীস-১৮৮]
হাদিস/আসার নং-০২
عن مجاهد قال: كان ابن عمر رضي الله عنهما كان إذا أجمع على إقامة خمسة عشر يوماً أتم الصلاة
মুসাফির কখন সালাত পূর্ণ করবে
(৯৩৮) তাবিয়ি মুজাহিদ বলেন, ইবন উমার রা. যখন ১৫ দিন অবস্থানের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করতেন তখন সালাত পূর্ণরূপে (চার রাকআত) আদায় করতেন। তাখরিজ: ফিকহুস সুনান, হাদীস নং ৯৩৮
নোট:
(ইবন আবী শাইবা ও মুহাম্মাদ কিতাবুল হাজ্জ-এ। তাদের উভয়ের সনদ সহীহ)। [মুসান্নাফ ইবন আবী শাইবা, হাদীস-৮২১৭]
হাদিস/আসার নং -০৩
حَدَّثَنَا أَحْمَدُ بْنُ يُونُسَ، حَدَّثَنَا أَبُو شِهَابٍ، عَنْ عَاصِمٍ، عَنْ عِكْرِمَةَ، عَنِ ابْنِ عَبَّاسٍ، قَالَ أَقَمْنَا مَعَ النَّبِيِّ صلى الله عليه وسلم فِي سَفَرٍ تِسْعَ عَشْرَةَ نَقْصُرُ الصَّلاَةَ. وَقَالَ ابْنُ عَبَّاسٍ وَنَحْنُ نَقْصُرُ مَا بَيْنَنَا وَبَيْنَ تِسْعَ عَشْرَةَ، فَإِذَا زِدْنَا أَتْمَمْنَا.
حدثنا أحمد بن يونس، حدثنا أبو شهاب، عن عاصم، عن عكرمة، عن ابن عباس، قال أقمنا مع النبي صلى الله عليه وسلم في سفر تسع عشرة نقصر الصلاة. وقال ابن عباس ونحن نقصر ما بيننا وبين تسع عشرة، فإذا زدنا أتممنا.
আহমাদ ইবনে ইউনুস (রাহঃ) ... ইবনে আব্বাস (রাযিঃ) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, (মক্কা বিজয়ের সময়ে) সফরে আমরা নবী (ﷺ) এর সঙ্গে উনিশ দিন (মক্কায়) অবস্থান করেছিলাম* এ সময়ে আমরা নামায়ে কসর করেছিলাম। ইবনে আব্বাস (রাযিঃ) বলেছেন, আমরা সফরে উনিশ দিন পর্যন্ত কসর করতাম। এর চাইতে অধিক দিন অবস্থান করলে আমরা পূর্ণ নামায আদায় করতাম। (অর্থাৎ চার রাকআত আদায় করতাম)। তাখরিজ: বুখারি- ৪২৯৯
ব্যাখ্যা/সমন্বয়:
*আনাস (রাযিঃ) এবং ইবনে আব্বাস (রাযিঃ) বর্ণিত হাদীসদ্বয়ে রাসূলুল্লাহ্ (ﷺ)-এর অবস্থানের মেয়াদ বর্ণনায় পার্থক্য দেখা গেলেও । বিশারদগণ বলেছেন, মূলত হযরত আনাস (রাযিঃ)-এর বর্ণিত হাদীসটি বিদায় হজ্জের সফরে রাসূলুল্লাহ্ (ﷺ)-এর অবস্থান মেয়াদ এবং ইবনে আব্বাস (রাযিঃ)-এর হাদীসে মক্কা বিজয়ের সফরে তাঁর অবস্থান মেয়াদের কথা উল্লেখ করা হয়েছে। সূত্র: ফিকহুস সুনান, হাদীস নং ৯৩৯
সারকথা হলো, সফরের দূরত্ব নিয়ে একাধিক হাদিস রয়েছে। আইম্মায়ে মুজতাহিদগণ উক্ত হাদিসগুলোকে মুকাইয়্যাদ (নির্দিষ্ট) ধরে নিয়েছেন। আর ইমাম ইবনে তাইমিয়া রহ. উক্ত হাদিসগুলোকে মুতলাক (সাধারণ) হুকুম ধরে নিয়েছেন। অর্থাৎ নির্দিষ্ট দূরত্ব শর্ত নয়, সফরে বের হলেই কসর আদায় করতে পারবে।
শেষ কথা হলো, ফুকাহায়ে আহনাফের মতে ৪৮ মাইল বা ৭৮ কিলোমিটারের কম সফরে গেলে, মুসাফির হিসেবে গণ্য হবে না। সুতরাং যারা হানাফি মাজহাব মানতে চায়, তাদেরকে সেভাবে আমল করার সুযোগ দেওয়া উচিত।
و الله اعلم بالصواب
উত্তর প্রদানে, মুফতি মুহাম্মাদ আব্দুর রাজ্জাক